গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

সিদ্ধার্থ দত্ত



জগা
      
  "দশানন রাবণ আসি বসেন সিংহাসনে
         তাহার পর হাতছানি দিয়া ডাকেন দুর্যোধনে"
এই পর্যন্ত বলতেই রিহার্সাল রুমে হাসির বান ডাকলো!
- এঃ আবার খিচুড়ি পাকিয়েছে রে!
- অ্যাই জগা আবার রামায়ণ মহাভারত গুলিয়ে ফেললি! এই নিয়ে কবার হল!? নাঃ তোকে দিয়ে হবেনা!
 
অভয়ের গলা শুনে জগা ঘাবড়ে যায়! এ পালার ওইই পরিচালক।বাদ দিলে জগা আর চান্সই পাবেনা!
 
- প্লিজ অভয়দা আরেকবার

- মনে রাখিস,এটাই লাস্ট চান্স কিন্তু! নে বল,
 
             "দশানন রাবণ আসি বসেন সিংহাসনে
               তাহার পর হাতছানি দিয়া ডাকেন বিভীষণে
                অগ্রজের আহ্বানে অনুজের মুখ হাঁড়ি
           লঙ্কেশ্বর ভাবেন মনে ব্যাটায় দিব ঝাঁটার বাড়ি"
- বলি এগুলো কি হচ্ছে জগা?
  ঠিক করে বলবি তো বল,নইলে বঙ্কুকে ছেড়ে দে! আমি আর মেনে নেবনা! তখন থেকে আজেবাজে ডায়লগ বলে যাচ্ছে! হ্যাঁরে,তুই কি  পালাকার হয়ে গেছিস নাকি?!বানিয়ে বানিয়ে মিলাচ্ছিস! কেন রে!
ঘাড় নিচু করে বসে থাকে জগা! অভয়ের ধমক,বাদ পড়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও নিরুত্তর থাকে!
রিহার্সালের শেষে
  বাইরে এসে অভয় বলে,' সত্যি বলতো জগা, কি হয়েছে তোর'! আরে,কাঁদছিস কেন!
- কাল মদ খেয়ে বাবা আবার মাকে মেরেছে! আমার বাবাকেই মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছিল!
কথা শুনে অভয় অবাক হয়!
 
- তা এর সঙ্গে পালার সম্পর্ক কি?!
- বাবা পালা দেখতে খুব পছন্দ করে! সামনের সারিতে এসে বসবেই!আমি আছি বলে আরো আসবে!
- তাতে কি!
- আমি তাই বাবাকে খিস্তি করে মা'র অপমানের শোধ তুলতে ওইসব তৈরি করেছি!
অভয় স্তম্ভিত হয়ে যায়! জগার মাথার চুলে বিলি কেটে বলে,'তোর বয়সে আমরা কেন এমনভাবে ভাবতে পারিনি রে জগা!!

ফেরৎ

নিস্তব্ধে বসেছিলেন রাধানাথ। চারদিকে বই।বাতাস ভারী হয়ে আছে বইগন্ধে। লেখার টেবিলের উপর ডাঁই করা কাগজ আর পত্রপত্রিকার রেলিংয়ের ঘেরাটোপে একটা মুখ ছেঁড়া খাম।রাধানাথ বসে আছেন একা!গদাই চা দিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। তবু রাধানাথ নিশ্চল বসে আছেন। বিস্তর কাটাছেঁড়া করেছেন,ফর্ম্যাট পালটেছেন।কিছুতেই কিছু হয়নি।ফল ওই এক,ফেরৎ আসা খাম। সুনন্দাও পিছনে হাসাহাসি করেন। 
- ওসব ছাই-পাঁশ লিখে কি লাভ! শুধু সময় নষ্ট! চেনাশোনা না থাকলে কেউ লেখা ছাপেনা আজকাল।ডাকে পাঠিয়ে কী আর লেখক হওয়া যায়!
স্ত্রীর এই কথাটা বুকের। ভেতর বাজে। ঠিকই বলেছে সু।কিন্তু তিনি যে
  ঘরানার মানুষ তাকে অতিক্রম করা কী অতই সহজ!লেখারা তাঁর মননে প্রকাশের অপেক্ষা করে।অসহায় রাধানাথ স্থানু হয়ে থাকেন!
- কি গো সকাল গড়িয়ে গেল যে! জলখাবার দিয়েছি সেও তো বেশ খানিক আগে! চা-টাও খাওনি!
সুনন্দা ঘরে ঢোকেন।টেবিলের উপর মুখছেঁড়া খামটার দিকে চোখ পড়ে তাঁর!
- ও এই ব্যাপার ! আবার ফেরৎ এসেছে!
নির্বাক রাধানাথ কোনোক্রমে মাথা নাড়েন।বিষয়টা লুকাতে চেয়েছিলেন।ধরা পড়ে গিয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকেন।
- খুব হয়েছে,এখন ওঠো।খাবার ঠান্ডা হচ্ছে। খেয়েদেয়ে মাথা ঠান্ডা করে ভেবো এখন!
বাধ্য ছেলের মতন উঠে পড়েন। বাইরে বেরিয়ে দেখেন,সত্যিই বেশ বেলা হয়েছে।
  
খাবার টেবিলে বসতেই বিদিশা ছুটে এল।
-দাদু আমাকে তোমার থেকে একটু ডিমভাজা দেবে ?
এই একজনের কাছে রাধানাথ নিঃশক্ত বোধ করেন।সব আবদার মেনে নেন এককালের দোর্দন্ডপ্রতাপ ম্যাজিস্ট্রেট!
- আয় মা। এই তো তোর জন্যেই আলাদা করে রেখেছি !
- তুমি আমার মিত্তি দাদু ! খাওয়া হলে আমাকে গল্প বলবে তো !
মাথা নাড়েন রাধানাথ। বুকের ভেতর আবার রক্তপাত শুরু হয়।
দুপুরবেলা বিদিশার দাদুর কাছে না শুলে ঘুমই হয়না। রাগিনী কতো বারণ করেছে।তবু মেয়েটা নাছোড়।দাদুর কাছে গল্প শোনার নেশা যে!
- তারপর ? ও দাদু তারপর ? সেই মেয়েটা কোথায় গেল?
একটু ভেবে নিয়ে বলতে থাকেন,
- গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা । চারদিকে গাছে ঘেরা অথচ একটাও পাখি ডাকছে না
..
গালে হাত রেখে বিদিশা দাদুর গল্প শোনে। মনে মনে হারিয়ে যায় সেই বনের ভেতর !
গল্প বলতে বলতেই ভেতরে তীব্র ঝাঁকুনি খান রাধানাথ! এইতো এইতো তাঁর প্রকাশনা ! এখান থেকে একটাও ফেরৎ আসবে না! প্রজন্মের কাছে এইই তো রেখে যাচ্ছেন তিনি !
 
পরম শান্তিতে ছোট্ট বিদিশাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলতে থাকেন,
- সেই ফাঁকা জায়গাটা একদম খালি ছিলনা কিন্তু মিত্তিদাদু !