গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

সুধাংশু চক্রবর্ত্তী



 রক্ত কথা বলছে


মানাই ছুটতে ছুটতে এসে সংবাদ দিলো – “ওরে গোরা, তোর বাবাকে নাকি পদ্মপুকুরের ধারে বেঁধে রেখেছে নারকেল গাছের সাথে ।  কেরোসিন নাকি পাচার করছিলো রাতের অন্ধকারে
গোরা ক্লাবঘরে বসে ক্যারাম পিটছিলো । শুনেই তড়াক্‌ করে উঠে দাঁড়ালো ক্যারাম ফেলে ।
তোকে কে বললো রে”?
যা গরম পরেছে কদিন ধরে । ছাদে শুয়ে ছিলাম মাদুর পেতে । নিজের কানেই শুনলাম । দুজন বলতে বলতে যাচ্ছিলো বাড়ির সামনে দিয়ে । শুনেই ছুটে এলাম তোর কাছে
চল তো দেখি গিয়ে
গোরা ছুটতে শুরু করে । পেছন পেছন ক্লাবের বন্ধুরা । পদ্মপুকুরের ধারে গিয়ে দেখে বাপ হলধর সামন্ত বাঁধা রয়েছেন গাছের সাথে । শুধু বেঁধেই ক্ষান্ত হয়নি । মারধোর দিয়ে গায়ের জামাও ছিঁড়ে দিয়েছে । নাক থেকে রক্ত ঝরে জামার বুক ভাসিয়েছে । জনা দশেক উত্তেজিত যুবক ঘিরে রেখেছে তাঁকে ।
গোরা কে দেখে জটলাটা সরে এলো ওর কাছে । মাতব্বর ছেলে টা এসে দাঁড়ালো ওর গা ঘেঁষে । গোরা ওকে চেনে । কাল্লু । পাড়ার মস্তান । দাগী আসামী । কাল্লু হেঁড়ে গলায় বললো – “তোর বাপকে আজ আর ছাড়বো না গোরা । কেরোচিন তেল পাচার করছিলো ? শ্লা, গেরামে অনেকেরই বাড়িতে হ্যারিকেন জ্বলছে না তেল না পেয়ে । আর তোর বাপটা কিনা কেরোচিন বেলাক করছে রাতের অন্ধকারে” !
গোরা জানে ওর বাবার খুব বদনাম । ভীষণ টাকার খাঁই । টাকা ছাড়া কিছু চেনে না । তবুও বাপ তো ।  মৃদু গলায় বললো, এবারের মত ছেড়ে দে কাল্লু । কথা দিচ্ছি বাবা আর ওসব করবেন না । করতেই দেবো না
এমনি এমনি ছেড়ে দেবো ভেবেছিস” ?
কি করতে হবে বল” ?
পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা । সাথে দুই টিন কেরোচিন । কি রাজী আছিস” ?
ঠিক আছে । হয়ে যাবে
নিয়ে যা তোর বাপকে । কেরোচিন আজই দিয়ে যাবি কিন্তু । আমাদের পাড়ায় এসে দিয়ে যাবি । কাল টাকাটা দিবি আমার হাতে । নইলে......
ঠিক আছে । পাঠিয়ে দেবো
আজ গ্রামে অনেকের ঘরেই হ্যারিকেন জ্বলবে । কাল্লু সেই আনন্দে হৈ হৈ করতে করতে চলে গেল সাকরেদদের নিয়ে । বাপ হলধর সামন্তকে বাঁধন মুক্ত করতে করতে গোরা গাল ভর্তি হাসি গিলতে থাকে । নিজেকে খুব চালাক ভাবতে পেরে খুব আনন্দ হচ্ছে । মনে মনে বললো দিচ্ছি তোদের টাকা আর দুই টিন কেরোসিন
রাতের কালো আকাশের বুকে টিম টিম করতে থাকা তারাগুলো দেখছে বাপ হলধর হালদারের হাত ধরে গোরা হাঁটছে বাড়ির পথ ছেড়ে  অন্য একটা পথে । হলধর হালদারের রক্তাক্ত নাক এবং ছেঁড়া জামাটাকে কাজে লাগাতে যে হবে আজ রাত্রেই ।

বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে

বাস থেকে নামা মাত্র সৌম অনুভব করলো শান্তিরও একটা গন্ধ থাকে। পায়ের তলায় প্রিয় গ্রামটির মাটি। সামান্য ভেজা ভেজা। তারমানে খানিক আগেই বৃষ্টি হয়েছে এখানে। মোড়াম ওঠা রাস্তায় ভাসছে খসা পাতা ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। সৌম্য নাকের পাঁটা ফুলিয়ে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বুকে ভরে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। প্রায় বছর সাতেক বাদে গ্রামে পা রাখলো। চেনা জায়গাটা কিছুটা অচেনা হয়ে গেলেও মাটির সোঁদা গন্ধ, পায়ের পাতা ভিজিয়ে দেবার জন্য উঁচিয়ে থাকা সবুজ ঘাসের ডগা, বাঁশঝাড়ে বাঁশপাতার ফিসফাস শব্দ -  এগুলো তো এতটুকু বদলায়নি!
বাস্তু ভিটেয় পা রাখতেই বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠলো। সচল পাদুটো নিমেষেই অচল। খোকা এলিবলে কেউ যে ছুটে এলো না দরজা খুলে! অথচ সাত বছর আগে ঠিক অন্য ছবি। কলেজের ছুটিতে এসে উঠোনে পা রাখলেই মা ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, খোকা এলি। আয় বাবা, বুকে আয়। কাঁধের ব্যাগটা ঝুপ্‌ করে পড়ে গেল উঠোনে। বুকের ভেতরটা হাঁকপাঁক করে উঠলো মা, মাগোবলে ডেকে ওঠার জন্য। 
দরজা খোলার শব্দ শুনে ব্যগ্র চোখে তাকালো। বড়দি বেরিয়ে এলেন। এসেই ওর বুকের ভেতরের হাঁকপাঁক করতে থাকা অবস্থাটাকে ঝড়ের চেহারা যেন দিলেন, এলি তাহলে? সেই তো এলি ভাই। আর একদিন আগে এলে মাকে শেষবারের মত দেখতে পেতিস। শেষ কদিন মায়ের মুখে শুধু একটাই কথা, খোকা এলি? খোকা?
শুনেই বুকের ভেতরটায় সজোর ধাক্কা। সর্বস্ব হারানোর একতাল ব্যথায় বুক যেন পাথর। পাদুটো কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না শরীরের ভার। তখনই আবার বৃষ্টি। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ধারা যেন মায়েরই স্নেহের স্পর্শ! টুপটাপ শব্দ করে মায়ের হয়ে যেন বলছে, খোকা এলি? খোকা? আয় বাবা, বুকে আয়।
সৌম্য উঠোনে আছড়ে পড়েই এতক্ষণ না বলতে পারা শব্দ দুটো বুক নিংড়ে উগড়ে দিলো, মা---, মাগো-----ও।