গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১১ মে, ২০১৬

তাপস মৌলিক



ম্যাডাম

 সেলিমপুরের মঞ্জরীদি ছিলেন এইচ এস বি সির ব্র্যাবোর্ন রোড ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। স্বামী সুব্রতদা ব্যস্ত এক্সিকিউটিভ,ছেলে কলেজে,মেয়ে স্কুলে।
একদিন সকালে ঘরদোর গুছিয়ে,সুব্রতদাকে অফিস রওনা করিয়ে,রান্না করে,নাকে-মুখে দুটো গুঁজে ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁপাতে হাঁপাতে যাদবপুর থানা থেকে ট্যাক্সি ধরলেন মঞ্জরীদি, অফিস যাবার জন্য। তাঁর নিজের একটা স্যান্ত্রো ছিল,সেটা তখন সার্ভিস সেন্টারে।
যেতে যেতে মোবাইলে কিছু ফোন সেরে নিচ্ছিলেন মঞ্জরীদি। আকাশবাণী ভবনের সামনে পৌঁছে তার খেয়াল হল, ডালহৌসি স্কোয়ারের হেড অফিসে একটা খুব জরুরী কাজ পড়ে আছে। তিনি হেড অফিসের সামনে ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে বিহারী ড্রাইভারকে বললেন,“ভাইয়া, দো মিনিট রুকিয়ে, অভি আতি হুঁ।
কাজ সেরে বেরিয়ে ফের ট্যাক্সিতে চড়ে বললেন,“চলিয়ে,ব্র্যাবোর্ন রোড।
ব্যস্ত মানুষ। তাড়াহুড়োয় খেয়াল করলেন না যে এটা সেই আগের ট্যাক্সিটা নয়।
নিজের অফিসের সামনে নেমে হাতব্যাগ হাঁটকাতে হাঁটকাতে তিনি জিগ্যেস করলেন, “কিতনা হুয়া, ভাইয়া?”
ট্যাক্সিওয়ালা মিটার দেখে বলল,“চালিস রুপিয়া,ম্যাডাম।
মঞ্জরীদির একটু সন্দেহ হল। সেই যাদবপুর থানা থেকে ব্র্যাবোর্ন রোড মাত্র চল্লিশ টাকা? মিটার-ফিটার খারাপ নাকি? যাক গে যাক। আমার কী? ভালই তো! ভাড়া মিটিয়ে হন্তদন্ত হয়ে মঞ্জরীদি ঢুকে পড়লেন অফিসে। অনেক দেরি হয়ে গেছে আজ।

বেলা দুটো নাগাদ ব্যাংকের ঝাঁ চকচকে অফিসে দ্বিধাজড়িত পায়ে আবির্ভাব হল এক বিহারী ট্যাক্সিচালকের। এদিক ওদিক কিছুক্ষণ দেখে সে এক কাউন্টারে এসে জিগ্যেস করল, “সাব, ইহাঁ কোই ম্যাডাম আয়ী হ্যায়? লম্বী সি, মোটি সি, চশমা পহনতি হ্যায়? মেরে গাড়ি মে সুবে আয়ী থি, আপকা ডালহৌসি আপিস মে, দো মিনিট রুকনে বোলি। ম্যায় তো উহাঁ সুবে সে খাড়া হুঁ...


কে বেশি পাগল,কবি না কবিতা ?

আমার তো ভাই কবিতার চেয়ে কবিদের বেশি ইন্টারেস্টিং লাগে। একেকজন যা আছেন!
সেদিন বিকেলে কলেজ স্ট্রিটে অশোকদার সঙ্গে দেখা। সেই একমুখ দাড়ি-গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া পাকা চুল। একটা পাঞ্জাবী পরেছেন, হলুদ-কালো লম্বা লম্বা ডোরাকাটা, তার ঝুল শেষ হয়েছে গোড়ালির চার-পাঁচ ইঞ্চি ওপরে, তলা দিয়ে গোল গোল দুটো সাদা থামের মত পাজামাটা দুইঞ্চি দেখা যাচ্ছে। পায়ে পাওয়ারের সাদা জুতো উইথ নীল মোজা। কাঁধে ব্যাগ।
পিঠে জব্বর এক চাপড় মেরে বললেন,“আরে সমু যে,খবর কী বলো। কতদিন পর দেখা!
সেকি! পরশু যে দেখা হল একাডেমিতে?”
পরশু ?একাডেমিতে? ধুর কী যে বলো, একাডেমি আমি কতকাল যাই না! বইটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম না? তারপর? পাঞ্জাবীটা কেমন বানিয়েছি বলো! আমার ডিজাইন।
দারুণ অশোকদা। তিন মাইল দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। একেবারে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।
হ্যাঁ,টাইগার পাতৌদি আমার হিরো ছিলেন। চলো,চা খাওয়া যাক।
রাস্তার ধারে একটা দোকানে চা খেতে খেতে অশোকদা ঝোলা থেকে আসল বাঘ বার করলেন, “এই দ্যাখো,আজই প্রেস থেকে এসেছে,আমার লেটেস্ট বই। তুমিই প্রথম দেখছ। কবিতাগুলো অবশ্য আগেও পড়িয়েছি তোমায়।
নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। কবিতাগুলো পড়েছি আগে? কী জানি! হবে হয়তো! অশোকদার কোনও কবিতাই আমার মনে থাকে না।
চা শেষ করে পয়সা দিতে যাব, অশোকদা হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ও কী,ও কী! আমি দিচ্ছি দাঁড়াও। আজ বই বেরোল,আর চা খাওয়াব না?”
এই বলে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে খুচরো পয়সা বার করতে গিয়ে অশোকদা হাঁটু মুড়ে রাস্তার ওপর প্রায় বসেই পড়লেন দুত্তোর,পকেটটা এত নিচে চলে গেছে! নাগালই পাই না। ঝুলটা একটু বেশিই হয়ে গেছে।
দেখলাম,বাস্তবিকই তাই। পকেটের বটমলাইন অশোকদার হাঁটুর চেয়েও ফুটখানেক নিচে, নাগাল পাওয়ার কথা নয়। অনেক কসরত করে পকেট হাতড়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন যখন, দেখি তাঁর হাতে খুচরো পয়সার সাথে দুটো আলু আর একটা পেঁয়াজ।
এই রে,দেখেছ? সকালে হাঁটতে বেরিয়ে বাজার করেছিলাম,পকেটেই রয়ে গেছে এগুলো। গিন্নী দেখলে যা দেবে না!