গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায়



বিধাতার ভুল

শীর্ণকায় পুরুষ্ট গোঁফধারী প্রৌঢ়কে দেখে বিহারী ভেবে ভবেশ জমিদার জিজ্ঞেস করলেন,
-
ক্যায়া বাৎ?
-
বাত তো বহুত হ্যায়,শুনেগা কৌন? 
- ম্যায় তো কালা নাহি হ্যায়,সব শুনেগা। বোল।
-
ম্যায় হিন্দি বেশী নাহি বোলতে পারতা,বাংলায় বলি?
জমিদার ভবেশ মুখুজ্যে হা হা করে হেসে বললেন
-
তুমি বাঙালী? 
-
শুধু বাঙালী না,সান্ডিল্য গোত্রীয় ব্রাহ্মন,পিছুটানহীন। পেশা রন্ধন। আদি বাসস্থান শান্তিপুর। আপনার বাড়ীতে রাঁধুনির কাজ করতে চাই।
-
মাসিক দক্ষিনা কত?
-
পেটচুক্তি খাওয়া আর বাসস্থান।
-
নাম কি?
-
ভুবন বাঁড়ুজ্জ্যে।
একরাশ সন্দেহ নিয়ে ভবেশবাবু ভুবনকে রাঁধুনি হিসেবে নিয়োগ করলেন।
পরদিন থেকেই ভুবন বাঁড়ুজ্জ্যে সক্কাল সক্কাল পুকুরে স্নান সেরে বাড়ীর রান্নাঘরে গিয়ে বললেন 
-
মা আজ কি রান্না করব বলে দিন।
আর আপনারা বিশ্রাম নিন।
এগারোটার মধ্যে রান্না শেষ দেখে মেয়েমহল হকচকিয়ে উঠল।
সন্ধ্যেবেলায় রাত আটটার মধ্যে রান্না শেষে অশীতিপর নগী বামনির কাছে বসে শুরু করলেন শ্রীকৃষ্ণ অষ্টোত্তর শতনাম। নগীবুড়ি বেজায় খুশি। এতদিন পর একটা জব্বর ভক্তিমন্ত লোক পাওয়া গেছে।
এদিকে ভূবনের রান্না ও ব্যাবহারে সকলেই ধন্য ধন্য করে উঠল।
কাজকর্ম সেরে ভূবন  অশত্থ তলায় খাটিয়ায় বসে থাকতেন।
অলস দুপুরের সঙ্গী ছিলো এক বাউন্ডুলে মুখপোড়া হনুমান। মুড়ির লোভে হনুমানটা প্রতিদিন আসতো।
এমনি করে বেশ চলে যাচ্ছিলো দিন,মাস বছর। কোন এক শীতের অলস দুপুর। খাওয়া দাওয়া সেরে বাইরে রোদে খাটিয়া পেতে ভূবন বাঁড়ুজ্জ্যে একটা বিড়িতে সুখটান দিচ্ছিলেন। এমন সময় হনু এসে হাজির। যথারীতি ধুতির খুঁটে বেঁধে রাখা মুড়ি দিলেন । মুড়ি খেয়ে হনুমান ভূবনের মাথা চুল্কাচ্ছিলো আর ময়লা বা উকুন বেছে খাচ্ছিল। আদর খাচ্ছিলেন ভূবন। এমন সময় হঠাৎই বিড়ির আগুনের ছ্যাঁকা লাগে হনুমানের গায়ে। ছ্যাঁকা লাগতেই এক পলকে ডানপাশের গোঁফ উপড়ে দিয়ে সপাটে একচড়। চিৎকার করে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। মুহুর্তে ভীড় জমে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যে মুখের চেহারা গেল পাল্টে। একদিকের গোঁফ অক্ষত। অন্যপাশে রক্তের বন্যা।
গরুর গাড়ীতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। গ্রামীন ডাক্তার চারটে সেলাই করলেন। অসুধ ইঞ্জেকশেন  দিলেন। ভূবনকে বাড়ীতে নিয়ে আসা হল।  রাত্রে জ্বর বাড়তে লাগলো। প্রলাপ বকতে শুরু করলেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই ভূবন এ ভূবনের মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন অচিনপুরে।
গ্রামের বহুলোক শ্মশানযাত্রী হল। ভবেশ বাবু বললেন তিনিই মুখাগ্নি করবেন। চিতায় ওঠানোর আগে বস্ত্রহীন ভূবনকে দেখে সবাই চমকে উঠল। তিনি নরও নন নারীও নন,তিনি শুধুই ভূবন। বিধাতার এক আশ্চর্য ভুল।

প্রবাহ

চিতা প্রায় নিভু নিভু। তখনও সন্ধ্যা হয় নাই। সর্বেশ্বর তাঁহার আমিত্বের ভান্ডে সযত্নে রক্ষিত পার্থিব সময়ের হিসাব কষিতে কষিতে বিষন্ন হইয়া পড়িল। মুহুর্তে কাকপিন্ডটি লইয়া একটি বায়স দুর আকাশে বিলীন  হইল।
শূন্যস্থান পুরণ করিবার মত অবশিষ্ট কিছুই রহিল না। দম্ভের তবকটি বড়ই পলকা। একমাত্র সত্য পঞ্চস্কন্ধাত্মক প্রবাহে ছেদ পড়িল।
অপিচ এইরুপ হওয়ার কথা ছিল না। সর্বেশ্বরের পিতৃদেব পরমেশ্বর মুখোপাধ্যায় ছররা পরগনার ডাকসাইটে জমিদার ছিলেন। একসময় বাড়ীর চৌহদ্দির মধ্যে বিশাল বিশাল আট দশটি ধানের গোলা বিরাজ করিত। পুষ্করিণী ভর্তি  মাছ, গোয়াল ভর্তি গরু দেখিয়া কেহ ভাবিতে পারিত না এই জমিদারির সূর্য কোনকালে আস্তমিত হইতে পারে।
কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা তাহা ছিলনা। তাঁহার কাছে লক্ষীকে প্রেরণ করিলেও সরস্বতীকে প্রেরণ করেন নাই। যেনতেন প্রকারেণ আগ্রাসী মনোভাব লইয়া জমিদারী বাড়াইয়া গিয়াছেন। একমাত্র বৈধ সন্তানের সরস্বতী লাভের কোন চেষ্টাই করেন নাই। উপরন্তু রক্ষিতা হেমী বাউরীর গর্ভজাত সন্তান সুফল বাউরীকে সন্তান হিসাবে স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণে বিশাল জমিদারী আকাশে  অশান্তির মেঘ ঘনাইয়া আসে।
বৈধ ও অবৈধ সন্তানে প্রায়শই ঠোকাঠুকি চলিত। ইতোমধ্যে সর্বেশ্বর জুয়া ও মদের নেশায় মাতিল। এবং পরমেশ্বরের শারীরিক দুর্বলতার সুযোগ লইয়া একটি একটি করিয়া জমি বিক্রয় করিতে লাগিল। এহেন কান্ডকারখানা  দেখিয়া সুঠামদেহী সুফল যারপর নাই বিরক্ত হইয়া সম্মুখসমরে নামিয়া পড়িল।
সুফল অবৈধ সন্তান হওয়ার কারনে জমিদারীতে আইনগত অধিকার ছিল না, তৎকারনে সে পরমেশ্বরকে সম্পত্তির কিয়দংশ তাহার নামে লিখিয়া দিতে বলিয়াছিল। তাহার আর্জি মঞ্জুর করিয়া একটি উইল করিবার অভিপ্রায় লইয়া উকিল ডাকিয়া ইচ্ছাপত্র লিখাইলেন।
এই সংবাদ সর্বেশ্বরের কর্ণকুহরে যাইতে সময় লাগিল না। সে মত্ত অবস্থায় পিতৃসমীপে আসিয়া অবলোকন করিল উকিলের ইচ্ছাপত্র লিখা শেষ। সই করিতে বাকী। পাশে রক্ত সম্পর্কিত অবৈধ ভাই সুফল এবং হেমী বাউরী।
সর্বেশ্বর রাগে দুই নয়ন বিস্ফারিত করিয়া সকলের দিকে অবলোকন করতঃ দাঁত কিড়মিড়াইতে লাগিল।
আচমকাই দুর্ঘটনা ঘটিল। যে মুহুর্তে পরমেশ্বর মুখোপাধ্যায় ইচ্ছাপত্রে সই করিবেন সেই মুহুর্তে সর্বেশ্বরের হাতের পিস্তল গর্জিয়া উঠিল এবং পিতৃদেবের দক্ষিণহস্ত বিদির্ণ করিল। অপর গুলিটি সুফলের বক্ষ ভেদ করিল।
গৃহমধ্যে ক্রন্দনের রোল উঠিল। প্রশস্ত দাওয়া রক্তে ভাসিয়া গেল।পরমেশ্বর জ্ঞান হারাইলেন। কয়েক দন্ডের মধ্যে পুলিশ আসিয়া সর্বেশ্বরকে হাতকড়া পরাইয়া থানায় লইয়া গেল।
তিনমাস অতিক্রান্ত হইল। পরমেশ্বর ইহলোক ত্যাগ করিলেন। এক্ষনে একমাত্র সন্তান সর্বেশ্বর মুখাগ্নি নিমিত্ত প্যারোলে ছাড়া পাইয়াছে।
দাহ শেষ। চিরন্তন প্রবাহে সাময়িক ছেদ। দিনান্তের শেষ সূর্য অস্ত গেল। পুলিশবেষ্টিত হইয়া সর্বেশ্বর থানায় চলিল।