এই সংখ্যার লেখকসূচি - সুবীর কুমার রায়, সুধাংশু চক্রবর্তী, উত্তম বিশ্বাস, নীহার চক্রবর্তী, নিবেদিতা পুণ্যি, সীমা ব্যানার্জী রায়, মনোজিৎ কুমার দাস ।
গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৭
সম্পাদকীয়
এই
সংখ্যাটির প্রকাশে এক সপ্তাহ বিলম্ব হলো । আমার কম্পিউটার যন্ত্রটির অসহযোগিতা
কিংবা আমারই নির্বুদ্ধিতার কারণে ‘গল্পগুচ্ছ’র ডকুমেন্ট ফাইলটি লোপাট হয়ে গিয়েছিল
। অবেশেষে স্মৃতি থেকে লেখকের নাম মনে করে মেইলবকস ঘেঁটে লেখাগুলি উদ্ধার করে
পত্রিকা প্রকাশ করলাম । এই পরিপ্রেক্ষিতে দুটি অনুরোধ করি । (১) যদি কেউ লেখা
পাঠিয়ে থাকেন অথচ ‘গল্পগুচ্ছ’র এই সংখ্যায় প্রকাশ হল না, দয়াকরে জানাবেন কিংবা (২) লেখাটা
আর একবার পাঠাবেন ।
শুভেচ্ছা
নেবেন, ভালো থাকবেন ।
সুবীর কুমার রায়
প্রচন্ড
এক শীতের রাত। রাত দশটা বেজে গেলেও উঠোনের কলতলা থেকে বাসন নিয়ে ঘরে না ঢোকায়, মাধবী চিৎকার জুড়ে দিলেন।
শহরের
একপ্রান্তে দুঁদে পুলিশ অফিসার স্নেহময় দত্তের বাস। লোকে বলে তার প্রতাপে নাকি
এখনও বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায়। তিন বছর আগে পাঁচ বছরের অণিমাকে রেখে মাত্র
কয়েকদিনের জ্বরে কণিকার মৃত্যুর এক মাসের মধ্যেই, বিশ বছরের মাধবীকে সাঁইত্রিশ
বছরের স্নেহময় বিয়ে করে নিয়ে আসেন। মা মরা মেয়েটাকে কে দেখবে, এই যুক্তি মেনে নিতে পারে নি
বলে পাড়ার লোক আড়ালে হাসাহাসি করলেও, মুখে কিছু বলার সাহস দেখায় নি। স্নেহময়কে আর
সবাই ভয় করলেও, তিনি নিজে কিন্তু মাধবীকে যমের মতো ভয় করেন। তাই বিয়ের বছর ঘুরতে
না ঘুরতেই ছ’বছরের অণিমা সর্বক্ষণের কাজের লোকে পরিণত হলেও, তিনি কোন প্রতিবাদ
করার সাহস দেখান নি, বরং ধীরে ধীরে গত দু’বছরে তিনিও নিজের সাথে তাঁর সম্পর্কের
কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়ে, অণিমাকে বাড়ির বিনা পয়সার কাজের লোক ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে
গেছেন। তার কষ্টে এখন আর তিনি কষ্ট পান না, কাজে ফাঁকি দিলে বিরক্ত হন, স্ত্রীর
অভিযোগে অকথ্য অত্যাচার করেন।
কাকভোরে
ঘুম থেকে উঠে ঘর ঝাঁট দেওয়া থেকে শুরু করে, মাধবীকে রান্নার কাজে সাহায্য করা,
টুকটাক দোকান বাজার করা, বাসন মাজা, ছোট ছোট জামা কাপড় কাচা, সব তাকেই করতে হয়।
মাঝে গতরাতের দু’টো রুটি ও তরকারি বা গুড় দিয়ে জলখাবার। দুপুরেও দু’টো ভাত জোটে
বটে, তবে সেটা কখন জুটবে এবং কী জুটবে, নির্ভর করে কখন কাজ শেষ হবে তার ওপর। প্রথম
প্রথম অত্যাচার, খিদে, পরিশ্রম, ইত্যাদি কারণে সে চোখের জল ফেলতো বটে, এখন কিন্তু
মুখ বুজে সব সহ্য করে। হয়তো চোখের জল শুকিয়ে যাওয়াও এর কারণ হতে পারে।
রাত
ন’টায় মাধবী নিজের ও স্বামীর খাবার নিয়ে নিজেদের ঘরে যাবার আগে অণিমার রুটি তরকারি
রান্নাঘরে রেখে দিয়ে যান। কোনদিন সুস্থ অবস্থায়, কোনদিন মত্ত অবস্থায় স্বামী ফিরলে,
একসাথে ঘরে বসে আহার সারেন। অণিমা তার বরাদ্দ দু’টো রুটি ও তরকারি খেয়ে নিয়ে, রান্নাঘর
পরিস্কার করে, রান্নাঘরের এঁটো বাসন উঠোনের কলতলায় নিয়ে গিয়ে মেজে পরিস্কার করে,
টুকটাক কোন ফাই ফরমাশ থাকলে সেরে, রান্নাঘরের পাশের ঘরটায় শুতে যায়।
আজ
এতো দেরি হওয়ায় মাধবী দু’চারবার চিৎকার করেও কোন ফল না হওয়ায়, রান্নাঘরে এসে দেখেন
অণিমার খাবার নেই। তাকে সহবত শেখাতে কলতলায় এসে দেখেন জড়ো করা বাসন পড়ে রয়েছে,
কিন্তু অণিমা নেই।
বাড়ির
ভিতরে কোথাও না থাকায় ও বাইরের দরজা হাট করে খোলা থাকায়, মাধবী স্নেহময়কে ফোন করে
ডেকে পাঠান। মাধবীর চিৎকারে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে যায় ও সব শুনে তারা আশেপাশে খুঁজতে
বেরোয়। ইতিমধ্যে স্নেহময় ফিরে এসে পুলিশে খবর দেন।
অল্প
সময়ের মধ্যেই অণিমার খোঁজ পাওয়া গেল। প্রায় রোজই তাকে যে দোকানে যেতে হয়, এমনকী
আজও বিকালে যেতে হয়েছে, তারই কিছু দুরে, রাস্তার পাশে ঠান্ডায় অর্ধমৃতা এক বৃদ্ধা
ভিখারিনি শুয়ে আছে। ঠিক
তার
পাশে স্নেহময় তনয়া মাটিতে বসে বাড়ি থেকে ঠোঙায় মুড়ে আনা রুটি তরকারি পরম যত্নে বৃদ্ধাকে
খাওয়াচ্ছে। বৃদ্ধার গায়ে অণিমার রংচটা চাদর।
সুধাংশু চক্রবর্ত্তী
লখিয়ার
হাতের গভীরে গুটিকতক টাকা ঘামে দরদর করে । একটা দুটো নয় , তিনটে পাঁচশো টাকার নোট । সঙ্গে আরও অতিরিক্ত একটা একশ ।
লখিয়া এতো টাকা আগে কখনো একসঙ্গে দেখেনি । একটা ধর্ষণের বিনিময়ে এতো টাকা ?
মেয়ে
ফুলিয়া মায়ের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে টের পায় দুই ঊরুর মাঝখানে তীব্র এক যন্ত্রণা ।
টনটনিয়ে উঠছে হাঁটার দরুন । ঘরে এসে দাওয়ায় বসতেই দেখে পায়ে রক্ত ।
লখিয়া বুক
থেকে আঁচল নামিয়ে টাকা কয়টা আঁচলের খুঁটে বেঁধে নিয়ে এসে দাঁড়ায় মেয়ের সামনে - “দাঁড়া , নিসুন্দি পাতা
ছেঁচে লাগিয়ে দোবোখন । একটুও ব্যথা-বেদনা থাকবে না রে মা ।”
ফুলিয়া
লজ্জায় মুখ লুকোবার চেষ্টা করতে করতে অস্ফুটস্বরে বলে – “ছবিয়া, সুরতিয়ারা জানতে পারলে কী হবে গো মা ?”
-
“কি আর হবে ? বলবি পড়ে গিয়েছিলাম আমগাছ থেকে । একটা কথা মনে রাখবি মা
আসল ব্যাপারটা কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে । গিন্নীমা বলেছেন পরে আরও টাকা
দেবেন । শুধু মুখ টিপে থাকতে হবে আমাদের । পারবি তো রে মা ? দুটো দিন
ভালোমন্দ খেতে পাবো এই টাকায় , তাই না বল ?”
ফুলিয়া
নিরুত্তর থেকে ভাবনায় ডুবে যায় । এখন যদি পেটে বাচ্চা এসে যায় ! মানুষের বাচ্চা
নাকি এভাবেই হয় । ও নিজেও নিশ্চয়ই এভাবেই হয়েছিলো ! ছবিয়া, সুরতিয়ারাও !
উত্তম বিশ্বাস
গ্রামের
বাড়ি থেকে বাবাকে এনে আমার ফ্লাটে বসার ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছি ! উনার আবার শুয়ে বসে
অস্বস্তি----ঝুলিয়ে রাখা চাই ! বেঁচে থাকতে ত আর উনাকে বাগে আনতে পারিনি এভাবে ;
তাছাড়া যখনই গ্রামের বাড়িতে বড়মুখ করে গেছি , তখনই দেখি কোমরে মোটা পাটের দড়ি
পেঁচিয়ে গাছের সাথে ঝুলছেন ! তবে ঋতুভেদে দৃশ্য দু’রকম ---শীতে খেজুর আর গ্রীষ্মে
তাল । তবে তালে ছুঁলে বাঁশ ! আমি
আমার স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই----‘ যাক , এই বয়সে
পৃথিবীর সকল বুড়োবুড়িরা যেখানে তাদের সন্তানদের কাঁধের ওপর জড়ানো জটের মত ঝুলছে ! ---আর
আমার বাবা সেখানে ,---দেখেছ কতটা স্বতন্ত্র !’ আমার শহরচোষা চোখ মাঝেমাঝে খেজুর
গাছগুলোকে দেখলে লজ্জাও পেতো ! বিশেষকরে মাসের শেষে টাকার তাড়া নিয়ে আমি যখন
স্ত্রীর কোলঘেষে বসতাম ; উনি বড়মুখ করে কোনদিন আমার কাছে একটি বিড়িও চাইত না---
টাকা তো দূর অস্ত , কোনও কিছুর প্রয়োজন হলেই দেখতাম, ঠোঙায় ঠিলে ঝুলিয়ে নিয়ে
চড়চড়িয়ে গাছে উঠছেন ! ইচ্ছা থাকলেও তখন
খেজুরগাছগুলোর জন্য মৃত্যু কামনা করতে পারতাম না ! বাবার সাত সন্তান আমরা ; সাত
দিক থেকে ঝড়ে পড়া আম জামরুলের মত সুনাম সুখ্যাতি কুড়িয়ে আনার চেষ্টা করতাম আমরা ;
কিন্তু বাবার হাতে তৈরী শীতের নলেন গুড়ের সৌরভ সুখ্যাতিকে আমরা টেক্কা দিতে পারিনি
কোনদিনই !
শীত
এলে মাঠের চেহারা যেত পাল্টে । সর্ষে ক্ষেতের আলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো মুচকি
মুচকি হাসত ; ---কেউ পোয়াতির মত পেট উঁচু করে , কারো বা দু’চোখ ভরা পিচুটি ; কেউ
আবার গোপালের মায়ের মত মাজাভাঙ্গা ; কেউ কেউ ভগীরথের মত ডাকাবুকো ---কেঊ বা রেশন
না পাওয়া আলোবাতাসহীন আশ্রয়হীন জীর্ণ শীর্ণ ভিখারি তরিবালার মত ঠায় দাঁড়িয়ে !
কুয়াশার বুকচিরে শনশন করে বাতাস বইত যখন , বুঝতে পারতাম---এইমাত্র বাবা বুঝি ওদের
চুল আঁচড়ে দিয়ে গেলেন ; কী খোলতাই না লাগছে ওদের মাথাগুলো ! দীর্ঘ অশৌচান্তের পর , গ্রামের মায়েরা যেমন নখ খুঁটিয়ে মাথাঘষে
স্নান করে, তেল সিঁদুর মেখে ঘরে ওঠে ---- ঠিক যেন অমন ফুরফুরে দেখতে লাগত তখন
মাঠের সমস্ত গাছেদের মাথা দোলান ! পোড়ামুখি ভাঁড় পুড়ে পুড়ে খয়ের হয়ে উঠত ; আর
জেলোর কানাছাপিয়ে উতলে উঠত গরম জিরেন রস ! সাপের ফনার মত লম্বা খেজুরের ছড় দিয়ে উঠোনের মাঝখানে বসে গুড় ঘুটতেন বাবা –--কী অদ্ভুদ
সেই শব্দ ! শিশু বয়েসে কিছুতেই মেলাতে পারতাম না --- গরম গুড়ের ঘাইমারা শব্দটা
আসলে কিসের মত ! বড় হয়ে সংসার পেতে এখন মিলিয়ে নিতে পারি এসব শব্দের সারাৎসার !
- স্যার , এসব গল্প শহরে বসেই লেখা হয় !
আমি বলছি এই গুড় খাঁটি ; আপনি বিশ্বাস করে একবার নিয়ে দেখুন ঠকবেন না !
- দাঁড়াও , বাবাকে একটু দেখিয়ে আনি । ভদ্রলোককে গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে গুড়ের পাত্রটা নিয়ে একচ্ছুট্টে বাবার কাছে এলাম । সন্তানের কাছে বাবারা মরেনা কোনও দিন ---আমার তো তাই বিশ্বাস ! এ জন্য ভালোমন্দ সমস্তকিছুর মতামত নিতে এখনও বাবার কাছেই ছুটে আসি ।
- দাঁড়াও , বাবাকে একটু দেখিয়ে আনি । ভদ্রলোককে গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে গুড়ের পাত্রটা নিয়ে একচ্ছুট্টে বাবার কাছে এলাম । সন্তানের কাছে বাবারা মরেনা কোনও দিন ---আমার তো তাই বিশ্বাস ! এ জন্য ভালোমন্দ সমস্তকিছুর মতামত নিতে এখনও বাবার কাছেই ছুটে আসি ।
- না গো ! আপনার গুড় ঠিক
নেই !
- কে বললেন ? আপনার বাবা ? উনাকে একটু বাইরে আসতে বলুন না !
- না ! উনি বাইরে আসতে পারলে তো আর আপনাকে ডাকতাম না !
- কে বললেন ? আপনার বাবা ? উনাকে একটু বাইরে আসতে বলুন না !
- না ! উনি বাইরে আসতে পারলে তো আর আপনাকে ডাকতাম না !
লোকটা ভারি নাছোড়বান্দা ! পরদিন আবার এসে
হাজির ! কে যে ডেকে দাঁড় করায় কে জানে !
- স্যার আপনার বাবার কাছে
একটু যেতে পারি ?
- ক্যান পাটালি এনেছেন
বুঝি ? দিন আমার কাছে দিন –আমিই নিয়ে যাচ্ছি ! সারাঘর নতুন নলেন গুড়ের পিঠেপুলর
গন্ধে যেমন গ্রাম্য দামাল শিশুরা হামলে পড়ে ; কিছুক্ষণের জন্যে বাবার ছবিটাতেও অমন
একটা চেনা অস্থিরতা ফুটে উঠল !
- এ আপনি কোথা থেকে এনেছেন
?
- স্যার আগে খুলে তো দেখুন
!
- আরে মশাই ! খুলব কিনা সেটা
আমার ব্যাপার ; কিন্তু কোথা থেকে এমন জিনিস এনেছেন সেটাই তো আপনাকে জিজ্ঞাসা
করছি---!
- বাংলানী ভাঁটা থেকে !
রসিকতা করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা খেয়েছে বুঝে , গুড়আলা থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল ,
- স্যার ! অন্যায় হয়ে গেছে
, আর এমন হবে না ! আজকের মত মাফ করে দিন ! বুঝতে পারিনি আপনার বাবা------!
আজ বাবার মৃত্যু বার্ষিকী বলে কথা !
সন্তান হিসাবে কিছু তো একটা কর্তব্য আছে আমার ! বিশেষকরে তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছে ----!
দ্রুত বাবাকে দেওয়াল
থেকে নামিয়ে গাড়ির মাঝের সীটে বসিয়ে , গুড় আলাকেও তুলে নিয়েই গাড়ি হাকালাম জোরসে !
পড়ন্ত বিকেলের রোদ সরিয়ে একসময় পৌঁছলাম বাংলানী ভাঁটায় ! গ্রামীন ফায়ার ব্রিক্সের
একটি নতুন কারখানা ! ধুধু করা আবছা চেনাচেনা গ্রাম---- সন্ন্যাসীর শেষ বসনখানি
চুরি গেলে তাঁর চোখে মুখে যেমন দিগম্বর উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়----এখন ঠিক তেমনই
! একের পর এক লরি , ম্যাটাডোর বোঝাই হয়ে আসছে খণ্ড খণ্ড খেজুরগাছের গুড়ি---ফিরতি
টিপে বোঝাই হয়ে শহরমুখী হচ্ছে পোড়া ইট !
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবার সাথে আমিও
দেখছিলাম,----- তাঁরই হাতে লালিত রসরাজ সন্তানদের শেষ কৃত্য ! আর তাদের আত্মাহুতির
অদ্ভুত চেনা গন্ধ--------------!!
নীহার চক্রবর্তী
তরুণ
শ্রীবাস মাঝির নৌকায় প্রায় পারাপার হয় সোনাদিদিমণি । তাতে খুব খুশী শ্রীবাস । ওর
চোখেমুখে খুশীর ঝিলিক দেখলেই বোঝা যায় । অন্যদিকে সোনাদিদিমণিও ওকে উপেক্ষা করতে
পারে না । দুজন চোখাচুখি হলে সেও স্মিত হাসে । তবে তার হাসির নিয়ন্ত্রণ বেশ বোঝা
যায় । কারণ তার সাথে আরও কিছু সহকর্মী থাকে ।
দিনে-দিনে
সোনাদিদিমণির প্রতি শ্রীবাসের আকর্ষণ বাড়তেই থাকে । তাকে ওর খুব ভালো লাগে । তবে
শ্রীবাসের মনোভাব সোনাদিদিমণি সেভাবে কিছু বোঝে না । শ্রীবাসের হাসির উত্তরে তার
মুখে শুধু নিয়ন্ত্রিত হাসি । তবে কোন-কোন সহকর্মী দুজনের হাসাহাসি লক্ষ্য করে মজা
পায় ।
এই
সেদিন রূপাদিদিমণি বলছিল সোনাদিদিমণিকে,''একটা
জিনিস বোঝো কি তুমি ?''
অবাক
হয়ে সোনাদিদিমণি জিজ্ঞেস করে,''কী গো ?''
তখন
রূপাদিদিমণি এক-গাল হেসে বলে,''শ্রীবাস কিন্তু
তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে । ওর হাসি লক্ষ্য করে দেখো । বেশ মায়া-মায়া আর
তন্দ্রা-তন্দ্রা । ভালোবাসার আভাস আর কি ।''
শুনে
লজ্জা পায় সোনাদিদিমণি ।
সলজ্জ-হেসে
বলে,''কি যে বল । বুঝি না ছাই । আসলে শ্রীবাস খুব
ভালো ছেলে বলেই আমার মনে হয় ।''
এর
কয়েকদিন পর শ্রীবাস একদিন সোনাদিদিমণিকে দেখে অনাবিল হেসে বলে,''আপনারে আমার খুব ভালা লাগে । কি যে ভালা লাগে আমার । কইতে পারি না ।
চুখে জলও আইস্যা পড়ে ।''
শ্রীবাসের
কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত সোনাদিদিমণি ।
খুব
আগ্রহের সঙ্গে শ্রীবাসকে বলে,''সে আমাকে তোমার
ভালো লাগতেই পারে । মানুষেরই মানুষকে ভালো লাগে । কিন্তু চোখে জল আসার ব্যাপারটা
বুঝলাম না । খুলে বল আমাকে ।''
তারপর
শ্রীবাস অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে । চোখ বুজে ফেলে । অবাক হয়ে সোনাদিদিমণি শ্রীবাসের
দিকে তাকিয়ে থাকে । হঠাৎ দেখে শ্রীবাসের গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে ।
সোনাদিদিমণি
আলতোভাবে ধাক্কা দেয় শ্রীবাসকে ওর সম্বিৎ ফেরানোর জন্য । তারপরেই শ্রীবাস চোখ-ভরা
জল নিয়ে বলতে থাকে,''সে অনেকদিন আগের কতা,দিদিমণি । আমরা ছিলাম দুই ভাই-বোন । আমি ছুটু । দিদি আমার চাইয়া কিসু
বয়াসে বড় । ওর বিয়া হয় । কিন্তুক দু'বছরে মদ্যি অ সোয়ামির
ঘরে গায়ে আগুন দিয়া নিজেরে শ্যাস করে । আপনার মুখডা ঠিক আমার সেই দিদির মুতো ।
একেবারে লক্ষ্মীঠাকুর । আপনারে দেখি আর অবাক হই । এহানেই আমার আনন্দ,এহানেই আবার দুক্ক ।''
শ্রীবাসের
কথা শেষ হলে সোনাদিদিমণি একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
তারপর
শ্রীবাসের হাত ধরে তৃপ্তির হাসি হেসে বলে,''আজ
থেকে তুমি আমার ভাই । আর ধর তোমার সেই দিদি আমিই । আমাদের ভাই-বোনের সম্পর্ক
পরমায়ু পাক । এসো,আমরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি ।''
শুনে
শ্রীবাস চোখের জল মুছতে মুছতে বলে ওর সদ্য-প্রাপ্ত দিদি সোনাকে,''তবে এগডা কতা আচে আমার । কই ?''
সোনা
হাসতে হাসতে বলে,''কইয়া ফেলো তাইলে । কী
কইব্যা ?''
''আমি
কিন্তুক এরপর থেইক্যা পারের ভাড়া নিমু না তুমার কাচ থিকা ।''
সোনা
তখন আবার শ্রীবাসের হাতদুটো ধরে এক-মুখ হাসি নিয়ে বলে,''আমি তো দিদি । তোমার থেকে আমার আয় ঢের বেশী । এমন ভাবলে হয় ? তবে মাসের চারদিনের ভাড়া আমি দেবো না । ওই ঠিক আছে । তাই তো ?''
তাতেই
রাজী শ্রীবাস ।
এক-মুখ
সরল হাসি হেসে সোনাকে,''তাইলে তাই হইব । তুমি
ভাইয়ের জুন্যু কত ভাবো । এ আমার কপাল ।''
পরে
শ্রীবাসের কথা সোনাদিদিমণি রূপাদিদিমণিকে বলে খুব আনন্দের সাথে ।
সে
শুনে হেসে উত্তর দেয়,''খুব ভালো কথা গো ।
তাই তো রবি ঠাকুর লিখেছেন,'অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে /
অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে' । তোমার সেই অচেনাকে
তবে চেনা হল কি দারুণভাবে । আমার কী আর সে কপাল আছে ?''
রূপাদিদিমণির
দু'চোখে জলের আভাস দেখা গেলো তার কথার পরেই । তবে
সোনাদিদিমণি তার কাছে কিছু জানতে চাইলো না তখন । হয়তো সে ভাবল,নিজের আনন্দটা আগে উপভোগ করি । তারপর ওরটা জানা যাবে । সময় তো আর বয়ে
যাচ্ছে না ।
নিবেদিতা পুণ্যি
১
খুব সূক্ষভাবে চিন্তাটা গেঁথে গেছে মিলার মনে।বরাবর-ই মিলা শুনে এসেছে সে খুব জটিল মনস্তত্ত্বের। পরে বুঝেছে পুরুষ যখন তা’কে কাবু করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়; তখন তার সম্পর্কে এমন মন্তব্য ছুঁড়ে বসে। প্রথম যেদিন মিলা অফিসে নিয়োগ পেলো, সকালে ম্যানেজারের একান্ত কক্ষে ডাক পড়লো তার। অবিবাহিতা মিলাকে বস ডাকছে; তা-ও আবার এত সকালে! পিয়ন মুরাদের মুখাভিব্যক্তিতে একটু রুঢ় ভাব, মুখের ভঙ্গী সংযত রেখে শুধু বল্লঃ “ম্যাডাম, ম্যানেজার স্যার আপনাকে দেখা করতে বলেছেন”।
মিলা তার পার্সটা হাতে নিয়ে মুরাদের পেছন-পেছন ম্যানেজারের কক্ষে এসে পৌঁছুলো। তখন-ও শাকিল সাহেবের অফিস কক্ষের জানলাগুলো খোলা হয়নি। মিলা ঢুকতেই শাকিল সাহেব এগিয়ে এলেন মিলাকে স্বাগত জানাতে।মুরাদ নানা ছলে কক্ষে এটা সেটা কাজ গুছিয়ে বসের উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করছিলো।প্রৌঢ় শাকিল সাহেবের চোখ দু’টো স্থির তখন মিলার দিকে। মিলা জানে এ সময়গুলো কিভাবে সামাল দিতে হয়। জানলার বাইরে দৃষ্টি রেখে দূরের গাছপালা বাড়ি ঘর দেখতে লাগলো মিলা।একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে শাকিল সাহেব বল্লেনঃ
-“এ রিপোর্টগুলো পড়ে মন্তব্য লিখুন। মন্তব্য খুব সংক্ষেপে লিখবেন এবং এতে আপনার স্বাক্ষর দিবেন”।মিলা ফাইলের রিপোর্টটায় মনোযোগ দিলো। ইতিমধ্যে অফিসের লোকজন প্রায় সবাই চলে এসেছে।নতুন একজন অবিবাহিতা মহিলার নিয়োগে অফিসের সবার ঔতসুক্যের শেষ নেই। সাহসী আর চাছা ছুলো স্বভাবের জলিল সাহেব তো বলেই ফেললেনঃ
- “স্যার, ম্যাডামকে দেখার অপেক্ষায় থেকে থেকে; দেখতে না পেয়ে; শেষ পর্যন্ত এখানেই চলে এলাম!” জলিল সাহেবের সাহসী মন্তব্যে অট্টহাসিতে সায় দিলেন বেলাল আর মিরন সাহেব।সহকর্মীরা কক্ষ ছাড়তেই কানের কাছে মুখ নীচু করে মিলাকে শাকিল সাহেব বললেন,
- “আমার কাছে বসে আপনি কাজ করলে; আমার কাজে কোন ক্লান্তি বোধ থাকবে না”।মিলা নিরুত্তর।চেয়ারটা টেনে মিলার খুব কাছে এসে বসে বস শাকিল।
- “আপনাকে সবুজ শাড়িতে এত চমতকার মানিয়েছে! না জানি লাল শাড়িতে কত অপরুপা লাগবে!” মিলা এবার তার পার্সে কলম খোঁজার ভাণ করে নিরব রইলো।মিলার এমন আড়াল করা স্বভাব শাকিলের আরো বেশি ভালো লাগলো।
- “ব্রুনাই থাকাকালীন এক সহপাঠি পেয়েছিলাম, তার নাম রাবাব; তিউনেশিয়ান মেয়ে, আপনার মতই তার দারুণ ফিগার!এক ছেলের মা হলেও তার বক্ষের সৌন্দর্য্য আপনার মতই এমন অটুট ছিলো।তবে আপনার চেহারার স্পেসিয়ালিটি হচ্ছে যাদুকরী কান্তি আর আপনার স্বভাবের রহস্যময়তাটা যে কাওকেই পাগল করে দেয়ার মত!” মিলা তখন মন দিয়ে রিপোর্ট পড়ায় ব্যস্ত।রিপোর্ট পড়া শেষে ফাইলটা শাকিলের টেবিলের উপর রেখে নিরবে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলো। এর মধ্যে পিয়ন মুরাদ আরোও দু’দুবার এ কক্ষে ঢুকলো, একবার গাড়ির চাবি নিতে; গাড়ি মুছবে বলে, আরেকবার চা দিতে হবে কি না তা জিজ্ঞেস করতে।শাকিল বিরক্ত স্বরে বল্লঃ
- “মুরাদ, তোমাকে না ডাকলে, এ ঘরে আজ আর এসো না!প্রয়োজন হলে আমি-ই তোমাকে ডাকবো” বুক পকেট থেকে কলমটা বের করে মিলার দিকে বাড়িয়ে দিলেন বস।
- “নিন, রিপোর্ট-টা লিখে ফেলুন!”
দরজার দিকে পা বাড়ালো মিলা। হাতে তার কমলা রঙের ফাইল।
- “সে কি! কোথায় যাচ্ছেন?
- “আমার রুমে। রিপোর্ট-টা লিখা শেষ করে আবার ফিরে আসবো। মুখের শক্ত হয়ে ওঠা পেশীগুলোকে সংযত করে হাসি টেনে এনে শাকিল সাহেব বল্লেনঃ
- “আচ্ছা ঠিক আছে! আবার এলে আমার সাথে চা খেতে হবে কিন্তু!” প্রায় আধ ঘন্টা পর বসের রুমে আবার এলো মিলা।আগের মত সহজ আচরণ এবার আর তার নেই।এখন সে আরো বেশি সংযত ও কৌশলী।ঢুকার সময়-ই রিপোর্ট-টির বিষয়ে আলোচনার প্রসংগ তুলে রুমে প্রবেশ করলো মিলা।
-“স্যার, কাজ তো কিছুই করেনি তারা! দিব্যি রিপোর্ট বানিয়ে বসে আছে!ডাটা প্রসেসিং এও মারাত্মক ত্রুটি!আমাকে সাইট-টা কি দেখানো যাবে, স্যার?!” সুচতুর বস মুহূর্তে সামলে নিলেন নিজের মুড,
-“ আহা! কষ্ট করে আপনি সাইট দেখতে যাবেন কেন? আপনি জাষ্ট রিপোর্টের মন্তব্যের জায়গায় ওকে লিখে সাইন করে দিন!সাইট দেখতে চাইলে একদিন আমি-ই না হয় আপনাকে সাথে করে নিয়ে যাব!চমতকার জায়গা সে’টা!টংগী আর উত্তরার মাঝামাঝি।নদী ভরাট করে প্লট তৈরীর কাজ চলছে, আপনার ভালই লাগবে।দিন! চট করে এখানে আপনার স্বাক্ষরটা দিয়ে দিন তো!”
প্রথমদিন বিধায় বসের সাথে কোন উচ্চবাচ্য বা সঙ্ঘাতে যাওয়া সমিচীন হবে না ভেবে মিলা চুপ রইলো।কমলা রঙ্গা ফাইল হাতে বস এবার মিলার পাশে এসে দাড়ালেন।নীল বল পয়েন্টটা বাড়িয়ে দিলেন মিলার দিকে।মিলা তার নিজের পার্সে হাত ঢুকিয়ে সিল্ভার কালারের বল পেনটা মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে স্বাক্ষর দিলো রিপোর্টের মন্তব্যে।মন্তব্য সে আগেই লিখে ফেলেছিলো, ওখানে সে লিখেছিলো- “অসন্তোষজনক”।
নীচে স্বাক্ষর দিয়ে লিখেছিলো- মালিহা তারান্নুম মিলা।
কমলা ফাইলটা চোখের সামনে ধরে; ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে শাকিল সাহেব মন্তব্য করলেন,
- “মিলা, আপনার স্বাক্ষর দেখলেই বুঝা যায়, আপনি জটিল মনস্তত্ত্বের একজন নারী”। মিলা হেসে জবাব দিলো,
- “ধন্যবাদ স্যার!আমাকে “নারী” বলে সম্বোধন করার জন্য।সত্যি-ই আমি নারী হিসেবে সমাজে কাজ করতে পেরে গর্ব বোধ করছি। সমাজের অনেক অন্ধকার স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর প্রতিভাত হচ্ছে আমার কাছে। আমি আমার রুমে যাচ্ছি স্যার! আরেকদিন চা খাবো!
২
সকাল থেকে অফিসের করিডোরে পায়চারী করছে ধ্রুব। সকালে কার্ড পাঞ্চ করার সময় প্রতিদিন একবার চোখে চোখ না রাখলে যেন তার দিনটাই মাটি হয়ে যায়। বিবাহিত ধ্রুব দুই ছেলের বাবা। এর আগে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাষক ছিলেন তিনি। ওখানকার-ই ছাত্রী তুলি; তার প্রেমে হাবু-ডুবু খাওয়া অবস্থায়; মধ্যবিত্ত পরিবারের ধ্রুব-র জন্য বিত্তবান বাবার এক মাত্র মেয়ে তানিশার বিয়ের প্রস্তাব আসে যা ধ্রুব-র বাবা মা উচ্ছসিত মনে গ্রহন করে নেন। ধ্রুব-র আপত্তি না মেনে ক্যান্সারের রোগী ধ্রুব-র বাবার মন রক্ষার্থে বিয়ে করে মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে ধ্রুব আর তানিশা।কিন্তু ঝিনাইদহের সেই মফস্বলের ধ্রুব কখনও মিলা নামের এমন রক্ষনশীলা মেয়ের প্রেমে পড়বে তা কি জানতো ধ্রুব?তানিশা তো কম সুন্দরী নয়? ছেলে দু’টো ও রাজপুত্রের মত সুন্দর দেখতে।অবশ্য ধ্রুব যে সুদর্শন তা একবারেই স্বীকার করা যায়।কিন্তু মিলা সামনে এলেই ধ্রুব ভুলে যায় সব। অতীত ভুলে বর্তমানটাই এখন ধ্রুবর কাছে স্থির।সময় যেন একটুও না হারায় তার জন্য সচেতন।মিলার সংযত দু’টো চোখ ধ্রুব-র অতি আকাঙ্ক্ষায় তৃষিত দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও দিন শেষে রাত অতিবাহিত হয় চরম উতসুক্যে।প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগে মনে; মিলা কেন এবং কিভাবে ধ্রুবকে এড়িয়ে যেতে পারে!যা পারেনি কখনও কোন নারী, হোক সে বিবাহিতা কিংবা অবিবাহিতা! পারেনি তানিশা কিংবা তার সহপাঠিরাও। পারেনি ধ্রুব’র বড় ভাইদের বউ-রা; যাদের ভাবী বলে সে সন্মান করতে চাইলেও ভাবী ডাক শুনতে তারা ছিলো তারা নারাজ। ধ্রুব’র পৌরষের কাছে হেরে যাওয়া তাদের নারীত্ব চাইতো পরিপূর্নতার আস্বাদ।পারেনি এড়িয়ে যেতে বন্ধু সহকর্মীদের বউ-রা, এমন কি অফিসের আকর্ষনীয়া সুদর্শনা সহকর্মী মাহা।ধ্রুব-র আকর্ষনে প্রায়-ই মাহা চলে আসে ধ্রুব-র কক্ষে আলাপ জমাতে। অথচ…
সুতির তাঁত শাড়ির আঁচলটা টেনে ধরে আছে মিলা।পায়ে পাতলা স্লিপার। বিন্দু বিন্দু ঘামে সারা মুখ চিক-চিক করছে। সি.এন.জি থেকে নেমে কার্ডটা পাঞ্চ করে সিঁড়ি বেয়ে দো’তলার দিকে উঠতে যেতেই পথ রোধ করে দাঁড়ায় ধ্রুব।শাড়ির আঁচলের প্রান্ত সামনের দু’টো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে মিলা শুধু আস্তে করে বলে,
- “আমি উপরে যাবো, আমার রুমে বসবো, ভালো আছেন তো, ধ্রুব ভাই?”
রুমে ঢুকতেই পেছন-পেছন ধ্রুব-ও রুমে ঢুকলো মিলা-র।
-“এক গ্লাস পানি খাওয়াবেন, মিলা?”
জগ পানি শুন্য দেখে গ্লাসটা হাতে নিয়ে রুম ছাড়তে উদ্যত হতেই ধ্রুব বাধা দিলো।
-“থাক মিলা!পানি লাগবে না! পানি পান করেও এ তৃষ্ণা ফুরাবে না।আপনার মত এত সুন্দরী মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনি মিলা! জীবনে অনেক এক্সট্রার প্রেম প্রস্তাব পেয়েছি, পেয়েছি অনেক ভাল্গার নারী সংগ, আমি আপনার মত একজন নারীর প্রেম চাই, প্রেম পত্র ভরা প্রেমের আকুতি চাই, ভালবাসা চাই, দেবেন?” মাথা নত করে মিলা উত্তর দেয়,
-“ভাবী ভালো আছেন? বাচ্চারা? ছোট ছেলেটা এখন কত বড়? বাচ্চাদের নাম কি রেখেছেন? ভাবী আর বাচ্চাদের নিয়ে একদিন বাসায় বেড়াতে আসেন, ভালো লাগবে।”
৩
আজ ৭ই আগষ্ট।ধ্রুব তার পরিবারসহ বেড়াতে আসবে মিলাদের ছোট্ট মেসটিতে।স্ব-পরিবারে ধ্রুব চলে যাচ্ছে ক্যানাডায়। ধ্রুব-র শ্বশুর স্পন্সরশীপ ভিসায় তাদের নিয়ে যাচ্ছেন নিজের কাছে। ১২ই আগষ্ট ফ্লাইট।সকাল থেকে গোছগাছে ব্যস্ত মিলা।সাথে তা’কে সাহায্য করছে শ্রেয়া আর রাধা।ওরা দু’জন-ই হিন্দু। একি বাড়িতে থেকেও যে যার মত ধর্ম মানে; কেউ কারো বিশ্বাসে আঘাত হেনে কথা বলে না, বা একে অন্যকে আলাদা চোখেও দেখেনা।শিক্ষার প্রকৃত মানেই বুঝি এই।মফস্বল থেকে আসা মিলা ওদের দু’জনের মত ততটা চালাক চতুর নয় যদিও কিন্তু তিনজনে মিলে শুরু থেকেই মেসের কাজগুলি ভাগাভাগি করে নিয়ে কাজ সেরে ফেলে চমতকার! শ্রেয়া আর রাধা পৃথক দু’টি বায়িং হাউজে চাকুরী করে। দু’জনের কর্মস্থল ভিন্ন হ’লেও একই ধরনের প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে বিধায় আলোচনার বিষয়বস্তুতে মিল খুঁজে পায় তারা। মিলা ওদের মাঝে নিজেকে কেমন বেমানান বোধ করে। ওদের প্রসাধণ চর্চিত মুখটাও কেমন মেকি লাগে এই ঢাকা শহরের মেকি রূপের মত।ওদের দু’জনকে সব সময় সুখী চেহারায়-ই দেখতে পায় মিলা। বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফিরে আর সন্ধ্যার পর যে যার মনের মানুষটির সাথে বেড়িয়ে পড়ে আনন্দ অভিসারে।গত রাতে শ্রেয়া দেখালো তার অফিসের বস তা’কে একটা জামদানী শাড়ি উপহার দিয়েছে।মিলা শুধু ভাবলো, বস শাড়ি দিবে কেন? এই শহরের অনেক কেন’র উত্তর মিলা’র নির্মল মন জানে না; জানার কথা-ও নয়।শেষ বিকেলের ক্লান্তির মত মিলাকে খুব বিষন্ন মনে হয় আজ।মনে ভয় হয়, ধ্রুবকে যে সে বাসার ঠিকানা দিলো; যদি একা আসে! আবার পরক্ষনেই মনটাকে প্রবোধ দেয়; একা এলেই বা কি? মিলা নিজে দরজা না খুল্লেই হ’লো! অবশ্য রুমমেট দু’জনকে আজ একটু আগে মেসে ফিরতে অনুরোধ করে রেখেছিলো সে।মিলা জানে-না; তারা দু’জন আদৌ তার এ অনুরোধ রাখবে কি-না! এক রুমের মেসের এক চিলতে বারান্দাটি অভিজাত উত্তরখান এলাকার আভিজাত্যকে এক টানে চোখের সামনে এনে দেয়।সবাই বিত্তশালী হওয়ার প্রতিযোগিতায় কি ভীষন ব্যস্ত! এত ব্যস্ততা আর প্রতিযোগিতার মাঝে হৃদয়বৃত্তির ঠাঁই কোথায়? মিলা যে ঠিক বাস্তববাদী তা বলা যায়-না, হৃদয়বৃত্তির পূজারী যে সে, তা-ও না!মিলা তার নিজ মনোস্বত্বে মনোনিবেশ করতে চাচ্ছে, নিজের মনের ঠিকানা খুঁজতে চাচ্ছে।পাঁচতলা বিল্ডিং এর মেসটির এই চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে চোখ গেলো এক জোড়া শালিকের ঠোঁটে ঠোঁট লাগানোর দৃশ্যে।মিলা বুঝতে চেষ্টা করলো, এটিকে কি বলে- আদর, সোহাগ, না কি কামনা? মিলা আসলে কোনটি চায়? কার কাছে চায় এমন? ঘরে ঢুকে নিজের সিঙ্গেল চৌকিটার উপর অফিস থেকে ফেরার পথে হকার্স মার্কেট থেকে কিনে আনা নতুন চাদরটা বিছায়।বিকেল ৫:৪৭ বাজছে। ধ্রুব আসার সময় দিয়েছে সন্ধ্যে ৭ টা।রাতের খাবার রান্না করার আয়োজন করতে মিলা রান্না ঘরে ঢুকে।
সন্ধ্যে ৬ টার আগেই ফলের প্যাকেট হাতে ঘরে ঢুকে রাধা, এর পর ব্যাকারী থেকে আনা বিস্কিট আর রসমালাই হাতে উচ্ছসিত কন্ঠে ঘরে আসে শ্রেয়া-
-“এই মিলা, তোর কলিগ দেখতে কি হ্যান্ডসাম না কি রে? নইলে এত্ত আয়োজন স…ব ভেস্তে যাবে!” হাসতে হাসতে বলে ফেল্ল শ্রেয়া।মিলা ভাবছিলো ওরা কি সুন্দরভাবে নিজেদের নিজেরা বুঝে আর কি চাওয়া উচিত তা নিজেরাই স্থির করে নেয়; যা পছন্দ করা উচিত তা করে, অথচ মিলা তা পারে না।ডিম আর সব্জী মিশিয়ে রান্না করা নুডুলস একটা বাটিতে ধনে পাতা কুচো সহ সাজাতে সাজাতে মিলা ভাবে ধ্রুবকে কি তার ভালো লাগে? ধ্রুব হ্যান্ডসাম কি না তা কি তার ভাবা উচিত? মিলা এভাবে কখনও কেন ভাবতে পারে না, বা পারেনি?
সন্ধ্যে ৭টার আগেই দরজার কলিং বেল্ বেজে উঠলো। দরজাটায় কি-হোল নেই তাই দরজা খুলতেই হকচকিয়ে গেলো মিলা। এত আগেই ওরা চলে আসবে তা ভাবেনি! ভেবেছে ময়লা নেয়ার জন্য বুয়া এসেছে। প্রতি সন্ধ্যায় বুয়াটা এসে এই বিল্ডিং এর সব বাসার ময়লার ব্যাগ নিয়ে যায়, আর মাস শেষে প্রতি বাসা থেকে এক’শ টাকা করে তা’কে দেয়া হয়।
উত্তেজক রাজকীয় ভঙ্গীতে ঘরে ঢুকে ধ্রুব।পারফিউমের কড়া ঘ্রাণে মিলাদের মেসটা ভরে ওঠে।উচ্ছ্বসিত কন্ঠে শ্রেয়া বলে উঠে-
-“ভাইয়্যা, আপনি তো দারুন হ্যান্ডসাম! মডেলিং করেন না কেন?”
নাটকীয় ভঙ্গীমায় চুলগুলোকে হাত দিয়ে সরাতে সরাতে মুচকি হাসে ধ্রুব।তানিশাও হাসে । স্বামীর ব্যাপারে তরুনীদের এহেন উচ্ছ্বসিত সংলাপে তানিশা মোটেও বিচলিত নয়, বরং গর্বিত, কারন সে এমন-ই একজনকে তার জীবন সাথী হিসেবে চেয়েছিলো, যে কি না নায়কসুলভ।ছোট ছেলেটাকে ধ্রুব’র কোলে দিয়ে তানিশা তার বর ছেলেটাকে কাছে টেনে মিলার চৌকিটায় বসে। মিলার খুব ইতঃস্তত বোধ হচ্ছে! কারন- এক রুমের এই মেসে তিন দেয়াল ঘেষা তিন চৌকি ছাড়া আর আছে তিনটা প্লাষ্টিকের চেয়ার। বসতে দেয়ার জন্য সোফা ও নেই। ধ্রুব একবার-ও বসেনি। ঘরময় পায়চারী করছে আর মিলাকে তাকিয়ে দেখছে।লাজুক ভঙ্গীতে তানিশাকে মিলা বল্লঃ
- “আমার সত্যি ই অবাক লাগছে ভাবী, আপনাকে পেয়ে!”
- “কেন, আশা করেন-নি বুঝি?”
- “না, ঠিক তা না! ভেবেছিলাম ধ্রুব সাহেব আপনাকে যদি না আনেন!” অট্টহাসিতে ভেঙ্গে দিলো মিলার অবিশ্বাস।ধ্রুব তানিশাকে তার বুকের কাছে টেনে নিয়ে বল্লঃ
- “দেখেন তো মিলা, এমন অপরুপা বউ রেখে কি একা কোথাও যাওয়া যায়? এক মুহূর্ত-ও কি দূরে থাকতে ইচ্ছে করে?”
কি এক অজানা কষ্টে বুকে চাপ ধরে থেকে গলা বেয়ে সেই চাপটা যেন কন্ঠ রোধ করে দিতে চাইলো মিলার। একটা ঢোক গিলে অনেক চেষ্টার পর ধ্রুব’র চোখের ভিতর চোখ রাখলো মিলা।ছলনার হাসি হাসলো ধ্রুব মিলার দিকে চেয়ে।বাচ্চা দু’টোকে নিয়ে আর গল্প-তামাশায় সময়টা কেটে গেলো বেশ।শুধু মিলার মনে ডাগ কেটে গেল কিছু বিস্ময়! নুডুলস খেতে গিয়ে তানিশার ছ্যাবড়ে যাওয়া লিপষ্টিক আলতো আঙ্গুলে ধ্রুব’র মুছে দেয়ার যত্ন, বাচ্চা দু’টোকে অপার মায়ায় আদর করার মুহূর্তগুলো, গল্পের ফাঁকে ফাঁকে নিরব চোখে মিলাকে ধ্রুব’র লক্ষ্য করে যাওয়া, সব শেষে সবাই মিলে গান গেয়ে শুনানোর সময় ধ্রুব’র চোখ মুখ আর অভিব্যক্তি জুড়ে ফুটে ওঠা দুষ্টুমী সব মিলে অফিসে দেখা- মিলার পিছু নেয়া সেই কাতর যুবক ধ্রুবকে যেন ঠিক মিলাতে পারছিলো না মিলা!
বাঙ্গালী সুন্দরীদের চেয়েও অনেক বেশী সুন্দরী আর আকর্ষনীয়া তানিশাকে ধ্রুব’র পাশে অপূর্ব জুটি মনে হয়েছে শ্রেয়া আর রাধার কাছে। মিলা লক্ষ্য করলো আনন্দের ঝর্ণা-ধারা তাদের এই ছোট্ট মেস রুম-টা জুড়ে।ধূসর সিল্ক শাড়ির নীল আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানতেই তানিশার সৌন্দর্য্য যেন আরও বেড়ে যায়। ধ্রুব তখনও অপলক তাকিয়ে মিলার দিকে।এ দৃষ্টি যেন ধ্রুব’র স্বাভাবিক আচরণকে ব্যহত করছে।চট করে মিলার খুব কাছে এসে অত্যন্ত দৃঢ় স্বরে ধ্রুব বলেঃ
- “আজ নিশ্চই ফোন নাম্বারটা দিতে আপত্তি করবেন না!চলেই তো যাচ্ছি!”
রাইটিং প্যাডের কোন ছিড়ে নম্বরটা খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাতে লিখে দিলো ধ্রুবকে মিলা।
- “নামটা?”
মিলা ত্রস্ত হাতে কাগজ-কোনটা ফেরত নিয়ে, এবার লিখলো--- মিলা।
কাগজটা হাতে নিতে নিতে সবাইকে খুব অবাক করে দিয়ে ধ্রুব হেসে বল্লঃ
-“আপনার মত এত সুন্দরী আর ভালো মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনি- মিলা!
You are the beauty of all beauties! আপনাকে আমি ভুলতে পারবো না!”
বিশ্ময়ে হতবাক সবাইকে সামলে নিতে তানিশা বলে ওঠলো-
- “আমার বাবার বাসার ফোন নাম্বারে ফোন করলে আমাকে পাবেন, মিলা। এই নিন ঠিকানা! যোগাযোগ রাখবেন!
৪
৮-ই আগষ্ট, সকাল ৮টা। মিলা তখনও অফিসে এসে পৌঁছোয়নি।উত্তরার ফায়দাবাদ এলাকা থেকে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টর বেশী দূরে নয় যদিও; মিলা সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী করে ফেলছে।
অবষন্ন মন আর দেহটায় গোসলের পানি ঢাল্ল বেশ করে! যাওয়ার আগে বালতিতে পানি ভরে জমিয়ে না রাখলে আবার অফিস থেকে ফিরে এসে হাত মুখ ধোওয়ার-ও পানি থাকবে না! এই এলাকায় সন্ধ্যার পর থেকেপানি আর বিদ্যুত দু’টোর সাপ্লাই ই থাকে।কিন্তু দিনের বেলায় কলে পানির সাপ্লাই থাকে না।ফ্যান চালানোর জন্য বিদ্যুত ও থাকে না। এ এলাকায় বেশিরভাগ মহিলাই
চাকুরিজীবি, তাই যারা বাড়ির বাইরে বের হোন, তাদের সমস্যা নেই। তবে পানি জমিয়ে রাখলে; প্রচন্ড গরমে অফিস ফেরত মানুষগুলো বাড়ি ফিরে এসে গোসলে ঠান্ডা পানি পায়, এই আর কি!
নইলে বাসায় এসে সরাসরি ট্যাপের পানি দিয়ে গোসল সারা যেতো না। পানি তখনো গরম-ই থাকে।এত প্রতিকূলতার মাঝেও এই ব্যস্ত নগর জীবনে অভ্যস্ত মানুষগুলোর ছুটোছুটি মফস্বলের সারল্যে বেড়ে উঠা মিলাকে বিস্মিত করে।ঢাকা শহরে চাকুরী করার না হয় মিলার যথাযথ কারন রয়েছে।শহরের অভিজাত ঘরের মেয়েরা তো চাকরী করতে বাধ্য নয়, তবে তারা কেন এমন হন্যে হয়ে ঘুরে?
অফিসে আসতেও দেরী হলো আজ।সি.এন.জি নিয়ে সোজা ঢুকে গেলো অফিসের গেইট পেরিয়ে ক্যাফেটেরিয়া বরাবর।সকালের নাস্তাটা আজ ক্যাফেটেরিয়া থেকেই কিনে খেতে হবে মিলার। ক্যাফেটেরিয়ার দরজায় পা রাখতেই সামনে এসে দাড়ালো ধ্রুব।
- “রাতে ভালো ঘুম হয়নি বুঝি? আসতে আসতে এত দেরী যে?” মিলার খুব কাছে এসে বলল ধ্রুব।
- “কাল তো অফিস থেকে আপনাকে ফেয়ারওয়েল দিবে, তাই না- ধ্রুব সাহেব?” ধ্রুব-র প্রশ্নটাকে এড়িয়ে ক্যাফেটেরিয়াতে বয়কে নাস্তার অর্ডার দিলো, মিলা।
- “শুনু্ন, মিস মিলা!” ধ্রুব-র কাকুতি।
-“একটু, প্লীজ!” মিলা ব্যস্ততা দেখাচ্ছে।
-“ হুম!” দু’হাতের হাত ভাঁজ করে সাদা টেট্রনের শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা ধ্রুব ক্যাফেটেরিয়ার বাইরে এসে দাঁড়ালো।
একটু পর ক্যাফেটেরিয়া থেকে মিলা বের হতেই মিলার দিকে তাকিয়ে ধ্রুব মুচকি হাসলো।হাতের পার্সটা কপালের এক দিকে তুলে মুখের বাম দিকটা ঢেকে অভিব্যাক্তি আড়াল করে নিলো মিলা।কেন যেন নিজের ভেতরকার তোলপাড় হওয়ার অনুভূতিটা ধ্রুবকে দেখাতে ইচ্ছে করছিলো না।আর মিলা যে ধ্রুবকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে ভালোবাসে; তা-ও-তো নয়! তবে রুঢ় আচরণ করে তাড়িয়ে দেয়ার মত কোন কাজ এ পর্যন্ত করেনি ধ্রুব।আর কোনও পুরুষকে ভালবাসলে কেমন অনুভূতি হয়, তা আজও জানা হয়ে ওঠেনি মিলার।মধ্যবিত্ত পরিবারের চরম বাস্তবিকতায় জীবন কেটেছে তার।মেইইন অফিসে ঢুকা পর্যন্ত একটা কথাও আর বলেনি ধ্রুব।শুধু মাথা নিচু করে নিরব থেকে ধীর পায়ে মিলার পাশাপাশি হেঁটেছে।এবার নিরবতা ভেঙ্গে মিলা বল্লঃ
-“ধ্রুব সাহেব, আপনি যে আমার সাথে দুষ্টুমী করেন, অফিসের লোকজন তো আপনার সাথে আমার নাম জড়িয়ে গুজব রটাবে, সেটা কখনও ভেবেছেন?”
চমতকার ভঙ্গিতে হেসে ধ্রুব জবাব দিলো,
- “আপনার সাথে নাম জড়িয়ে গুজব রটলে, আমি যা খুশী হবো-না মিলা! আমার জনম স্বার্থক হয়ে যাবে!”
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মিলা কিছুক্ষন, তার পর খুব অসহায় স্বরে প্রশ্ন করলো ধ্রুবকে-
-“কিন্তু কেন?”
এবার অন্যদিনের মত সেই দুষ্টুমীর ঢঙ্গে কুর্নিশ করে মিলাকে জবাব দিলো,
-“সে আমি আপনাকে বুঝাতে পারবো-না মিলা!”
৫
পরদিন অফিসে ঢুকতেই মিলা একটু অপ্রস্তুত বোধ করলো।সবাই এসেছে পার্টি ড্রেসে। মিলা ভুলেই গেছে যে আজ ধ্রুবকে অফিস থেকে বিদায় সম্বর্ধনা দিতে যাচ্ছে।খুব সাদা-মাটা সালওয়ার কামিজে চলে এসেছে মিলা।ম্যানেজার একটু ক্ষুব্ধ চোখে মিলার দিকে তাকালেন,
-
“Mila, You are Looking Exhausted Today!”
বিব্রত মিলা কি উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারছিলো না।মিরন সাহেব টিপ্পনি কেটে নীচু স্বরে বললেন,
- “মিলা আপা আজ যথার্থ বিরহে আছেন!”
অফিসের বিশাল হল রুমে আজ দুপুরের লাঞ্চের আয়োজন। বক্তব্য রাখছেন অফিসের একে একে অনেকেই, মিলার বক্তব্য রাখার পালা এলে মিলা যখন দেখলো ধ্রুব-র চোখ ঠিকরে জল আসতে চেয়ে চোখ দু’টো বড় বেশি লাল হয়ে অভিমান প্রকাশের ব্যঞ্জনায়, মিলার মন ক্যামন করা এক অনুভূতিতে বলতে পারলো না তেমন কিছুই।শুধু বলল-
- “ আমাদের কাছ থেকে দূরে গিয়েও প্রবাসে পরিবার নিয়ে খুব ভালো থাকুন, ধ্রুব সাহেব! শুভ কামনা!” এক অভাবনীয় কাঁপুনি অনুভব করলো মিলা নিজের দেহে।
সবশেষে ধ্রুবকে যখন মাইক্রোফোন দেয়া হলো, মিলার দিকে সরাসরি তাকিয়ে ইংরেজী কবিতার চরন আবৃত্তি করতে করতে ধ্রুব এসে দাঁড়ালো ঠিক মিলার সমূখে-
-“You are the Wonder! Wonder of this
wonderful world!
You are Beautiful! You are the most Beautiful of all the Beauties!”
শত জোড়া চোখ নিবদ্ধ মিলার দিকে।মিলা এখন শংকিত কিংবা বিব্রত কোনটাই নয়! সবার সামনে ধ্রুব এভাবে তার সাথে ফ্লার্ট করতে পারলো? নিজের ভিতরে নিজে ডুব দিলো যেন; তারপর পানকৌড়ির মত জলে ডুব দিয়ে তুলে আনলো এক কষ্ট ঝিনুক।তা’তে মুক্ত আছে কি নেই ভাবতে ভাবতে মিলা চলে এলো অফিস গেইট পর্যন্ত।
-“ ম্যাডাম, আপনার তো লাঞ্চ করার কথা সবার সাথে!” পিয়ন মুরাদ দৌড়ে এসে মিলাকে বল্ল।কানে যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না, বা শুনতে চাইছে না মিলা।হাতে ধরে থাকা পার্সটাও যে টেবিলের উপর রেখে চলে এসেছে; খেয়াল নেই!বাসার কাছাকাছি চলে এসে মনে পড়লো কথাটা।মোড়ের দোকানীর কাছে সি.এন.জি ভাড়াটা চেয়ে নিলো। ভাড়া মিটিয়ে ঘরে ঢুকেই বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে থাকলো মিলা।মিলার কাছে ধ্রুব’র সব কিছুই মনে হয়েছে অভিনয়, ভাণ, তার কিছুই সঠিক নয়! সত্য নয়! জেদের বশে সুদর্শন ধ্রুব জয়ী হতে চেয়েছে, চেয়েছে রক্ষনশীলা মিলাকে ছলনার আশ্রয় নিয়ে কাবু করে, নিজেকে নারী-মোহন পৌরষের অহংকার প্রতিষ্ঠা করতে। ধ্রুব এটা কি করলো? অথচ ধ্রুব আর মিলার মাঝে চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বের সুন্দর সম্পর্ক হতে পারতো! হতে পারতো চিরস্থায়ি এমন সম্পর্ক যা ইতিহাস হওয়ার মত! অন্ততঃ মিলা সেরকম ধরনের-ই মেয়ে, যে কি না সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলার মত নয়, আবার নিজ স্বার্থ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সম্পর্ক গড়বার মত-ও নয়!বালতিতে জমিয়ে রাখা সবটুকু পানি ঢেলে গোসল সারলো মিলা।মনে হচ্ছিলো মনের সব যন্ত্রনা ভর করে আছে রন্ধ্রে-রন্ধ্রে, মাংসের প্রতিটি আঁশে-আঁশে; যা কি না মগের পর মগ ঠান্ডা পানির ধারা ঢেলেও স্বাভাবিক করা যাচ্ছিলো না!ভেজা চুল না মুছেই
বিছানায় এলিয়ে পড়লো মিলা। চুলের পানিতে বালিশের তুলো চুপচুপে। পাখার বাতাস থাকা জরুরী ছিলো এ সময়, কিন্তু নেই। রাতে বিদ্যুত আসবে।গভীর ঘুম আসা চাই এখন!যেন সব দৃশ্য মুছে যেতে পারে তার মন থেকে। ভ্যাপসা গরমে চোখ বুজে শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পরতে পারলো মিলা।
৬
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে তখন। ইতিমধ্যে কলে সাপ্লাইয়ের পানি চলে এসেছে। স্নান-ঘরে বালতি ভরে পানি উপচিয়ে পড়ছে- ঝর ঝর করে। খেয়াল নেই কোন দিকে, গভীর ঘুমে অচেতন মিলা।অফিস ছুটি শেষে মেসে ফিরে কল বন্ধ করলো রাধা। অন্ধকার ঘরে ঘুমে বিভোর মিলাকে কামড়ে সুপুষ্ট মশারা ঢোল পেট নিয়ে নড়তে পারছে না। তাই তারা মিলার আশে পাশেই চাদরের এখানে সেখানে বিশ্রামরত।ঘরে বাতি জ্বালাতেই চোখ কুঁচকে তাকালো মিলা।
- “কখন এলি?” ঘুম জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করলো মিলা।
-“ অনেক্ষন! এই অসময়ে ঘুমাচ্ছিস যে? শরীর খারাপ না কি রে?”
- “হুম”
-“ধ্রুব দা’র ফেয়ারওয়েল পার্টি কেমন হলো?”
-“ভালো”
মিনি শ্যাম্পুর প্যাক আর কাপড় হাতে গোসলে চলে গেলো রাধা। চিতকার করে গান গাইছে আর গোসল করছে রাধা। মুচকি হাসলো মিলা। রাধার এই স্বভাবটা মিলার খুব পছন্দ। গান গাইতে পারুক বা না পারুক; সব কাজ সে গান গেয়ে গেয়ে-ই করে। অথচ মিলা তা পারে না। অভিমান হয়, মনে হয় কলেজে সেরা গায়িকা ছিলো সে। অভাবের সংসারে হারমোনিয়ামটাও বিক্রি করা হয়ে গেছে।লাইটের সুইচ অন করতেই মনে পড়লো অফিসের টেবিলের উপর যে পার্স টা ভুলে ফেলে এসেছে; তা’তে টাকা আছে ৩,০০০; ধ্রুব-র জন্য উপহার কিনবে বলে টাকাটা সাথে নিয়ে গিয়েছিলো।দামী টাচ মোবাইলটাও পার্সের ভেতর রয়ে গেছে। এখন আবার অফিসে গিয়ে পার্সের খোঁজ নিতে শক্তি পাচ্ছে না।কাঁচেড় চুড়ির টুং-টাং শব্দ কানে আসছে মিলার। রাধা গোসল সেরে এসে শাড়ি পড়ে প্রসাধণে সাজাচ্ছে নিজেকে। গুন-গুন করে গানের সুর ভাজতে ভাজতে মিলার কাছে এসে ওর হাতটা চেপে ধরে বলল-
“এত হ্যান্ডসাম লোকটাকে আজ আলাদা করে একটু সময় দিবি না? এতটা রক্ষনশীলতা ভালো না!” চমকে উঠলো মিলা।রাধা তা’কে এ কথায় কি বুঝাতে চাইছে?”
রাধা বাইরে বেরুনোর পর, ঠান্ডা পানির ঝাপটায় মুখটা ধুয়ে নিয়ে; বেসিনের সামনের আয়নায় নিজেকে দেখলো মিলা।পাশাপাশি তানিশার চেহারার ঔজ্জ্বল্য তার নিজের কাছেই নিজের সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিলো।কোথায় তানিশা, আর কোথায় সে! কিন্তু ধ্রুব আসলেই যে মিলাকে প্রহসণ করে- তা একবারও আর মনে হচ্ছে না কেন? দরজার কলিংবেলটা বেজে উঠলো খুব চাপা সুরে।মনে হ’লো খুব আলতো চাপে কলিং বেল বাজিয়েছে কেউ।দরজা খুলতেই মিলার পার্সটা বাড়িয়ে দিয়ে মাথা নত করে সামনে এসে দাঁড়ায় ধ্রুব।হচকচিয়ে যায় মিলা খানিকটা।কিন্তু পরক্ষনে মনে হয় তার; কি যেন কি ঘটে যাচ্ছে! ধ্রুব হারিয়ে যেতে থাকে মিলার ভেজা চুলের অরণ্যে… মিলার মুখাবয়বের তিল পরিমান বাদ না রেখে ভরিয়ে দিতে থাকে তার মাদক ছোঁয়ায়।মিলা যেন পৃথিবী খুঁজে পায় স্বস্তির।প্রশান্ত চোখ জোড়ায় চোখ রাখে ধ্রুব মিলার চিবুক তুলে। বিছানায় জড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে বসন্তের রঙ্গিণ ফুলের পাপড়ি। দেহ ত্বকের নমনীয় কমনীয় অনুভূতিগুলো সব দলিত মথিত করে নেয় ধ্রুব-র পৌরষের আধিপত্য।আর মিলা তার সুধা ঢেলে
প্রমাণ করে; সে এক সুন্দর বসুন্ধরা- রঙ্গে, ঐশ্বর্য আর মাধুর্যে।বুকের কাছে টেনে এনে ধ্রুব মিলার চুল্গুলো মুখ থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
- “এত ভালোবাস আমাকে? এতখানি ভালোবেসে এভাবে নিজেকে আড়াল করে রাখতে কেন, মিলা? এ অন্যায়, ভারি অন্যায়!” উত্তর দিতে পারছে না মিলা।সে শুধু চোখ বুজে ধ্রুব’র গায়ের ঘ্রাণ টেনে নিচ্ছে।মাতাল করা পুরুষের ঘ্রাণ নারীটিকে করে দিয়েছে বিবশা।জীবনে প্রথম পুরুষের স্পর্শ আর দেহের ঘ্রাণ পেয়ে সমাজ, ধর্ম, নিয়ম, শাসন সব ভুলে গেছে মিলা এক নিমেষে।দরজার কাছ থেকে আবার ফিরে এসে মিলাকে জড়িয়ে নিলো ধ্রুব প্রকৃতির মত। মিলার মনে “দ্বিধা” শব্দটির বিন্দুমাত্র আর কাজ করছিলো না। জলদ কন্ঠে ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো,
- “আমার সাথে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাবে আজ?কাল বিকেলে তো চলেই যাচ্ছি! আর দেখা হবে না!”
সি.এন.জিতে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে থেকে; ঢাকা শহরের উত্তরা থেকে শহরের কোন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছুচ্ছে- দু’জনের একজনের-ও সেদিকে খেয়াল নেই।বেইলী রোডের নাটক পাড়ার লোকজনের ভীড়ে মিশে গেলো দু’জন। নাট্য-মঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেলো দু’জন আরেক নির্জন কোনে।যেন অনন্ত জীবনে আঁকড়ে ধরে রাখার বাসনা আর আকাঙ্ক্ষায় দু’জন দু’জনকে বেঁধে নিলো বাহুর বাঁধনে। চঞ্চুতে চঞ্চুতে তুলে নিতে থাকলো অঢেল সুপ্ত নির্যাস। সাকির পাত্রে অফুরাণ মদ যেন আর ফুরোয় না।পান পাত্র হাতে নেশায় চুর মদ্যপায়ি যেন রাতের আঁধার নিংড়ানো মদ ক্রমাগত পান করেই চলেছে। রাত বাড়ছে। ডুকড়ে কেঁদে ওঠে মিলা।
-“আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা, ধ্রুব!”
বেইলি রোডের পথ পেড়িয়ে অনেকটা দূর দু’জনে একসাথে হাঁটলো। সি.এন.জি পাওয়া যাবে না। এ দিকে মিলাকে রাতেই পৌঁছুতে হবে উত্তরায়, আর ধ্রুব চলে যাবে বারিধারায়।রাত ১০টার পর বেইলি রোডের এ পাশটা জনশুন্য হতে থাকে। অবশেষে একটা সি.এন.জি পেলো তারা। রাস্তায় মিলাকে জড়িয়ে ধরে থেকেই গল্প করতে থাকলো ধ্রুব; আরেকটি মেয়ের।রুপা তার নাম।সে না কি ধ্রুবকে মিলা যতটা ভালোবাসে, তার চেয়েও বেশি ভালোবাসতো,