জয়দেবপুরে
তৈরি হচ্ছিলো সুবিশাল রাধাকৃষ্ণ মন্দির । মন্দিরের চুড়ার কাজ চলছিলো সেদিন । হঠাৎ
এক মিস্ত্রী ওপর থেকে নীচে পড়ে গেলো । সময় নিলো না । মারা গেলো সে । চারদিকে ‘হায়-হায়’
ধ্বনি দেখা দিলো । কেউ মিস্ত্রীকে চেনে না । শেষমেশ অন্য
মিস্ত্রীরা বলল,’’এর নাম লিয়াকত । শুধু মিস্ত্রী নয় ।
শিল্পী ।‘’
লিয়াকতের
নাম কানে আসতেই অনেকেরই মাথা গরম হয়ে গেলো । তাদের সদ্য শোক আগুনে জ্বলে গেলো ।
পাপ আর ব্যাভিচার বলে চারদিকে কথা উঠলো । প্রায় সবার মুখে একটাই কথা,‘’মুসলমানের
ছেলে কীভাবে মন্দিরের কাজ করে ? এ যে পাপ । সে পাপের ফল
ফলেছে ।‘’ কিন্তু পাপটা কার ? লিয়াকতের
বুঝি ? জয়দেবপুরের মানুষের ধারণা তাই । সেইসাথে আর একজনের
। প্রধান মিস্ত্রীর ।
চারদিকের
চাপে মন্দির-কমিটি চেপে ধরল প্রধান মিস্ত্রী সুকুমার মিস্ত্রীকে । কমিটির পক্ষ
থেকে তাকে বলা হল,’’আমাদের আগে বলনি কেন ? কোন সাহসে তুমি
লিয়াকতকে কাজে লাগিয়েছিলে ? এ যে মহাপাপ । মুসলমানের
ছেলের পা পড়েছে মন্দিরে । আর সে পাপেই...’’ একথা শুনে
সুকুমার অবাক হল খুব । কিছুক্ষণ ভেবে নিলো । তারপর সে উত্তর দিলো বিজ্ঞের সুরে,’’শিল্পীর আবার জাতধর্ম কী ? শিল্পী শিল্পীই ।
আমরা তাই ভাবি । লিয়াকতের মতো বড় শিল্পী এ তল্লাটে আর কোথায় ? তাই ওকেই নিয়েছিলাম চূড়ার কাজে । তাছাড়া লিয়াকত ছাড়াও বসির আর নিজাম
আগে কাজ করে গেছে এখানে । পাপের কথা বলবেন না। সব নিয়তি ।‘’
সুকুমারের
কথা কেউ কানেই নিলো না । তাকে বলল,’’যা হওয়ার আগে হয়ে গেছে । এখন মন্দিরের চুড়া
যেটুকু হয়েছে ভেঙে দাও । আর মুসলমান মিস্ত্রী এনো না ।‘’ সুকুমার
সঙ্গে-সঙ্গে মুখের মতো জবাব দিলো তাদের,’’আমি এ কাজ করতে
পারছি না । অন্য মিস্ত্রীদের দেখুন । আর যদি নেন,তবে
মুসলমান মিস্ত্রীতে ভরিয়ে দেবো দল । জানবেন ওরাই সবচেয়ে নিপুন শিল্পী । আমরা শিখি
ওদের কাছ থেকে ।‘’ ,
আর
সেখানে দাঁড়ালো না সুকুমার মিস্ত্রী । বাড়ি ফিরে তার মিস্ত্রীদের বলল,’’ওখানে আর কাজ
নয় । ওখানে পাপীরা সব মন্দির বানাচ্ছে । আমরা কাজ করতে থাকলে আমাদের পাপ দিনে-দিনে
বাড়বে । তোমরা কি তাই চাও ?’’ সদলে সবাই বলে উঠলো,’’একদম না । আপনি আমাদের ভগবান । যেখানে যেতে বলবেন,সেখানেই যাবো আমরা ।‘’ মিস্ত্রীদের কথা শুনে
সুকুমারের চোখ জল ভরে গেলো । হঠাৎ তার মনে হল লিয়াকতের কুলখানিতে যেতে হবে ।
সবাইকে সে কথা মনে করিয়ে দিতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো ।
সেই
অভিশপ্ত মন্দিরের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে সুকুমার আর তার মিস্ত্রীরা বারবার খুঁজতে
থাকলো সদা হাস্যময় মুখ লিয়াকতকে । তাকে খুঁজতে খুঁজতে সবার চোখ জলে ঝাপসা হয়ে এলো
। সুকুমার অস্ফুট-স্বরে তাদের বলল তখন,’’ওই পাপের দিকে কেউ আর তাকাস না। লিয়াকতের
আত্মা শান্তি পাবে না তাহলে ।‘’ তার কথা শুনে মিস্ত্রীদের
মুখে তখন অনাবিল হাসি খেলে গেলো । তারা বলল সুকুমারকে,’’একদম
তাই । আমাদের এ এক ভুল । অনিচ্ছায় কিছু পাপ হল । কুলখানিতে গিয়ে সে পাপ দূর করে
আসা যাক ।
সেই
মন্দিরের কাজ এখন বন্ধ । সুকুমার মিস্ত্রী তা জেনে তার দলের মিস্ত্রীদের প্রায় বলে, দেখিস তো,কাঠের মালা গলায় দেওয়া মিস্ত্রী পাওয়া যায় কিনা । তারা শুনে হেসে মরে ।
বলে সুকুমারকে, ‘এ তল্লাটে মিলবে না। বৃন্দাবন থেকে আনা
যেতে পারে । এবার শুনে সুকুমার মিস্ত্রী হাসতে হাসতে পেটে হাত দেয় অনবরত
।