গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

সরিৎ চট্টোপাধ্যায়



কবচ কুণ্ডল

- তাও যদি রঙটা এট্টু ফরসা হত রে!
- ওইতো তিরিশ কিলোর শরীর। একটু ছলাকলা শেখ মা এবার; চার মাসতো হল!
- রোজ এট্টু চিনি দিয়ে মাখন খা। গতরে চর্বি লাগবে।

আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে কণা। বীথি,রাজিয়া,ময়নামাসি;ওদের কথাগুলো কানে বাজছে। এমাসে সিধুদার হাতে যে কতটুকু পাঠাতে পারবে,কে জানে!সিধুদা,সবাই সিধুদাই ডাকে; লোকাল ট্রেনে চিরুনি,লাল ফিতে,শসা,টক-মিষ্টি-ঝাল লজেন্স বা ইঁদুর-আরশোলা মারার বিষ বেচে। ডান পাটাকে একটু টেনে চলে। কতবার বিনিপয়সায় লজেন্স চেয়ে খেয়েছে কণা;সেদিন বিষ চেয়েছিল। সিধুদাই নিয়ে এসেছিল এইখানে,এই পাড়ায়।
কণা আয়নায় দেখে, পুকুরপাড়ে মা থাউপিসিকে বলছে - মেয়েটাকে কাঁথিতে ওর মামার কাছে পাঠিয়ে দিলাম গো দিদি;ওখানেই ইস্কুলে ভত্তি করে দিয়েছে। সত্যিই; কত কিছু শিখছে কণা।সারি বেঁধে আসা মুখগুলো আর চোখেই পড়ে না; শুধু বুকের চুলগুলো - কালো,সাদা,কাঁচা-পাকা।

আজ ময়নামাসি ডেকে পাঠাল।
- এট্টু সাবধানে থাকিস মেয়ে। উনাদের ভিজিটের খবর আছে। বড় টিপ পরা ভদ্দরমহিলা দেখলেই ঘরে ঢুকে নুকিয়ে থাকবি। আর,এই-এগুলো পরে নিস। কণা অনেকক্ষণ আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে। ভয় করছে ওর। ভাইয়ের এখনও আরো চার মাস ওষুধ চলবে। রোগা কালো হাতে শাঁখাজোড়া কি বিশ্রী দেখাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজের পুরিয়াটা খোলে কণা; অপটু হাতে সিঁদুর এঁকে নেয় কুমারী সিঁথিতে।
ওদিকে ফিরতি মেচেদা লোকালে সিধু মুখস্থ বুলি আওড়ে চলেছে, - দেবো নাকি দাদা ছাল ছাড়িয়ে,নুন মাখিয়ে! হে হে হে,আরে আরে রাগ করেন কেন দাদা - কচি শসা- খুব কচি!

পাইথোগোরাস

বিপুল স্যর! 
ভাবতেই ফিক করে হেসে ফেলে তনু। রীণাতো শুনে আঁতকেই উঠেছিল, তুই পাইথোগোরাসের ছেলেকে বিয়ে করছিস!
বিয়ের পরও বেশ ক'বার স্যর বলে ডেকে জিভ কামড়েছে তনু। 

তবে শ্বশুরবাড়ি হো তো এইসা। নইলে ভাবা যায়, অষ্টমঙ্গলার পর শাশুড়ি বলছে, তুমি কি শাড়ি পরেই থাকবে নাকি? এখন তো বারমুডাও পরে। 

মায়েদের একটা গ্রুপ আছে, বিবর্তন। তনুকে চোখ টিপে বলেছিলেন, বি-বর-তন। অনেক হল বর বর করে। কাল, দু সপ্তাহের জন্য নিউজিল্যান্ড বেড়াতে চলে গেলেন। ব্যাকপ্যাকিং করবে। টেরিফিক!

আজ তনুর অফিস ছুটি। সৌম্য অফিস ফেরতা দাঁত বার করে ঢুকল। হাতে দু্টো প্রকাণ্ড সাইজের মোচা। কয়েক ন্যানোসেকেন্ডের জন্য তনুও লাফিয়ে ওঠে - আহা, মোচার ঘণ্ট! কিন্তু পরক্ষণেই মায়ের অনুপস্থিতি আর নিজের রন্ধনশিল্পে প্রভূত পরাক্রম মনে পড়ে যেতেই 'রাঁধবে কে?' বলে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। 
পাইথোগোরাস বিছানায় উপুড় হয়ে কী সব লেখালিখি করছিলেন, হঠাৎ দরজায় মৃদু গুঞ্জন। তাকিয়ে দেখেন,একজোড়া মাথা। সামনের মাথাটা বলে উঠল,স্যর,একটা কঠিন অঙ্ক আছে। 
ড্রয়িং রুমে একটি ত্রিভুজ। তিনজোড়া হাতে মোচা ছাড়ানো শেষ। তনুর হাতে ছুরি। বহুকাল পর সেই পরিচিত গলা,ছুরি দিয়ে মোচা কাটবি! সৌম্য লাফ দিয়ে বঁটি আনতে যায়। এদিকে,বিপুল স্যর এই আট মাস যাবত তুই আর তুমি'র কনফিউসানে দাঁড়ি টানেন। আর্থরাইটিসে ধরা হাঁটুটা চেপে ধরেছে বঁটিটা। অপটু কিন্তু দৃঢ় হাতে মোচা কাটা হচ্ছে। 
পরদিন দুপুরে, রান্নাঘরে - বুঝলি মা,বাঙ্গালী রান্না মানেই ফরমুলা। বড়জোর চারটে। ব্যাস! 
সৌম্য ফুট কাটে, বাবা ঠিক বলেছে,দু সপ্তাহ যথেষ্ট। মা আসলে অবাক হয়ে যাবে। 
একজোড়া দৃষ্টিবাণে সৌম্য ভস্ম। খেতে বসে তনু শুধু বলে,ইস্! মা'ই খেতে পারল না। 
পাইথোগোরাস নির্লিপ্ত গলায় বলে,বেশ হয়েছে। আরো যাক নিউজিল্যান্ডে গরু খেতে।