গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

মোহম্মদ জাহিদুল ইসলাম



বাস্তু সংস্থান

কূয়োব্যাঙটা মনে করে কূয়ো ছাড়া জগতে আর দ্বিতীয় কোন জলাশয় নেই। বদ্ধ কূয়োতেই তার আশৈশব বসবাস। মাঝে মাঝে দু'একটা ধোরা কিংবা মেটো সাপ শিরশিরে নেমে আসে নিচে, বংশ বিনাশ করে দিয়ে চলে যায়। কোন দুঃখ নেই মনে,ব্যাঙের কান্না আর ক'জনায় দেখে। কখনো কখনো ছোট ছোট বাচ্চা ব্যাঙ বৃথা চেষ্টা করে কূয়োর বৃত্ত ছেড়ে পালাবার কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠে না। অগভীর কূয়োর বাঁধন ধীরে ধীরে তাদের কাছে গোটা পৃথিবী হয়ে উঠে।
শেষমেষ,বাইরের অজানা বৃহৎ পরিবেশটা আদৌ তাদের জানাশোনার বাইরেই রয়ে যায়। বয়োবৃদ্ধরা রাত জেগে গল্প শোনায় দৈত্য-দানবের,তারা খুব নিষ্ঠুর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়,বিশালদেহী আর কুৎসিত বাসনার; তবুও গুটিকয়েক ব্যাঙ  মিলে আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। সমাজ তাদের একসময় আলাদা করে দেয়। জীবন দূর্বিষহ করে তোলে। ভাগ্যের বর্ষণে কোন একসময় বর্ষার পানি ফেঁপে উঠলে, অনেকে সফল হয় ধৈর্য আর সুদীর্ঘ চেষ্টাবলে; অনেকে আবার সেই ছোট্ট কূয়োতেই থেকে যায়। যারা সফল হয় তারা অবশ্য দ্বিতীয়বার ফেরে না তবে সাফল্যের এক বিশাল দ্বার উন্মুক্ত করে  দিয়ে যায়!
গত বর্ষায় কূয়োব্যাঙটা শেষবয়সে এসে কূয়ো ছেড়ে বের হতে পেরেছে। সময় পেরোতে পেরোতে এখন শীত। তাতে কি? ব্যাঙটা মুগ্ধ বাহিরের জগতের অগাধ সৌন্দর্যে, জীবিকার তাগিদে এখানে-সেখানে ঘুরে বেরায় আর সৌন্দর্যসুধায় প্রবলভাবে আকর্ষিত হয়। যতদূর চোখ যায় ততদূর নতুনত্বে ছাওয়া, একের পর এক নুতন নুতন সৃষ্টি। ব্যাঙের গায়ের চামড়া ইতোমধ্যে পাল্টে গেছে। নতুন পরিবেশে নতুন রূপ। গাছ-পালা,পাখ-পাখালি সবই অদ্ভুত আর অত্যাশ্চার্য। কখনো দেখা হয়নি, কখনো সাক্ষাৎ হয়নি এমন সব নতুন বন্ধুদের সাথে মেলামেশা। নাহ! কূয়োর শুকনো পিঁপড়ে আর কচুগাছ ছাড়া যার কিছুই দেখা হয়নি আজীবনে তার জন্য এ সত্যিই অনেক কিছু। বাহিরের দুনিয়ায় থাকার পর ব্যাঙটার মনে হয়, সে বেশ ভ্রমণপিয়াসু। এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতেই বেশ আমোদ পায়।  অল্পদিনেই বেশ কয়েকটা স্থানও তার বেড়ানো হয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু ব্যাঙের ডেরায় দু'এক দিন থেকে এসেছে; খুব আতিথ্যপ্রিয় ছিল তারা,মেহমানদারিতে বেশ নাম-ধাম কামিয়েছে। অবশ্য,বয়োবৃদ্ধদের একখানি কথা ঠিক-ঠাক মতন অক্ষুণ্য রয়েছে, দৈত্য-দানবের চারণভূমি থেকে যতখানি দূরত্ব বজায় রেখে চলা যায় ততটাই মঙ্গল। এদিকে,সুখ যেমন আছে তেমনি দুঃখের বেড়াজালও অপ্রীতিম। স্বজাতীদের মাঝে খাবার নিয়ে মরণ লড়াই সর্বদা লেগেই থাকে তখন ব্যাঙটার বুক ভয়ে শুকিয়ে খাল হয়ে যায়। কিছু কিছু স্বজাতি খুবই ভয়ঙ্কর, খাবার পেতে মরিয়া হয়ে থাকে মাসের পর মাস। সারাদিন শেষে প্রত্যেক রাত্রে ব্যাঙটা তাই নির্জন স্থানে বসে একা একা চিন্তা করে,এ জীবন খুলে দেখলে কোন অংশেই মন্দ নয়। চাঁদের দিকে তাঁকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। মনে হঠাৎ সাধ জাগে- ইস! যদি চাঁদে যাওয়া যেত।
গায়ের চামড়া আবার বদলে গেছে। রাতের ব্যাবধানেই সব- টের পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। দেহে শক্তির প্রয়োজন। ছোট ছোট পিঁপড়ে খেয়ে ক্ষুধা মেটানো এখন আর সম্ভব নয়। সময় পাল্টেছে এখন বড় বড় পোঁকার স্বাদ ছাড়া আর কিছুই পেটে ঢোকে না; সব উগলে দেয়। রাত হতে বেশি দেরি নেই, সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে অথচ কোন খাবারের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। অগত্যা ব্যাঙটা লাফিয়ে লাফিয়ে শুষ্ক পথ চলতে থাকে। হাঁটুর জোড় কিছুটা কমে গেলে পথ চলা থামিয়ে খানিক বিশ্রাম করে নেয়। ব্যাঙটা শুয়ে শুয়ে ভাবে- পুরো দুনিয়াটাই সে দেখে ফেলেছে। মনে তার এখন কোন শোক-তাপ নেই। সুউচ্চ গাছের গুড়ি, দক্ষিণের মুক্ত হাওয়া, প্রজাপতির কোমল রঙ, সকালের কুসুমগরম হলুদ সূর্য, বিশাল সমুদ্রতট সবই তার দেখা।
হঠাৎ কখন যেন একটা সাপ এসে তার সামনে ফণা তুলে হিসিয়ে উঠে। ব্যাঙটা কোন টের পায়না। সাপের হিস্ হিস্ শব্দে ব্যাঙের ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ব্যাঙটা তখন আর পিছু হটেনা, শুধু তার আফসোস হয় কূয়োর ভেতর আটকে থাকা সেই ব্যাঙদের উপর- হায়! তারাও সেই কিছুদিনের মাঝে একই মৃত্যুর মুখোমুখি হবে অথচ তারা কিছুই দেখলোনা, কিছুই জানলোনা,কিছুই শিখলোনা!