
ঠিকানা
সুষমাদেবীর অশ্রুতে সুশোভনবাবুর পাঞ্জাবিটা
ভেজে। ভিজে জামা লেপ্টে হৃদয়ে আঘাত করে হতাশার প্রতিচ্ছবি হয়ে। স্বপ্নগুলো ভাঙা
দর্পনের মতো পরিহাস করে।
পরস্পরকে জড়িয়ে যেন দুটি 'ব্রততী'। যৌবনের যৌনতা, প্রৌঢ়ত্বের খুনসুটি পেরিয়ে
বার্ধক্যের অবলম্বন। বিবাহের সার্থকতা বোধহয় এখানেই।
দু'জোড়া চোখ যেন পাতা ফেলতে ভুলে গেছে। পৃথিবীটা আশ্চর্যজনকভাবে যেন স্থির।
জোনাকি শুধু কর্তব্যপালন করছে,যদিও উচ্ছাস নেই অন্যদিনের মত। গ্রীষ্মের রাতও বড় দীর্ঘ লাগে। কালবৈশাখির মেঘ
তো হাঁকডাক না করে থাকতে পারেনা, তবু কেন বিষাদগ্রস্ত?
শুধু
কৃত্রিমতার প্রতীক হয়ে পাখাটা বনবন করে ঘুরছে। সুশোভনবাবু ভাবেন সম্পর্কগুলো এত
ঠুনকো ?
জানালায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরান সুশোভনবাবু।
নাতি-নাতনিকে নিয়ে শাশুড়ি- পুত্রবধূর
দ্বন্দ্ব চিরন্তন। তা'বলে গায়ে হাত। মানতে পারেন না সুশোভনবাবু।
নিস্তব্ধতা ভেঙে সুশোভনবাবু জিজ্ঞাসা “দু'বেলা দু মুঠো ভাত ফোটাতে পারবে?"
বাইরের আকাশটা এখন নির্মল। মৃদুমন্দ মলয় বাতাস বইছে।
জীবনতৃষা
রমেশের জ্বরটা কি কমেছে না আকাশে মেঘ? গত কয়েকদিন শরীরে প্রবল উত্তাপ।
রমেশ চেয়েছিল আরো বাড়ুক। বিলীন হোক পঞ্চভূতে এ দেহভার। আর যে বয় না জীবন।
জীবনে অনেক ছ্যাঁদা রমেশের।
কোনটাই মেরামত করতে পারেনি। কিছু জায়গা পচে ক্ষয়প্রাপ্ত। অভাব যেন ক্রনিক ব্যাধি।
সুদিনের আশায় পেরোল
চল্লিশ
বছর। বিধাতা শেষ বন্ধন ছিন্ন করেছে তার সাথে।
আজ সকাল থেকেই রোদ বেশ কয়েকদিন
পর। রমেশের মন কুয়াশাচ্ছন্ন। বাল্যজীবনের কথা মনে আসে। অভাবী বাবা শরৎ উপন্যাস ধার
করে নাম রাখেন রমেশ। কিন্তু জীবনটা তাকে বিদ্রুপ করেছে চিরদিন।
অভাবে সপ্তম শ্রেণিতেই ইতি।
প্রথমে চায়ের দোকান, তারপর নানা দোকান ঘুরে আজ রিক্ত।
শহরে মালিকের মাল আনতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পা হারায়। মুহুর্তে অযোগ্য হয়ে ওঠে।
মা অভাবের শিকার, বাবা ক্যান্সারের। নিজে পা-হারা। নিজেরই খাবার নেই, অন্যকে আর জড়ানোর সাহস হয়নি জীবনে। অপুষ্টিতে আজ সে চল্লিশেই ষাট। একমাথা
কাঁচাপাকা চুল, মুখে কয়েক সপ্তাহের না কাটা
দাড়ি।
উমার কথা মনে আসে। সে এখন ঘোর
সংসারী। একদিন ভাবনায় ছিল তার সাথে জীবন জোরার। সম্পর্ক হারিয়েছে জীবন পথের
বাঁকেই।
রোদে এসে বসে রমেশ। সূর্যদেব
কি
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে?
এমন জীবন
রাখার মানে হয়?
অতএব রমেশ চলল স্টেশন ছাড়ানো মেঠো রেললাইনের দিকে। রেললাইন
পার্শ্বস্থ জি টি রোড বড় ব্যস্ত। একের পর এক গাড়ি। চঞ্চলতা বাড়ে রমেশের। ট্রেনের
সময় এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ একটা কাগজের টুকরো একটা
কালো অ্যাম্বাসাডর থেকে উড়ে এসে আটকে গেল রমেশের ছিন্ন চাদরে। তিক্ত রমেশ খিস্তি
দিল গাড়ির উদ্দেশ্যে।
অবহেলায় কাগজটা খুলে দেখে একটা
কথা "বাঁচাও"। চমকে
ওঠে রমেশ। খিস্তি দেবার সময় স্পষ্ট দেখেছে
গাড়ির নম্বর WB 41
7355।
এবার বিধাতাকে বিদ্রুপ করে সে, মৃত্যুপথযাত্রীকে জীবন রক্ষার ভার অর্পন?
রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে যায় রমেশ-
"দাদা থানাটা কোনদিকে?"