
ছেলেটা
এক টাকার কম এখন আর
কাউকে ভিক্ষা দেওয়া যায় না। মানিব্যাগের খুচরোর চেন খুলে দুটাকা আর এক টাকার কয়েন
সরিয়ে পাঁচ টাকার কয়েনটাই হাতে নেয় তৃণা। খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পরা শ্যামলা রঙের
ছোট্ট ছেলেটা হাতটা পেতেই রয়েছে। পাঁচ টাকার কয়েনটা ওর প্রসারিত হাতে ফেলে দেয়।
পরমুহূর্তেই ছোট্ট পা দুটো নেচে ওঠে। তৃণা তাকিয়ে থাকে। কত বড় হবে? টিকলুর থেকে
ছোটই হবে মনে হয়। নাচের ছন্দে রাস্তা পার হয়ে চায়ের দোকানে ঢোকে। অল্পবয়সী যে
তিনটে মেয়ে একটু আগে ছেলেটাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তারাও ওর খুশি দেখে হেসে ওঠে। পাঁচ
টাকাটা চায়ের দোকানের বউটার দিকে বাড়িয়ে ধরে। টাকাটা হাতে নিয়ে তার দিকে একটা
বিস্কুট এগিয়ে দেয় দোকানী। বিস্কুটটা নিয়ে দোকানের একপাশে দালানের ওপরে গিয়ে বসে।
মহিলাটি ছোট কাঁচের গ্লাসে এক গ্লাস চা এনে নামিয়ে রাখে তার সামনে। চায়ে বিস্কুটটা
ডুবিয়ে পরিতৃপ্তির কামড় দেয় ছেলেটা। টিকলুর মুখ ভেসে ওঠে তৃণার মনে।
আজ সকালেও দুধ খাওয়া নিয়ে খুব
রাগারাগি হয়েছে টিকলুর সঙ্গে। রেগে গেলেই ওর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গিয়ে ঠোঁটদুটো থরথর
করে কাঁপতে থাকে। তারপর চোখে জল। তাদের একমাত্র সন্তান টিকলু ঘোষণা করেছে নতুন
আরেকটা বেব্লেড না এনে দিলে কাল থেকে আর কিছুতেই দুধ খাবে না। এই নিয়ে বোধহয় দশটারও
বেশি বেব্লেড হবে। তবু তৃণা জানে অফিস থেকে ফেরার সময় ও কিনে নিয়ে যাবে। সারাদিন
মা ছাড়া থাকে যে ছেলেটা।
চা-বিস্কুট শেষ হয়ে
গেছে। চায়ের তলানি পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছে।
ইস্, ছেলেটাকে দশটা টাকা দিলেই হত, বিস্কুটের বদলে পাঁউরুটি খেতে পারত। এখন গিয়ে
দিয়ে এলেও তো হয়। নাহ্, থাক, সেটা বোধহয় বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আর তাছাড়া রোজই এই
বাসস্ট্যান্ডে আসতে হয়। চিনে রাখলে আবার মুশকিল, রোজই চাইবে।
বাস এসে গেছে। সম্বিত
ফিরে পায় তৃণা। জানলার ধারের সিটে গুছিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকায়। ছেলেটাকে আর দেখা
যাচ্ছে না। বাসটা ছেড়ে দিয়েছে। ছেলেটার মুখটা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছেনা, অথচ
টিকলুর অভিমানী মুখটাও ভেসে উঠছে বারবার। যেন দুটো মিলেমিশে যাচ্ছে ওর মনের মধ্যে।
প্রাণপণে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে শ্যামলা রঙের অপরিচ্ছন্ন ছোট্ট বিশেষত্বহীন
সাধারণ মুখটাকে। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে...
সহযাত্রী
রোজকার মতো আজও ছেলেটা
লেডিজ সিটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নাহ্, ছেলে বললে বোধহয় একটু ভুল হবে। ওর পরণে
আজ রানি কালারের লেডিজ গেঞ্জি আর লেডিজ জিনস। অধিকাংশ দিনই লেডিজ টি-শার্ট বা
গেঞ্জিই পরে ও। ঠোঁটে লিপস্টিক। আজ কানে রিংটা পরেনি। তবে ঘাড় অবধি লম্বা ঘন
কোঁকড়ানো চুল পিছনে ব্যাক ক্লিপ দিয়ে আটকেছে। লেডিজ সিটের একপাশটা তখনও খালি ছিল।
ও বসেনি। কোনদিনই বসেনা, যদিনা একাধিক সিট খালি থাকে। কখনও বসলেও মহিলা কেউ এসে
দাঁড়ালে উঠে যায়।
আজকেও সালোয়ার কামিজ
পরা তরুণীটি দেখে সরে দাঁড়াল। জেনারেল সিটের দিকে ছেলেটি পারতপক্ষে দাঁড়ায় না।
অনেকটা খালি থাকলে অন্যদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কোনও কোনওদিন বসে অবশ্য।
ওদিক থেকে একেকদিন টুকরো মন্তব্যও উড়ে আসে। মেয়েরা অধিকাংশই নিরাসক্ত থাকে। কেউ
কেউ অবশ্য সরাসরি মন্তব্য না করলেও ঈষৎ বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়, যেন এ আপদটা এখানে
কেন, ওদিকে গিয়ে দাঁড়াতে পারেনা? বাধ্য হয়ে পাশে দাঁড়াতে হলে কেউবা আপনমনে বা অন্য
একটি মহিলাকে উদ্দেশ্য করে অনুচ্চারিত কথাটা বলেও ফেলে কখনও। একটা নীরব সম্মতি
ভাসতে থাকে লেডিজ সিটে। তবুও ও অন্যদিকে যায় না। লেডিজ সিটের সামনে চুপ করে
দাঁড়িয়ে থাকে।
ওর কোনও বন্ধু নেই।
বন্ধু অথবা বান্ধবী। রোজ ঠিক এইসময় কাঁধে একটা ছোট লেডিজ ব্যাগ নিয়ে হেদুয়ার মোড়ে
এসে দাঁড়ায়। দুশো চল্লিশ নম্বর বাসে উঠে লেডিজ সিটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। শেয়ালদা
এলে নেমে যায়।
মাঝে মাঝে বাসে অপরিচিত
মানুষেরা পরস্পরের সঙ্গে গল্প করেন। ভোট, গরম, বৃষ্টি, টি-টোয়েন্টি, বাজারদর এসব
যেকোনকিছুই আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। একেকদিন আবার সব চুপচাপ। কোনও কোনও পুরুষ কেন
লেডিজ সিটে বসে জানলা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে, কেন কেউ বয়স্ক
অথবা প্রতিবন্ধী দেখেও সিট থেকে উঠে দাঁড়ায় না - এমন নানা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে
বাসের ভেতরটা উষ্ণ হয়ে ওঠে কখনও। অথবা কোনওদিন হয়তো কোনও তরুণী নিজে থেকে উঠেই
বসতে দেয় কোনও বৃদ্ধ ভদ্রলোককে। যেসব মায়েরা দলবেঁধে বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে
যান, তাঁদের কেউ একজন না এলে বাকীরা উদ্বিগ্ন মুখে খোঁজ নেয় তার। এইসব কোনও কথার
মধ্যেই ও থাকেনা। চুপ করে এক দৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে থাকে। ওকে কখনও কেউ ডেকেও কথা
বলেনা বা সরে গিয়ে বসতে জায়গা দেয় না। ও নিজেও কারোর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যায় না।
মনে হয় আদপে বাসটার মধ্যে ওর কোনও অস্তিত্বই নেই হয়ত।
আমিও রোজ ওইসময় হেদুয়া
থেকে বাসে উঠি অফিস যাওয়ার জন্য। দুপুরে সাধারণত লেডিজ সিট ফাঁকাই থাকে।
বেশিরভাগদিনই জানলার ধারে সিট পাই। পাশের ফাঁকা সিটে অথবা কোলের ওপর ব্যাগটা রেখে
একটা বই বার করে কিম্বা মোবাইলে বই পড়তে পড়তে যাই।
আমিও কোনওদিন ওকে ডেকে
কথা বলিনি, বা, পাশের খালি সিটটায় ডেকে বসাইনি। মাঝে মাঝে আমার সিটের সামনে এসেও ও
ঠিক অমনি করেই দাঁড়িয়ে থাকে। অস্তিত্বহীন হয়ে।