৫টি গল্প লিখেছেন অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী , দুপুর মিত্র, রাজন নন্দী ও অরন্দম চন্দ্র
গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৩
অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
মহাপ্রস্থান
(শেষ অংশ)
(পূর্ব
প্রকাশিতের পর)
বাতায়নের অফিসে তাঁর নিজের ঘরে ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে একটু বিশ্রাম
নিচ্ছিলেন আশিস সান্যাল। হিমেশ এসে একটা টুল নিয়ে তাঁর পায়ের কাছে বসল। বলল, --
পায়ে ব্যথা হচ্ছে নাকি জেঠু? বলেই দুহাত দিয়ে আস্তে আস্তে তাঁর পা টিপতে শুরু করল।
সান্যালের মুখ দিয়ে আরামের অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল। তিনি চোখ খুলে হিমেশকে
দেখলেন। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে বললেন,-- মতলবখানা কী?
হিমেশ
বলল, -- আছে একখানা। আগে পা দুটো একটু ভালো করে টিপে দিই। ভালো ব্যথা মনে হচ্ছে?
সে তো
আছেই অষ্টপ্রহর! এটাকে সঙ্গে নিয়েই ওপারে যেতে হবে। তোর ব্যাপারটা শুনি।
হিমেশ আর্য বসুর বৃত্তান্ত প্রথম থেকে শেষ অবধি খুঁটিয়ে বর্ণনা
করল। সান্যালের বোঁজা চোখ আস্তে আস্তে খুলে গেল। মেদবহুল গন্ডদেশের আড়াল থেকে তাঁর
ছোট্ট চোখের কুতকুতে চাহনি বিঁধতে থাকল হিমেশকে। কিন্তু কোন মন্তব্য করলেন না
তিনি। হিমেশ বলল, -- কালকের কাগজে এটা লিড নিউজ করুন জেঠু,আমি কপি তৈরি করে এনেছি।
একটু দেখে নিন।
সান্যাল
বললেন, -- কাগজটা কি তুলে দেওয়ার মতলব করেছ?
--
আপনি বিশ্বাস করছেন না ব্যাপারটা?
-- আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু যায়-আসে না। একবার খবরটা প্রকাশিত
হলে আর্য বসুর কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছ? আমাদের এতদিনের পুরানো কাগজ – আমরা যদি ব্যাপারটা ছাপি,যতই অবিশ্বাস্য হোক লোকে হামলে পড়বে তার
উপরে।
সত্যিই তো, এদিকটা ভেবে দেখেনি হিমেশ। সে শুধু সর্বসমক্ষে প্রদর্শন
করার পর আর্য বসুর বিড়ম্বনার কথা ভেবেছিল। তার আগের সময়টুকুও তো তাঁকে জনসমক্ষের
আড়ালে রাখা দরকার। সে বলল, -- কী করা যায় জেঠু?
সান্যাল
বললেন, -- আগে তোমার কপিটা পড়ি। তারপর ভাবছি।
শেষ পর্যন্ত আর্য বসুর নাম-পরিচয় গোপন রাখা হল।
এমন কি,হিমেশ যে এই ঘটনার সুত্রধার সেটা যাতে তার কাগজেরও কেউ জানতে না পারে সেই
ব্যবস্থা করলেন সান্যাল। সংশোধিত কপিটি সেভ করার পর হিমেশের ল্যাপটপ থেকে সেটি
মুছে দেওয়া হল। তার খসড়ার প্রিন্ট আউট-টিও নষ্ট করে দেওয়া হল। সবশেষে হিমেশকে
সাবধান করলেন সান্যাল,সে যেন কোনমতেই তার মোবাইল থেকে বা অফিস কিম্বা বাড়ির টেলিফোন
থেকে কালকের পর আর্য বা অদ্রিকে ফোন না করে। আর্য বসুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে
আজকেই একটা নতুন সিম নিক সে,তার নম্বরটা যেন সে কাউকে না দেয় এবং আর্য বসু ছাড়া
সেই নম্বর থেকে দ্বিতীয় কাউকে ফোন না করে।
হিমেশ বিদায় নেওয়ার সময় সান্যাল বললেন, -- শুধু তোমার মুখ চেয়েই
রিস্কটা নিলুম। যদি শেষরক্ষা হয় – ইট্স গোয়িং টু বি দ্য
নিউজ অব দ্য সেঞ্চুরি!
পরের দিন বাতায়ন-এর বিক্রি সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে
গেল। আগের থেকে অনুমান করে দ্বিগুণ কপি ছাপার ব্যবস্থা করেছিলেন সান্যাল। সমস্ত
কপি নিঃশেষিত বেলা আটটা বাজতে না বাজতেই। বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী - দু’ধরনের মানুষের কৌতূহলের চাপে কাগজের অফিসের টেলিফোন নামিয়ে রাখতে
হল। কাগজের কর্মচারীদের মোবাইল তাদের পরিচিত জনেদের জিজ্ঞাসার প্রাবল্যে সুইচ অফ
করতে হল। বাতায়ন-এর প্রতিদ্বন্দ্বী দৈনিকটি পরদিন সম্পাদকীয়তে কোন ম্যাজিসিয়ানের
এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক কাণ্ডকারখানাকে সংবাদ বলে প্রচার করে সংবাদপত্রের মহান
ঐতিহ্যকে কালিমালিপ্ত করেছে বলে বাতায়ন-এর কঠোর সমালোচনা করল। পরিশেষে এই আশা
ব্যক্ত হল যে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকেরা এবং যুক্তিনিষ্ঠ মানুসেরা প্রদর্শনের দিন
বাতায়ন নিযুক্ত জাদুকরের সব জারিজুরি ফাঁস করে দেবেন।
দিন পনের পর আর্য বসু তাঁর অলৌকিকভাবে পাওয়া
ক্ষমতা প্রদর্শন করবেন। আশিস সান্যালের নেতৃত্বে সমস্ত ব্যবস্থার আয়োজন চলতে লাগল।
ইতিমধ্যে বাতায়ন এর সংবাদের সূত্র ধরে দেশবিদেশের বিভিন্ন কাগজে আর্টিক্ল এবং
জনসাধারণের মতামত প্রকাশ পেতে থাকল।
বিবিসি কয়েকজন তরুণ বিজ্ঞানীকে নিয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে সরাসরি তার
সম্প্রচার করল। আশ্চর্যের ব্যাপার, বিজ্ঞানীদের কেউই ধারণাটিকে সম্পূর্ণ আজগুবি
বলে উড়িয়ে দিলেন না। আর্য বসুর নাম প্রকাশিত না হওয়ায় তাঁরা তাঁকে ‘ভারতীয় যোগী’ বলে উল্লেখ করলেন।
নিউট্রিনো কণার রহস্যময় আচরণের সঙ্গে কোয়ান্টাম থিওরি দিয়েও তাঁরা এর ব্যাখ্যা
পেতে সচেষ্ট হলেন।
আর্য বসু হিমেশকে কয়েকটি
শর্ত দিয়েছেন। প্রথমত,দর্শকসংখ্যা যাই হোক না কেন তাদেরকে সম্পূর্ণ নীরব রাখার
দায়িত্ব নিতে হবে। দ্বিতীয়ত,চড়া আলো চলবে না। মঞ্চে মৃদু,নরম আলো রাখতে হবে। কারুর
সন্দেহ হলে অবশ্য তাঁরা মঞ্চের উপরে তাঁর পাশে বসে সব পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
ক্যামেরা ব্যবহার করতে পারেন সাংবাদিকেরা। কিন্তু শব্দ হয় বা ফ্ল্যাশ-বাল্ব অথবা
চড়া আলো ব্যবহার করতে হয় এমন ক্যামেরা চলবে না।
সেইমতই সব ব্যবস্থা
করলেন আশিস সান্যাল। সমস্ত নিউজ এজেন্সি এবং দেশবিদেশের টিভি চ্যানেলকে আর্য বসুর
শর্ত জানিয়ে আমন্ত্রণ করলেন। বেছে বেছে কিছু বিজ্ঞানী ও গুণী মানুষকেও ডাকা হল।
এছাড়া,আমন্ত্রিতের তালিকায় থাকলেন দেশবিদেশের বিখ্যাত সব সংস্থার প্রতিনিধিরা।
মঞ্চের বাইরে যাতে ভালোমত পুলিশ প্রহরা থাকে সেই ব্যবস্থাও করা হল।
নির্দিষ্ট দিনে
সন্ধে আটটার সময় পুলিশের গাড়ি আর্য বসু ও হিমেশকে নিয়ে বাতায়ন-এর অফিসে পৌঁছাল।
অফিস সংলগ্ন একটি হলে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে দর্শক
সংখ্যা খুব সীমিত রাখতে পারেননি সান্যাল। রাজনীতি জগতের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিকে
আমন্ত্রণ দিতে হয়েছে তাঁকে। সাড়ে ন’টায় শুরু হবে প্রদর্শনী।
রাত দশটায় ধ্যানে বসবেন আর্য বসু। তার আগে কয়েকটি কথা দর্শকদের জানাবেন তিনি।
তারপর হিমেশ তাঁর পরিচয় এবং এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য জানাবে।
ন’টার মধ্যেই আমন্ত্রিতরা সব এসে গেলেন। বাইরে কৌতূহলী বিশাল জনতা।
যথেষ্ট পরিমানে পুলিশবাহিনী হলটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আর্য বসুর শর্তের কারণে টিভি
চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সাংবাদিকেরা গোপন ক্যামেরা
নিয়ে মঞ্চ ঘিরে জায়গা নিয়েছেন। বিজ্ঞানমঞ্চের লোকেরাও পিছিয়ে নেই। অনেকেরই সন্দেহ
ব্যাপারটা বিশুদ্ধ ম্যাজিক বই কিছু নয়। আর্য বসুকে না দেখা পর্যন্ত আশিস সান্যাল
খুব উদ্বেগে ছিলেন। তাঁর বুক কাঁপছিল রীতিমত – আজ যদি তিনি ধ্যানে
নিমগ্ন না হতে পারেন! কিন্তু তাঁকে দেখার পর আশ্বস্ত হলেন তিনি। আর্য বসুর প্রসন্ন
মুখ ও আত্মবিশ্বাসী অবয়ব দেখে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সান্যালের।
ঠিক সাড়ে ন’টার সময় মঞ্চে এলেন আর্য বসু। সঙ্গে কেবল হিমেশ। আর্য বসু
মাইক্রোফোন হাতে তিন মিনিট মাত্র কথা বললেন। বললেন, -- যে ব্যাপারটি আমার জীবনে
ঘটেছে সেটি আমার একান্ত ব্যক্তিগত ঘটনা বলে মানি। কোনভাবে এটি প্রকাশ পাক আমি
চাইনি। দুঃখের বিষয়,প্রকাশ তো হলই – রীতিমতো নাটকীয়ভাবে এর
প্রচারও করতে হল। এতে নিজের দায় অস্বীকার করি এমন কৃতঘ্ন আমি নই। তবে এর প্রধান
দায়িত্ব আমার পুত্রপ্রতিম হিমেশের। কেন সে এমন সিদ্ধান্ত নিতে আমায় বাধ্য করল সেটা
সে-ই আপনাদের বিশদ বলবে। আমি শুধু আর দুটো কথা আপনাদের বলব। বাতায়নে এর বৈজ্ঞানিক
ব্যাখ্যা যা দেওয়া হয়েছে তার অতিরিক্ত আমার কিছু জানা নেই। সেটি সঠিক কিনা তাও আমি
বলতে পারব না। আমি শুধু আমার ধারণার কথা জানিয়েছি। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস
করি,বিনা প্রমাণে বিশ্বাস করা বিনা প্রমাণে অবিশ্বাস করার চেয়ে কম অবৈজ্ঞানিক।
আপাত-অবিশ্বাস্য কিন্তু সুন্দর সমস্ত ধারণা একদিন না একদিন প্রমাণিত সত্য হবে বলেই
আমি বিশ্বাস করি। কেউ কেউ আমাকে ভারতীয় যোগী ভেবেছেন। তা সঠিক নয়,আমি অতি সাধারণ
এক মানুষ মাত্র। যা ঘটেছে তা একান্তই ‘তাঁর’ ইচ্ছায় ঘটেছে এবং ঘটতে থাকবে। সবশেষে আমি করজোড়ে মিনতি করছি, আপনারা সম্পূর্ণ নীরব
থাকবেন। নইলে ধ্যানে নিমগ্ন হতে অসুবিধে হবে। আমি চাই না এত আয়োজন বৃথা হোক -
বিশ্ববাসীর সামনে যেন আমাদের প্রতারক
প্রতিপন্ন না হতে হয়।
আর্য বসু হিমেশের হাতে মাইক্রোফোন দিয়ে
নিজের আসনে বসে পড়লেন।
হিমেশ শুরু করল আর্য
বসুর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে। তারপর তাঁর লেখা সাতটি গল্প ও একমাত্র উপন্যাসটির
প্রসঙ্গে এল। পরিশেষে সে বলল, -- আজকের এই অলৌকিক প্রদর্শনের উদ্দেশ্য নয় কোনোভাবেই
ক্ষমতার অপব্যবহার করা। তিনি ইচ্ছে করলেই নিজের তরুণ বয়সে ফিরে গিয়ে নতুন করে
জীবনকে উপভোগ করতে পারতেন। আজকের পর তিনি চাইলে তাঁর বিত্ত-বৈভবের অভাব থাকবে না।
অথচ, তিনি কিছুতেই চাননি নিজেকে এইভাবে প্রকাশ করতে। আমি তাঁকে জোর করেছি
কেবলমাত্র তাঁকে বিখ্যাত করে তুলতে যাতে বিশ্ববাসী তাঁর লেখাগুলির প্রতি আকৃষ্ট
হয়। নইলে অনামী এই লেখকের লেখা পাঠকদের অগোচরেই থেকে যাবে চিরদিন। তিনিও মনেপ্রাণে
চান তাঁর হৃদয়-নির্যাস, তাঁর আনন্দ পাঠকদের সাথে ভাগ করে নিতে। এই প্রসঙ্গে
বলি,তিনি আগে থেকেই তাঁর সমস্ত রচনার গ্রন্থস্বত্ত্ব বাতায়ন-কে লিখিত দলিল করে দান
করেছেন এই শর্তে যে সেই পুস্তক বিক্রির লভ্যাংশের পঁচাত্তর ভাগ সরকারি
নিয়ন্ত্রণাধীন এক ট্রাস্টে যাবে,যে ট্রাস্ট বিজ্ঞান-গবেষণা ও সাহিত্য-সাধনায় ব্রতী
তরুণদের অর্থসাহায্য করবে। বাকি পঁচিশ ভাগ অর্থ দিয়ে বাতায়ন একটি সাহিত্য পত্রিকা
প্রকাশ করবে। সারা বিশ্বের সাংবাদিকেরা আজ এখানে উপস্থিত আছেন। তাঁদের কাছে আমার
সবিনয় প্রার্থনা, তাঁরা যেন আজকের পর কোনভাবেই আর্য বসুকে বিরক্ত না করেন। মনে
রাখবেন,খ্যাতি তিনি নিজের কোন স্বার্থে চাননি – খ্যাতির বিড়ম্বনা
কোনভাবেই তাঁর প্রাপ্য নয়। তিনি শুধু চান তাঁর রচনা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক,
বিশ্ববাসী যেন তাঁকে ভুলে গিয়ে তাঁর লেখাগুলি নিয়েই পরিতৃপ্ত থাকেন।
দশটার সময় ধ্যানে
বসলেন আর্য বসু। বহু গোপন ক্যামেরা বিভিন্ন কোণ থেকে তাঁর শরীরকে ছেঁকে ধরল। হিমেশ
আশ্বস্ত হল যে দর্শকরা আর্যবসুর আবেদনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। হলে অখন্ড নীরবতা।
এগারটা বাজার পর থেকে তাঁর শরীরের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেতে লাগল। মুখের চামড়া
টানটান হতে শুরু করল,চুলের রঙে বদল দেখা গেল। একটিমাত্র কৌপীন পরে বসেছিলেন তিনি।
ধীরে ধীরে তাঁর হাতের ঈষৎ শিথিল পেশী শক্ত হতে থাকল, শরীরে যেন খানিকটা মেদেরও
সঞ্চার হল। ঠিক বারটার সময় যখন তিনি চোখ খুললেন তখন তাঁর মাথায় পাতলা নুনমরিচ রঙের
চুলের জায়গায় ঝাঁকড়া কালো চুল,কেবল ঝুলপির কাছে সামান্য রূপোলী আভাস। দর্শকরা
মন্ত্রমুগ্ধ! কেউ কেউ নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেলেন। আশিস সান্যাল মঞ্চের সামনেই
ছিলেন,তাঁর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল বিদেশি এক মহিলা সাংবাদিক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
একটা মৃদু গুঞ্জনের ঢেউ বয়ে গেল সারা হলে। আর্য বসু দু’হাত তুলে দর্শকদের সংযত হবার ইশারা করেই আবার চোখ বুজলেন। সান্যাল
ভাবলেন, ঈশ্বর কি এমনি করেই মাঝে মাঝে তাঁর অস্তিত্বের জানান দেন!
রাত্রি একটা থেকে
আবার পরিবর্তন শুরু হল আর্য বসুর শরীরে। রাত দুটোয় চোখ খুললেন তিনি। সামান্য যা
মেদের সঞ্চার হয়েছিল তা ঝরে গিয়ে শরীর এখন ছিপছিপে। চুল আরও ঝাঁকড়া হয়ে নেমে এসেছে
কপালে। গালে পাতলা দাড়ি,চোখের খানিক নীচে দু-একটা ব্রণও দেখা যাচ্ছে। আর্য বসু এখন
বিশ বছরের তরতাজা তরুণ। এরপর যা করলেন তিনি,হিমেশও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। উঠে
দাঁড়িয়ে হাতের উপর ভর দিয়ে শুরু করে পরপর কয়েকটা আরচিং করে নিলেন অত্যন্ত
সাবলীলভাবে। তারপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বললেন, -- ঈশ্বর আমাকে মাফ
করুন,ক্ষণিকের জন্য মতিভ্রংশ হয়েছিল,সেই বয়সের স্মৃতিতে আক্রান্ত হয়ে সেভাবেই নিজের শরীরকে চালনা করে ফেললাম। ভুলে গিয়েছিলাম
এই শরীরের প্রকৃত অধিকারী আর আমি নই।
হিমেশ মঞ্চের একপাশ থেকে দর্শকদের দিকে
তাকিয়ে দেখল,অনেকেই রুমাল বের করে নিঃশব্দে চোখের জল মুছছেন। তারও কান্না পেতে
থাকল।
সকাল সাড়ে ছ’টায় হিমেশ যখন কোনক্রমে সাংবাদিকদের নাগাল এড়িয়ে আর্য বসুকে নিয়ে
পুলিশের গাড়িতে তাঁর বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে পারল তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য
সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই তাদের ছেড়ে আসা রাস্তার উপর পড়ে কাঁদতে কাঁদতে গড়াগড়ি
দিচ্ছে।
আর্য বসুর বাড়িতে
পুলিশ-পাহারার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু পরের দিন তাঁর আর খোঁজ পাওয়া গেল না। অদ্রি
একটু বেলা করে ওঠে। সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠে বাবার ঘরে এসে দেখে দরজা খোলা।
বিছানা নিভাঁজ। বাবা হয়ত ধ্যানে বসেই কাটিয়েছে সারা রাত। কিন্তু এত সকালে বেরোল
কোথায়? এখন তো তাঁর আর অফিস নেই। বাইরে বেরোতে গিয়ে দেখে সদর দরজা ভেতর থেকেই
বন্ধ। ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখল গেটও তালাবন্ধ। সেখানে যথারীতি তিনজন পুলিশ
বন্দুক নিয়ে বসে। তাজ্জব বনে সে হিমেশকে ফোন করল।
বছরখানেক কেটে গেছে।
বন্ধ ঘর থেকে আর্য বসুর উধাও হয়ে যাওয়া রহস্যের কোন কিনারা হয়নি। রাজ্যের গোয়েন্দা
পুলিশের হাত থেকে সিবিআই তদন্তের ভার নিয়েও এখন পর্যন্ত সেই রহস্যের কোন সূত্র বের
করতে পারেনি। তবে আর্য বসুর কোন সন্ধান না পাওয়া গেলেও তাঁর রচনাবলি ইতিমধ্যেই
বাংলা জয় করে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি তা দেশকে
অতিক্রম করে পৃথিবী জয় করতে বেরোবার উদ্যোগ নিচ্ছে। হিমেশ বাতায়ন-এর সাংবাদিকতা
ছেড়ে তার প্রকাশনা বিভাগের ভার নিয়েছে।সে এখন হিমশিম খাচ্ছে অসংখ্য আবেদনকারীর
মধ্যে রুশ,জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষার অনুবাদক বাছাই করতে। সে এত ব্যস্ত যে তার বাবার
অকাল মৃত্যুর শোকও সে ভুলতে বসেছে। আর্য বসুর অন্তর্ধান রহস্যের বোঝা একা নিজের
বুকে বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে সে মাস তিনেক আগে একদিন তার মায়ের কাছে সেই নিগূঢ়
তথ্যটি প্রকাশ করে ফেলেছিল যা বিশ্বের কোন গোয়েন্দা দপ্তরই কোনদিন জানতে পারবে না।
সেই রাতে আর্য বসু তাঁর অজ্ঞাত শারীরি বিক্রিয়ায় নিউট্রিনো কণাকে আটকে কুড়ি থেকে চল্লিশের
দিকে না ফিরে সোজা শূন্যের দিকে চলে গেছেন। মাকে তথ্যটি জানিয়ে দেওয়ার পরই হিমেশ
নিশ্চিতভাবে জেনে গেল মায়ের কাছে তা প্রকাশ করার সিদ্ধান্তটি ছিল একান্তভাবে ‘তাঁরই’ নির্দেশ। কেননা দেখা গেল, বাবার মৃত্যুর পর
থেকে মায়ের অবয়ব ও আচরণে নিরাসক্তির যে প্রলেপ পড়েছিল,সেদিনের পর থেকে তা ফিকে হতে
হতে অন্তর্হিত হয়ে গেল। তাঁর মুখে ফিরে এল আগেকার লাবণ্য। ধীরে ধীরে বইতে লাগল সেই
সুবাতাস যা তার বাবার জীবিতকালে বইত। তার মা এখন নিয়মিত ধ্যানে বসছেন। ধ্যানের
মধ্যে প্রায়ই নাকি তিনি বাবার গলার আওয়াজ পান,এমনকি মাঝে মাঝে তাঁর হাতের স্পর্শও
পান।
* *
* * *
দুপুর মিত্র - দুটি অনুগল্প (মেটা ফিকশন)
সীতাপুরাণ
সীতার
জন্ম

সীতা নামকরণ ও এলাকাবাসীর নানা আলাপ
ঘর মেয়ের হাসিতে আলোয় ভরে ওঠেছে
যেনে হাল চাষ ফেলে দৌঁড়ে আসেন সীতার বাবা। এসেই মেয়েকে কুলে নিয়ে তার নাম দেন
সীতা। ঘরে পাড়া-প্রতিবেশীর সবাই এসে জড়
হয়েছেন। সীতা নাম দেওয়া হয়েছে শুনে অনেকেই বললেন- এই নাম কেউ রাখেন না।
সীতা মানে দু:খ,সীতার
আজন্ম জীবন ছিল দুঃখের । মা বাবাকে অনুরোধ করেন মেয়ের নাম যেন সীতা না রাখা হয়।
কিন্তু বাবার কথা অন্য,যে সীরধ্বজ রাজার হলকর্ষণের সময়
সীতার জন্ম হয়,জমি চাষ করার সময়
লাঙলের আঘাতে ভূমি বিদীর্ণ করে যে
সীতার জন্ম হয়,কোনও কৃষকের ঘরে মেয়ে হলে তার নাম
তো সীতাই রাখতে হবে। সীতা শুধুই দু:খের এ ভুল, সীতা একজন কৃষকের হাল কর্ষণে
আনন্দের জন্ম। একজন কৃষক সারা জীবন এইই চায়।
সীতার রূপ ও চরিত্রের বর্ণনা
বয়স যতই বাড়ে সীতার রূপও ততই বাড়তে
থাকে। এলাকাবাসীর নজরেও পড়তে থাকে সীতা । শুধু রূপে নয়,গুণেও। মা-বাবার হেন কাজ নেই যে
সীতা তা করে দেয়না। সীতার মা-বাবা সীতাকে নিয়ে
খুবই খুশি আর আনন্দিত। এলাকাবাসীও সীতার রূপগুণে খুব মুগ্ধ। সবার মনে কেবল একই কথা- সবার ঘরে যেন সীতার মত মেয়ে জন্ম নেয়।
নবগঙ্গার ভাঙন ও সীতার পরিবারসহ ঢাকায় আগমন
সীতার বয়স যখন ১৬ কি ১৭,সীতার বিয়ে নিয়ে কথা বলছেন তার মা-বাবা,দু-একটা ছেলে পক্ষও এসে
দেখে গেছে সীতাকে সে বছরই শুরু হল নবগঙ্গা নদীর ভাঙন। নদীর
এই যে ভাঙন শুরু হল তার আর শেষ নেই। অনেক মানুষকে গ্রাম ছেড়ে দিতে হল। কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে। সীতাদেরও একই অবস্থা।
ধানী জমিগুলোও সব নদী খেয়ে নিল। সীতারা চলে এল ঢাকায়। ঢাকায় তাদের কিছুই চেনা নেই।
এলাকার যে লোকটির সাথে তারা ঢাকায় এসেছিল, সেই লোকটিই বলল সীতা আর তার মাকে গার্মেন্টে কাজ করতে। আর সীতার বাবা কাজ নিল
রিক্সা চালনার। বস্তিতে অজস্র মানুষের সাথে একটি ভাঙ্গন অতিক্রম করে তারা এমন এক জগতে
এসে পৌঁছল,তাদের মনে হল- কোনোরকম জীবনটা এখন
কাটিয়ে দিতে পারলেই চলে।
সীতার বিয়ে ও অপহরণ
এরকম সুন্দর একটি মেয়ে বস্তিতে থাকে, বস্তির কোনও ছেলেরই নজর এড়াল না
বিষয়টা। মা-বাবা এটা বুঝতে পেরে আর আজানা-অচেনা জায়গা, কিছু একটা হয়ে গেলে এরকম ভেবেই
মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল মা-বাবা। ছেলে সেই বস্তিতেই থাকে। কাজ
করে একই গার্মেন্টে। বিয়ের দু একদিন যেতে না যেতেই বস্তির ছেলেরা অপহরণ করে নিয়ে যায় সীতাকে।
সীতার অগ্নিপরীক্ষা:
সীতার কান্না দেখে মায়ায় পড়ে যায়
সেইসব ছেলেরা। সেদিনই বস্তির পাশেই বখাটে ছেলেরা ফেলে রেখে যায় সীতাকে। এবার শুরু
হয় স্বামীর সাথে সীতার ঝগড়া। সীতার স্বামী সীতাকে আর ঘরে নিতে চায় না। কারণ সীতা
এখন অসূয়া। সীতা কিছুতেই বোঝাতে পারে না, বখাটে ছেলেরা তার শরীর পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখেন নি। রাতভর কান্না । স্বামী কোন
কথাই মানতে চাইলনা । সীতাকে এখন অগ্নী পরীক্ষাই দিতে হবে । পরদিন রাতে রান্নাঘরে
সীতা তার শরীরে নিজেই আগুন ধরিয়ে দিল ।
সীতার নাম মাহাত্ম্য
সীতাকে লংকার রাজা রাবণ অপহরণ করে
নিয়ে গেলে তাকে উদ্ধার করতে রাম,লক্ষণ,হনুমানসহ বিশাল বাহিনী লংকা আক্রমণ
ও ধ্বংস করে। সীতাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেও পরবর্তীতে রামচন্দ্রের অযোধ্যা রাজ্যের
প্রজারা সীতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সীতার চরিত্রের পবিত্রতা প্রমাণের জন্য
রাম অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করেন। অগ্নিপরীক্ষার অংশ হিসাবে সীতাকে অগ্নিকুণ্ডে
প্রবেশ করতে হয়। সীতা সতীসাধ্বী হলে আগুন তার কোনো ক্ষতি করবে না,এই ছিলো সবার বিশ্বাস। অগ্নি
পরীক্ষার মাধ্যমে সীতার চরিত্রের পবিত্রতা প্রমাণ হলে রামচন্দ্র সীতাকে ঘরে
ফিরিয়ে নেন। কিন্তু পরবর্তীতে আবারও সীতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন রাম
সীতাকে আবারও বনবাসে পাঠান। সেখানে বাল্মিকী মুণির আশ্রমে সীতা আশ্রয় পান। এর
কিছুদিন পরেই সীতার দুই পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। লব ও কুশ নামের দুই পুত্র সন্তান
বড় হওবার পরে রাম একবার শিকার করতে বনে গেলে রামের সাথে পুত্রদের দেখা হয়। তখন
আবারও সীতার চরিত্র নিয়ে প্রজাদের নিন্দা শুরু হয়। এতে লজ্জা ও ক্ষোভে সীতা
পাতালে প্রবেশ করেন।
এরপর থেকে কোনও মা-বাবাই তাদের মেয়ের নাম সীতা রাখেন না।
দুপুর মিত্র
রাধামঙ্গল
রাধার জন্ম:
পাঠক বিশ্বাস করেন আর নাই করেন এই
রাধার জন্ম এইভাবেই। একবার বিষ্ণু রম্যবনে প্রবেশ করে রমণ ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ফলে
কৃষ্ণের ডান অংশ থেকে কৃষ্ণমূর্তি
ও বাম অংশ থেকে রাধা মূর্তি প্রকাশ পায়। রাধা কৃষ্ণকে কামাতুর দেখে তাঁর দিকে অগ্রসর
হন। রা অর্থ লাভ এবং ধা অর্থ ধাবমান। ইনিই অগ্রসর হয়ে কৃষ্ণকে লাভ করেছিলেন বলে- এঁর নাম হয়েছিল রাধা।
পৃথিবীতে পা পড়ল রাধার।
বলুন – জয় রাধা।
রাধার
কিশোর বেলা:
এ পাড়া থেকে ও পাড়া ঘুরে বেড়ায়
রাধা। রাধার কথার শেষ নেই। রাধার জানার শেষ নেই। রাধার আকুল হওয়ার, বিহ্বলিত হওয়ার শেষ নেই। মা পারেন
না রাধাকে বোঝাতে, রাধাই বরং মাকে বোঝান। পাড়ার সমস্ত
কাকীদের সাথে রাধার খাতির। রাধা এক্কা দুক্কা খেলে খেলে পার করে দেয় বেলা। রাধা
দুপুর বেলা কোথায় খাওয়া-দাওয়া করে কেউ জানে
না। একবার এ বাড়ি তো,কাল অন্য বাড়ি। রাধা ছুটে চলে,নিজের মত,নিজের উচ্ছ্বাসে। সমস্ত পাড়া
রাধাময়। সমস্ত পাড়াই রাধা। সমস্ত পাড়াই
রাধাময়।
বলুন – জয় রাধা।
রাধার
রূপের বর্ণনা:
কালো রাতের তারা হাসাহাসি করে রাধার
চুলে। রাধার হাসিতে হেসে ওঠে দেবকুল। রাধার মসৃন হাতে স্পর্শে জেগে ওঠে সবুজ ঘাস।
রাধার চোখে চোখ রেখে কত দেবতা হয়ে যায়
অজ্ঞান। রাধার আঙ্গুল যেন কচি ঘাসের লতা। রাধার কুচযুগলে তারারা সুশোভিত। নাভি যেন
এক ফোটা শিশির। রাধার কথা সুরের মালায় গাথা অসংখ্যা শব্দ।
বলুন – জয় রাধা।
রাধার
কলেজ গমন ও দেবতাদের উল্লাস ও সহপাঠীদের হত্যা-ধর্ষণ:
প্রতিদিন কলেজে যায় রাধা। অনেক পড়তে
হবে তার। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে বাড়ির সকালের সমস্ত কাজ শেষে রাধা যায় কলেজে।
কলেজে রাধার প্রেমে পড়ে আছে সমস্ত ছেলেরা।
একবার দেখামাত্র কেউ চোখ ফেরাতে পারত না। কেউ ফেরাতে পারে না নিজেদের মুখ। রাধা
হাসে আর হাসে। তার হাসিতে গড়িয়ে পড়ত সমস্ত জগত। একদিন বাড়ি ফেরার পথে সেই রাধাই ধর্ষিত হয় সহপাঠী দ্বারা। শুধু
ধর্ষণ নয়,ধর্ষণ করে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে
যায় সহপাঠীরা।
বলুন – জয় রাধা।
নারদ
মুনীর কৃষ্ণের কাছে বিচার ও দেবতাদের ক্ষোভ:
এই ঘটনায় কেঁপে ওঠে দেবতালয়। নারদ
মুনী বিচার দেন কৃষ্ণকে। ঘোর কলি ঘোর কলি। কৃষ্ণ- এ রাধার কেমন অবতার। কৃষ্ণ ক্ষেপে ওঠেন। কৃষ্ণের লাল চোখ থেকে বের হতে থাকে
লাভা। সেই লাভায় কাঁপতে থাকে পুরো পৃথিবী।
পৃথিবীবাসীর
মুখে রাধা রাধা নাম:
পুরো এলাকা থেকে আরেক এলাকা, পুরো পৃথিবীতে
চাউর হয়ে যায় এই ঘটনা। লোকজন হায় হায় করতে থাকে। লোকজন হায় হায় বলতে থাকে। মানুষের
চোখে আর ঘুম আসে না। এ রাধার কি হল। লোকজন বলতে লাগল,রাধার সেই সব সহপাঠিরা,যারা রাধাকে ধর্ষন করে হত্যা করেছে, কেউ আর বাঁচতে পারি নি। সেদিন রাতেই
মদ খেয়ে বিষক্রিয়ায় মারা যায় তারা।
বলুন – জয় রাধা।
রাজন নন্দী
‘আমি করি। সব মানুষই
আদতে বহুগামিতায় বিশ্বাস করে। দেখে শুনে এরকমই মনে হয় আমার। তবে অন্যরা আমার থেকে আলাদা।
কারন সাধারনত কেউ এ বিষয়ে স্টেটমেন্ট দিয়ে বেড়ায় না’। মনের ভাব লুকানোর
কৌশল আমার জানা নেই। অনেকেই মনের ভাব লুকিয়ে সুন্দর করে হাসতে জানেন। আমি পারি না। আমার চেহারায় নিশ্চয়ই অসমর্থন ফুটে উঠেছিল। বুঝতে পেরেই
কিনা কে জানে, তিনি একটু থামলেন। খানিক পরেই, যেন বোঝাচ্ছেন, তেমনি সহজ ঢঙ্গে শুরু
করলেন, ‘আরে, আমাদের সমাজে তো এই
ভাবনাটারেই কোন প্রশ্রয় দেয়া হয়
না। তাই না? এই ধর আমাগো সংস্কৃতি–শিক্ষা। সেইখানেও তো
এই ভাবনাটা রীতিমত ব্রাত্য।
কিন্তু তারপরেও তো আমরা ভাবি। যখন আমরা নিজের সাথে একলা হই তখন ভাবি। তখন ঐ সংস্কারের শিকল
কিছুটা আলগা হয়। মগজের অলিগলিতে রতি বাসনার নানা চোরা স্রোত আমাগো সিক্ত করে। কি মিয়া করে না?’
আমি, হ্যা বা না দুটোই হতে
পারে ধরনের হাসি দিলাম। আমার স্টকে নানা ধরনের হাসি আছে। হাসিদের নামও আছে। এই হাসিটার নাম ‘কৈতব হাসি’। হাফ বোতল স্কচের
প্রভাবে জাফর ভাই তখন সপ্তম আসমানে। কৈতব হাসি তাকে বিশেষ বিচলিত করল না। তিনি অবিচল ভাবে বলতে
লাগলেন, ‘কৈশরে, মহল্লার এক বন্ধুর
মুখে প্রথম শুনছিলাম। তারই নারী সঙ্গের কথা। নিষিদ্ধ পল্লীতে তার অভিযানের গপ্প। আমর গা ঘিনঘিন
করছিল। নিছক শরীরের জন্য কোন নারীর কাছে যাওয়াটাকে আমার মনে হইছিল রুচিহীন। আমার কিন্তু এখনও
তাই মনে হয়’।
কথা শেষ হতেই, ষষ্ঠ পেগে শেষ চুমুক
দিলেন জাফর ভাই। গ্লাসটাকে পাশের টেবিলে রাখলেন। রকিং চেয়ারটায় ঘাড়টা রেখে চোখ
বুজলেন। মৃদু দুলতে লাগলেন। কিছুটা বিরতি। আমি আমার দ্বিতীয় পেগটা ঢাললাম। আমার কি এখন কিছু বলা
উচিত? এই যে আমি কখনও একা
আবার কখনও দলবল নিয়ে জাফর ভাইয়ের মদ ধংস করতে আসি। অন্তত সেই খাতিরে তো কিছু বলা উচিত। কি বলব? আজকের আলোচনার
প্রসঙ্গটা কেন শুরু হল?
কোন দিকে
যাচ্ছে? আমার শালা কোন ধারনাই
নেই। আষাঢ়ের বৃস্টির মত আ কা শুরু হয়ে গেছে। আজ মনে হয় জাফর ভাইকে
কথায় পেয়েছে। হঠাৎ , চোখ না খুলেই জাফর
ভাই শুরু করলেন, ‘বুঝলা, মেয়েগো গভীর চোখ, নদীর মতন চুল আমারে
টানে। নারীর শরীরের গন্ধ
আমারে মদির করে। যে কোন প্রেমিকের মতই আমি নারীর রুপের তারিফ করি। কিন্তু সারাটা জীবন আমার
প্রেমিকাদের কাছে আমি অন্যরকম কিছু চাইছি’। বলে, ‘আমার দিকে তাকালেন।
যেন যাচাই করছেন। আমি বলতে চাইলাম, কি চেয়েছেন? তিনি আমাকে কোন
সুযোগ না দিয়ে, আবার শুরু করলেন, খালি শরীরের জন্য কোন
নারীরে কামনা করাটা আমি ঘেন্না করি। চাতক যেমন মেঘের কাছে যায়। দলছুট হরিণ যেমন যায়
পাহাড়ি ঝরনার কাছে। নারীর কাছে আমি সেইরকম তৃষ্ণা নিয়াই যাই’। এই পর্যন্ত বলে, জাফর ভাই বাথরুমে
গেলেন।
প্রায় চার বছর হল
আমাদের পরিচয়। উনি বয়সে আমার চেয়ে প্রায় এক যুগেরও বড়। কিন্তু আমরা প্রায় বন্ধু। প্রায় বলছি, কারন তার প্রবল
ব্যাক্তিত্বের কাছে আমি খানিক কোনঠাসা। প্রায় সবসময়ই তিনি বক্তা এবং আমি স্রোতা। তবে
মদ খেলে তিনি অনেক সহজ হয়ে উঠেন। এবং অদ্ভূত কারনে তার প্রিয় গালীগালাজ একদম ভুলে যান। তখন
ফরাদ মহাজনের মতন চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন। জাফর ভাই আবার মহাজন সাহেবের জীবনাচরনের প্রবল
সমর্থক। এই তো সেদিন। শাহবাগে
তখন কেবল যুদ্ধাপরাধ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। জাফর ভাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সাথে আমরাও। ক’দিন বাদেই দেখি জাফর
ভাইয়ের কোন খবর নাই। কেন ? কারন ফরাদ মহাজন এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে
ফতোয়া দিয়েছে। অমনি জাফর ভাইও হাত ধুঁয়া ফেললেন। মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছিল তার উপরে। তবে এই
শীতের দেশে কয়েকজন মাত্র বাঙ্গালী থাকি – সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে সময় লাগে নি ।
স্টকহোমে আজ মাইনাস
চার। এমন শীতে সব কিছুই জমে যায়। বাথরুমের
দরজা খুলল। আমি তাকিয়ে দেখি, জাফর ভাই বাথরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। সাদা লুঙ্গি আর ফতুয়া। আধপাকা চুল ভর্তি
মাথা । বললাম, বস্ ঠিক আছেন তো ? তিনি
আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হাসলে উনার চোখের নীচের চামড়াগুলো খানিক কুচকে একটা
বিচিত্র মুখভঙ্গি হয়। আমি তার
হাসির নাম দিলাম, ‘ভেংচি হাসি’। নামটা দিয়েই আমার ভীষন হাসি পেল। একটা নাম গোত্রহীন জেনুইন
হাসি। স্কচে ধরছে আমারে!
‘কি বল মিয়া! ছয় পেগে
জাফর আলমের কিছ্ছু হয় না। তুমি তো এখনও দুই পেগ শেষ করতে পারলা না’। বললাম, বস্ বেশী খাওয়া যাবে
না। বউ রাগ করে। পরে সারারাত সোফায় থাকতে হইব। যেন আমার কথা উড়িয়ে
দিলেন, সেই ভঙ্গিতে শূন্যে
হাত ছুড়লেন জাফর ভাই। ‘তোমরা মিয়া বউরে যে
কেন এত ভয় পাও! বিয়েটারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভাব কেন? একটাই তো জীবন। ও তোমাদের তো আবার
পূণর্জন্ম আছে। তা পরের জন্মে হাতি – ঘোড়া কি না কি হবা। এই জীবনটাই একটু চেখে দেখ না!’ বলে, সাত নাম্বার পেগ
নিলেন। আমি বললাম, ভাই! আজকে আর নাই
খাইলেন। তিনি আবার সেই ভেংচি হাসি দিলেন। বললেন, ‘শোন পিয়াল, আমার বিয়ের পরে পরেই, আমার এক পুরানো প্রেমিকার সাথে প্রথম সেক্স হইছিল। সেও তখন বিবাহিত। যেন
বিয়ের পরেই আমরা দুজনে টের পাইলাম যে আমরা কি হারাইছি! সেই হারানো আর তারে খুঁজে পাওয়াটাই
প্রেম। শরীরটা উপরি। তোমারে যেমন বলতাছি, তেমনি আমার বউকেও সব বলছিলাম । কারণ আমি কোন
লুকোচুরির মধ্যে থাকতে চাই নাই। দেখ, বিয়েটা কিন্তু টেকে নাই। কিন্তু আমি টিকা আছি। আমার প্রেম টিকা আছে।
আচ্ছা যাও তুমিই বল, বিয়েটা আসলে কি ?’
আমার মেজাজে তখন
স্কচের মৌতাত। তেতে উঠছি। বললাম, জানিনা বস্। তবে যারে তারে লাগানোর মধ্যে আমি কোন ক্রেডিট দেখি
না। আদিম সমাজেও মানুষ তাই করত। সভ্যতা মানুষের জীবন যাপনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মত
যৌনাচরণেও পরিমিতি বোধ যোগ করছে। বহুগামিতা কোন আধুনিকতা না, আদিমতা । আর পূণর্জন্ম কেন আমি তো
বস্ কোন ধর্মেই বিশ্বাস করি না। জাফর
ভাইয়ের কোন প্রতিক্রিয়া নাই। কেবল চোখটা আবার বন্ধ করলেন। আস্তে আস্তে সাত নাম্বার পেগটা শেষ করলেন। ‘তোমাদের নিয়া এই একটা
সমস্যা। তর্ক করতে শিখলা না। খালি রাইগা যাও। কিছু হইলেই ‘আমি নাস্তিক’, ‘প্রগতিশীল’ এই বইলা আলগা ভাব নাও।’ বললাম, বাদ দ্যান। কালকে
এগারটায় মানব বন্ধন আছে । যাবেন ? জাফর ভাই একেবারে
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। ‘কিসের মানব বন্ধন? শাহবাগটা নাস্তিকদের
আড্ডা হইছে একটা। কান্ড জ্ঞানহীন
সব পুলাপাইন। অন্যের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়া মজা নেয়। সরকারের ব্যাকিংয়ে সব লাফাইতাছে । সব শালা ভারতের দালাল।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
মনে মনে বললাম, লে হালুয়া! মুখে
বললাম, জাফর ভাই, যাই। আপনার নেশা
কাটলে আর একদিন কথা বলা
যাবে। জাফর ভাই আবার ‘ভেংচি হাসি’ দিলেন। সেই উপলক্ষ্য
উপেক্ষা করে আমি ততক্ষণে পথে।
অরিন্দম চন্দ্র

আধি-ভৌতিক
কয়েকদিন আগে বক্রেশ্বর গিয়েছিলাম,তারাপীঠ থেকে সিউড়ী হয়ে।শ্মশানের
ধারে বাসুদেব মিশনে ভোলাবাবা আমাদের সেবা-যত্নে অতন্দ্র
প্রহরী।যাইহোক,দুপুরে ওনাদের চাষের মোটা চালের ভাত,উচ্ছে চচ্চড়ী,কচু দিয়ে মুসর ডাল,সজনে ডাঁটা আলু কুমড়োর তরকারী,মোচার ঘন্ট আর টমেটোর চাটনী খেয়ে
জব্বর একটা ভাতঘুম দিলাম।বিকালে চা খেয়ে ঘুরতে বেরিয়ে আবিস্কার করলাম যে গোটা
টাউনে আমি একা পর্যটক।
ফেরার সময় অন্ধকার পথ দিয়ে শ্মশানের
পাশ দিয়ে আসতে বেশ গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।আশ্রমের কাছে পৌঁছবার আগেই লোডশেডিং।সিগারেট
ভিতরে মানা,তাই আরেকটু আগিয়ে গেলাম...গোটা এলাকা অন্ধকার,ঝিঁ-ঝিঁ পোকার অবিরাম ডাক,আকাশে আধ-ফালি চাঁদ,পাশে
বক্রেশ্বর নদী,ইতিউতি দু-একটা মড়া পোড়ানোর পর
নিভুনিভু চুল্লী আর অন্ধকার পটভূমিতে অনেকদূরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আলোকিত চুল্লী,বেশ কবি
কবি ভাব এল,প্রেমিকার চাঁদমুখ ভেবে পিছন ঘুরতেই
শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত নামল।অন্ধকার এক দাড়িগোঁফের জংগল নিয়ে ক্ষয়াটে একটা চেহারা,পরণে হাঁটু ছাড়ানো সাদা আলখাল্লা,ভাঁটার মত চোখ...বড় বড় দাঁত......
সিগারেটের
ধোঁয়ায় কাশতে কাশতে খেয়াল করলাম ভোলাবাবার পোষা ভুটুর তর্জন-গর্জনে পাগলটা দৌড়
দিয়েছে...
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)