গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

গৌতম সেন



মেট্রোপথে

গোবিন্দবাবু ফিরছেন দক্ষিণেশ্বর থেকে। যাত্রা একাধারে সংক্ষেপিত ও আরামদায়ক করতে শ্যামবাজার  থেকে মেট্রো  ধরেছেন। বরিষ্ট নাগরিকের আসনে বসে, সন্ধ্যারতির সুর সুখরোমন্থন করতে করতে চলেছেন। ভিড় হালকা হতে তাঁর নজরে আসে সামনের সিটে এক ভীষণ চেনা মুখ। স্মৃতি-অভিধান ঘাঁটা শুরু হয়ে গেল তাঁর। অথচ যাকে নিয়ে  তাঁর এই অনুসন্ধান  সে যদি একবার তাঁর দিকে একটু দৃষ্টিপাত করতেন। ভদ্রলোক সিটের একপাশে আরামে হেলান দিয়ে  ঢুলছেন।
একসময় সেই ঘুমন্ত মানুষটির পাশে সিট খালি হল। আক্ষরিক অর্থে একলাফে তিনি ওই ব্যক্তির পাশে গিয়ে বসলেন। শুধু তাই নয়, বসার সময় একটা মৃদু ধাক্কা প্রয়োগ করলেন। তাঁর এই কৌশলে কাজ হল। ভদ্রলোকের ঘুম ছুটে গেল। গোবিন্দবাবুর চোখে চোখ পড়তেই তিনি চমকে উঠলেন – “আরে গোবিন্দ না! কত যুগ পরে দেখা।” গোবিন্দবাবুর মুখ যেন তখন এক তৃপ্তির ক্যানভাস। এতক্ষণে জট খুললো। তিনি কোন ঢাকগুড় না করে বললেন -“হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ। কিন্তু ভায়া নামটা তোমার কিছুতেই মনে আসছে না। তোমাকে দেখা ইস্তক হাতরে চলেছি তোমার নাম।”
- “সে তো তোর ‘তুমি’ সম্বোধনেই পরিস্কার। আমি দেবাশিস রে, তোদের দেবু।”
- “ও বাঁচালি রে! তখন থেকে শুধু ঢুলছিস! একবার আমার দিকে চাইলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত।”
- “আমি তো নামব সেই শেষ। তুই নামবি কোথায়?”
“আমি নাকতলায় থাকি, নামব গীতাঞ্জলী।” – গোবিন্দবাবু নিজের আস্তানার খবর দিলেন, “তোর ফোন নাম্বার টা দে। গিয়েছিলি কোথায়?”

ফোন নাম্বার বিনিময় হ’ল দুজনের। চাকরী থেকে অবসরের পর কয়েকবছর যা যোগাযোগ ছিল, তারপর থেকে দুই বন্ধুর মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বললেই চলে। সেই বন্ধুত্বের আজ আবার পুনর্নবীকরণ হল। তাঁর বন্ধু নন্দন থেকে বাংলা সিনেমা দেখে ফিরছে শুনে বললেন – “এখনও আগের মতই সংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়ে চলেছিস। একটু ধম্মে-কম্মে মন দিলেও তো পারিস?” আমি তো দক্ষিণেশ্বর, বেলুড় নিয়মিত যাই।” বন্ধু দেবাশিষ উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন। বলেন –“দেবদেবীর আশীর্বাদ তো আমায় ঘিরে রয়েছে সেই অন্যপ্রাশনের দিন থেকেই, আর তোরা তো আছিস রে – তোদের পূণ্যে আমার পূণ্য, নইলে বহর বাড়ে!” বন্ধুর এই কথার জবাব আর গোবিন্দবাবুর দেওয়া হয় না। মেট্রোর ভিতরে ঘোষণা শোনা যায় – ‘স্টেশন্‌ গীতাঞ্জলী’।

সব ভাল যার শেষ ভাল

কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। ঘড়ির গায়ে আটটা বাজে তখন। সাত্যকি ঠিক করল আজ অফিস কামাই করবে।  সময়কে সুযোগ দেবে দুলকি চালে চলার। মাসখানেক হল মেদিনীপুরের দাঁতন গ্রামে সে এসেছে বদলী হয়ে। কোচবিহারে তার বাবা, মা, আর একভাই থাকে। বিয়ে থা করার সময় হয়নি এখনো।
বাড়ির দরজায় একটা ভ্যান রিক্‌সা এসে থামল। “এটা কি সাত্যকি মল্লিকের বাড়ি?” এক মহিলা এসে জিজ্ঞাসা করলেন। “একেবারে সঠিক!” – সাত্যকি জানায়। ভদ্রমহিলার স্বাভাবিক ছন্দ ঈষৎ বিঘ্নিত হলেও, ধাতস্থ হয়ে বললেন –“একটু দেখা হ’তে পারে ওনার সঙ্গে?”
“আপনার সামনে যিনি দাড়িয়ে, তিনিই সাত্যকি মল্লিক।”  -কৌতুকমিশ্রিত সুরে জানায় সাত্যকি, “আগে ভিতরে এসে বসুন, তারপর যা বলার বলবেন।” ধন্যবাদ জানিয়ে ভদ্রমহিলা ঘরের ভিতর এসে বসলেন।
- “আমার নাম শ্রাবন্তী মিশ্র। এখানকার মহিলা সমবায়ের নাম শুনেছেন নিশ্চই? আমি সেই সংগঠনের সম্পাদিকা।“
- “বেশ! বলুন আমার সঙ্গে কি প্রয়োজন।”
- “এখানকার ব্যাঙ্কে কার্যাধ্যক্ষের দায়িত্বে আপনার আগে যিনি ছিলেন, তাঁর কাছে  মহিলা-পরিচালিত এক কয়ার প্রকল্পের জন্য সরকারী ঋণ বা অনুদান পেতে কাগজ-পত্র জমা দিয়েছিলাম। খারিজ হয়ে গিয়েছিল কোন এক বিশেষ কারণে।”
- “তা কারণটা আপনি জানলেন কি করে? আর জানেনই যদি, দয়া করে বলুন একটু শুনি।“
-“কারণ আর কি? আপনাদের ব্যাঙ্কের আগের ম্যানেজার মহা কোরাপ্ট লোক ছিলেন। আমাদেরটা হয়ে যেত, যদি আমরা ওনার কথা মত পারসেন্টেজ অব স্যানশান্‌ড অ্যামাউন্ট ওনাকে দিতাম।“
এবার হো হো করে হেসে ওঠে সাত্যকি। সামলে নিয়ে বলে – “ক্ষমা করবেন।”
-“হাসলেন কেন? সহকর্মীর এই দূর্নাম মানতে রাজি নন?”
“না, তা নয়। আপনি প্রচন্ড রেগে গেছেন।”
-“কিভাবে বুঝলেন?”
-“কেন জানেন না, বাঙালী রেগে গেলে হিন্দি বা ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করে?”  শ্রাবন্তীদেবীর মুখে এক নিরুত্তাপ হাসি ফুটে ওঠে।

সব ভাল যার শেষ ভাল। মহিলা সমবায়ের প্রকল্পটি লোন পেল। শ্রাবন্তীদেবীরা সবাই খুশি। খুশি সাত্যকিও।  শ্রাবন্তীদেবী ও তাঁর সংগঠনের কিছু কর্মী কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছিলেন সাত্যকিকে। শ্রাবন্তী মিশ্রকে সেদিন সাত্যকি বলেছিল –“একটাই বিরাট ভরসার কথা, আমার পরে যিনি আসবেন তাঁকে আর বোধহয় কোনও কোরাপ্ট ম্যানেজারের গল্প শুনতে হবে না!” এরপর শ্রাবন্তী মিশ্রের প্রাণখোলা হাসি সাত্যকিকে অবাক করে দিয়েছিল। সে আর এক অন্য গল্প।