গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭
তাপসকিরণ রায়
ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী--১৬
ভোপালের
শিবপুরী ফোর্ট। পোহরী তহসিলের শিবপুরে এর অবস্থান। এটা একটি প্রাচীন কেল্লা। বলা
হয় দু হাজার বছরের আগের এটি একটি ঐতিহাসিক ফোর্ট। ফোর্টটি ভোপাল নগর থেকে বহুদূরে
গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত। তদানীন্তন রাজা বীরখন্ডেরাও এটি তৈরি করিয়ে ছিলেন। রাজা
বীরখন্ডেরাও ছিলেন খুব ভোগবিলাসী চরিত্রের লোক,
তাঁর এই কেল্লায় প্রায়ই নর্তকীদের গান বাজনা ও নাচের জন্যে
নিয়ে আসা হত। এখানে প্রতি রাতে বসত নাচ-গানের আসর। অন্য রাজ্য থেকেও এখানে মেয়েদের নিয়ে এসে ভোগ-বিলাসিতা চলত। এখানকার মজলিসে চলত চরম আনন্দ ফুর্তি। রাজা তাঁর সারাটা জীবন
নারী, সূরা ও ভোগ-বিলাসিতার
মধ্যেই জীবন কাটিয়ে গেছেন।
এই কেল্লা
এক সময় লোকজনরা দেখতে আসত। তারা কেল্লা ঘুরে ফিরে দেখত,
এখানে বিরাট বিরাট লন,
ঘর, দেওয়ালের সুন্দর কারুকাজ নকশি দেখত। এর
দেওয়ালগুলি দর্শনার্থীদের জন্যে রঙ করানো হয়েছিল। সাজ সজ্জাগুলিকে আবারও দেখার মত
করে সজ্জিত করা হয়েছিল। লোক দেখত এখানকার মজলিশী নাচঘর ও তার সাজ সরঞ্জাম। দেখত
রাজা বীরখন্ডেরাওয়ের বিরাট আয়োজন সজ্জার বহর। তারপর দীর্ঘ দিন কেটে গেছে এখানে আর
কেউ আসে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানের পতিত জাগায় জন্মে গেছে জঙ্গল। এখন এ জাগা
দিন ভর স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে। দিনের পরে যখন রাত আসে তখন ধীরে ধীরে জেগে ওঠে এ হাবেলি, ভিতরের নাচ ঘরে জ্বলে ওঠে আলোক
সজ্জা। কেল্লা আবার তার হাজার বছর অতীতে ফিরে যায়--আবারও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
এখনও নাকি
রাতের মহফিল জমিয়ে বসে থাকেন রাজা বীরখন্ডেরাও ! রাত হলেই এখানের ফোর্ট জেগে ওঠে ! সেই দু
হাজার বছর আগের দিনগুলিতে পৌঁছে যায় ! অতীতের
সেই বাঈজীদের নাচ শুরু হয়। তাদের ঘুঙুরের বোল ঝংকৃত হয়ে ওঠে, গানের গুঞ্জনের মাঝে মাঝে উচ্ছল
পুরুষদের লিপ্সিত আওয়াজ জেগে ওঠে। আওয়াজে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে গমগম করে ওঠে সে
কেল্লার প্রাসাদ মহল !
এক সময়ের
লোকালয় আজ জন-মানবহীন হয়ে পড়ে
আছে। শিবপুরি এরিয়াতে এখন জন সংখ্যা অনেক কমে গেছে। প্রায় মাইল খানেক দূরত্বে
রয়েছে জন-
বসতি। এই বসতির বাসিন্দাদের
কাছ থেকে জানা যায় যে এখানকার অলৌকিক ঘটনার কথা। তারা বলে,
ওই কেল্লার কথা, এক কিলোমিটার দূর থেকেও তাদের কানে মাঝে মাঝে ভেসে আসে নাচ গানের আওয়াজ, ঘুঙরু পায়ে কে বা করা যেন নেচে
চলেছে বলে মনে হয় ! অনেক
লোকের জমায়েত আসরের হৈচৈ হল্লার আওয়াজও গভীর রাতে ওদের কানে ভেসে আসে !
স্থানীয়
গ্রামের এক বৃদ্ধ গল্প করেছেন। একবার নাকি এক ফৌজি লোক এসেছিল কেল্লা দেখতে। তখন
সেখানে চারদিকে ভীষণ জঙ্গল হয়ে গেছে। ভয়ে কেউ দিনের বেলাতেও দুর্গের ধারকাছ ঘেঁষে
না। ফৌজি লোকটা এসে গ্রাম থেকে জল খেয়ে তারপর কেল্লার কথা জিজ্ঞেস করে ছিল।
গ্রামের যে যা ঘটনা জানতো সবাই কিছু কিছু বলে ছিল তাকে। যাওয়ার সময় এ সব ঘটনাকে সে
ফু মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলে ছিল, যত সব বাজে কথা, আজ রাতে আমি একা ওখানে থাকব, দেখি কি দেখতে পাই. আমাকে ভূতেরা কি বলে ?
গ্রামের
বয়স্কদের দু একজন তাকে বাধাও দিয়ে ছিল। কিন্তু কে কার কথা শোনে ! সে ফৌজি সিপাই সেদিন রাতেই গিয়ে ঢুকে ছিল সেই কেল্লায়। এরপর
কদিন তার কোন খোঁজ খবর নেই। গ্রামের লোকরাও তার খবর জানার জন্যে আগ্রহে দিন
কাটাচ্ছিল। তারপর সে ফৌজির লাশ দশ দিন পরে পুলিশ ওই কেল্লা থেকে পচাগলা অবস্থায়
বের করে নিয়ে এসেছিল। শেষে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে নাকি বলা হয়েছিল, হার্টফেল করে মারা গেছে। এও
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। এ ঘটনা যখন ঘটে তখন এই গল্প বলা বৃদ্ধের বয়েস নাকি
পঁচিশ বছর ছিল।
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

বিষ
চাঁপার মায়ের নাম শেফালি। শেফালি যে শিউলি ফুলের নাম চাঁপা জানত না। পাড়ার ইশকুলের দিদিমনি শেফালি ফুল মানে শিউলি ফুল বলে দিয়েছিল, তবেই না জানল চাঁপা। চাঁপার বয়স বেশী নয়, এই সবে তেরো পেরিয়ে চোদ্দর ঘরে পা রেখেছে। ঠাকুমা বুড়ি লোকের কাছে বলে দশ। হি হি...এত হাসি পায়! পাড়ার ইশকুলে চার ক্লাস পর্য্যন্ত পড়েছিল, তারপর আর ইশকুলে যায়নি। বই-বেতন লাগে না ঠিকই, উঁচু ক্লাসের দিদিদের পুরনো বই দিদিমনিরা দেয়, তাই দিয়েই চলে যায়। কিন্তু ইশকুলে পড়তে গেলে একটা গোটা জামাও তো চাই! এমনিতেই ছেলে-ছোকরারা ঘুরঘুর করে, গায়ে জামা না থাকলে তো কথাই নেই! চাঁপার একটাও জামা ছিল না তখন। এখন মায়ের লাহা বাবুদের বাড়িতে কাজ হয়ে জামা পরতে পেয়েছে। আগে ছেঁড়া গামছা গায়ে দিয়ে থাকত। লাহা বাবুরা টাকা ভাল দেয়। খাটনি আছে, কিন্তু পুষিয়ে দেয়। পুজোর সময় বৌ-বিটিরা এলে এটা সেটা দিয়ে যায়। কিন্তু লাহা গিন্নির ভারি মুখ। মাঝে মাঝেই লেগে যায়।
চাঁপার মায়ের নাম শেফালি। শেফালি যে শিউলি ফুলের নাম চাঁপা জানত না। পাড়ার ইশকুলের দিদিমনি শেফালি ফুল মানে শিউলি ফুল বলে দিয়েছিল, তবেই না জানল চাঁপা। চাঁপার বয়স বেশী নয়, এই সবে তেরো পেরিয়ে চোদ্দর ঘরে পা রেখেছে। ঠাকুমা বুড়ি লোকের কাছে বলে দশ। হি হি...এত হাসি পায়! পাড়ার ইশকুলে চার ক্লাস পর্য্যন্ত পড়েছিল, তারপর আর ইশকুলে যায়নি। বই-বেতন লাগে না ঠিকই, উঁচু ক্লাসের দিদিদের পুরনো বই দিদিমনিরা দেয়, তাই দিয়েই চলে যায়। কিন্তু ইশকুলে পড়তে গেলে একটা গোটা জামাও তো চাই! এমনিতেই ছেলে-ছোকরারা ঘুরঘুর করে, গায়ে জামা না থাকলে তো কথাই নেই! চাঁপার একটাও জামা ছিল না তখন। এখন মায়ের লাহা বাবুদের বাড়িতে কাজ হয়ে জামা পরতে পেয়েছে। আগে ছেঁড়া গামছা গায়ে দিয়ে থাকত। লাহা বাবুরা টাকা ভাল দেয়। খাটনি আছে, কিন্তু পুষিয়ে দেয়। পুজোর সময় বৌ-বিটিরা এলে এটা সেটা দিয়ে যায়। কিন্তু লাহা গিন্নির ভারি মুখ। মাঝে মাঝেই লেগে যায়।
চাঁপাদের
তিন বোনের নামই ফুলের নাম। চাঁপাই বড়। মেজবোনের নাম জবা আর ছোটবোনের নাম বকুল। চাঁপার মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল ছেলে হলে নাম রাখবে পলাশ। তা
চাঁপার মায়ের সে ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি। হয়নি তো হয়নি, তিনটে মেয়ের পরেও আবার একটাকে চাই! আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচিনে!! এই
নিয়েই ঝগড়া চাঁপার ঠাকুমার সঙ্গে ওপাড়ার কেষ্ট লাহার গিন্নির। সেদিন ঠাকুমা গিয়ে
শুনিয়ে দিয়ে এসেছে দুকথা।–তা, আমার
বৌয়ের শখ যদি থাকে, তোমার কিসের এত ইয়ে? তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকল, এখনও তো ছেলের বৌ
একটাকেও আনতে পারলে না। আমার বৌ তিনটে মেয়ে লিয়ে এসেছে বলে এত্ত রাগ! মর্...মর্...আমার
বৌ-বিটিকে যে অমন বলে তার মুখে পোকা পড়ুক, শত্তুর...শত্তুর!!
আমার ছেলে থাকলে আরো দুটো হত, তোর তাতে কি?”
চাঁপার
অবশ্য এইধরণের গালাগাল ঠিক পছন্দ নয়। কিন্তু বললেই শুনছে কে?
ঠাকুমার যা মুখ। ঠাকুমাকে ভয় পায় ওরা তিন বোনেই। লাহা গিন্নির
চাকরিটাও মায়ের এবার বোধহয় গেল, গেলে খাবে কি? এত মুখ মনিব সইবে কেন? তাও আবার ছেলে না হওয়ার
খোঁটা-- চাঁপার মা’ও ভাবে মনে মনে। কত বাড়িই যে ঘুরেছে, এই
বুড়ির জ্বালায়। যেখানে
কাজ পাবে, সেখানেই বুড়ি ছুটবে। আগে ভাগে জেনে নেবে মাইনে কত, কি
দেবে-থোবে। দুটো পয়সা যে বাঁচিয়ে রাখবে, তা দেবে না বুড়ি।
‘লোককে গাল দিস, তুই মরতে পারিস
না, মরলে হাড় জুড়োয়’ চাঁপার মা
ভাবে মনে মনে।
চাঁপাদের
বাপ নেই। বাপ রাস্তার ওপারে চটকলে কাজ
করত। কাজ আবার কি! শুধু তো মদ গিলতে আর জুয়া খেলতে যাওয়া আর রেতের বেলায় এসে চাঁপার মায়ের সঙ্গে
ঝগড়া, লাঠালাঠি। এক রাতে চাঁপা নিজেও দেখেছে
রান্নাঘরের বেলুনি নিয়ে এসে মা’কে মারতে। ভয়ে ককিয়ে
উঠেছিল চাঁপা। ঠাকুমা বুড়ি মুখচাপা দিয়ে নিয়ে গেল বাইরে গজগজ করতে করতে—পুরুষের রাগ অত ধরলে কি আর চলে!’ বাপ মরে গিয়ে মায়ের মারধোর
কমেছে বটে কিন্তু ঠাকুমা বুড়ির চিৎকার কম নয়। তবে হ্যাঁ,
তাদের কিছু বলে না। নইলে মা কি তিন বোনকে রেখে কাজে যেতে পারত!
লোকে বলে মেয়ে হলে সংসারে তার দাম কমে যায়। কিন্তু ঠাকুমার যত দোষই থাক, তাদের তিন বোনকে বুকে আগলে রাখে। সময়মত খাওয়াদাওয়া জোটে না, মাথার চুলে তেল পড়ে না। তবু চাঁপা যে দিন দিন দেখতে বেশ ডাগরটি হচ্ছে বোঝা যায়। কি করে
বোঝে? কি করে আবার, রাস্তা দিয়ে গেলে লোকে
কেমন করে তাকায়। শুধু রাস্তার লোক কেন, এই তো গেল
বিষ্যুদবারে লাহা গিন্নিকে পূজার ফুল দিতে গিয়ে লাহা বাবুই তো বললে—চাঁপা যে!
বাবা বেশ বড় হয়ে গেছিস তো। তা কাজকর্ম কিছু শিখলি, নাকি ঘরে বসে থাকিস। মায়ের সঙ্গে এসে দুটো কাজও তো করে দিতে পারিস।‘
তাই শুনতে পেয়ে লাহা গিন্নি বলে উঠল---ও কেন কাজ করতে যাবে,
এইটুকু মেয়ে। আজকালকার
দিনে সবাই লেখাপড়া শিখছে, ও শিখবে না
নাকি? কি রে, চাঁপা”—বলেই চাঁপার দিকে তাকালেন। লাহা বাবু লোকটাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না
চাঁপা। খালি দেখা হলেই ওর বাড়িতে কাজ করতে যাবার জন্য বলবে। লাহা গিন্নি ঝগড়া করুক,
কিন্তু চাঁপার
সঙ্গে কথা কইতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন—যা চাঁপা, তোর কোন কাজ নেই, যা... মা’কে পাঠিয়ে দিস।‘
সেদিন
সাতসকালে মা
গেছে লাহা বাবুর বাড়ি কাজে। চাঁপাকে বলে গেল যাবার সময় রাস্তার কল থেকে দু বালতি
জল এনে রাখতে, মা কাপড় কাচবে। চাঁপা বোন দুটোকে মুড়ির
বাটি দিয়ে বসিয়ে রেখে গেল জল আনতে।
কলতলায় ঠাকুমাকে দেখল দুটো লোকের সঙ্গে কথা কইতে। লোকদুটোকে আগে
দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না চাঁপা। কিছুক্ষণ দূর থেকে দেখার পর নিজের মনেই মাথা
নাড়ল--না, এরা এপাড়ার লোক নয়। তবে এখানে কেন? আর বুড়ির সঙ্গেই বা এতো কথা কিসের? চাঁপা হাঁক
দিল—ঠাকুমা, ঘরকে যাও, বুন দুটো একলা রইছে।‘
ঠাকুমা যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে, এমন করে তাকাল ওর দিকে দিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকল—আয়, ইদিকে আয়’ বলেই সেই লোকদুটোকে বললে—এই আমার বড় লাতিন, চাঁপা। খুব ভালো, কাজে কম্মে...যা বলবেন, সব সুনবে বাবু।‘
ঠাকুমা যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে, এমন করে তাকাল ওর দিকে দিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকল—আয়, ইদিকে আয়’ বলেই সেই লোকদুটোকে বললে—এই আমার বড় লাতিন, চাঁপা। খুব ভালো, কাজে কম্মে...যা বলবেন, সব সুনবে বাবু।‘
ভুরু
কুঁচকে উঠল চাঁপার। ঠাকুমা কি কোন বাড়ি কাজে লাগাবে তাকে?
মা জানলে কুরুক্ষেত্তর। মা বলে দিইছে, আর
কারুকে কাজে লাগাবে না। তবে, বুড়ি কি চাইছে? দুপুরে কাজ সেরে মা এলো বাড়িতে। ততক্ষণে চাঁপা ভাত আর দুটো ধুঁধুল
পুড়িয়ে রেখেছে। লাহা গিন্নি কালকের বাসী মাছ দিয়েছিলো, তাই দিয়ে আজ চলে যাবে।
লাহা গিন্নি জানে, বাড়িতে অনেকগুলো মুখ হাঁ করে আছে,
তাই দেয়-থোয় বেশী করে। এমন মনিবও থাকবে কিনা কে জানে! খাবার পর
ঠাকুমা কি যেন মা’কে ডেকে বললে। আর জ্বলে
উঠল মা---কি, আমার খাবে, আমার
পরবে, আর আমার মেয়েদের লিয়ে তুমি লোককে লোভ দেখাও?
দূর হও এখান থেকে। তুমি কি আমার শাউড়ি, যে
তুমাকে মাথায় করে রাখব? এত্তদিন রেখেছি সেই ঢের, আর না। মাগো, কি কালসাপ পুষেছি ঘরে, রাস্তা থেকে তুলে লিয়ে এসেছিলাম তুমায়, আর
তুমি কিনা...যাও,
আজই বিদেয় হও। আর না, অনেক করেছি তোমার
জন্যি...দুর হও তুমি, এখনি...যাও ‘
রাত
হল। সেদিন আর কোন রান্নাবান্না হল না। চাঁপার মা লাহাবাবুর বাড়ি থেকে কাজ করে এসে
চুপ করে ঘরের দরজায় বসে রইল। বোন দুটো মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে। চাঁপা সাহস করে মায়ের
কাছে এগিয়ে এল---মা, ঠাকুমা,আমাদের নয়?’
--না...’
কোন দূর থেকে যেন ভেসে এল মায়ের স্বর।
চাঁপা
মায়ের গাঁ ঘেঁসে বসেছিল। এবার আর থাকতে না পেরে হুহু করে কেঁদে উঠল। ঠাকুমায়ের
জন্য কষ্ট হচ্ছে মা...কেন তাড়ালে?’
মা
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠল—বিষ কেউ হাতের
কাছে রাখে? হয় খায়, নয় ফেলে দেয়?
আমি ফেলে দিইছি। আমার পূজার ফুলের ঘরে উ ধুতরোর বিচি ছিল ....’
বলেই চাঁপাকে কোলের কাছে আঁকড়ে ধরে বসে রইল। কি যেন একটা অজানা ইঙ্গিত চাঁপার মনে খেলা করতে লাগল।
ঠাকুমা কি তাকে কোথাও পাঠিয়ে দিচ্ছিল, লোকগুলান
তবে কে? ঠাকুমা কে, এখানে কি করে
এল? ঠাকুমা কি কাউকে দেবে বলে তাদের আদর-যত্ন করত?
বাপ মরেছে কবে, বুন দুটো .....’
--হে
ভগবান, আর একটু বড় করে দাও, নইলে
বুঝব কি করে?’ মা’কে ধরে সেই
দিনের আশায় চাঁপা বসে রইল আকাশের দিকে তাকিয়ে, মনের ভিতর
বুড়ির জন্য হাহাকার...মায়ের জন্য দুঃখ...
আকাশে
তখন চাঁদ আর মেঘের
খেলা শুরু হয়েছে।
সুবীর কুমার রায়
দাদারা তখন
নাটক করার নেশায় মেতেছে।
পন্ডিত স্যারের মেজছেলে, দাদার
প্রাণের বন্ধু অশোকদাও, দাদার
সাথে নাটকের দলে আছে।
আর আছে পন্ডিত স্যারের
সেই ভাইপো, আমার সহপাঠী
বলাই, বা বাবু। এখনকার
মতো তখন নাটকের এত
চল্ ছিল না, দলতো
ছিলই না। যতদুর মনে
পড়ে “বন্ধন” নামে একটা
নাটক সেদিন বড় রাস্তার
ওপর “পাঠ ভবন” নামে
একটা পাবলিক লাইব্রেরীতে সন্ধ্যায়
মঞ্চস্থ হবে। দুপুর থেকেই
দাদা, অশোকদা ও আরও
সকলে নাটক নিয়ে খুব
ব্যস্ত। হলে চেয়ার পাতা,
মাইক বাঁধা, আলোর ব্যবস্থা
করা, জোর কদমে চলছে।
আজকের এই অনুষ্ঠানে পন্ডিত
স্যার প্রধান অতিথির আসন
অলঙ্কিত করবেন।
সন্ধ্যাবেলা দাদা,
অশোকদারা গ্রীনরুমে মেক-আপ
নিয়ে ব্যস্ত। দর্শকরা কার্ড
হাতে হলে ঢুকতে শুরু
করেছে। মাইক্রোফোন হাতে পেয়ে
পর্দার ওপাশ থেকে কে
যেন একই কথা বারবার
ঘোষণা করে চলেছে। ঘোষণার
মাঝেমাঝে, কাম-সেপ্টেম্বর এর
মিউজিকের রেকর্ড বাজানো হচ্ছে।
হলের বাঁধানো মঞ্চে উঠবার
জন্য দু’পাশে সিঁড়ি
রয়েছে। পর্দার পিছন দিয়ে
মঞ্চে যাবার ব্যবস্থা যেমন
থাকে তাতো আছেই। হল
থেকে বাঁধানো মঞ্চ বেশ
উচু। যাহোক্, একসময় মঞ্চের
পর্দা ধীরে ধীরে দু’পাশে সরে গেল।
নিয়ম মতো উদ্বোধন সঙ্গীত
ও দু’-একজনের বক্তৃতার
পর, ঘোষণা করা হলো—
এবার আমাদের প্রধান অতিথি,
শ্রী রবীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য মহাশয়,
কাব্য ব্যকরণ তীর্থ, ইত্যাদি
ইত্যাদি, তাঁর মূল্যবান বক্তব্য
রাখবেন।
পন্ডিত
মশাই মঞ্চে এলেন। তাঁর
সামনে মাইক্রোফোনটা সেট করে
দিয়ে যাওয়া হলো। স্কুলের
পড়ানোর কায়দায় তিনি মাঝেমাঝেই
দুই পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের
ওপর ভর দিয়ে উচু
হচ্ছেন, এবং বক্তৃতা দিয়ে
যাচ্ছেন। দীর্ঘক্ষণ সময় পার
হয়ে যাওয়ার পরেও, তাঁর
বক্তৃতা শেষ হওয়ার কোন
লক্ষণ দেখা গেল না।
'পাঠ ভবন' হলও রাতে
একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত
ভাড়া দেওয়া হয়। বেশি
দেরি হলে সম্পূর্ণ নাটক
মঞ্চস্থ করায়, অসুবিধা দেখা
দিতে পারে। কী ভাবে
তাঁকে ক্ষান্ত করা যায়,
এই নিয়ে দাদারা চিন্তায়
পড়ে গেছে। এমন সময়
তিনি বললেন, “এই তো গেল
গোড়ার কথা, এখন দেখতে
হবে, রস কয় প্রকার।
রস প্রধানত তিন প্রকার,
আদি, মধ্য ও অন্ত।
এবার তিনি আদি রস
ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন।
অবস্থা যা দাঁড়ালো, তাতে
এইভাবে রসের ব্যাখ্যা করতে
গেলে নাটক তো দুরের
কথা, তিনি অন্ত রসে
পৌঁছনোর আগেই, 'পাঠ ভবন' হল
ব্যবহার করার অনুমোদিত সময়
অন্ত হয়ে যাবে। শেষে
তাঁর কাছে গিয়ে ফিসফিস্
করে, বক্তব্য ছোট করার
কথা বলার চেষ্টা করা
হলো। কিন্তু তিনি সেসব
কথা শুনলে, তবে তো
তাঁকে বলা হবে। যাইহোক,
এইভাবে অনেক চেষ্টার পরে
তিনি তাঁর মূল্যবান বক্তব্য
শেষ করে, ফুলের তোড়া
হাতে নিয়ে প্রথম রোতে
তাঁর জন্য নির্দিষ্ট আসনে
বসলেন। বহু আকাঙ্খিত নাটক
শুরু হলো।
পন্ডিত
স্যারের ভাইপো বাবু, যে
আমার সাথে পড়তো, কৌতুক
অভিনয় ভালোই করতো। এই
নাটকেও সে একটা হাসির
রোলে চুরান্ত অভিনয় করছে।
দু’একবার হাততালিও পেয়েছে।
পুরোদমে নাটক চলছে, এমন
সময় পন্ডিত স্যার মঞ্চে
ওঠার পাশের সিঁড়ি ব্যবহার
না করে, পা উঁচু
করে হাতে ভর দিয়ে
একবারে দর্শকদের সামনে দিয়ে
মঞ্চে উঠে, মঞ্চের মাঝখানে
গিয়ে, বাবুর হাত ধরে
বললেন— “এই বাবু, এদিকে
আয়”। মঞ্চের সমস্ত অভিনেতারা
দাঁড়িয়ে পড়েছে, অভিনয় বন্ধ।
এবার তিনি দর্শকদের উদ্দেশ্যে
বললেন— এই যে বাবু,
আমার ভাইপো, ভাল নাম
বলাই ভট্টাচার্য্য, এর অভিনয় আমার
খুব ভালো লেগেছে। এর
অভিনয়ে খুশি হয়ে একে
একটা মেডেল দেবার কথা
ঘোষণা করছি। আজকের এই
নাটকে সকলেই খুব ভালো
অভিনয় করছে, ইত্যাদি কিছু
কথা বলে, তিনি প্রায়
একই কায়দায় মঞ্চ থেকে
নীচে নেমে এসে নিজের
আসনে বসলেন। নাটক আবার
শুরু হলো।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)