গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

নীহার চক্রবর্তী




সেই তিমিরে 

জয়দেবপুরে তৈরি হচ্ছিলো সুবিশাল রাধাকৃষ্ণ মন্দির । মন্দিরের চুড়ার কাজ চলছিলো সেদিন । হঠাৎ এক মিস্ত্রী ওপর থেকে নীচে পড়ে গেলো । সময় নিলো না । মারা গেলো সে । চারদিকে হায়-হায়ধ্বনি দেখা দিলো । কেউ মিস্ত্রীকে চেনে না । শেষমেশ অন্য মিস্ত্রীরা বলল,’’এর নাম লিয়াকত । শুধু মিস্ত্রী নয় । শিল্পী ।‘’
লিয়াকতের নাম কানে আসতেই অনেকেরই মাথা গরম হয়ে গেলো । তাদের সদ্য শোক আগুনে জ্বলে গেলো । পাপ আর ব্যাভিচার বলে চারদিকে কথা উঠলো । প্রায় সবার মুখে একটাই কথা,‘’মুসলমানের ছেলে কীভাবে মন্দিরের কাজ করে ? এ যে পাপ । সে পাপের ফল ফলেছে ।‘’ কিন্তু পাপটা কার ? লিয়াকতের বুঝি ? জয়দেবপুরের মানুষের ধারণা তাই । সেইসাথে আর একজনের । প্রধান মিস্ত্রীর ।
চারদিকের চাপে মন্দির-কমিটি চেপে ধরল প্রধান মিস্ত্রী সুকুমার মিস্ত্রীকে । কমিটির পক্ষ থেকে তাকে বলা হল,’’আমাদের আগে বলনি কেন ? কোন সাহসে তুমি লিয়াকতকে কাজে লাগিয়েছিলে ? এ যে মহাপাপ । মুসলমানের ছেলের পা পড়েছে মন্দিরে । আর সে পাপেই...’’ একথা শুনে সুকুমার অবাক হল খুব । কিছুক্ষণ ভেবে নিলো । তারপর সে উত্তর দিলো বিজ্ঞের সুরে,’’শিল্পীর আবার জাতধর্ম কী ? শিল্পী শিল্পীই । আমরা তাই ভাবি । লিয়াকতের মতো বড় শিল্পী এ তল্লাটে আর কোথায় ? তাই ওকেই নিয়েছিলাম চূড়ার কাজে । তাছাড়া লিয়াকত ছাড়াও বসির আর নিজাম আগে কাজ করে গেছে এখানে । পাপের কথা বলবেন না। সব নিয়তি ।‘’
সুকুমারের কথা কেউ কানেই নিলো না । তাকে বলল,’’যা হওয়ার আগে হয়ে গেছে । এখন মন্দিরের চুড়া যেটুকু হয়েছে ভেঙে দাও । আর মুসলমান মিস্ত্রী এনো না ।‘’ সুকুমার সঙ্গে-সঙ্গে মুখের মতো জবাব দিলো তাদের,’’আমি এ কাজ করতে পারছি না । অন্য মিস্ত্রীদের দেখুন । আর যদি নেন,তবে মুসলমান মিস্ত্রীতে ভরিয়ে দেবো দল । জানবেন ওরাই সবচেয়ে নিপুন শিল্পী । আমরা শিখি ওদের কাছ থেকে ।‘’ ,
আর সেখানে দাঁড়ালো না সুকুমার মিস্ত্রী । বাড়ি ফিরে তার মিস্ত্রীদের বলল,’’ওখানে আর কাজ নয় । ওখানে পাপীরা সব মন্দির বানাচ্ছে । আমরা কাজ করতে থাকলে আমাদের পাপ দিনে-দিনে বাড়বে । তোমরা কি তাই চাও ?’’ সদলে সবাই বলে উঠলো,’’একদম না । আপনি আমাদের ভগবান । যেখানে যেতে বলবেন,সেখানেই যাবো আমরা ।‘’ মিস্ত্রীদের কথা শুনে সুকুমারের চোখ জল ভরে গেলো । হঠাৎ তার মনে হল লিয়াকতের কুলখানিতে যেতে হবে । সবাইকে সে কথা মনে করিয়ে দিতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো ।
সেই অভিশপ্ত মন্দিরের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে সুকুমার আর তার মিস্ত্রীরা বারবার খুঁজতে থাকলো সদা হাস্যময় মুখ লিয়াকতকে । তাকে খুঁজতে খুঁজতে সবার চোখ জলে ঝাপসা হয়ে এলো । সুকুমার অস্ফুট-স্বরে তাদের বলল তখন,’’ওই পাপের দিকে কেউ আর তাকাস না। লিয়াকতের আত্মা শান্তি পাবে না তাহলে ।‘’ তার কথা শুনে মিস্ত্রীদের মুখে তখন অনাবিল হাসি খেলে গেলো । তারা বলল সুকুমারকে,’’একদম তাই । আমাদের এ এক ভুল । অনিচ্ছায় কিছু পাপ হল । কুলখানিতে গিয়ে সে পাপ দূর করে আসা যাক ।
সেই মন্দিরের কাজ এখন বন্ধ । সুকুমার মিস্ত্রী তা জেনে তার দলের মিস্ত্রীদের প্রায় বলে, দেখিস তো,কাঠের মালা গলায় দেওয়া মিস্ত্রী পাওয়া যায় কিনা । তারা শুনে হেসে মরে । বলে সুকুমারকে, ‘এ তল্লাটে মিলবে না। বৃন্দাবন থেকে আনা যেতে পারে । এবার শুনে সুকুমার মিস্ত্রী হাসতে হাসতে পেটে হাত দেয় অনবরত