গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

ব্রতী মুখোপাধ্যায়



ঔরস 
 
খানিকটা নিজে নিজে হেঁটে আর বেশিটাই বাপের কাঁধে চেপে চড়াই ছেড়ে নিচে নামছে দুর্বি। মহাকোশলের এ দিকটায় পাহাড়ঘেরা আকাশিয়া গাঁয়ে ফিবছরশীতের শেষে পুরানা মায়ের থানে যে জমজমাট মেলা বসে সেখান থেকেইফিরছে। হাতে একটা কাগজের চড়কি, লালনীলহলুদসবুজ রঙের। পকেটেমোমফালি।
দুর্বি বলল--- বাপু! মেসোকে তো দেখলাম না।  
 
দুর্বিরা
 বেরিয়েছিল ভোরে। মাসির ঘর আকাশিয়ার মাঠের নিচে। সেখানে বাসিভাত ডাল আর সবজি দিয়ে সেঁটে নিয়েছে দুজন। 
দুর্বির
 বাপ বলল--- মেসো বাগি হয়ে গেছে। 
--- বাগি কি, বাপু?
--- বুঝবি না এখন। 
দুর্বি
 দুহাত দিয়ে বাবার গাল চেপে ধরে আদর করে একবার। তারপরই জানতে চায়--- বাঘ দেখেছ, বাপু?  
---
 দেখেছি। 
---
 ভালুক দেখেছ?
---
 দেখেছি, বাপ।
---
 হাতি?

বাপ ছেলেকে বলতে থাকে--- পাহাড়জঙ্গলে সাতপুরুষের বাস, জমিন ছিল,এখন নেই। ভিনগাঁয়ে কাজ না জোটে যখন, জঙ্গলে কাঠপাতা, গাছের মূল,ইঁদুর, সাপ এইসমস্ত আনতে যেতে হয়। পাশ দিয়ে বাঘ হাঁটে নিজের মনে। দলবেঁধে ভালুক গাছে উঠে চাক ভেঙে মধু খায়। দূরে দাঁড়িয়ে হাতি এক একদিনঅবাক হয়ে দেখে।
দুর্বি বলে--- জঙ্গল দিয়ে এলাম। বাঘ দেখলাম না তো? 
---
 সন্ধের বাদে বারণঝিলের ধারে জলের জন্যে আসে। বকাস নি আর, বাপ। আলো থাকতে ঘর যেতে হবে। তোর মার পরশু থাকতে জ্বর।

দুর্বির খিদে পেয়েছে। মোমফালি পকেটে আছে মনে পড়ল। কিন্তু সে তো মারজন্যে। মোমফালি মার খুব প্রিয়।  বাপকে বলল--- পা দুখছে।

যখন ঘরের বেশ কাছেই, গুলমোহর গাছগুলোর লম্বা লম্বা ছায়া অন্ধকারেই মিশেযেতে প্রস্তুত, জনাকয় লোক তাদের সামনে। হঠাৎ একটা শব্দ, আর একটা শব্দ,আরও একটা তারপর। দুর্বির বাপ উপুড় হয়ে মাটির উপর আর সে বাপের কাঁধথেকে ছিটকে মাটিতেই একটুখানি দূরে, বাপের মুখ তার দিকে ফেরানো। সেচেঁচিয়ে কেঁদে উঠল--- বাপু---!!! 
একজন
 বলল--- লড়কা ঠো?
একজন
 বলল--- ডায়না হাত কী আঙ্গুলি ছাঁট দেঁ? 
---
 ছোড় দে ইসে।
তৃতীয়
 জন।

দুর্বির বয়েস তিন বছর সবে। মরতে মরতেও তার বাপ ভাবছিল কেউ হয়ত ছেলেকে একদিন বলে দেবে জলপাইউর্দির  লোকগুলো কারা আর রাইফেল কি।    

বিছে 

বিলাইতির বিছেকে বড় ভয়। বৃষ্টিবাদলার দিনে বিছেদের আনাগোনা বাড়ে। যেজন্যে সে বারান্দা বলে একচিলতে যা আছে সেখানে রাতের বেলা ছেঁড়া মাদুর পেতে দুবলাপাতলা শরীরটা এলিয়ে দিতে পারে না। তাকে একটিমাত্র দরজার বাঁদিক করে একটুখানি জায়গা নিয়ে ঘরেই শুতে হয়। শুয়েই সে, গরম যতই লাগুক, পুরনো ছেঁড়া সুজনি দিয়ে মাথা থেকে পা অব্দি সারা শরীর ঢেকে নেবে ভাবে।   
 

ছোট্ট একটা ঘর। তারই মধ্যে জানালার পাশটায় কালু তার বউকে নিয়ে শোয়। কালু যখন খুদে,
 মানে বুকের দুধ ছাড়ে ছাড়ে যখন, তখন রাতে এক একদিন ঘুম ভাঙলে তার বাপ পাগল যেমন আদর করত, আদর করতে করতে  বলত--- বিলাইতি, আমি তোকে অন্ধকারেও  দিব্যি দেখতে পাই।  
মানুষটাকে, বছর চার হবে, লেবেল ক্রসিং আছে অথচ নেই বলে রেলগাড়ির চাকার তলায় যম তুলে নিল।  
 

বিলাইতির জোছনাপারা রঙ। ঘুম না এলে হঠাৎ সে ভাবে---
 তাকে কি কালুরাও রাত্রে দেখতে পায়?    
 

কালুর সবে বিশ। রঘুবীরের মেয়েটার ছুকছুকুনি বেশি,
  গায়েগতরে বেড়ে উঠল সেদিন। কালু তার চোখের মণি অল্প বয়েস থেকে। বিলাইতি লক্ষ করল, দুইজনে ক্রমশই বেপরোয়া। সুযোগ পেলেই চকাস চকাস চুমু। বিলাইতি দেখে ফেলল কালু শুধু চুমুই খাচ্ছে এমন না, টুকুসোনার বাতাবীবাতাবী মাইদুটোয় যখনতখন হাত দিচ্ছে---  কে আছে কে নেই খেয়াল করছে না।     
 

কি বলতে কী করে ফেলে! টুকুসোনার পেট হয়ে যায় যদি?
 ভয় করে তার। নরেন মুদির কাছে কিছু ধার নিয়ে,  সঙ্গেসঙ্গেই প্রায়, ছেলের জন্যে সে কানেখাটো গোপাইল্যার রাস্তার কিনারায় ফেলে রাখা পানগুমটিটা জলের দরে কেনে। তারপরই টুকুসোনার মা জামাইএর হাতে ওই অকালধাড়ী মেয়ে ছাড়া আর কিছুটি না ঠেকালেও বিলাইতি দেরি না করে ছেলের বিয়ে দেয়।   

কালু চায় দেরি না করে রাত্তির নেমে আসুক। সে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে মুখে কিছু পুরে বউকে জড়িয়ে শুয়ে পড়তে চায়। কথা বলে না কেউ। তবে শব্দ ভেসে আসে। টুকুসোনা এমন সব শব্দ করে,
 মাদুরের ভেতর থেকে অন্ধকাররঙের বিছে বিষাক্ত দাঁড়া উঁচিয়ে বিলাইতির দিকে তেড়ে আসতে চায়। তার চোখের পাতা ভিজতে থাকে নিশব্দে।   
বিলাইতির এখনও মাসে একবার ছেঁড়া কাপড় লাগে।