মৃতের গন্ধ মৃত্যুর গন্ধ
-ও বোধয় মইরা গেসে? কোন
খোঁজখবর নাই।
-ক্যান, গন্ধ বের হইসে?
-সদ্যমৃতের গন্ধ আমার
অসম্ভব প্রিয়।
-ওয়াও। ফিলিং কাফকা!
প্রায়শই আমি মৃতের শরীরের গন্ধ পাই। বাবারমৃত্যুর পরপরইতাঁর শরীর
থেকে বেরোনো হিম অথচ মাদক যে গন্ধ আগরের সাথে মিশে আমাকে নেশা ধরিয়েছিল, ঠিক সেইগন্ধটা
যেন নাকে এসে ধাক্কা দেয়। বাবার সিথানে আর পায়ের কাছে আগরবাতিগুচ্ছ ধোঁয়া
ছড়াচ্ছে-সারা ঘরময় সেই ধোঁয়ারকুণ্ডলীপাক খাচ্ছে আর খাচ্ছে। অতঃপর, সারা বাড়িময়
ঘুরছে সেই পাক। আমি এক হিমশীতল গন্ধ পাচ্ছি। সেই থেকে শুরু। ইদানিং আমি প্রতিটা
মৃতের গন্ধ থেকে বেছে বেছে বাবার শরীরেরগন্ধটা একদম আলাদা করতে পারি!যখনইমৃতের
শরীরের গন্ধ আমার মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ে, ঠিক তখনই বাবার শরীরের গন্ধটা অনুভব করি
তীব্রভাবে।
প্রায়শই রাতে বাবা নানাভাবে
তাঁর উপস্থিতি জানান দেন। কখনো কখনো অতি সাবধানী হয়ে ফিসফিস করে কথাও বলেন।
-জানস বাজান, আমি জীবিত
থাকতে তো কোন মরা বাড়িত যাইতাম না। কেল্লাইগ্গা ক’সাইন দেহি ?
-কইতাম ফারতাম না।
কেল্লাইগ্গা?
-হা হা হা। একাত্তরের সেই গণহত্যার ফরেত্থাইক্যা ফ্রায় রাইতে আমি
মৃতের গন্ধ ফাইতাম। সবাইরে মাইরা ফালাইলো ঐ হারামজাদারা! তোর দাদাদাদী, চাচাফুফু
সবাইরে!মারার একদিন পর আইসা দেহি লাশের উফরে লাশ। রক্ত জমাট বাইন্দা আছে। আগর
জ্বলে নাই সেদিন। জ্বালানোর মানুষই তো আছিলো না! সেই যে বাসি রক্তসহ লাশেদের বোটকা
ঝাঁঝালো গন্ধডা মাথায় ঢুকলো, আর ফিছন ছাড়ে নাই। সেজন্য আগরের গন্ধ আমি সহ্য করতাম
ফারতাম না কোনদিন।
-আমিও তো আপনার সইল্যের
গন্ধ ফাই। কিন্তুক আগর আমার ফ্রিয়।
-হা হা হা বাজান,
সিলসিলা। আমার মস্তিষ্কে ঢুকসিলো আমার মৃত বাপমা-চাচাচাচী-ভাইবোনের সইল্যের গন্ধ
আর তোর ক্ষেত্রে তোর মৃত বাপ মানে আমার সইল্যের গন্ধ। হা হা হা।
-আপনি হাইসেন না এমন
শব্দ কইরা। রোমমেটরা জাইগা গিয়া আমারে বির বির করতে শুনলে ফাগল ভাববো।
-জগতের সবাই ফাগল রে,
বুঝলি বাজান?
বাবার শরীরে আগরের গন্ধ ভুরভুর করে আর রাতভর জেগে জেগে আমি সেই
গন্ধে বিভোর হই। এই গন্ধ আমাকে ডানে বামে-চারদিকে আড়াল করে রাখে। আমাকে পরম মমতায়
জড়িয়ে রাখে। আমি শিশুর মত গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকি বাবাকে জড়িয়ে।আমি শুয়ে থাকি
তাঁর শরীরের গন্ধ জড়িয়ে। আর আমি আমার মৃত বাবার লোমশ বুক থেকে কি অদ্ভুত হিম অথচ
এক অপার্থিব মাদকতাময় গন্ধ শুষে নিতে নিতেরাতের পর রাত পার করি।