
জ্বলে ওঠা
এক
খ্যাতিবান হউন কিংবা না হউন প্রতিটি প্রবীণ কবিরই কমবেশী ভক্তকূল জুটে যায়।
খ্যাতিবান না হলেও কবি সফরাজ দেওয়ানেরও কিছু ভক্ত রয়েছে। কথায় বলে পীর
উড়েন না, মুরীদেরাই ওড়ায়। ভক্তদের উছিলায় সফরাজ আজ ফেইসবুক সেলিব্রিটি
কবি। তারপরেও তার মন সর্বক্ষণ খচ খচ করে। শ্রেষ্ঠ কবিতা সহ সাত/আটটা বই
বের হওয়ার পরও যখন দেশের মানুষের কাছে প্রত্যাশিত কবি স্বীকৃতি মিলে না
তখন তিনি আর হিসেব মেলাতে পারেন না।
দুই
কবি সফরাজ দেওয়ান ভক্তসমেত চলাফেরা করতে
ভালোবাসেন। গুটিকয়েক ভক্তসহ তিনি এসেছেন কবি আসলাম আহমেদ খানের কবিতা আড্ডায়। আড্ডায় আছেন জনপ্রিয় দু/তিন জন কবিসহ কয়েকজন উঠতি তরুণ কবি। কথা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি
দেবাশীষ কুমার
বলেন,’কোন কবির বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেলে
নতুন করে তার কিছু দেয়ার থাকে না। নবীনেরাই পারে নতুন ভাবনায়, নতুন কৌশলে কবিতায় চমক সৃষ্ট করতে -
পারে জ্বলে উঠতে।'কথাটা শুনেই সফরাজ দেওয়ান চটে ওঠেন, 'কে বলেছে আপনাকে? রবীন্দ্রনাথ তো বুড়ো বয়সেও বাঁকে
বাঁকে চমক সৃষ্টি করে গেছেন ....
বয়সের সাথে কাব্যচর্চার কোন সম্পর্ক নেই।' সফরাজ দেওয়ানকে লক্ষ করে আসরের সর্বকনিষ্ঠ তরুণ কবি এবার বলে
বসে, 'আঙ্কেল, কবি দেবাশীষদা তো ঠিকই বলেছেন, বয়েস হলে ..' ছেলেটি কথা শেষ করতে পারে না, তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন তিনি,আঙ্কেল? কে আঙ্কেল,কার আঙ্কেল? ...'
একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত উপস্থিত কবি সলিল চৌধুরীকে সফরাজ দেওয়ানের চকচকে টাকের দিকে
তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসতে দেখা যায়।
কাপুরুষ
নিউমার্কেটে ঢোকার মুখে বা সাইডে পার্ক করে
রাখা এক্স-কলোরার
নামানো জানালায় যে মুখটি ভেসে এলো তা দেখে সত্যিই চমকে উঠি। সেই চোখ, সেই মুখ, থুতনিতে বিউটি স্পট সেই কালো তিলটা। ওর মুখের দিকে
চেয়ে আমি ফিরে যাই তিরিশ বছর আগের দিনগুলোতে,
আমাদের
কলেজ জীবনে। সহপাঠি ছিলাম আমরা। দুজনেই সংস্কৃতিমনা। রবীন্দ্রসঙ্গীতে তার জুড়ি ছিলো
না। আমি বাজাতাম তবলা আর করতাম ভরাট কন্ঠে আবৃত্তি। কলেজে কতো অনুষ্ঠানে যে ওর তবলচি হয়ে পাশাপাশি
থেকেছি। এক সময়ে
দুজনেই
ভাবতে শুরু করি আমরা অবিচ্ছেদ্য। বয়স এবং প্রেমের আবেগে কেউই তখন বুঝতে পারিনি শ্রেণী-বৈষম্য সমাজের নির্মমতা। আমি ঐ
কলেজের দফতরির ছেলে আর ওর বাবা স্থানীয় সাংসদ। ছোটবেলা
থেকেই অসম্ভব মেধাবী আমি, এবং নিশ্চিত
জানতাম
প্রতিষ্ঠা পেতে বেগ পেতে হবে না। ওর সাথে সম্পর্কের ভাবনায় এটিই ছিলো আমার একমাত্র পাথেয়।
আমাদের সম্পর্ক চাউড় হয়ে ওর বাবার কানে যায়। আমাকে ডেকে নিয়ে শাসানো হয়। দেওয়া হয় কলেজ থেকে বাবাকে
বরখাস্ত করার হুমকি । সেই ভয়াবহ সময়ে একদিন লাইজু আসে । বলে, "চলো পালিয়ে যাই,আমি তৈরী হয়েই এসেছি।" সাহস হয় না
আমার। আমি
ভাবি বাবার কথা। ভাবি দারিদ্রপীড়িত আমাদের পরিবারের কথা। ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। বেশ
শক্ত হয়েই আমি বলে উঠি, "না লাইজু এ আর সম্ভব নয়। তুমি তোমার বাবার কাছেই ফিরে যাও।" কিছুটা সময়
অবাক হয়ে
আমার মুখের দিকে তাকায়। "আআগাপাছতলা কাপুরুষ তুমি",
বলেই হঠাৎ
হন হন করে চলে যায়। এর কিছুদিন পর ওর বিয়ে হয়ে যায়। তারপর? তখন তো আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর আর কি করে রাখি! মনোযোগ দিতে শুরু করি জীবনে
প্রতিষ্ঠায়।
ভাবনার মাঝেই হঠাৎ গাড়িটি থেকে ডাক আসে। "আংকেল,
শুনেন"। কাছে যাই, লাইজু তো ঠিক আগের মতোনই আছে,এতোটুকুও আচড় ফেলতে পারেনি সময়! আমি বলি,"লাইজু,কেমন আছো তুমি?কতোটা বছর পর তোমাকে দেখছি আজ ..." খিল খিল করে হাসতে শুরু করে সে,
গালে সেই
টোল। বলে,আংকেল,বয়স্ক লোকেরা সবাই এ ভুল করে।
আমি লাইজু না,আমি তার মেয়ে তনুজা। তা,মামকে আপনি কি করে চিনেন?"
দৌড়ে পালিয়ে আসি। আমি তো এক আগাপাছতলা
কাপুরুষ।