গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

তুষার সেনগুপ্ত



ফসল

রিক্সার প্যাডেলে পা'দুটো যেন বসতেই চাইছে না কেয়ামতের। খালি ছিটকে ছিটকে ওপর দিকে উঠতে চাইছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে আর শরীলটাও যেন শূন্যে ভাসছে। রোজই ভাবে আজ আর যাবে না হাবুলদের ঠেকে কিন্তু ইস্টিশনের শেষ লোকালটা চলে যেতেই কি যে হয়....
রোজ রাত্তিরের মত আজও বাড়ি ফিরে লন্ঠনের টিমটিমে আলোয় চম্পার ঘুমন্ত মুখটা দেখতে দেখতে কেয়ামত প্রতিজ্ঞা করে কাল থেকে আর ওমুখো হবে না। ডালে চুবিয়ে চুবিয়ে গোটা চারেক রুটি কোনমতে পেটে সেঁধিয়ে হারিকেনটা নিভিয়েই কেয়ামত জাপটে ধরে চম্পাকে। আর রোজকারের মতই ঝাপটা দিয়ে কেয়ামতের হাত সরিয়ে দিয়ে চাপা গনগনে গলায় খিঁচিয়ে ওঠে চম্পা মরণ! গাঁজা টেনে মাঝ রাত্তিরে সোহাগ কত্তে এসেছে। কেন,হাবুলের গাঁজার ঠেকে মাগি পাওয়া যায় না?বলেই উল্টোদিকে ফিরে শোয়। সারাদিন রিক্সা ঠেঙিয়ে রোজগার। বিবির খাওয়া পড়ার তো আর অভাব রাখেনি কেয়ামত। নিজের রক্তজল করা রোজগারের পয়সায় একটু ফুর্তি করলেই মাগির যত জ্বালা। একে নেশার ঘোর তার ওপর শাদি করা বিবির অচ্ছেদ্দা। মাথায় আগুন জ্বলে যায় কেয়ামতের। রিক্সার হ্যান্ডেল ধরা ডানহাতের শক্ত থাবায় খামচে ধরে চম্পার বুক। বাঁহাতে চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে গর্জে ওঠে,

"কিসের এত তেজ তোর? বলি,তোর কিসের এত তেজ? তিন বচ্ছর শাদি হয়েছে,একটা বাচ্চাও তো বিয়তে পারলি না..... আয় শালি...."
কেয়ামতকে এক ধাক্কায় চৌকি থেকে নিচে ফেলে দিয়ে চম্পা দাঁতে দাঁত চেপে গুমরে ওঠে, "একদম ছুঁবি না আমায়। আমাকে তো শেষ করেছিস, আমার পেটেরটাকেও....."
ঘুরঘুট্টি অন্ধকারেও চম্পার মুখটা দেখতে চেষ্টা করে রহমত। ঘন অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। ইষ্টিশনের পেছনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসা শেয়ালের চিৎকারকে ভেদ করে শুনতে পায় চম্পার হিসহিসে গলা,"তিন বচ্ছর ধরে লোকের মুখে শুনছি আমি নাকি বাঁজা। শালা! মরদের খ্যামতা নাই আর বিবি কিনা বাঁজা....."
জমাট বাঁধা অন্ধকার গায়ে মেখে কেয়ামত বোঝার চেষ্টা করে বিবি পোয়াতি হওয়ার খবরটা আনন্দের,  নাকি.....

দায়

পুরো সতেরো দিন হয়ে গেল অনির্বাণ ইণ্ডিয়াতে আছে। সাকুল্যে বাইশ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। আর মোটে পাঁচটা দিন হাতে আছে। সামনের শনিবারের রিটার্ন ফ্লাইটে টিকিটও কাটা আছে। সামনের মানডেতে জয়েন না করতে পারলে চাকরীটাই বাঁচানো দায় হবে। একেই এই রিসেশনের বাজারে রোজই অফিসে ঢুকে প্রথমেই ডেস্কে চোখ বুলিয়ে নেয় ভয়ে ভয়ে, কার কপালে যে কবে পিঙ্ক স্লিপ জুটবে কে জানে। তার ওপর আবার এই রকম দুম করে পুরো বাইশ দিনের ছুটি নিয়ে ইণ্ডিয়ায় আসতে হল। ছোট মেসোমশাই ফোনে এমন করে খবরটা দিল যে অনির্বাণ নিশ্চিত ছিল দিন পনেরোয় সব ঝামেলা সামলে নিতে পারবে। কিন্তু কোথায় কি? হসপিটালের আই.সি.ইউ-র সামনের ওয়েটিং রুমের সোফায় বসে ডাক্তারের অপেক্ষা করছে অনির্বাণ। মনে মনে ঠিক করল ডাক্তারের কাছে আজ ক্লিয়ার পিকচার চাইবে। ডাক্তার রুটিন চেক-আপ সেরে বেরতেই অনির্বাণ দ্রুত পায়ে গিয়ে ডাক্তারকে ধরল। অদ্ভুত কৌতূহলী স্বরে প্রশ্ন করলো,
- ডাক্তার,মায়ের অবস্থা এখন?"
- একটু বেটার লাগলো আজকে,তবে বোঝেনই তো ক্যান্সারের পেশেন্ট এবং এডভান্সড স্টেজ, কালও কিছু হয়ে যেতে পারে আবার নেক্সট দশ পনেরো দিনও...."
ডাক্তারের মুখের কথা শেষ করতে না দিয়েই অসম্ভব অসহিষ্ণু গলায় অনির্বাণ বলে উঠলো,
"ডাক্তার ! আপনি তো একদিন দুদিন বলে বলে পুরো সতেরোটা দিন কাটিয়ে দিলেন, সামনের শনিবারের মধ্যেও কিছু না হলে? আমায় যে ফিরতেই হবে ফিলাডেলফিয়ায়........."