লন্ডনের
ফ্লাইটটা প্রায় দুঘন্টা দেরিতে এলো আজ । হাতঘড়িটা দেখলেন অনিমেষ । সকাল ছটা । লাগেজ নেওয়ার জন্য
কয়েক মিনিটের অপেক্ষা । এয়ার পোর্টে গাড়ি পাঠাতেও বারণ করেছেন,
ট্যাক্সি নিয়েই চলে যাবেন । আসলে কয়েক ঘন্টার জন্য আসা । আজ রাতের ফ্লাইটেই যেতে হবে
আবুধাবি । ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকেই কয়েকটা বাংলা খবরের কাগজ কিনে ট্যাক্সিতে
চাপলেন ।
ডাক্তার
অনিমেষ দত্ত , বেশ ব্যস্ত মানুষ । নামি সার্জেন , নিজের একটা নার্শিং হোম আছে
কলকাতা থেকে একটু দূরে বারাসাতে । জটিল অপারেশনের জন্য অনিমেষের বেশ নামডাক । কয়েক
বছর হ’ল, কলকাতার হৈ-হট্টগোল থেকে দূরে বারাসাতেই একটা চার কামরার ফ্যাটে চলে
এসেছেন । একমাত্র ছেলে আমেরিকায় পড়াশোনা করছে । শুধু স্ত্রী মাধুরীই জানতেন অনিমেষ
আজই ফিরছেন কয়েক ঘন্টার জন্য । স্ত্রী মাধুরীও কাল চেন্নাই চলে যাবে ছোট বোনের
কাছে । অনিমেষ সেরকম ব্যবস্থাই করে রেখেছেন ।
ফ্ল্যাটে
ঢুকে এককাপ কফি নিয়ে বসার ঘরে এলেন । গত দুতিন দিনের কাগজগুলো পড়া দরকার । আরাম
কেদারায় গা এলিয়ে দিলেন অনিমেষ । বিমান যাত্রার ধকল , রাত্রে প্রায় ঘুম হয়ইনি ।
কতক্ষণ গা এলিয়ে আছেন খেয়াল নেই । হঠাত ঘরে হাজির পুলিশ অফিসারের পোষাকে কে একজন ।
খুব ক্ষিণ চেনা চেনা লাগছে । ‘গুড মর্নিং ডাঃ দত্ত, আমি হারান হাজরা , এখানকার ওসি
, কয়েকটা কথা জানার ছিল ...’ বিরক্ত অনিমেষ বলে ‘দেখুন অফিসার, আমি এইমাত্র ফিরলাম
, আপনি যদি...’। অনিমেষকে শেষ করতে না দিয়েই হারান বলে ‘জানিতো স্যার আপনার ফ্লাইট
আজ দু ঘন্টা লেট করেছে । এয়ার ট্রাভেলও ট্রেণের মত হয়ে গেছে আজকাল, কি বলেন ?’ বলেই হাসলো এক অদ্ভুত স্বরে । এবার হারানের
হাসিটা যেন কেমন চেনা চেনা লাগল, মনে করতে চেষ্টা করল অনিমেষ । বললো ‘আমি খুব
ক্লান্ত অফিসার’ । এবার একটু রুক্ষ হারান, বলে ‘পুলিশতো আপনার নার্শিং হোমের
ডাক্তার নয় স্যার যে আপনি ঠিক করে দেবেন কোন রোগীর কবে অপারেশন হবে’ ।
অনিমেষ
দৃশ্যত শান্ত । রাগের প্রকাশ নেই । রাত্রি ৯টায় ফ্লাইট । তারপর...
। অনিমেষ বলে আপনি বরং কাল আসুন অফিসার, এনি
টাইম অ্যাট ইওর কনভিনিয়েন্ট । সেই বিশ্রী হাসি হেসে হারান বলে ‘ ইয়ার্কি মারছেন
স্যার ! কালতো আপনার এই সময় ফ্লাইট নম্বর
থ্রী টু সিক্স ওয়ান’এ সিট নম্বর থ্রীবি তে সিটবেল্ট বেঁধে বসে থাকার কথা’ ! অনিমেষ
বুঝতে পারল – হারান হাজরা সুবিধের লোক নয় , বলে বেশ বলুন’।
-
ডাঃ দত্ত , আপনি বিন্দিয়া নামে
একটা মেয়েকে চিনতেন ? বয়স বছর ষোল সতেরো হবে ।
-
না তো । কিন্তু তার সঙ্গে আমার
কি সম্পর্ক ?
-
একটু মনে করার চেষ্টা করুন ।
তিনবছর আগে জামালপুর স্টেশন থেকে মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিলেন । তারপর আপনার ঘরে কাজের
মেয়ে হিসাবেই ছিল মাস তিনেক ।
-
হতে পারে । আমার মনে নেই । কি
করেছে মেয়েটি ?
-
না , কিছুই করেনি , আর করবেও না
। তা সেই মেয়েটি গেল কোথায় মিঃ দত্ত ? আপনার ঘরেতো মাস তিনেক কাজ করেছিল ? তারপর ?
-
তা করেছিল , তারপর চলে গেছে
এইটুকুই বলতে পারি ।
-
বাঃ , ফাইন ! জামালপুর থেকে
সঙ্গে করে আনলেন , ঘরের কাজে লাগালেন , তারপর আর খবর রাখলেননা ?
-
কাজের মেয়েরা এরকমই হয় , কাজের
মেয়েরা বেশিদিন টেকেনা ।
কথাটা
যেন লুফে নিলেন হারান হাজরা , ‘একটু ভুল বললেন স্যার, বলুন কেউই টেকেনা । আর এখান
থেকেইতো আমার গল্পটার শুরু’ । আবার সেই গা জ্বালানো হাসি । হারান বলে চলে –
‘ওয়েল। আমার জিজ্ঞাসা আপাতত শেষ । আপনার কাল রাত নটার ফ্লাইট তো ? হ্যাঁ , ভালো
কথা সেইবিন্দিয়া নামের মেয়েটা মারা গেছে মাস তিনেক আগে । বডি পাওয়া যায়নি , আশা
করছি পেয়ে যাবো’ । একটু চমকে উঠলেন অনিমেষ । বডি পাওয়া যায়নি , আবার বলছে পেয়ে
যাবে ! দরজা বন্ধ করার একটা জোর আওয়াজে সচকিত হলেন অনিমেষ । হারান চলে গেছে । হারান হয়তো একটু জোরেই দরজাটা বন্ধ করেছিল
। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল অনিমেষ ।
খবরের কাগজটা কোল থেকে নীচে পড়ে গেছে, প্রথম পৃষ্ঠার বড় বড় অক্ষরে একটা খবরের
হেডিং বেশ পড়া যাচ্ছে ।
অনিমেষ
প্রথমেই কাজের মেয়েটিকে ডেকে ধমক দিলেন , কেন তাকে খবর না দিয়ে হারানকে সরাসরি
তা্র ঘরে পাঠিয়ে দিল । স্ত্রী মাধুরী চেঁচামেচি শুনে ছুটে এলো জানতে চাইলো কি
ব্যাপার ? । বিরক্ত অনিমেষ বলে ‘একজন পুলিশ অফিসার সোজা আমার ঘরে চলে এলো কি করে ?
তাকে বাইরের ঘরে বসিয়ে আমাকে খবর দিতে পারতে তো । সব নিয়ম কানুল বদলে গেল নাকি ?’
মাধুরী আকাশ থেকে পড়েন, বলেন ‘পাগল হয়ে গেলে নাকি ? এখনো বাইরের কোলাপসিবল গেট
তালা বন্ধ, পুলিশ অফিসার কি পাচিল ডিঙ্গিয়ে আসবে নাকি ?’ অবাক হন অনিমেষ তাহলে
সত্যিই স্বপ্ন দেখেছেন । কিন্তু হারান হাজরার প্রতিটি বাক্যইতো মনে আছে , এমনকি তার
গা জ্বালানো হাসিটাও ।
অনিমেষ
বন্ধু সঞ্জয় সেনকে ফোন করে । সঞ্জয় এখানকার থানার ওসি কি
বদলি হয়ে গেছে ? হারান হাজরা নামে কাউকে চিনিস নাকি ? এখানে থানার ওসি হয়ে এসেছে ? সঞ্জয়
জানাল ‘নাতো বিশ্বজিত চাকলাদারইতো আছে , গতকালইতো দেখা হলো । খুব টেন্সড , কি একটা
কেস’এ ওপরের নাকি দারুণ চাপ । তা কি ব্যাপটা, সাত সকালে পুলিশের খোঁজ নিচ্ছিস’ ? ‘না,এমনি,
পরে বলবো’ বলে ফোনটা রেখে দিল অনিমেষ ।
অনিমেষ একবার ভাবলো পাড়ার ছেলেদের কাউকে
জিজ্ঞাসা করে । তারপর ভাবলো, না ওদের অনাবশ্যক কৌতুহল হতে পারে , বলতে পারে ‘ কি
হয়েছে স্যার ? চাঁদা চেয়েছে ? ডিটার্ব করেছে ? একবার বলুন স্যার, আমরা ঠিক খুঁজে
বের করে থোবড়া পালটে দেবো’ । পাড়ায় অনিমেষের যে খুব একটা পরিচিতি আছে তা নয় । তবে
দুর্গা পুজো কালিপূজোয় মোটা অঙ্কের চাদা দেয় তাতেই খুশি । কিসের ডাক্তার, কোথায় ডাক্তারি
করেন এসব জানার আগ্রহ তাদের বিশেষ থাকেনা । এবার কালিপূজোয় বস্ত্র বিতরণের
অনুষ্ঠানে থাকার জন্য পাড়ার ছেলেরা ধরেছিল । অনিমেষ জানিয়েছিল ‘না ভাই ঐ সময় আমি
সিঙ্গাপুরে থাকবো – একটা সেমিনার আছে’ । অবশ্য এ জন্য ত্রিশ হাজার টাকার একটা চেক
দিয়েছিল, ছেলেরা তাতেই খুশি ।
অনিমেষ মহীতোষ নন্দীকে ফোন করলো । মহীতোষ
এ আঞ্চলের বেশ কেউকেটা লোক, প্রভাবশালী রাজনীতিক । সে নাকি অনেক বিশ্বজিৎ চাকলাদার
, হারান হাজরাদের মত লোককে পকেটে রাখার ক্ষমতা রাখে । বয়সে প্রায় সম বয়সী হলেও অনিমেষ ওকে দাদা বলে । জিজ্ঞাসা
করল ‘মহীতোষদা, হারান হাজরা নামে কোন পুলিশ অফিসারকে চেনেন’ ?
মহীতোষ জানাল, ‘বিলক্ষণ চিনি , বছর পাঁচেক আগে বিশ্বজিতের আগে হারানইতো এখানে ছিল,
এখন বোধহয় প্রোমশনে লালবাজারে পোষ্টেড ।
তোমার মনে নেই ডাক্তার,
কালো ছিপছিপে ধরণের একটা ছোকরা , বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসে ...তুমিতো আমার সঙ্গে একবার
থানায় গিয়েছিলে কি একটা কাজে..., তা হঠাত হারানের খোজ কেন, এনি প্রবলেম’ ? ‘ না না
তেমন কিছু নয়’ বলে ফোনটা রেখে দিল অনিমেষ । এইবার মনে পড়ে গেল, সেদিনের সেই কালো
ছিপছিপে ছোকরাটা আর হারানের হাসি একই রকম । ছোকরাটা সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিল ‘আচ্ছা
স্যার, মানুষের দেহের কোন অঙ্গটা সবচেয়ে দামি, কিডনি নাকি মরে যাওয়ার পর তার
পুরো কঙ্কালটা ?’
অনিমেষ
আপ্রাণ চেষ্টা করছে স্বাভাবিক হবার । আসলে একটু আগে দেখা স্বপ্নটা ওকে তাড়িয়ে
বেড়াচ্ছে । নিশ্চিত ওটা স্বপ্নই । কিন্তু হারান হাজরা ওর স্বপ্নে হাজির হল কেন ?
সেতো অস্তিত্বহীন নয় ! দুপুরে খাওয়ার টেবিলে স্ত্রী মাধুরীকে জিজ্ঞাসা করলো,
বিন্দিয়া নামে সেই কাজের মেয়েটাকে তার মনে আছে কিনা । মাধুরীর মনে আছে, মাস তিনেক
মাত্র কাজ করেছিল । বললো ‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছেতো । বেশ ঠান্ডা মেয়ে ছিল ,তবে
মানসিক ভারসাম্য একটু কম ছিল, মাঝে মাঝে একা একা কাঁদত । তা তুমিইতো ওর বাবা মা’র
সন্ধান পেয়েছো বলে ওকে ওর দেশের বাড়িতে রেখে এলে । মাধুরী একটু অবাক হ’ল। এতোদিন
পরে সেই মেয়েটার কথা জিজ্ঞাসা করছে কেন অনিমেষ ! আশেপাসে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে
মাধুরীর তেমন কৌতুহল কোনদিনই ছিলনা । আর এখনতো মেয়েদের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনার মিছিল
মানুষকে উত্তেজিতও করেনা একটুও !
নিশ্চিত
হয়ে অনিমেষ বসার ঘরে গিয়ে কয়েকটা ফোন করল । অনেক কাজ , সময় কম । কাজের মেয়েটাকে
বলে দিল, ‘আমাকে না জিজ্ঞাসা করে কাউকে এঘরে পাঠাবিনা । শুধু অভিমন্যু সামন্ত এলে
আমার ঘরে পাঠিয়ে দিবি’ । অভিমন্যু সামন্ত – এ বাড়িতে অপরিচিত নয়, মাঝে মাঝেই আসে
। তার সঙ্গে অনিমেষের কি সম্পর্ক মাধুরীও জানেনা । মাধুরী
জানে অভিমন্যু অনিমেষের নার্শিংহোমের কোন কর্মচারী হবেওবা । আসলে অভিমন্যু এখানে
একটা মেয়েদের উদ্ধার আশ্রমের কাজকর্ম দেখাশোনা করে । গতবছরেই বোধয় , মাধুরী খরের
কাগজে দেখেছিল অভিমন্যুদের উদ্ধার আশ্রম থেকে দুটো মেয়ে নাকি পালিয়ে গিয়েছিল ।
মিনিট
পাঁচেক পরে দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকল অভিমন্যু সামন্ত । মুখ তুলে একঝলক দেখে নিয়ে
খবরের কাগজে মুখ নামালেন অনিমেষ । বললেন ‘তা চক্রব্যুহ থেকে বেরোতে পারবে,
অভিমন্যু সামন্ত’ ? থতমত খেয়ে যায় অভিমন্যু । এবার অভিমন্যুর দিকে চেয়ে বললো
‘গুপীনাথকে হোমে খাবার সাপ্লাইএর বরাতটা তুমিইতো দিয়েছিলে’ ? অভিমন্যু ঘাড় নাড়ে ।
অনিমেষ বলে বেশ । তা গুপীনাথ হোমের অফিস ঘরে মদের আড্ডা বসাবে , মেয়েগুলোকে রেপ
করবে এই বরাতটাও কি তাকে তুমি দিয়েছিলে’ ? আভিমন্যু স্থির । কয়েক মুহুর্ত পরে বলে
‘বাবাকে কাল রাত্রে তুলে নিয়ে গেছে স্যার’। অনিমেষ বিচলিত হ’ল কিনা বোঝা গেলনা ,
বলে ‘তাতো যাবেই, যুধিষ্ঠীরইতো সবার আগে স্বর্গে গিয়েছিল’ ! অভিমন্যু সঙ্গে সঙ্গে
উত্তর দেয় ‘হ্যাঁ স্যার, একটা কুকুর নাকি তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সত্যি নাকি
স্যার ?’ অনিমেষ অভিমন্যুর কথা গায়ে মাখলো কিনা বোঝা গেলনা ।
অভিমন্যুর
বাবা যুধিষ্ঠীর সামন্তই হোমের সুপারিন্টেনডেন্ট । বয়স হয়েছে । ছেলে অভিমন্যুই
কাজকর্ম দেখাশোনা করে । অভিমন্যু করিৎকর্মা, পাড়ার নেতাদেরও কাছের ছেলে । অনিমেষ
নিজেকে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করেছিল । কাগজে-কলমে হোমের মালিক মল্লিকা
রাধাকৃষ্ণাণকেতো আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা ! ঘড়ি দেখল অনিমেষ , পৌনে ছটা বাজে । ছটার
মধ্যে যাদের আসার কথা তারা এসে যাবে । তারপর রাত্রি সাড়ে নটায় আবুধাবির ফ্লাইট । এক
বান্ডিল নোট অভিমন্যুর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘তুমি কিছুদিন দেশের বাড়ি ঘুরে এসো
অভিমন্যু’ । ইতিমধ্যে অভিমন্যুর কাছ থেকেই জেনে গেছে অনিমেষ দিশারি উদ্ধারাশ্রমের
মাটি খুড়ে উদ্ধার হয়েছে ৬টি নরকঙ্কাল !
সন্ধ্যা
ছটার আগেই একে একে এসে গেলেন অনিমেষের নার্শিং হোমের সুপার ডাঃ কুজুর, অস্থি
বিশেষজ্ঞ ডাঃ সৌমেন অগ্নিহোত্রী, দিশারি উদ্ধারাশ্রমের ডাক্তার ক্ষেত্রপাল, আর
নামি ঠিকাদার ভারু এন্ড এসোসিয়েটের রাম প্রতাপ ভারু । ডাঃ ক্ষেত্রপাল ও
অগ্নিহোত্রী বেশ উত্তেজিত । ঘরে ঢুকেই বললো ‘আপনার একটা ভুল আমাদের সবাইকে ফাঁসিয়ে
দিল ডাঃ দত্ত । অনেকবার আপনাকে বলেছিলাম অভিমন্যুটাকে তাড়ান, শুনলেননা’ । ডাঃ
ক্ষেত্রপাল বেশ উত্তেজিত স্বরে বললো ‘গুপীনাথ ওই বোবা মেয়েটাকে রেপ না করলেতো কোন
ঝামেলাই হতনা , আর আপনারই কাছের ছেলে অভিমন্যুই গুপীনাথকে হোমে ঢুকিয়েছিল’ । ডাঃ
অগ্নিহোত্রী বললেন ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম ডাঃ দত্ত, কিডনি পর্যন্ত ঠিক আছে কঙ্কালের
ব্যাপারটা করবেননা । বিধ্বস্ত অনিমেষ শুধু শুনলেন, শান্ত স্বরে রামপ্রতাপ ভারুকে
জিজ্ঞাসা করলেন কেসটা কে দেখছে , বিশ্বজিৎ চাকলাদার ? ভারু জানাল ‘মাথা খারাপ
স্যার ? এ কেস বিশ্বজিতের কাছে থাকে ? কেস এখন লালবাজারে , এসিস্ট্যান্ট ডেপুটি
কমিশনার গোয়েন্দা, হারাণ হাজরার টেবিলে’। হারান হাজরার নামটা শুনে চমকে উঠলেন
অনিমেষ । ভোর বেলায় দেখা স্বপ্নটা মনে
পড়লো ।
ওদের
উত্তেজিত কথাবার্তার মাঝে মাধুরী কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি কেউ । অনিমেষ
জানতে চাইলেন ‘কি ব্যাপার তুমি ? কিছু বলবে’ ? মাধুরীর ছোট্ট উত্তর ‘না শুধু জানতে
চাইবো ছোট বোন মল্লিকাকে এই নরকে টেনে আনলে কেন ? ও তো কোন দোষ করেনি ! আমাকে দিয়ে
ওর নাম সই করিয়ে ... ছিঃ ছিঃ’ ! সকলেই নিঃস্তব্ধ । একটা ফোন এলো । ওপারের কন্ঠ
শুনে অনিমেষ চিৎকার করে উঠলেন ‘হোয়াট’ ? মেঝেতে আলপিন পড়ার শব্দও শোনা যাবে ।
ওপারের কন্ঠ বেশ শোনা গেল ‘ইয়েস স্যার, ফ্লাইট নম্বর থ্রি টু সিক্স ওয়ান’এ আপনার
বুকিং ক্যানসেল করা হয়েছে । কলকাতা পুলিশ একটা লুক আফটার নোটিশ পাঠিয়েছে’ । ফোনটা
ক্রেডলে রাখতেও পারলেননা অনিমেষ , পড়ে গেল । কারো মুখে কথা নেই । ডাঃ কুজুররা ওঠার
তোড়জোর করছেন । কলিং বেল বাজলো । মাধুরী সদর দরজা খুলে আগন্তুককে বসার ঘরটা দেখিয়ে
দিলেন ।
ছজন
মানুষ বসার ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে । দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়েই আগন্তুক পরিচয় দিলেন
‘লালবাজার থেকে আসছি , আমি হারান হাজরা !
শর্মিষ্ঠা ঘোষ

শর্মিষ্ঠা ঘোষ

মায়া
বাড়ির
পরিবেশ আজ অস্বাভাবিক থমথমে । সকালের এই সময় সাধারণত দুজনের গলাউচ্চস্বরে বাজে। না , ঝগড়া
কেউ করে্ন না কারো সাথে ,
কিন্তু ভুল লোককে বিয়ে করে জীবনভর কেমন পস্তাতে
হচ্ছে তার ফিরিস্তি পরস্পরকে শোনাতে শোনাতে চায়ের সেশন টা কাটে । আবার
ব্যতিক্রমও আছে । যে যার হবি নিয়ে আলোচনা শুরু করে অন্যের মনোযোগ
দাবী করেন কোন কোন সময় । আলোচনা গড়ায় বিতর্কে । এটুকুই দাম্পত্যের
নয়া সমীকরণ ।
মুখে
না বললেও মায়া জানেন তাঁর স্বামীটি লোক খারাপ নন । যথেষ্ট সফল ও । অর্থনীতিতে
ভারতের প্রথম সারির
প্রোফেসারদের সমকক্ষ । আর মহীন জানেন , মায়া না থাকলে তাঁর সংসার টিকতো
না । ছেলেমেয়েদের আহ্লাদ ,
আবদার , পড়াশুনো, চিকিৎসা , লোক-লৌকিকতা
সব কিছু মায়া বরাবর একা হাতে সামলেছেন । এখন ছেলে মেয়েরা
ডানা মেলেছে
। এখন বাবাকে নিয়ে তাদের গর্ব ধরে না। বাবার সাহচর্য সেভাবে না পাবার
অভিমান আজ অনেকটাই ফিকে মনে হয় । আর মায়া একার হাতে সব কিছু সামলাতে
গিয়ে নিজের চাকরীর প্রোমোশনের কথা চিন্তাও করেন নি। ট্রান্সফার নেবেন না বলে । আজ
যখন ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত , মা বলতে অজ্ঞান , তিনি বোঝেন
তাঁর সেদিনকার ডিসিশন সঠিক ছিলো ।
দুজনেই
রিটায়ার করে এখন
শান্তিনিকেতনে থিতু, ছেলেমেয়েরা বর , বৌ , বাচ্চাকাচ্চা
, চাকরীবাকরি নিয়ে
দূরে দূরে। তাই মায়ার অখণ্ড অবসর। সুযোগ পেলেই প্রোফেসার সাহেবকে বিদ্ধ
করেন বাক্যবাণে। আর মহীনও ছাড়বার পাত্র নন। বেদপুরাণ লোককথা উল্লেখ
করে শোনান ভারতীয় ধারণায় স্ত্রী এবং মায়ের যেমন সংজ্ঞা আছে , মায়া
তার বাইরে নন। সারাজীবন অধ্যয়নে ব্যয় করে তিনি তাঁর স্ত্রীর সম্মানও
বৃদ্ধি করেছেন বৈকি! ছেলেমেয়েরাও রোজকার এই রগড়ের কথা জানে । দুজনেই
নিজের নিজের কোলে ঝোল টানেন, চেষ্টা করেন ছেলেমেয়ের সমর্থন আদায়ের।
এ ব্যাপারে তাঁরা মায়ের দিকেই একটু বেশী ঝুঁকে থাকে সবসময়। বাবাকে
মুখে কিছু বলে না, কিন্তু
মহীন বোঝেন। তাঁর অনুতাপ ও হয় মাঝেসাঝে। সেই যেবার তিনি
জার্মানিতে প্রথম সেমিনারে যোগ দিতে গেলেন সান্তুর টাইফয়েড চলছে। এই জ্বর
ধাঁ ধাঁ করে উঠে যায়,
ছেলে ভুল বকে। রিনি আরও ছোট। মায়ের ওপর ফেলেরেখে
তিনি যেতে বাধ্য হলেন। সেবার তাকে এয়ারপোর্টে সি অফ করতে বাড়ির
কোন লোক আসতে পারলো না । ওখানে পৌঁছে নিয়মিত ফোন করে ছেলের খবর
নিয়েছেন তিনি। আজ খতিয়ে দেখতে গিয়ে মনে হয় , কই , সান্তুতো
একবার ও ফোন ধরতো না ।
রিনি
বরং ছেলেমানুষি কৌতূহলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইতো সবকিছু , কোথায়
গেলেন, কি
দেখলেন , কি খেলেন
ওখানকার খাবার , জানতে
চাইতো ভূগোলের সীমানায় তার যেটুকু জ্ঞান গম্যি তা সঠিক কতটা । সান্তু
বরং তিনি ফিরে আসার পর ওখানথেকে আনা জ্যাকেট পেয়ে
খুবএকটা উচ্ছ্বাস দেখায় নি ,কিন্তু রিনি
পাড়ায় বেরিয়ে পড়েছিল তার ডল দেখাতে । ছেলেটা তাঁর বড্ড অভিমানী । মায়ের ধাঁচ
পেয়েছে। মেয়ে
অনেক বেশি উচ্ছল । কিছু চেপে রাখতে পারে না। ওকে বোঝা
যায় । সান্তুর
মনের তল পাননি তিনি । ছেলেকে তাই বুঝি একটু ভয়ই পান
মহীন। আজ
আবহাওয়া বিগড়ে গেলো সক্কাল সক্কাল মেয়ের একটা ফোনে। প্রতি রবিবার নিয়ম
করে ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী ফোন করে বুড়োবুড়িকে । তাই রবিবার সকালে তাঁদের
নিজেদের নৈমিত্তিক ঝগড়া বাদ । হাঁ করে থাকেন তীর্থের কাকের মতো এই
ফোনগুলোর আশায়।আজও ছিলেন তাই । আজও ফোন এলো । সান্তুর পরিবার ভালোই আছে
। ওরা এবার পুজোতে আসার চেষ্টা করবে কোলকাতায় । গতবার আসতে পারে নি। আই
বি এম ছেড়ে রয়্যাল ব্যাঙ্ক অফ স্কটল্যান্ডে জয়েন করায় ছুটি মেলেনি। নাতি নাতনী
চ্যাট করে দাদুর সাথে কম্পিউটারে । মায়া আবার ফেসবুকে ততটা
সড়গড় না । তাঁর ফোনই ভরসা ।
রিনি
আজ ফোন করলো নির্ধারিত সময়ের আগেই । ঝড়ের বেগে যা বলে গেল , তার
মর্মার্থ এই আভাসের সাথে আর থাকা অসম্ভব । অনেক হয়েছে , আর
নয় । মায়াই ধরে ছিলেন ফোনটা । তিনি হকচকিয়ে গিয়ে
হাত থেকে একবার ফোন ফেলে দিলেন । শেষে বললেন , ‘ তোর বাবার সাথে কথা
বল’।
কিন্তু মেয়ে রাজি হোল না । বলল , ‘ আমি
এখন রাখি , মা
। আমার প্যাকিং
করতে হবে । আমি আসছি । তখন শুনো সবকিছু’। মায়ার স্থাণুবৎ চেহারা দেখে
মহীন বিপদ আশঙ্কা করলেন । মায়া খুব গুছিয়ে কিছু বলতে পারলেন না । ব্যথা
হচ্ছে মাথায় । হাত পা অবশ। মহীন চেনা বন্ধু ডাক্তার কে খবর দিলেন। ঘুমের
ওষুধ খেয়ে তখনকার মত ঘুমিয়ে পড়লেন মায়া। মহীন ঠায় বসে রইলেন পাশে।
ফাঁকা লাগে, বড্ড
ফাঁকা লাগে এই পারিপার্শ্বিক, মায়াকে ছাড়া। রান্নার
লোক এসে নিজের বুঝব্যবস্থায় যাহোক কিছু রেঁধে গেলো। পড়েই রইলো সেসব।
পরদিন মেয়ে এসে হাজির। কই,
মেয়েকে দেখে আজ কারুর আনন্দ হোল নাতো! বুকটা
বরং কি একটা অমঙ্গল আশঙ্কায় ছ্যাঁত করে উঠলো। মায়া সামলে উঠেছেন অনেকটাই
আজ। শান্ত ভাবে মেয়েকে দেখলেন। মেয়ে মায়ের দিকে খানিক তাকিয়ে নিজের
ঘরে ঢুকে গেলো। শুধু তিন বছরের নাতনীটা সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো ।
মহীন
কি বলবেন, কি
করবেন দিশাহারা হয়ে গেলেন। দুপুরে খাবার টেবিলে তিনজনে মুখোমুখি হলেন।
কথাবার্তা বিশেষ হোল না। রিনি শান্তিনিকেতনে ভালো নার্সারি
স্কুল এর খোঁজখবর নিলো বাবার কাছে। ছায়া ঘনাল
মায়ার মুখে। আড়চোখে সব দেখলেন মহীন। কিছু বললেন না। খাওয়ার পর মহীন
কে নিয়ে পড়লেন মায়া ,
ভেজানো দরজার ওপাশে। বললেন, ‘ তোমার মেয়ে তোমার
মতই হয়েছে, হঠকারী!
আগে পিছে ভাবনা নেই, হুট
বলতে ডিসিশন নিয়ে
ফেলে’। মহীন
বোঝানোর চেষ্টা করেন,
‘ নিশ্চয় বড় কোন অশান্তি হয়েছে’। মায়া
রেগে ওঠেন, ‘ আমাদের
সাথে আলোচনা তো করতে পারতো একবার। বলা নেই , কওয়া নেই , ঘরদোর
সংসার ছেড়ে চলে এলো! ঝগড়া কে না করে , আমরা করি নি কখনো ? তুমি
যেরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিলে তাতে ত আমার কবেই বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ
ছিলো সংসার থেকে। কই, আমি
তো করিনি তা , কেবল
সন্তানদুটোর মুখচেয়ে!’ মহীন
আহত হন, ‘ কই
আগেতো কখনো বলনি এসব কথা’। মায়া ঝামরে ওঠেন, ‘ জানলে
কি করতে? বদলাতে
নিজেকে?’ মহীন
রেগে উঠতে গিয়েও ওঠেন না। তিনি জানেন , তাঁর অনেক দোষ। জানেন, মায়ার
অসীম ধৈর্য। জানেন, মায়ার আত্মত্যাগ
অস্বীকার করা বেইমানি। তাই বলেন, ‘ এই আলোচনা পরে করা যাবে। এখন
রিনির কি ব্যবস্থা করা যায় ভাবো’। মায়ার মাথাধরাটা
ফিরে এলো আবার।
কোন কূলকিনারা পেলেন না। ঠিক হোল বিকেলে মেয়েকে জিজ্ঞেস
করবেন , কেন এতবড়
একটা ডিসিশন নিতে হোল?
কোনই কি রাস্তা নেই আর? চা খেতে গিয়ে সেদিন ছলকে পড়ল
চিন্তিত মহীনের পাজামায়। মায়া চিনি মেশাতে ভুলে গেলেন চায়ে। রিনিই
শুধু নির্বিকার। যেন ও রোজ এভাবেই চা খায় শান্তিনিকেতনের বাড়িতে।
যেন মাঝের চারটা বছর ছিলই না ওর জীবনে। মহীন কথা হাতড়াতে লাগলেন।
আত্মজাকে
বড় অচেনা লাগছে আজ। এই কি সেই মেয়ে, বাবাকে
না বললে কিছুই হজম হোতো না যার? দাদার ঠিক বিপরীতধর্মী
? মায়া একটু একটু করে হারাতে থাকেন আত্মবিশ্বাস। তাঁর বড়
গর্ব ছিলো এই ছেলেমেয়েকে নিয়ে। তিনি তাদের
মানিয়ে নেবার ক্ষমতা যাতে হয়, সেই চেষ্টাই করে গেছেন জীবনভর । ওরা অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে বেড়ে ওঠার
পথে। আর পাঁচটা বাবার মতো মহীন ওদের পাশে থাকতে পারেন নি সবসময়। যখন
আর সবার বাবা হাত ধরে প্রথম স্কুলে নিয়ে গেছে, মায়াকে তখন সে কাজ একাই
করতে হয়েছে। সবার বাবা পুজোর ছুটিতে বেড়াতে নিয়ে গেছে যখন , মহীন কে
ছুটতে হয়েছে কোন সেমিনারে। বার কয়েক পরিবারকে নিয়ে গিয়েছেন বিদেশ, কিন্তু
সে আর ক’বার
? বরং
ছুটিছাটায় ছেলেমেয়ে নিয়ে মায়া বাপের বাড়ি চলে
যেতেন বর্ধমানে।
অবশেষে
মুখ খুলল মেয়ে নিজেই। মিটি মিটি হেসে মা কে জিজ্ঞাসা
করল্যাং, ‘ তোমরা
খুব চিন্তায় পড়ে
গেছ মনে হচ্ছে
? টেনশন
কোর না। আমার ব্যবস্থা আমি ঠিক করে নেব! ‘ রুখে উঠলেন মায়া । ‘ তুই
ভেবেছিস টা কি
? বুড়ো
বাবা, মা
র কোন চিন্তা হবে না ? তুই
যা খুশি করিস আমাদের অবর্তমানে! যতদিন বেঁচে আছি, চিন্তা
তো হবেই। তুই ও তো মা হয়েছিস, একদিন ঠিক বুঝবি বাবা মার কি জ্বালা
!’ তা
যা বলল এবার মেয়ে, তা
এরকম! নিউইয়ারের অফিস পার্টিতে গেছিল আভাসের সাথে।
অফিসের হেজি পেজিরাও যে গমক ঠমক দেখাচ্ছিল , অসহ্য! এই সেদিনের কথা, ঐ
কোম্পানিতে ঢোকার জন্য আভাসের রেকমেন্ডেসন দরকার বলে এবেলা ওবেলা
হত্যে দিতো যে সুবীর, তার বৌ পর্যন্ত ভান করছে এমন , যেন চিনতই না কোনকালে ! আশেপাসের ফ্ল্যাটবাসীরাও কৌতূহল দেখায় কখনো সখনো। ‘ কি বৌদি, এবার ভেকেসনে কোথায় যাচ্ছেন? ব্যাংকক না দুবাই? জানেন তো, পালবাবুরা স্টেটসে ঘুরে এলো’। ফোকটের পয়সায় মিনিমাগনা বিদেশ ভ্রমণ এখন জলভাত। রিনি জানে অনেকেই ক্লায়েন্টের থেকে গিফটের মোড়কে এসব ফেসিলিটি নিয়ে থাকে । এতে দোষের কিছু নেই। একে ঘুষ বলা যায় না । কিন্তু আভাস মানতে চায় না । লজ্জায় মিনমিন করেছে রিনি। কি করে লোকজনকে বোঝায় , তার বরটা একটা নীতিবাক্যের ঝুড়ি! সদা সত্য কথা বলিব, সুবোধ গোপাল টাইপ! রিনির মুখ লাল হয়ে ওঠে। মায়া হেসে ওঠেন, ‘ এই কথা! তুই কোথায় যাবি বল, আমি আভাসকে বলে দিচ্ছি। আমরাও ঘুরে আসবো খন। অনেকদিন যাইনি কোথাও। যাতায়াত ভাড়া তোর বাবার, হোটেল খরচ তোদের’। মেয়ে ফুঁসে ওঠে , ‘না, আমি এই যাওয়ার কথা বলছি না, আসলে তোমরা বুঝবে না। এগুলো আজকাল স্ট্যাটাস সিম্বল । রাম শ্যাম যদু মধুরাও টুসকিতে বিদেশ ঘুরে আসছে, গাঁটের একটি কড়িও না খসিয়ে!’ মহীন ভেতরে ভেতরে কেঁপে যান। এই মনোভাব মেয়ে কোথা থেকে পেলো! তিনিও উচ্চাকাঙ্খি ছিলেন ঠিকই, অস্বীকার করবেন না, তার জন্য পরিবার কে খানিক অবহেলাই করেছেন, মায়া দ্বিগুণ হয়ে ঢেকে দিয়েছে সেই খামতি । কিন্তু, এই নীতি বিবর্জিত আত্মসর্বস্বতা ? এই কি তাঁর শিক্ষা ? জামাই তাঁর বৌ অন্ত প্রাণ । জামাই বৌ ছেড়ে থাকতে পারে না বলে অফিস থেকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর প্রস্তাব ও ফিরিয়ে দিয়েছে। এদিকে রাম শ্যাম যদু মধুরা কোথায় উঠে যাচ্ছে ফনফনিয়ে, পার্টিতে তাদের বৌদের দেমাকে পা পড়ে না !
হত্যে দিতো যে সুবীর, তার বৌ পর্যন্ত ভান করছে এমন , যেন চিনতই না কোনকালে ! আশেপাসের ফ্ল্যাটবাসীরাও কৌতূহল দেখায় কখনো সখনো। ‘ কি বৌদি, এবার ভেকেসনে কোথায় যাচ্ছেন? ব্যাংকক না দুবাই? জানেন তো, পালবাবুরা স্টেটসে ঘুরে এলো’। ফোকটের পয়সায় মিনিমাগনা বিদেশ ভ্রমণ এখন জলভাত। রিনি জানে অনেকেই ক্লায়েন্টের থেকে গিফটের মোড়কে এসব ফেসিলিটি নিয়ে থাকে । এতে দোষের কিছু নেই। একে ঘুষ বলা যায় না । কিন্তু আভাস মানতে চায় না । লজ্জায় মিনমিন করেছে রিনি। কি করে লোকজনকে বোঝায় , তার বরটা একটা নীতিবাক্যের ঝুড়ি! সদা সত্য কথা বলিব, সুবোধ গোপাল টাইপ! রিনির মুখ লাল হয়ে ওঠে। মায়া হেসে ওঠেন, ‘ এই কথা! তুই কোথায় যাবি বল, আমি আভাসকে বলে দিচ্ছি। আমরাও ঘুরে আসবো খন। অনেকদিন যাইনি কোথাও। যাতায়াত ভাড়া তোর বাবার, হোটেল খরচ তোদের’। মেয়ে ফুঁসে ওঠে , ‘না, আমি এই যাওয়ার কথা বলছি না, আসলে তোমরা বুঝবে না। এগুলো আজকাল স্ট্যাটাস সিম্বল । রাম শ্যাম যদু মধুরাও টুসকিতে বিদেশ ঘুরে আসছে, গাঁটের একটি কড়িও না খসিয়ে!’ মহীন ভেতরে ভেতরে কেঁপে যান। এই মনোভাব মেয়ে কোথা থেকে পেলো! তিনিও উচ্চাকাঙ্খি ছিলেন ঠিকই, অস্বীকার করবেন না, তার জন্য পরিবার কে খানিক অবহেলাই করেছেন, মায়া দ্বিগুণ হয়ে ঢেকে দিয়েছে সেই খামতি । কিন্তু, এই নীতি বিবর্জিত আত্মসর্বস্বতা ? এই কি তাঁর শিক্ষা ? জামাই তাঁর বৌ অন্ত প্রাণ । জামাই বৌ ছেড়ে থাকতে পারে না বলে অফিস থেকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর প্রস্তাব ও ফিরিয়ে দিয়েছে। এদিকে রাম শ্যাম যদু মধুরা কোথায় উঠে যাচ্ছে ফনফনিয়ে, পার্টিতে তাদের বৌদের দেমাকে পা পড়ে না !
রিনির
রাগ হয় । অভিমান হয়। ঐ দেমাকি ফুলটুসিদের বরেদের চাইতে আভাস কোন
অংশে কম ?
আই আই টির ব্রিলিঅ্যান্ট স্টুডেন্ট আজ কোথায় লটপটাচ্ছে
স্রেফ কতোগুলো
ভুয়ো পেটি মিডলক্লাস সেন্টিমেনট এর দোহাই দিয়ে! রাগে
দুঃখে ফেটে পড়তো
রিনি। আভাস হা হা করে হাসতো। বুঝেও যেন বুঝতে চাইতো না ।
গা জ্বলে যেত রিনির।
সেই ঝগড়াই ডাল পালা ছড়িয়ে আজ এখানে! হয় আভাস নিজেকে বদলাক, নয় রিনি
আর ফিরছে না !
মায়া মহীনের মুখের দিকে তাকান। যা ভেবেছিলেন , তাই
। মহীনের মুখে
মিটিমিটি হাসি । মহীনের চোখে বিষাদ। মায়ার ভীষণ মায়া হোল জামাই এর জন্য । মায়ায়
ভীষণ গর্ব হোল স্বামীর জন্য। মায়া
জানেন, মহীন
বুঝে গেছেন কিংকর্তব্য
। নিজের ই তো জিন মেয়ের শরীরে। তাকে বশ করাটাই এই মুহূর্ত থেকে
হয়ে উঠবে অধুনা বেকার সদাব্যস্ত প্রোফেসর সাহেবের গ্রেট টাস্ক ।
মায়ায়
বুক থেকে নিমেষে একটা ভার নেমে গেলো। তিনি নাতনীকে ডাকলেন, ‘ চলো,টিয়া
, আমরা
বেড়িয়ে আসি ।
তুমি নদী দেখবে বলেছিলে , আজ আমরা খোয়াই
নদীর কাছে গল্প করতে যাবো’।
বাচ্চাটা আনন্দে কিচিরমিচির করতে করতে এসে
দিদার গলা জড়িয়ে ধরলো। আবেশে চোখ বুজে এলো মায়ার। কচি মাথাটায় মুখ
ডুবিয়ে নিষ্পাপ ঘ্রাণ টেনে নিলেন তিনি বুকভরে। আঃ কি শান্তি !