গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

সাঈদা মিমি




প্রলাপ

এটা কি এমন কোন দ্বীপ? যার চারপাশে জল আর স্বজনদের কাছে পৌঁছুনোর জন্য কোনো বাহন নেই? একটা টলোমলো করে উল্টে যেতে পারে, এমন ডিঙ্গি নৌকা, তাও! স্বপ্নটা আছে, রবিনসন ক্রুশোও একদিন ফিরেছিলো । এখানে সাগরের জল ঘোলা, আদিম গুহাগুলিতে বন্য প্রাণীদের হাঁড়গোড় পড়ে আছে । হয়তো অনেককাল আগে খাদ্য না পেয়ে, নিজেদেরকেই হত্যা করতে শুরু করেছিলো ওরা! কি সাংঘাতিক উত্তাপ! জঙ্গলঘেরা খাঁড়িতে নেমে বসে থাকারও উপায় নেই, হাঙরেরা ঘুরছে । কিছু খুচরো মাছ ভাটির বেলাভূমিতে আটকে পড়ে, অচেনা সব ফলমূল, একখণ্ড বন আর পাথুরে জমিন ।
অবস্থা দেখে মনে হয়, এটা নিরক্ষরেখার নীচের কোনো দ্বীপ হবে । সূর্য শেষপ্রান্তে যাবার পর অনেকক্ষণ ঝুলে থাকে । মিষ্টি পানির একটা ঝর্ণা আছে বলে রক্ষা, সেখানে জোঁকের আড্ডা । কোন প্রাণী নেই; না পশু কিংবা পাখি । এখানকার সমুদ্রপাড়ে গাঙচিল ওড়ে না, দিগন্ত কোন জাহাজের ধোঁয়া দেখা যায় না । হা ঈশ্বর, এটা পরিত্যাক্ত দ্বীপ! আশা নেই, কোনো আশাই নেই? এই জমিতে ফসল হবে না, এখনও পর্যন্ত বৃষ্টি দেখিনি । আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? ফসল বোনার বীজ কি আছে আমার কাছে? একটা গমের দানাও নয় ।

প্রথমে দিনের হিসেব রাখতাম । কয়েকটা মাসেরও রেখেছিলাম । এখন আর কোনো হিসেব রাখিনা । প্রথমে লজ্জা নিবারণের মত বস্ত্র ছিলো । এখন কিছু ছেঁড়া ত্যানা আছে । হাতের দিকে তাকালে বলিরেখা স্পষ্ট চোখে পড়ে । নিজের সম্পর্কে কোন ধারণা নেই, অতীত প্রায় মুছে গেছে, বর্তমান শব্দটা অপরিচিত লাগে । এই দ্বীপে কোন অজ্ঞাত নাবিকের সমাধি নেই, কেউ এসে পাথরের গায়ে বাণী উৎকীর্ণ করেনি । আমারও সমাধি হবে না । আমি মুছে যাবো । আমার লিখিত প্রলাপ রোদ ও বাতাসে চাপা পড়ে ফসিল হয়ে যাবে । তারাদের দেখা যায়, এত কাছে? যেনো আকাশ নেমে এসেছে সিলিংয়ের দূরত্বে । অনায়াসে আমি প্রক্সিমা সেন্টরাই পাড়ি দিয়ে আরেক গ্রহাণুপুঞ্জে চলে যেতে পারি । যাবো? রাত্রি আমার হাত ধরে রেখেছে । তার বুকে অনেক গল্প কিন্তু সে কথা বলতে পারে না ।

নগরবাড়ি ফেরীঘাট

আরও দুটো দিন থাকার ইচ্ছে ছিলো, বগুড়া শহরের এই জায়গাটা নামটা একটু অদ্ভুত, 'ঠনঠনিয়ার নাজিরবাড়ি'। সবাই মিলে ছাদে বসলেই সামনে এডওয়ার্ড পার্ক; অপূর্ব । কালও ওখানে ঘুরেছি, আজ বাসে, ঢাকায় ফিরছি । ঝর্ণার বিয়েকে কেন্দ্র করে দারুণ এক জমায়েত হয়েছিলো। আমরা সেজেছিলাম, নেচেছিলাম, গেয়েছিলাম এবং রঙখেলায় মেতেছিলাম । অস্বীকার করবো না, গরমটা একটু বেশি, বাবা আর থাকতে চাইলেন না । 
বাস ছুটছে, এখানে স্টপেজে দাঁড়ানোর তাড়া নেই, নির্বাচিত গান বাজছে সহনীয় সুরে, এসি বাস । বাবা আয়েশ করে ঘুম দিয়েছেন । বাসে? কিভাবে পারেন? আমি গাঢ় সবুজ প্রকৃতি দেখছি । কাল রাতে খাবার পর যখন ছাদে যাচ্ছিলাম, তখন খালাত বোনের দেবর পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলো । -কি? কিছু বলবেন? অনেকক্ষণ আমতাভাবের পর সে কিছুই বলতে পারেনি। একটু ঝাঁকুনি, ফেরীঘাট আইচ্চে... নামেন... নামেন । তবে কি আমিও তন্দ্রাঘোরে হারিয়েছিলাম?
ফেরীঘাটে এলে যাত্রীরা নেমে যায়, তারপর বাস ফেরীতে ওঠে । কয়েকবার নৃশংস কিছু দূর্ঘটনা ঘটেছিলো, যাত্রীসহ বাস পড়ে গিয়েছিলো নদীতে । প্রায় তিরিশটা বাস, কয়েকটা প্রাইভেট কার, আর ট্রাক লোড হতে ঘন্টাখানেক । উজানপাড়ি, তাই, আরিচা পৌঁছুতে পাঁচঘন্টা । তখন তো সেতুনির্মাণ হয়নি, পদ্মা আর যমুনার সঙ্গম মোহনায় জল ঘোলা ঢেউ কেটে পরস্পরে সমর্পিত হয় ।
ফেরীঘাট মানেই এক আশ্চর্য রঙের বাজার! রাস্তার দুইপাশে রেস্টুরেন্ট, সেরকমই তো লেখা! গুলগুল্লা হোটেল এণ্ড রেস্টুরেন্ট, মায়ের দোয়া, পারাপার, একটু জিরান, বারবার আসি, রহমতের বরকত... এত মনে রাখা যায়? 
এরকম কোথাও বসে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছি । তীব্র ঝাঁঝালো, মশলাদার কিন্তু স্বাদু । -বাবা, এতো ভাতের দোকান! ওরা রেস্টুরেন্ট লিখেছে কেনো!! -তোর মতন ভাতমগজ নিয়ে হোটেল চলবে? মগজে ঘুটা দে, রেস্টুরেন্টের মর্মার্থ বুঝে যাবি । আমার বাবা মানুষটা বড্ড ভালো, রসিকতা পছন্দ করেন । একদিনের কথা বলি, পাঁচদিন জ্বর হয়ে ঘরে পড়েছিলেন বাবা, সেই পঞ্চমদিবস পার হয়ে যাওয়ার পর দেখি, বাবা মা কে জড়িয়ে ধরে গাইছেন, 'ও হাসিনা, মন আমার বাইরম বাইরম করে;। মা প্রবল মোচড়ামুচড়ি করছেন, 'মিনসে পাঠা, ঘরে বড় বড় ছেলেমেয়ে' তবু বুইড়ার রস কমে না ।' বাবা কয়েকমিনিট ব্যবধানে অনেককিছু খাওয়ালেন। মুড়িবানানো, ডিমসেদ্ধ, পরোটা-মাংস, ভাত-মাছ... রাক্ষুসির মত সবই খেলাম। -কেমনে পারছি বাবা! -পদ্মার বাতাসে খিদে পায়। -এটা পদ্মা? -না, যমুনা । বাবা উদাস হলেন, আমার কেনো জানি মনে হলো, বাবা দেশভাগের আগের সময়ে চলে গেছেন, তার কৈশোরে, আলিপুরদুয়ারের বাড়ির উঠানে । 
ফেরি ছেড়েছে, অপ্রয়োজনীয় মানুষেরা নেমে গেছে । বাসের সিটে বসে আছি। বাবা বলেছেন, আর ঘন্টাদেড়েকের মধ্যে আবার খিদে পাবে, তখন ফেরির ডাইনিং থেকে খাইয়ে আনবেন । এমন সময় স্বর্গীয় সুর, "তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছি/ মনে আপন মেনেছি/ তুমি বন্ধু আমার মন জানো না...." কে? এক পথবাউল; গান শুনিয়ে যার উপার্জন । একতারায় সুর মাতাল হচ্ছে, "তুমি জানো নারে প্রিয়, তুমি মোর জীবনের সাধনা..........." কেমন করছে, আমার মন খুব কেমন করছে। কোনো এক অচেনা প্রিয়র মুখ প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যস্নাত যমুনায়।