গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

৯ম বর্ষ ১১তম সংখ্যা ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০


এই সংখ্যায় ৯টি গল্প লিখেছেন ব্রতী মুখোপাধ্যায়, সুধাংশু চক্রবর্তী, সমরেন্দ্র বিশ্বাস, নীহার চক্রবর্তী, দীপলেখা মুখার্জী, বর্ণালি বিশী, সুদীপ ঘোষাল, শান্তিময় কর ও ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী ।

পাঠ প্রতিক্রিয়া


                অণুগল্প সংকলন ‘ভদ্রাসন’ / ব্রতী মখোপাধ্যায়
                                                        

ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের অণুগল্প সংকলন ‘ভদ্রাসন’ হাতে পেয়েছি এবং পড়েছি বেশ কিছুদিন আগে । কিন্তু গল্পগলো পাঠ করার পর আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া প্রস্তুত করতে পারিনি আমার অলসতার কারণে । অথচ এই সময় যারা গল্প লিখছেন বিশেষত অণুগল্প, তাদের মধ্যে সার্থক অণুগল্পকার হিসাবে ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের নাম বেশ আগেই থাকবে । সংকলনটিতে স্নাতক, রূপকথার দেশে ও যুদ্ধ এই তিন পর্যায়ে মোট ৫৪টি গল্প স্থান পেয়েছে । প্রতিটি গল্পই এক নিশ্বাসে পড়তে হয়, আর সেটাই অণুগল্পের বৈশিষ্ট্য । কিন্তু ব্রতীর গল্পগুলি একবার পড়ার পরও পাঠকের মনে যে রেশ রেখে যায় তা পাঠককে তাড়িত করে বারবার গল্পগুলিকে পাঠ করতে ।

সুধাংশু চক্রবর্তী


আতঙ্কের সাগরতীরে দাঁড়িয়ে

এখন রাত দশটা । রাস্তার টিউব লাইটের আলোর নীচে অসংখ্য শ্যামাপোকা এসে জুটেছে । দুটো কুকুর, নিজেদের শরীরটাকে বৃত্তাকারে গুটিয়ে নিয়ে, মুখ গুঁজে পড়ে আছে লাইটপোস্টের নীচে ।  সহসা ছোট্ট একটা মারুতি ভ্যান, প্রায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো গলির ভিতরেই ছোট্ট একটা বাড়ির সামনে । বাড়িতে ঢোকানো হলো চিরঘুমে শায়িত বছর তিরিশেকের একটি যুবককে । কুকুরদুটো নিমেষেই বৃত্তাকার ভেঙে দ্রুত সরলরেখায় । পরক্ষণেই গলির বাতাস নড়েচড়ে বসলো এক বৃদ্ধা মায়ের সন্তান হারানোর বুক ভাঙা হাহাকারে । জেগে থাকা কিছু প্রতিবেশীর চোখেমুখে ফুটে উঠলো আতঙ্কের ছায়া ।

ব্রতী মুখোপাধ্যায়

বর্ণালি বিশী

মঙ্গলসূত্র

নাহ্! এবারেও হল না...,দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল মানসী। বেশ কিছুক্ষণ শরীরটাকে ওইভাবেই ছেড়ে রাখল। আবার হুট করে কী ভেবে মোবাইলের ক্যালেণ্ডারে বুঁদ হয়ে, দাঁতে ঠোঁটের কোণাটা চেপে হিসাব কষতে কষতে বিড়বিড়াল, ইস!এক মাস সাত দিন মাত্র... খবরটা যদি কাল রাতের জায়গায় আরেকটু আগে জানাত, বাপন! জানতই যখন বিয়েটা করবে! ইনস্টলমেন্টটা শেষ না হলে জিনিষটা হাতে দেবে না যে! আকাশ-পাতাল ভেবে অয়নের কাছে গেল গুটিগুটি পায়ে। আশায় বুক বেঁধে। আর বলতে গিয়েই শুনল ভ্রু কুঁচকে অয়নের সেই ঘ্যানর ঘ্যানর আরে, আদ্যেখলাপনা গুলো ছাড় তো! এই বুড়ি বয়সে আর মানাবে না...মানসীর চটপট প্রত্তুতর চল্লিশে আজকাল বিয়ে করছে আর আমি বুড়ি! টোটনের স্কুল গণ্ডি এই তো সবে পার হল। গলায় আরেকটু সুর চড়িয়ে বির্তকিতে জবাব দিলএই নিয়ে অনেকগুলো বিয়ের অনুষ্ঠান পার করলে এবারেও ভাসুরপো’র বিয়েটাও ওই ভাবেই পার করবে? আসল কথাটা বল!

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 কানা শানুর মিছিল কিংবা শ্রেণী-বিজয়

রাত দশটার নির্জনতাকে ফেঁড়ে দিয়ে অতর্কিতে উঠে এলো বোমা আর গুলির শব্দ। ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধে ভরে রইলো মানুষের চিৎকার। আক্রমণকারীরা নিঃশব্দেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোলাগুলির শব্দ আর ধোঁয়ার কুয়াশা কেটে  যেতেই অন্ধকারের অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এলো দুটো মূর্তি। তারা সন্তর্পণে এসে দাঁড়ালো স্পটটায়। সেখানে শান্তি দাস ওরফে কানা শানু প্রচন্ড আহত। জামা প্যান্ট রক্তে রক্তময়। কোন নড়ন চড়ন নেই, যেন একটা লাশ পড়ে আছে। ওদেরই একজন কোমরের ভোজালিটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিতে নিতে বললো, ‘শালারা পালিয়েছে! শানুদাকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। একদম দেরী করা চলবে না!’ অন্যজন শানুর ক্ষতে রুমাল দিয়ে বাঁধন দিতে দিতে বললো, ‘এম এল এ-র পোষা চামচা শালা পানু সাহাও ওই দলটায় ছিল। ঠিক চিনতে পেরেছি।

নীহার চক্রবর্তী

                                                            প্রেমে নেই হৃদে


মিতুলের একমাত্র মাসী ক্যান্সারে মারা যায় বছর তিনেক আগে তার বাচ্চা-কাচ্চা ছিল না । মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকে মিতুলের মেসোমশায় আসতে শুরু করে ওদের বাড়িতে । মাসে দুবার চল্লিশ কিমি ট্রেনে চেপে সে হাসিমুখে উপস্থিত হয় মিতুলদের বাড়িতে ।শুরুতে মন্দ লাগেনি মিতুলের বাবার । দুজন মিলে বসে মদও খেয়েছে । তার পছন্দের খাবার এনে দিয়েছে । আর মিতুলের মার তো কথাই নেই । বোনের স্মৃতি ধরে রাখে বোনের বরকে যত্ন-আত্তি করে,ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে । কিন্তু সমস্যা এলো তিনবছর পর । একদিন মিতুলের বাবা ওর মাকে একান্তে বলল,'এবার তোমার বোনের বরকে বিয়ে করে সংসার করতে বল । আমি দুবার বলেও কাজ হয়নি ।' মিতুলের মা তার মুখে এমন কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলো । কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো ।

দীপলেখা মুখার্জি

সুদীপ ঘোষাল

পরশুরাম

নয় ছেলে আর পাঁচ মেয়েকে নিয়ে মিতা ও তার বর পাঁচবিঘে জমির আমবাগানে বেশ সুখেই ছিল। মিতার বর মিলিটারি বিভাগে কাজ করার সময় এক অত্যাচারী লম্পটকে মেরে জঙ্গলে পুঁতে ফেলেছিল। কেউ জানতে পারে নি। তারপর কয়েক বছর পরে চাকরি ছেড়ে তার শখের আমবাগানে চলে এল। একরাশ বৃষ্টিফোঁটার ঝাপটা লাগা সুখে সে মিতার সংসারে মেতে গেল। ছেলেরা ধীরে ধীরে বড় হল। একে একে তাদের বিয়ে হল। চাকরির সন্ধানে তারা চলে গেল বাড়ি ছেড়ে। মিতার বয়স    হল। তার বর চলে গেল পরপারের ডাকে। 

শান্তিময় কর

 সন্দেহের জ্বালা  

এ যে বিনা মেঘে বজ্রপাত ! হঠাৎ যেন আকাশ থেকে পড়লো শুভময়। তার চোখের সামনে সমগ্র পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো। মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করে উঠলো। অনেক কষ্টে কোন প্রকারে নিজেকে সামলে সে আর্তনাদ করে উঠলো, “কী বলছো কি সুমনা” “ঠিকই বলছি,”আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নাই। তোমার জীবনে সুমনা নামে কেঊ কোনদিন ছিল বা আছে, ভুলে যাও। এখন থেকে তোমার আমার পথ আলাদা”। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শুভময় কে কিছু বলার সুযোগ বা সময় না দিয়েই ঝড়ের বেগে চলে গেল সুমনা। 

ত্রিভুনজিৎ মুখার্জী

 ঠাকুমা

প্রত্যেক দিন কাঁচের গ্লাসে গ্লুকোজের জল খাওয়ানোর সময় ঠাকুমার কানে কানে ঠাকুরদা কি বলেন শুনতে ইচ্ছে হয় l ক্ষনিকের জন্য তাঁর নিষ্প্রভ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আবার পরে ফিকে হাঁসিটা ঠোঁটের কোনে এসে অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকেন ঠাকুমা,  সেই ক্ষনিকের হাঁসিটা মিলিয়ে যায় পরক্ষনে l কিং কর্তব্য বিমূঢ় ঠাকুরদা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন ঠাকুমার নিথর শরীরের দিকে l অশ্রুসিক্ত নেত্র থেকে টপ টপ করে পড়ে দু ফোঁটা অশ্রু l এই দেখে আসছে রীনা দিনের পর দিন l কেউ ডাকলে সাড়া দেন না  ঠাকুমা কিন্তু  ঠাকুরদা যখন গ্লুকোজের জল গোলান কাঁচের গ্লাসে ঐ শব্দ শুনে  একটু চোখ খুলে দেখেন ঠাকুরদাকে l   ঠিক সেই সময় ঠাকুমা মুখটা অনেক কষ্টে খুলে ঐ গ্লুকোজ এর  জল টুকু খান আর ঠাকুরদাকে কি যেন বলতে চেষ্টা করেন সেটা তিনিই বোঝেন l ওটাই বুঝি ঠাকুমার মৃত সঞ্জীবনী সুধা l এই চলছে বেশ কয়েক মাস l সারাদিন চোখ বুজে ঐরকম পড়ে থাকেন ঠাকুমা l কেউ কখনো ডাকলে সাড়াও দেন না কি ঘুরেও তাকান না l ঠাকুরদা ছাড়া কি কেউ ওনার কষ্ট বোঝার নেই?