
ছায়া
হঠাৎ
ছায়া টা নড়ে চড়ে উঠলো..! কেঁপে উঠলো বাঁশঝাড়।
শ্যামল
বাবু তখনও বসে ছিলেন তার কুঁড়েঘরের সামনে । কিছুখন আগেই তিনি মহাজনের বাড়ি থেকে
ফিরেছেন ।
দু'কাঠার এই
ভিটে টা শ্যামল বাবুর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া । পেশায় স্কুল মাস্টার শ্যামল বাবুর
এই দু'কাঠাই সম্বল। সেটাই আজ বন্ধক রাখতে গেছিলেন মহাজনের কাছে। ধূর্ত মহাজন দলিল রেখে
মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিতে চাইলো ।
তাতে
কি আর হয়....!! মা মরা একমাত্র মেয়েটার বিয়েতে কম করে হলেও কুড়ি হাজার টাকা লাগবে।
টাকার যোগাড় না হলে বিয়েটাই যে ভেস্তে যাবে..!! তাছাড়া এমন সুপাত্র কি সবসময় পাওয়া
যায়.! মেয়েটার জন্য বড় মায়া হয় তার। দরিদ্র স্কুল মাস্টার শ্যামল বাবুর বুকের
ভেতরটায় কেমন হাহাকার করে ওঠে।
আবার
নড়ে ওঠে বাঁশঝাড়ের ঐদিকটা..!! বেরিয়ে আসে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি। শ্যামল বাবু
আকস্মিক উঠে পরে বসা থেকে। বিদ্যুৎ গতিতে ঘর থেকে হারিকেন নিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়ায় । হারিকেনের আবছা আলোয় মুখ
লুকানোর আগেই ছায়ামূর্তি টাকে এক ঝলক দেখে নেয় শ্যামল বাবু ।
ছায়ামূর্তি
টাও আর দেরি করে না মোটেই । অন্ধকারে কোন একটা বস্তু ছুড়ে মারে শ্যামল বাবুর দিকে। তার পাঁয়ের
কাছে এসে পরে ওটা । এরপর ছায়া টা নিমিশেই মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।
শ্যামল
বাবু কৌতুহলে কুড়িয়ে নেয় বস্তুটা। একটা কাপড়ে মোড়ানো কুড়ি হাজার টাকা....!!!
দু'ফোটা নোনা জল শ্যামল বাবুর দুগন্ড বেঁয়ে গড়িয়ে পরে। অস্ফুটভাবে তার মুখ থেকে
উচ্চারিত হয়,'মহাজনদের ঘরেও তবে মানুষ জন্মায়..!!'
চোর
চারদিক
স্তব্ধ । সুনসান নিরবতা। সবাই উন্মুখ হয়ে আছে বিচারের
রায় শোনার জন্য । বিচার হচ্ছে চুরির ।
আরাম
কেদারায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে বিচারক সালামত মেম্বার । ঠিক তার পায়ের কাছেই মাটিতে বসে আছে
মন্টু চোরা।
গত রাতেই সে
ধরা পরেছে।
উত্তর পাড়ার
মকবুল মহাজনের ঘর থেকে পুরো এক বস্তা চাল সে নিয়ে যাচ্ছিলো । পালাবার সময় মাথা ঘুরে
পরে গিয়েছে বলেই তাকে ধরা গেছে। একেবারে বস্তার নিচে চাপা পরে ছিলো। আর তখনি লোকজন
দেখতে পেয়ে ধরলো তাকে। তারপর একচোট বেদম উত্তম মাধ্যম তো হলোই । মকবুল মহাজনের ভাষায়,
" শালা একটা নিমক হারামের বাচ্চা। আমার জমি বরগা চষে খায়, আর আমার ঘরেই চুরি
করে। প্রতি বছর মোট ফসলের পাঁচের এক অংশ দেই বলেই তো খেয়ে পরে বেঁচে আছে। তবুও বলে
কিনা তাকে তিনের এক দিতে হবে...!! এমনকি এও বলে যে, সে চাষ করে বলে তার অর্ধেক ফসল
প্রাপ্য..!! শালা কত বড় নিমক হারাম। আমি জমি না দিলে তো না খেতে পেয়ে মরতি তবুও শোকর
নাই ফকিন্নির বাচ্চাদের এই এক সমস্যা । এদের মন ভরে না, শুধু আরো চাই,আরো চাই "
মন্টু
চোরার কঠিন শাস্তি দাবি করে তাকে মেম্বারের হাতে তুলে দিয়েছে মহাজনের লোকজন। মন্টু
কে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে কি পরিমান মারের ধকল তার উপর দিয়ে গেছে। একেবারে বিপর্যস্ত
অবস্থা মন্টু একবার ভাবে সবাইকে খুলে বলে যে, সে এবং তার পরিবার গত কয়েকদিন ধরেই উপোস
কাল বিকেলে তার ছোট মেয়েটা প্রচন্ড ক্ষুধা সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায় । তবু সে একমুঠো চাল যোগাড়
করতে পারেনি
। এমনকি কেউ
ধার পর্যন্ত দিতে চায়নি তাকে। পুরো বছর কষ্ট করে সে মহাজনের জমি চষে।বছর শেষে সব ফসল
মহাজনের গোলায় ওঠে।তাকে যেটুকু দেয়া হয়,তা তিন মাসেই শেষ। এরপরের দিনগুলো তার এবং
তার পরিবারের জন্য হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।তাই সে বাধ্য হয়েই চুরি করতে গিয়েছিলো মহাজনে
বাড়িতে ।
করেও ছিল সে । কাকপক্ষীও টের পায়নি । কিন্তু কয়েকদিনের উপোসি
দেহে সে ঐ বস্তার ভার বইতে পারেনি। আচমকা মাথা ঘুরে পরে গেছে।এরপরের ঘটনা তো সবাই জানেই ।
তবে
মন্টু পরক্ষনেই ভাবলো এদের কে বলে লাভ নাই।এরা কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। কারণ এরা
সবাই উদর পূর্তি করে এসেছে।তাই সালামত মেম্বারের পায়ের কাছে বসা মন্টু মিয়াও সকলের
মত স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করছে রায় শোনার জন্য । সে মনেমনে প্রত্যাশা করছে তাকে যেন
মৃত্যুদণ্ডই দেয়া হয়..!