গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১১ মে, ২০১৬

সীমা ব্যানার্জী রায়



ফচকামির কীর্তিকান্ড

সোমবার সন্ধ্যেবেলা নিজের বিলাসবহুল চেম্বারে রায় সাহেব বসে ছিলেন। তাঁর প্রচুর ইচ্ছে করছিল সামনে বসা ত্যাঁদড় ছেলেটিকে একটা কষিয়ে চড় কষানোর। যতবারই ইচ্ছা করছিল ততবারই জল খাচ্ছিলেন। সামনের চেয়ারে বসা রজত নামের ছেলেটি অফিসের মোস্ট এফিসিয়েন্ট ছেলে। সব ভেবেচিন্তেই নিজের বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন। ছেলেটা দুদিন মেয়েটাকে নিয়ে ঘুরলোও। এখন বলছে ওর নাকি ছোটবেলা থেকে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। যদি তাই হবে হতভাগা তবে মেয়েটাকে নিয়ে ঘোরার কি দরকার ছিল?
তিনি একটু গলা নামিয়ে বললেন “ কোথায় তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল?”
পাটে পাট চুল আঁচড়ানো রজত মাথা নিচু করে বসেছিল। ঐ অবস্থাতেই বলল: "আমেরিকায়।”
তিনি এবার একটু গলা ঝাঁকাড়ি দিয়ে চোখের ভ্রু ট্যারছা করে বললেনঃ “ তা হলে মেয়েটির কথা বলার সময় কই টুঁ শব্দ ও করলে না যে। এক কথায় সুড় সুড় করে মেয়েটিকে নিয়ে ঘুরলে কদিন।”
রজত এবার মুখ তুলে অতি বিনয়ের সাথে বললঃ “ভেবেছিলাম, মেয়েটি এন আর আই হবার দরুন হয়ত দেশের এই আমাকে পছন্দ করবে না। ওখানকার ছেলেরা হয় মাচো তারপর রংটাও হয় অনেক ধোপদুরস্ত। হয়ত আমাকে খেলিয়ে রেখেছে। কিন্তু টোপ ফেলে রেখেছে অন্য বড়শি-তে। তাই -ই একটা রিস্ক নিয়েছিলাম আর দেখলাম আপনার বন্ধুর মেয়ে কিন্তু এরকম আরো কিছু ছেলেকে মাথা ঘুরিয়েছে এবং তাদের থেকে মোটা কিছু আদায় -ও করেছে। আমাকে-ও সে আজ এই শপিং মল কাল সেই শপিং মল-এ নিয়ে যাচ্ছিল। পকেটের মানির অবস্থা বেশ কাহিল হয়ে পড়ছিল।
কি দিয়ে যে তাকে চিনব বুঝতে পারছিলাম না। মেয়েটিকে দেখে মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একেবারে প্রথমদিন তো ভালোই লেগেছিল তাই আমেরিকার সেই মেয়েটিকে নাকচ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে একেই বিয়ে করব ঠিক করেছিলাম। তাই নিয়ে বেশ কদিন ঘুরলাম। কিন্তু সে বিয়ের কথা বল্লেই কেঁদে ভাসাচ্ছে। অযথা প্যান প্যান করলে কে কি ভাববে, তাই আবার কিছু উপহার দিয়ে তাকে শান্ত করতে হচ্ছিল। কান্নার কারণ জিগে্স করলে সে বলছে , “ছোটবেলা থেকে বিয়ে সম্বন্ধে তার অন্য ধারণা। আগে সে ঘুরে নেবে দরকার হলে লিভ টুগেদার থাকবে তার পরে চিন্তা করবে সে বিয়ে করবে কিনা।”
রায় সাহেব বিরক্ত হয়ে জিগেস করলেন, “একতরফা তার দোষ-ই দেখিয়ে চলেছ, দেখছি।
তা তোমার দেশ ছেড়ে হঠাত আমেরিকায় কেন বিয়ে ঠিক হয়েছে ছোটবেলা থেকে?”
রজত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর মুখ উঠিয়ে বললঃ “ আপনি যেমন আপনার বন্ধুর মেয়ের জন্য আমাকে সিলেক্ট করলেন তেমনি আমার বাবার বন্ধুও তার দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের সাথে আমার বিয়ের ঠিক করে রেখেছেন। আমার বয়স তখন ৫ বছর। আর সে ৩ বছরের।”
আবার ঢকাস করে একটা ঢেকুড় তুলে বললেন, “ সেই মেয়ে বড় হবার পরে আর দেখা হয়েছিল নাকি? না একেবারে দেখা হবে ছাদনাতলায়? তার আগে একটু অন্য মেয়েদের বাজিয়ে দেখছো, তাই না?”
দেশে আসলে দেখা হয়েছিল বেশ কয়েকবার। স্কাইপ-এ তো রোজ-ই একবার করে দেখা হয়। আমরা ঘোরাঘুরি-ও করেছি তবে দেখলাম দেশের মেয়েরা অনেক আ্যডভান্স এন আর আই মেয়েদের চেয়ে। সবাই আজকাল আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া যেতে চাইছে।”
চোখ পাকিয়ে রায় সাহেব আবার বল্লেন “ অ্যাডভান্স কি সেন্সে?”
রজত -এর মুখ লাল হয়ে উঠল...কি বলবে ভেবে পেল না...সঠিক উত্তরটা সেন্সর কাট হলে তার ভালমানুষি ইগোইজম এ বাধার সৃষ্টি হবে। মেয়েদের সম্বন্ধে সে এই ন্যুড কথা বলতে পারবে না। একেবারেই না।”
“কি হল? চুপ করে রইলে যে? উত্তর খুঁজে পাচ্ছো না তাই না?
বেশ! তাহলে উত্তরটা পেলে জানিও। ভালমানুষি সেজে কেন যে আমাদের মত মানুষকে ধাঁধায় ফেল কে জানে?”
রায় সাহেব দেখলেন- ত্যাঁদড় ছেলেটা মুখ টিপে খালি হেসে যাচ্ছে। আর নিজের ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে হাত বুলিয়ে আড়চোখে রায়সাহেব আর রজত -এর কথাগুলো গলাদ্ধকরণ করতে চাইছে। ঠোঁট টিপে মুখে শিস দিয়ে মনে হয় কি একটা লারে লাপ্পা গানও গাইছে।
আবার জল খেয়ে একবার আড়চোখে দেখে নিলেন সেই লারেলাপ্পা এক কানে দুল পরা ছেলেটাকে। কি উদ্ভট সব আদবকায়দা। ইচ্ছে করে... থাক, ইচ্ছেটাকে বেশি উস্কানো ভাল না, যুগ বদলেছে। এরা এরকম হলেও অনেক সময় দেখা গেছে এরাই ভাল হয়।
তিনি চিন্তা করে দেখলেন একবার এই ত্যাঁদোড় ছেলেটাকে কোপ মারলে কেমন হয় দেখা যেতে পারে...অনেক সময় হিতে বিপরীত দেখা গেছে।
কাজেই রজত কে ছেড়ে সেই ছেলেটাকে ডেকে বললেন বন্ধুর মেয়ের কথা
একগাল হেসে সে উত্তর দিল...এ সব মেয়েকে নিয়ে ঘাস কাটা যায় সার...ঘর করা যায় না। আমার ওকে নিয়ে ঘাস কাটা হয়ে গেছে। আপানারা অনেক সিনিয়র কাজেই এখনকার মেয়েদের ইকোয়েশন -এর ফর্মূলা আপনার অজানা। আপনি বিয়ে ঠিক করবেন তারপর সে বিয়ে করবে সেই ছেলেকে। সেগুড়ে বালি স্যার। এরকম কত ছেলে নিয়ে তাদের কারবার আপনি জানেন না। আজ এ ছেলেকে ধরছে, তারপর তার চেয়ে ভাল স্ট্যাটাস ছেলে পেলে আবার একে ছেড়ে তাকে ধরছে। এরা হচ্ছে আজকাল স্বাধীন জেনানা। ওর হয়ত ফেসবুক হাসব্যান্ডও আছে।
“ফেসবুক হাজব্যান্ড?”-
“হ্যাঁ! কেন থাকতে নেই? এ ত আর লিগাল নয়। জাস্ট একটা ফানি গেম। ও আপনি বুঝবেন না।
আমরা দেখতে চ্যাংড়া কিন্তু আমরা ভাজা মাছ ধীরে সুস্থে খাই। দরকার হলে তবে ওল্টাই।
রায় সাহেব সব শুনে ভাবলেন ত্যাঁদোর ছেলেটা তো চরম জুতো মারল ঠান্ডা মেজাজে ঠাস ঠাস করে...উচিত শিক্ষা দিয়ে দিল তাকে যে “ফলম পরিচয় না বৃক্ষে”।
কি আর করবেন, মাথার প্রেশার মনে হয় লাফিয়ে ওপরে আটকেছে। মনে মনে বললেনঃ “কে জানে বাওয়া! আজকালকার এইসব ছেলে-মেয়েদের বোঝে আমাদের মতন ওল্ড ফ্যাশন বাপের কি আর সাধ্যি?
ছোটবেলায় কোথায় যেন পড়েছিলেন-
ছেলে আর মেয়ের লেখাপড়া
আপনা হতে ডুবে মরা!!!!!