এই সংখ্যায় ৫টি গল্প লিখেছেন - শর্মিষ্ঠা ঘোষ / 'রাক্ষস' , রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য / 'স্কুল', সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায় / 'মা' , সূর্যনাথ ভট্টাচার্য /' কপালে লিখিতং' অর্ধেন্দু শেখর গোস্বামী/ 'মহাপ্রস্থান' (ধারাবাহিক)এবং রাজন নন্দী ' জয়া , তাড় তিল আর যত তালগোল'
গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৩
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
এতক্ষণে
চোখটা জ্বালা করছে বড়মেয়ের । যতোনা ধোঁয়ায় , তারচেয়ে বেশি একটা হাহাকারে । গালটা ধুয়ে
যাচ্ছে নির্মলধারায় । তার জায়গায় কষ্টটা উঠে আসছে গলাবেয়ে , মোচড় দিতে
দিতে । নির্মল কান্না নিভিয়ে দিচ্ছে ক্রোধবহ্নি । অক্ষম ক্রোধ । গত বছর দুয়েক
বিস্ফোরণের অপেক্ষায় চেপে রাখা রাগটা । কুলিকের ক্ষীণধারা পেরিয়ে উত্তুরে বাতাস হু
হু করে ছুটে আসছে ,তার ঝাপটায়
বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে উড্ডীয়মান ধোঁয়ার কুণ্ডলী । আগুনে চরচর
শব্দ হচ্ছে কাঁচা কাঠে । লম্বা লগা দিয়ে কাঠ সামলাচ্ছে দুজন ডোম । একজনের পরনে
জিন্স আর টিশার্ট , আর একজনের
বুশশার্ট , প্যান্ট ।
পৌরসভার মাইনে করা হাইটেক ডোম । প্রচলিত ধারণাগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে বড়মেয়ের । আগে
কখনো শ্মশানে আসে নি । এই প্রথম । মুখাগ্নি করেই দাদাভাই সরে পড়েছে , আর এমুখো
হচ্ছে না । মুখেচোখে স্পষ্টতই মুক্তির ছাপ । হাঁপিয়ে উঠেছিলো টানা দুবছর
বহুকাঙ্খিত মৃত্যুর অপেক্ষায় থেকে থেকে ।
খানিক দূরে
ওর বন্ধুদের জটলা । সিগারেট ফুঁকছে দলটা । দাদাভাই এর মুঠোর ভেতর থেকে পানামা উঁকি
মারছে । বড়জামাই এসে চোখের সামনে দাঁড়ালো , বড়মেয়েকে সরে যেতে বলছে ধোঁয়ার থেকে । আসলে
ভয় পাচ্ছে , বড়মেয়ে
হঠাৎ করে অজ্ঞান না হয়ে পড়ে । মেয়ের জলে ভাসা চোখে ধরা পড়ছে চিতার ওপর চৌকো মতো
একটা মাথা , মুখে কি
আরামের ওম ? কি শীত কি
শীত গেছে কদিন । কি ভীষণ কষ্ট পেয়েছে বড়বউ শীতের কামড়ে । ছোট করে ছেঁটে দেওয়া
চুলগুলো পুড়ে গিয়ে গলে
পড়ছে ঘিলু । খুলি উঁকি মারতে দেরি আছে । একটা হাড্ডিসার হাঁটু উঁচু হয়ে আছে ।
শুকিয়ে প্রায় আমসি হয়ে ,
ছোট
হয়ে যাওয়া একটা শরীর ,
তলাথেকে
আগুনের লকলকে জিভ চেটে দিচ্ছে আদরে , যেমন করে সদ্যোজাত বাছুরের গা চেটে দেয় গোমাতা
!
দূরে
দাঁড়ানো মণিকাকু , ছটটু ।
ফ্ল্যাশব্যাকে সরে সরে যাচ্ছে ছোটবেলা । একঢাল লম্বাচুল , ব্যক্তিত্বময়ী
চেহারার অধিকারী বড়বউ । পরিবারে অসম্ভব দাপট তার । অন্য জায়েদের ছেলেমেয়েরা সবাই
ডাকে বড়মা ।
তারপর একটা গ্যাপ , দূরত্ব
তৈরি হয়েছিলো জটিল সময়ের ঘূর্ণিতে । অথচ ভেতরে একটা নাম না জানা টান , চোরাস্রোত
।
এখান থেকে
দূরে দেখা যাচ্ছে কুলিক ফরেস্ট । সেই শীতকাল । সেই পিকনিক । কুলিকের ধারে তিরিশ বছর
ধরে একই রকম আছে সেই পথটা । এখন পিচ ঢালা হয়েছে , আর খানিক চওড়া । রাস্তার ধারে জনসংখ্যা
বেড়েছে সাতগুণ । গজিয়ে উঠেছে হোটেল , ‘ মীন ভবন’।
তিরিশ বছর
আগে সেদিন খানিকটা এগিয়ে গেছে বাসনপত্র , শতরঞ্চি , গ্যাস সিলিন্ডার আর ওভেন বোঝাই ঠেলাটা ।
তার পেছন পেছন চার থেকে দশের একপাল ছেলেমেয়ে , সম্পর্কে যারা ভাইবোন , কাজিন ।
তারও খানিক পেছনে হেলতে দুলতে একটা মাঝবয়সী মহিলার দঙ্গল , তারা
পরস্পরের জা । একটা পরিবার কেন্দ্রিক বনভোজনের শেষে দলটা ফিরছে কুলিক ফরেস্ট থেকে
। সূর্যটা এখন ফ্যাকাসে । চাঁদের স্টেনসিল আঁক দখল নিয়েছে আকাশের দৃষ্টিসীমায় ।
হঠাৎ হৈহৈ করে উঠলো বাচ্চাকাচ্চার দলটা , ‘ রকেট ... রকেট ‘... সবচেয়ে
যেটা বড় ঐ দলে , সে হাল
ধরলো , ‘ ওটা কমেট , হ্যালির
ধূমকেতু ... অনেকবছর পর পর দেখা যায় ... ঐ দ্যাখ , ঝাঁটার মতো একটা ল্যাজ ও আছে ‘। সদ্য
হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভ বার্ষিকপরীক্ষা
দিয়েছে সে । জানুয়ারিতে নতুন ক্লাসে যাবে । পেপার পড়ে গোটা দুএক । নেশা । গল্পের
বইয়ের পোকা । চোখে চশমা উঠেছে সদ্য । বেশ রাশভারী ভাব দেখায় ভাই বোনেদের সামনে ।
ওর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা পেছন ফিরেছে , মায়েদের এই দুর্দান্ত খবরটা দিতে হবে , এক্ষুনি ।
সমস্বরে কিচিরমিচির করে রিপোর্ট দিতে দিতে দলটা ভাঁটাবাড়ির পুকুরের পাড়ে পৌঁছেগেছে
, ওমা , ওটা কি ? বাদামী
রঙের একটা ছোটোখাটো কুকুর পুকুরপাড়ের গর্তে ঢুকে পড়লো লেজ গুটিয়ে । এবার অনেকেই
চিনতে পেরেছে , জে ফর
জ্যাকেল ! এবার ছোটবড়র দলদুটোর ব্যবধান আর রইলো না । অন্ধকার ছেয়ে আসছে
ভাঙ্গারোডের দুপাশের নয়ানজলিতে । অনেকটা বাদে বাদে দু একটা ঝোপড়া , কুপির আলো
আসছে ন্যাকড়ার দরজার আড়াল থেকে । ততক্ষণে বেশ গোলগাল হাল্কাহলুদ
একটা চাঁদ উঠে পড়েছে । উত্তুরে হাওয়া জ্যাকেটের বাঁধা মানতে চাইছে না । ছোট ছোট
হাতগুলো মায়েদের শালের নিচে উষ্ণতা খুঁজছে । ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশায় খানিকদূর গিয়েই
আটকে যাচ্ছে দৃষ্টি ।
এই রাস্তায়
পৌরসভার বাতি নেই । দূরথেকে ঠং ঠং একটা আওয়াজ আসছে । পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধোঁয়া উঠছে
কাছেই শ্মশান থেকে । বড়মা বললেন , ‘মড়া পোড়ানোর সময় বাঁশ দিয়ে পেটায় , এটা সেই
শব্দ’ । মুহূর্তে
কচিকাঁচার দলটা চুপ করে গেলো । ছোটোগুলো কোলে ওঠার জন্য বায়না করতে লাগলো । কিন্তু
সারাদিন দৌড় ঝাঁপ রান্নাবান্না করে বেলাশেষে গাণ্ডেপিণ্ডে মাংসভাত খেয়ে
প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার পর মায়েদেরও আর এনার্জি নেই । তাছাড়া রান্নার যোগাড়
যন্তর , ফাইফরমাস
খাটতে খাটতে জীবন গেছে । বড়জা খালি খুন্তি নেড়েছেন আর মুহুর্মুহু পান জর্দা
খেয়েছেন । কাজেই হা-ক্লান্ত বাচ্চাগুলোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কান্না ঘ্যানঘ্যান সামলাতে
সামলাতে ক্লান্ত ছায়াগুলো ঘরমুখো বেসামাল পদক্ষেপে , অথচ অসম্ভব পরিতৃপ্ত , সারাদিন
উল্কার বেগে কেটে গেছে ।
আনন্দম ।
এই বড়বউ এর দুই নেশা । রান্না আর পান । নিজে কুটোটি নাড়বেন না। সবাই জোগাড়যন্ত্র
করবে । রান্না করতে তার আবার নিজস্ব খুন্তি হাতা কড়াই হাঁড়ি গামলা চাই । সব্জি
কুটতে নিজের বঁটি চাই । নাহলে কিছুই তাঁর পছন্দ হয় না। সবাই আড়ালে হাসাহাসি করে
বটে , কিন্তু
এটাও স্বীকার করে, বড়গিন্নী রাঁধেন দারুণ । বাড়ির যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে, পূজা
পার্বণ , জন্মদিনে
তাঁর রান্না মাস্ট । তিনি শুঁটকিমাছ , এঁচোড় , তেল কৈ , পোলাও রাঁধলেই চেনাজানা পরিচিত , অর্ধ
পরিচিত লোকের পাত পড়ে বাড়িতে । দেবা দেবী দুজনেই ভীষণ পপুলার বন্ধুমহলে । বড়বউ
কাজকম্মে নিখুঁত পরিপাটী ,
ঈর্ষণীয়
।
স্থাণুবৎ বড়মেয়ের এখনো যেন কানে আসছে , ‘বড়মেয়ে রে
, দেখে যা , এরা কেমন
করে আমার সাথে’ !
বড়বউএর
সাথে শেষবার দেখা হয়েছিলো দুমাস আগে । তখন বড়বউ অভিযোগ নাকি অনুযোগ করেছিলো , ‘ আমি আর
পারছিনা রে ‘,
তার
শুকনো গালবেয়ে নেমে এসেছিলো লবনজল । বড়মেয়ে শঙ্কিত হয়েছে , কে আবার
শুনে ফেলবে কোথাথেকে ,
শুধুশুধু
বকুনি দেবে অসহায় বিধবাকে । যেটুকু খেতে দেয় তাও বন্ধ করে বলবে , ‘মায়ের
চেয়ে মাসির দরদ বেশি যখন ওরাই তবে নিয়ে যাক । বুড়িটা হাড়মাস একেবারে জ্বালিয়ে
খাচ্ছে , মরেও না’ ! যাতে তাড়াতাড়ি
মরে সেইজন্য প্রায়শ্চিত্তও করিয়েছে , তাও টিকে আছে অভাগী ! কপাল দোষে ! তাই তাড়াতাড়ি গাল মুছিয়ে
বড়মেয়ে বলেছে , ‘ঠাকুরকে
ডাকো’, মনে মনে
বলেছে বাকিটা , ‘যেন তোমায়
তাড়াতাড়ি মুক্তি দেয়’!
দুই বাড়ির
মাঝখানে ফুট দশেকের রাস্তা । তার এপাশ ওপাশে বড়বউ আর বড়মেয়ের বাপের ঘর । প্রচণ্ড
ঠাণ্ডায় বড়বউ কোঁকায় । সব শোনা যায় এবাড়ি থেকে । বড়বউএর কোমর পড়ে গেছে ,বার তিনেক
মাইলড স্ট্রোকও হয়ে গেছে । হাসপাতাল ঘুরে এসেছে বার তিনেক । এখন আর হাসপাতাল নেয়
না । নিয়েই বা কি করবে ?
কিডনিরও
সমস্যা আছে । এখানে হবে না , বাইরে নিতে হবে । ডায়ালিসিস করা দরকার । এই বয়সে আর সেসব
করবে না ছেলে- বউ । অযথা পয়সা নষ্ট করে লাভ নেই ! উঁচু খাট থেকে পড়েটরে যাবে , সেই অছিলায়
বড়বউ এর
বিয়ের সময়কার খাটটাও বেরকরে নিয়ে চলে গেছে এ ঘর থেকে । সে খাট এখন বড় নাতির দখলে ।
একে একে এঘর থেকে উধাও হয়েছে বড়বউএর স্বামীর আমলের টিভি ,বাইফোকাল
চশমা , যা ছাড়া সে
অন্ধ , পুরনো
আমলের কাঠের আলমারি ,যত দামি
কাপড়চোপড় ,সখের সৌখিন
কাশ্মীরি শালগুলো । মেঝের ওপর পুরনো পাতলা তোষক পাতা , পাতলা একটা
কম্বল এখন সম্বল । এ ঘরের লাইটটা ফিউজ হয়ে গেছে বহুকাল আগে
। আর কেউ লাগায় নি । সন্ধ্যে নামলেই ঘুটঘুটটি অন্ধকার । বেশিরভাগ
সময়ই বড়বউ আর ছেলেবউ
এর ঘরের মাঝের দরজা বন্ধ থাকে । এ ঘরের গুডনাইট মেশিনটাও নিয়ে গেছে । অন্ধকারে মশা
কামড়ায় । দুপুরে একমুঠো ভাত আর বেগুন সেদ্ধ দূরথেকে ছুঁড়ে দিয়েছে হয়তো ছোট নাতি ।
বড়বউ বেগুন ভাজা ছাড়া সেদ্ধ খেত না কস্মিনকালে , রাগ করে খায় নি । তাই রাতেও মিল অফ । অবশ্য
রাতে শুকনো মুড়ি বিস্কুটের বেশি জোটে না । বেশিরভাগ দিন তাও দেয় না । বেশি পায়খানা
করবে বেশি খেলে । কাঁথাকাপড়ে মাখিয়ে ফেলবে । ক্যাথিটার লাগানো আছে । ছেচড়ে ছেচড়ে
শৌচাগার যেতে হয় অনেকটা দূরে । তাও অন্যঘর পেরিয়ে । বড়বউ এর নিজের ঘর ছেড়ে বেরনো
মানা । কোন লোকজন তাকে দেখতে গেলেই আবদার জোরে , ‘আমার বড় মাছ খেতে ইচ্ছে করে , মাংস খেতে
ইচ্ছে করে , আর
কালোমিষ্টি’। বউ শুনলেই কপালে উত্তম মধ্যম । খাওয়া বন্ধ । ‘নিয়ে যাক
পীরিতের লোকেরা । করে মরি আমরা , আবার লোকের কাছে নিন্দে করে’!
ভয়ের ছুতোয়
দেখতে যাবার লোক কমে আসে । বড়বউ এর থালাবাটি কাজের লোক মাজতে পারবে না বলে দিয়েছে । ছেলেবউএর
হুকুম । নিজেকেই ধুয়ে নিতে হয় নিজের খাবার থালা । ধুয়ে নিতে হয় পরনের নাইটি টাও ।
এই শীতে গরম জল জোটে না স্নানের , টাইমের কলে জল এলে কোনমতে মাথাটা বাড়িয়ে দেয় কখনো সখনো
জলের নীচে । কে জানে কবেকার শুকনো মুড়ি লেগে আছে বাটিতে দু চারটে । মাছি ভনভন করছে
তাতে । বড়বউ মাঝেমাঝেই চিৎকার করে কাঁদে । বলে , ‘আমাকে হাসপাতালে দিয়ে আয়’। কখনোবা
বড়মেয়ের নাম ধরে ডাকে । সব শুনেও উত্তর দিতে ভয় পায় বড়মেয়ে । ছুটে গেলে বড়বউ এর
ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়বেই শুধু । শত হলেও নিজের মেয়ে তো আর না সে । যারা
রেখেছে তারা বৈধ উত্তরাধিকারী । সামাজিক মতে হকদার ভালো-মন্দের ।
বিশ্রীরকম
কনকনে ঠাণ্ডা পড়েছে এবার । প্রায় এক ডিগ্রী তে নেমে যাচ্ছে তাপমাত্রা মাঝেমাঝেই ।
ডবল কম্বলের নীচে অনুশোচনায় পুড়ে যায় বড়মেয়ের রাত । কত কষ্টই না পাচ্ছে বড়বউ ।
কোনদিন হটওয়াটার ব্যাগ ছাড়া বিছানায় যেত না এই মহিলা যৌবনে । সম্বৎসর চাই তার
হিমানী গ্লিসারিন সাবান বা পিয়ারস । তার মগ বালতি আলাদা । তার তারে কাপড় মেলতে
পারবে না আর কেউ । খাওয়াটা তার কাছে একটা আর্ট । শব্দ না করে , বেশি হাঁ
না করে , গুছিয়ে
অল্প পরিমাণ কোয়ালিটি আহার ।
বড়মেয়ে সব
ব্যাপারে বড়বউকে অনুকরণ করে । বড়বউ সবার কাছে বড়মেয়ের পরিচয় দেয় , ‘আমার মেয়ে’
বলে । বড়মেয়ে
ভাবে একটা রুমহিটার কিনে দিলে হয় । আবার ভয়ও লাগে , যদি ওরা বলে বসে , ‘আমাদের
ক্ষমতা নেই ফুটানির বিল দেবার’ । এই ছুতোয় আয়াটাকেও ভাগিয়েছে । ওঁত পেতে আছে মরবে কবে বুড়ি
। উইল বদলানো হয়ে গেছে । বাড়িটা বেচার চেষ্টা চলছে । সবই আটকে আছে একটা
মৃত্যুর অপেক্ষায়।
অনেকদিন
বাদে সব জায়েরা একত্রিত হয়েছে , বড় জা উঠোনে মাচার ওপর শোয়া । বুকের ওপর কয়েকগাছি
রজনীগন্ধার ডাঁটি , চোখের
পাতায় তুলসীপাতা । মেজ জার মনের অসুখ । সেও এসেছে আজ অনেকদিন পর । সেজ জা বছর দুই
পর পা রাখল এ বাড়িতে । দুবছর আগে এক সন্ধ্যায় বড় জায়ের ঘরে বসে উল বুনছিল দুই জা ।
ছেলেবউ এসে বলেছিল, ‘কর , কর , খুবকরে
আমার নিন্দে কর’! সবসময় আতঙ্কে ভুগত ছেলেবউ , এই বুঝি শাশুড়ি কারুর কাছে নিন্দে করল ওর !
অপমানিত সেজ জা আর মাড়ায় নি
ওই চত্বর । আজ ডুকরে কাঁদছে সে । ছোট বউ জোর করে গাম্ভীর্য ধরে
রাখার চেষ্টা করছে , সে আবার
বেশীক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারে না । এ বাড়িতে সে এসেছে অনেক পরে । খুবএকটা
সখ্য গড়ে ওঠেনি ‘ বড়দিমনির ‘ সাথে ।
সবাই আন্দাজ করে , বড়বউ একা
ঘরে মরে পড়ে ছিল , কে জানে
কখন থেকে । মরার পর মাথায় পরিয়ে দিয়েছে মাঙ্কিক্যাপ ,গায়ের ওপর
নতুন কম্বল , পায়ের নীচে
হটওয়াটার ব্যাগ ! মাথার পাশে গীতা ।
বছর পঁচিশ
আগে ছোটদের দলটা ছুটছে পরিত্রাহি ,’ মাছ , মাছ , জেঠুমনি মাছ ধরেছে, এই অ্যাত্ত বড়’ ‘না, না , অ্যাত্ত বড়’, বলে আরেকজন
ছোটছোট হাতগুলো যতদূর সম্ভব প্রসারিত করার চেষ্টা করলো । আজ মাছ পেয়েছে মানে আজ
বাড়িতে এলাহি আয়োজন । বিরাট আঁশবঁটি নিয়ে বড়মা সেই মাছ কাটতে বসবে । বাচ্চারা যে
যার ঘর থেকে থালা বাটি নিয়ে লাইন দেবে । দেখবে সে এক শিল্পের নামান্তর । কি
নৈপুণ্যে মাছের সাইজ যাই হোক না কেন , গুনে গুনে এমন পিস করবে যে সকলের কপালেই
প্রসাদ জুটবে । সেদিন সবঘরে অসময়ে আখায় আঁচ পড়বে । গুলের ধোঁয়ায় পড়শি জানান দিয়ে
মাছ রান্না করে ধোঁয়াওঠা একথালা ভাত সাবড়ে , উঠোনে বা বারান্দায় গোলটেবিল বৈঠক বসবে ।
বাচ্চারা ঘিরেধরে জেঠুমনির থেকে মাছ ধরার গল্প শুনবে । বড়রা টুকটাক চুটকি ঝাড়বে ।
কাঠ অর্ধেক
লাগলোই না । ডোম বলল , ‘নাও, হোশপাইপ
লাগাও’
। তারপর ফিরল
বড়মেয়ের দিকে , ‘দিদি, পুষিয়ে
দেবেন কিন্তু , কি ফাইন
করে পোড়ালাম দেখলেন তো’ !
ওরা
আস্ত আস্ত কাঠের গুঁড়ি জলদিয়ে নিভিয়ে ফেলল । তারপর লাঠির আগায়
ছোটো মত একটা কালো টুকরো তুলে দিল মেটে হাঁড়িতে । এবার অস্থি বিসর্জন । দাদাভাই এর
ডাক পড়লো আবার । ও হাঁড়িটা নিয়ে জলে নেমে গেল , অস্থি বিসর্জন দিয়ে ডুব দিতে , উঠে কাছার
ওপর পরিপাটি গুছিয়ে আনা মায়ের শাল চড়াল গায়ে ।
বড়মেয়ের
মনের কোণে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা , কুলিকের ঠাণ্ডা বাতাসে আরেকবার রেগে উঠতে গিয়ে পারলো না , কু-সন্তান
যদ্যপি হলেও , মা নিশ্চয়
ছেলের গায়ে তার সখের শালের স্পর্শে ভুলে যাবে মরণ শীতের রাত আর ঠাণ্ডার নীল কষ্ট ! এদিকে
চিতায় জলের তোড়ে আস্তে আস্তে মুছে গেল শেষ চিহ্নটুকুও ।
মেজ জায়ের
ছেলে ডোমেদের হাতে হাতে চিতা পরিষ্কার করে সামনে তুলসীগাছ পুঁতে , গীতা রেখে
বড়জামাই এর আনা রজনীগন্ধার মালা চড়িয়ে , একগোছা ধূপকাঠি জ্বেলে দিলো । ডোম বলল , ‘এবার আর
ফিরে তাকাবেন না’ !
মেয়ে যেন
মাতৃঋণ শোধ করে শ্বশুর ঘরে চলেছে । বড়মেয়ে নির্বিকার দেখতে লাগলো কিভাবে শূন্য
চিতা স্নান সেরে সেজেগুজে অপেক্ষা করতে লাগলো পরবর্তী নাগরের ! নির্লজ্জ রাক্ষস কাঁহিকা
!
কুঁউউউউউউউউউ শব্দটা হতেই লাগল ফোনে । সুমন্তর মাথাতেও ওই শব্দটা ঘুরপাক খাচ্ছে সংক্রমণের মত।
অজিতই প্রথম নৈঃশব্দ ভাঙল ।
- না নেই ! এটা তো জাষ্ট সেল ফোন অফ করে রাখলে রাতে ব্যবহার করি আমরা । তাছাড়া, ফিনান্স কোম্পানীর লোনের জন্য একটা প্রুফ অফ অ্যাড্রেসও বটে । তাই রাখা।
- হুম !
একটু এগিয়েই দেখল- বন্ধ দোকানগুলোতে শাবল দিয়ে পেটান চলছে শাটার গুলোতে । একপাল ছেলে দৌড়াদৌড়ি করছে লাঠি নিয়ে । স্কুলের গেটে ভীষণ ভীড় । ঢুকতে পারবে কিনা স্কুলে, এই চিন্তা কেয়ার মনে । অজিতকে দেখল, পুলিশ নিয়ে খেদানোর চেষ্টা করছে ওই সব ছেলেদের । স্থানীয় কাউন্সিলর চড় উঁচিয়ে হঠাৎ তেড়ে গেল অজিতের দিকে। অজিত প্রাণপণে বোঝাবার চেষ্টা করছে তাকে । অজিতের সহযোগী কন্সটেবলরা ধীরে ধীরে অধৈর্য হয়ে উঠছেন। সহকারী এস আই ছেলেটি এসে অজিতের কানে কানে কিছু বললে সে একটু সরে এল । অজিত মোবাইল বের করে পকেট থেকে। কাউন্সিলার ভদ্রলোক তান্ডব শুরু করেছেন। সঙ্গে বহু ছেলে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে যে কোন মুহূর্তে। এক্ষুণি কিছু করা দরকার। শূন্যে ফায়ার করতে পারলে ভালো হত, কিন্তু প্রয়োজনীয় পারমিশান পাবে না, অজিত জানে। কাউন্সিলার অজিতের দিকে দু’হাত দিয়ে কদর্য ঈঙ্গিত করছে। কেয়া দেখল অজিত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে লাঠি। সামান্য পাঁচ-সাত জনের পুলিশবাহিনী লাঠিচার্জ করতে উদ্যত হতেই কাউন্সিলার পেছিয়ে এসে দাঁড়াল একটা বাসের পেছনে। ফ্লিপ-টপ মোবাইল খুলে চাপাগলায় কাউকে নির্দেশ দিলেন, “টপকা দে শালে কো!” ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে হতভম্ব কেয়ার তখন নড়ার ক্ষমতা নেই।
স্কুল
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
সেল ফোনটার রিংটোন বেজে উঠল । কেয়ার এই ফোনটা নতুন । আগের ফোনটা চুরি হয়ে যাওয়াতে এই ফোনটা কিনেছে । বেশীর ভাগ ফোন নাম্বার আর নেই । কেয়া অত খুঁটিনাটি জানত না। ডিভাইস মেমোরিতে নামের সঙ্গে নাম্বার গুলো সেভ করে রাখা ছিল বলে এই বিপত্তি । নাম্বারটা একই , সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছ থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই পাওয়া গেছে । কলিং নাম্বারটা তাই অচেনা । ওদিকে স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে ! এখন,
ফোন তুলে
কথা বলতে গেলে,
খানিকটা সময় নষ্ট । দোনোমনা হয়ে ফোনের আনসার বাটনে চাপ দিল কেয়া ।
- হ্যালো
!
- নমস্কার ম্যাডাম । আমায় আপনি চিনবেন না । সামান্য কথা ছিল দু- একটা ।
- নমস্কার,
কি বলবেন সংক্ষেপে বলুন । একটু তাড়া আছে । আমার নাম্বারটা কোত্থেকে পেলেন?
- নাম্বার আমরা পেয়ে
যাই । এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বলছিলাম কি,
দুদিন পরে যে বন্ধ্ ডাকা হয়েছে,
সেই দুদিন স্কুলে যাবেন নাকি?
- না ! প্রথম দিন বন্ধ্ ! তাই যাবো না । দ্বিতীয় দিন স্কুলে যাবো ।
- আপনি লালকমল?
- মানে ?
- কিছুই না
! ওই লালকমলরা
বন্ধ্ ডেকেছে । আমি নীলকমলের
লোক । প্রথম দিনও আপনি স্কুলে যাবেন , কেমন ? রাখি ।
কেয়া একটু ঘাবড়ালো ! এসব ওর ভালো লাগে না । গতকাল টিচারদের একটা মিটিংয়ে ঠিক হয়েছে,
ওরা কেউ আসবে না স্কুলে প্রথম দিন । সুমন্ত বেরিয়ে গেছে । বুবাই ওর সাথেই বেরুবে । এই সময় হঠাৎ উটকো ঝামেলা ভালো লাগে না ।
শহরতলীর এই আধা সরকারী স্কুলে গণ্ডগোল লেগেই আছে।
কেয়ার দুই বন্ধু বড় বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায় । সেখানে, এই সব বন্ধের দিনগুলোতে,
একটা অলিখিত নিয়মই আছে,
বন্ধ , তা যে পার্টিই ডাকুক,
আসতে হবে না স্কুলে । সাড়ে তিন লক্ষ টাকার ডোনেশান আর মাসে সাড়ে বাইশ হাজার টাকা ফি দিয়ে যে সব অভিভাবকরা ভর্তি করান নামী স্কুলে, সেই সব স্কুলে কে আর ঝামেলা বাধাতে চায় । অবশ্য কিছুই বলা যায় না, অতি বাঁদর ছাত্র- ছাত্রীদের
।
বাঁদরামি করলেও আস্তে করে
বলে, কি সুইট বাচ্চাটা ! ঠিক যেন বাচ্চা শুয়োর- বলে ঝাল মেটায় বন্ধু টিচাররা । অভিভাবকরাও খুশী আর ছাত্র- ছাত্রীরাও ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না । এসব কথা রেক্টরের কানে গেলে বিপদ । দুধেল গাইকে কে আর খোঁচাতে চায় !
গত একমাস ধরে স্কুলে খুব গণ্ডগোল । টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে অভিভাবকরা বেশ ঝামেলা করছে । এইসব মার্কস নিয়ে যে আসল পরীক্ষায়
পাশ করা যাবে না,
সেটা কিছুতেই ওদের বোঝানো যাচ্ছে না । বাইরের লোকজন নিয়ে হামলা করেছে বড় দিদিমণির ওপর । উনি অনড় । কিছুতেই অ্যালাউ করবেন না ফেল-করা ছাত্রীদের। এর কিছুদিন আগে একজন ক্লাস
ফোর স্টাফের নিয়োগ নিয়ে ম্যানেজিং কমিটিতে একটা গণ্ডগোল হয়েছিল । তিনজন টিচার রিপ্রেজেনটেটিভের মধ্যে একজন ছিল কেয়া । বড় দিদিমণির কিছুই করার ছিল না । এই পোষ্টটা ডিআই থেকে এসএসসির মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল । এস সি/ এস টি কোটা থেকে জেনারেল কোটা করেই পাঠানো । তাও নীলকমলরা
এন্তার ঝামেলা করেই যাচ্ছে । একদিন তো সাজিয়ে গুছিয়ে একটা দলকেও আনা হয়েছিল,
স্কুলের গেটের সামনে,
বিক্ষোভ দেখানোর জন্য । অনেকেই ব্যক্তিগত কুৎসা শুরু করেছিল,
অন্যতম টিচার রিপ্রেজেনটেটিভ তুলিকার বিরুদ্ধে । ওর নিজস্ব জীবনে ডিভোর্সের কারণ নিয়ে নানা আজে বাজে মন্তব্য মিটিংয়ে তো বটেই,
অভিভাবকদের প্রতিনিধিদের সামনে বীভৎস খারাপ ভাবে তুলে ধরে,
তুলিকা যে কতখানি বদ চরিত্রের সেটাও বোঝানো হয়েছিল । এটা করেছিল পুরুষরাই বেশী ভাবে । চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল কেয়া । তুলিকার স্বামী যে রোজ মদ খেয়ে এসে পেটাত,
সেটা আর বলতে পারলো না। তবে অন্যভাবে যতটা পারা যায়,
সেটা করাতে অন্যদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছে,
সেটা বুঝতে পারে ।
কেয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে । মোকাবিলা করার শক্ত শপথ নিয়ে বুবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে স্কুলের জন্য । বুবাইকে ওর স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে,
রিক্সাটা ঘুরিয়ে নেয় নিজের স্কুলের সামনে । ভাড়াটা চুকিয়ে দিয়ে,
নামতেই একটা ছেলে বলল- দিদিমণির বুকের সাইজটা বেশ
ডবকা তো ! একবারে আয়েশা টাকিয়া
!!!! দিদিমণির ব্রার সাইজ কত ? আশেপাশের কয়েকজন হো হো করে হেসে ওঠে । অপমানে মুখ লাল হয়ে হয়ে আসে কেয়ার । থাপ্পড় কষাতে ইচ্ছে করলেও,
জবাব না দিয়ে,
স্টাফ রুমে ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খায় । ছেলেটাকে মনে হয়,
সেদিনের সাজানো জমায়েতে দেখেছিল । প্রতিমা আর অহনা ট্যারা চোখে তাকায় কেয়ার দিকে ।
-
কি রে,
কেয়া !
আরে দ্যাখ না ! বাইরে কয়েকটা ছেলে অসভ্য কথা বলছিল আমার শরীর নিয়ে । মাথাটা গরম হয়ে গেছে ।
কি বলেছে ?
আমাকে আয়েশা টাকিয়ার সঙ্গে তুলনা করে খারাপ কথাগুলো
বলেছে ।
- সালওয়ার কামিজ পরে আসিস কেন ?
- বেশ করি !
‘তোর ভালো ভালো শাড়ী গুলো বিক্রি করার জন্য ওএলএক্স ডট. ইনে বিজ্ঞাপন দে । আমি কিনে নেবো । আমার তো বাবা, আবার শাড়ী ছাড়া ভালোই লাগে না ! আমি তো তোর মত হিন্দি সিনেমার অনন্ত যৌবনা নায়িকা নই’ । অহনা একটা বিছুটি মার্কা হাসি হেসে বলল
।
রাগে ফেটে পড়লেও বেশী কথা বাড়াল না কেয়া । প্রতিমা আর অহনা হল জলের চরিত্র । যে পাত্রে যখন,
তখন সেই রূপ ধারণ করে । এখন এখানকার কাউন্সিলরের খোচর। স্কুলের দৈনন্দিন খবর পাচার করে ম্যানেজিং কমিটির ওই স্থানীয় কাউন্সিলরকে । তুলিকা, একদিন তার ডিভোর্সের ব্যাপারটা খুব আবেগের বশে বলে ফেলেছিল প্রতিমাকে । ঠিক তারপরেই চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে যায়। ব্যাপারটা কুলের আচারের মত,
অনেকেই তারিয়ে উপভোগ করে । আর উত্তর না দিয়ে,
ক্লাসে যাবার জন্য তৈরি হল কেয়া । কোনো রকমে পঁয়তাল্লিশ মিনিট কাটিয়ে ফিরে এলো স্টাফ রুমে ।
সেল ফোনটা অন করতেই দেখল,
সুমন্তর একটা মিসড কল অ্যালার্ট। রিং ব্যাক করতেই সুমন্ত উত্তেজিত হয়ে বলল:-
- শোনো,
অজিতকে মনে আছে ? অজিত সরকার- আমার কলেজের ক্লাসমেট ?
- মনে থাকবে না কেন?
পুলিশে চাকরী করে তো ?
- হ্যাঁ! সেই অজিত আমাদের থানায় ওসি হয়ে এসেছে । আজ দেখা হল । সন্ধেবেলায় বৌকে নিয়ে ফ্ল্যাটে আসতে পারে, সময় পেলে । জলখাবারের জন্য কিছু একটা বানিয়ে রেখ ।
- হ্যাঁ! সেই অজিত আমাদের থানায় ওসি হয়ে এসেছে । আজ দেখা হল । সন্ধেবেলায় বৌকে নিয়ে ফ্ল্যাটে আসতে পারে, সময় পেলে । জলখাবারের জন্য কিছু একটা বানিয়ে রেখ ।
- ঠিক আছে । সেল ফোনটা বন্ধ করল কেয়া । মনমেজাজ ভাল নেই । সুযোগ পেলে সুমন্তর সামনেই অজিতকেও বলবে আজকের অনামা কলের কথা । এখন আর সুমন্তকে বলবে না । টেনশনে থাকবে ।
চারটের সময়ে বেরিয়ে পড়ল কেয়া । বুবাইকে নিয়েই বাড়ী ফিরে যাবে । সুবিধে একটাই- বুবাইয়ের স্কুলের সময়টা ম্যাচ করে নিজের স্কুলের সাথে । ছেলেটার ক্লাস নাইন হয়ে গেছে,
তাও একটু সাবধানেই থাকে কেয়া । স্কুলে একা ছাড়তে চায় না । বুবাই একটু গাঁইগুঁই করে,
তবে ওর বেশী কিছু বলে না । গীটার শেখার বায়না করেছিল । সুমন্তর চেনা সিনে মিউজিসান আ্যসোসিয়েশানের একজনকে ঠিক করে দিয়েছে,
শেখানর জন্য । বাড়ীতেই এসে শিখিয়ে যান উনি । ভালই শেখান । বুবাইও মনের আনন্দে আছে বলে আর বেশী কথা বলে না ।
সন্ধে সাতটা নাগাদ এল,
অজিত মৌমিতাকে নিয়ে । ওদের চার বছরের মেয়েটাও দারুণ ফুটফুটে । বুবাইয়ের সাথে জমে গেল টুনটুনি । আধঘন্টার মত পুরোনো দিনের চর্বিত চর্বণ হলো । গল্প- গুজবে কেয়া ভুলেই গেছিল সকালের টেনশানের কথা । বেসফোনে ফোনের বাজনা
। সুমন্তই ধরল ফোনটা ।
- বাঃ ! বাঃ ! থানার নতুন ওসির সঙ্গে দেখি ভালই পীরিত আপনাদের । তাতে তো লাভ হবে না দাদা ! আপনার মিসেসকে বলবেন, উনি যেন স্কুলে যান বন্ধের প্রথম দিন । আর আপনি তো আপিস যাবেনই । সরকারি চাকুরে তো ! তাই আর বেশী কিছু বললাম না ।
- বাঃ ! বাঃ ! থানার নতুন ওসির সঙ্গে দেখি ভালই পীরিত আপনাদের । তাতে তো লাভ হবে না দাদা ! আপনার মিসেসকে বলবেন, উনি যেন স্কুলে যান বন্ধের প্রথম দিন । আর আপনি তো আপিস যাবেনই । সরকারি চাকুরে তো ! তাই আর বেশী কিছু বললাম না ।
- কে আপনি ?
-
জেনে কি লাভ ? আর হ্যাঁ ! ওই ওসি আমাদের নজরে আছে । বলে দেবেন । আগের থানায় থাকতে,
মালটা সোজা ব্যাটে খেলতে গেছিল। কী লাভ হল? বরফিকে অ্যারেস্ট
করেও তো ধরে রাখতে পারলি না ! উল্টে এই থানায় বদলী । এখানে বেশী তেড়িবেড়ী করলে দুঃখ আছে ওর কপালে । বলে দেবেন ! রাখি !
কুঁউউউউউউউউউ শব্দটা হতেই লাগল ফোনে । সুমন্তর মাথাতেও ওই শব্দটা ঘুরপাক খাচ্ছে সংক্রমণের মত।
অজিতই প্রথম নৈঃশব্দ ভাঙল ।
- কে করেছিল ফোনটা ? আর তুই ওরকম ধিনিকেষ্টর মত দাঁড়িয়ে কেন সুমন্ত ?
- না,
মানে !
- আরে,
কি হয়েছে বলবি তো !
-
একজন ফোন করে বন্ধের প্রথম দিন কেয়াকে স্কুলে যেতে বলল । আর তুই যে আমার বাড়ী এসেছিস সেটাও জানে । বরফিকে অ্যারেস্ট করার জন্য তোকে এই থানায় বদলি করেছে সেটাও বলল । কেয়া আর তোর প্রতি হামদর্দী দেখিয়ে তোদের বলল,
সাবধানে থাকতে । হা হা করে প্রত্যুত্তরে হাসল অজিত । মৌমিতা বলল:-
- আপনার বন্ধুকে নিয়ে আর পারিনা ! জ্বলে পুড়ে গেলাম। সব সময় টেনশানে থাকতে হয় । ওই জমানাতেও একই কেস করত আর এই জমানাতেও সেই জেদ । এটা ক্যালকাটা পুলিসের অ্যাডেড এরিয়া হওয়াতে এখানে নিয়ে এসেছে । জানি না, কপালে কি আছে । আর কেয়া বৌদি, তোমাকেও বলি- এইসব গণ্ডগোলের মধ্যে যাও কেন বাপু ! বুঝতে পেরেছি, তুমি ওই দিন স্কুলে যাবে না ! তাই এই থ্রেট ! পুলিশের ঘর করছি তো, একটু একটু বুঝি । অজিত জিজ্ঞেস করল
- আপনার বন্ধুকে নিয়ে আর পারিনা ! জ্বলে পুড়ে গেলাম। সব সময় টেনশানে থাকতে হয় । ওই জমানাতেও একই কেস করত আর এই জমানাতেও সেই জেদ । এটা ক্যালকাটা পুলিসের অ্যাডেড এরিয়া হওয়াতে এখানে নিয়ে এসেছে । জানি না, কপালে কি আছে । আর কেয়া বৌদি, তোমাকেও বলি- এইসব গণ্ডগোলের মধ্যে যাও কেন বাপু ! বুঝতে পেরেছি, তুমি ওই দিন স্কুলে যাবে না ! তাই এই থ্রেট ! পুলিশের ঘর করছি তো, একটু একটু বুঝি । অজিত জিজ্ঞেস করল
- তোর বেস ফোনে কলার আই ডি আছে সুমন্ত ?
- না নেই ! এটা তো জাষ্ট সেল ফোন অফ করে রাখলে রাতে ব্যবহার করি আমরা । তাছাড়া, ফিনান্স কোম্পানীর লোনের জন্য একটা প্রুফ অফ অ্যাড্রেসও বটে । তাই রাখা।
- হুম !
কেয়া হতভম্ব হয়েছিল এতক্ষণ । আস্তে আস্তে সম্বিত ফিরে পেয়ে সকালের ঘটনাটা বলল সবাইকে । অজিত মুচকি হেসে বলল ‘সেদিন স্কুলে যাবে কি যাবে না,
সেটা তোমার ব্যাপার কেয়া । আমার কিছু বক্তব্য নেই । তবে, তোমার সেল ফোনে ওই নাম্বরটা উঠেছে,
ঐটে দাও আর সঙ্গে তোমার নাম্বার । দেখি, ট্রেস করতে পারি কিনা’ !সুমন্ত বলল:- ‘আমাকে তো যেতেই হবে । সরকারি চাকরি।
না হলে একগাদা হুজ্জতি ! আমি বলি কি কেয়া,
তুমি সেদিন স্কুলে যাও । বুবাইকে যেতে হবে না । পাশের ফ্ল্যাটে মাসীমার কাছেই থাকবে । বেকার ঝামেলা বাড়িয়ে কি লাভ?
কি বল,
অজিত’ ?-
‘আমার কিছু বলার নেই,
যেতে পারো, তবে ওদের অত সাহস হবে না মনে হয়’।
শান্ত স্বরে
উত্তর দিল অজিত ।
-
হ্যাঁ হ্যাঁ ! কেয়া যাবে ! রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায় ! মৌমিতা ঝাঁঝিয়ে উঠল ।
তালটা কেটে সেদিনের মত আড্ডা শেষ ।
বন্ধের আগের দিন সুমন্ত একটা ব্যাকপ্যাকে পাজামা,ফোলানো বালিশ,
পাতলা একটা চাদর,
টুথব্রাশ, টুথপেষ্ট, তোয়ালে আর এক প্যাকেট তাস নিয়ে চলে গেল অফিসে । একদম বন্ধের শেষে ফিরবে বাড়ীতে,
তার পরের দিন ! টেবিল জোড়া দিয়ে রাত কাটাবে অফিসে। বুবাইকে সব বুঝিয়ে পাশের ফ্ল্যাটে মাসীমার জিম্মায় রেখে বেরিয়ে
পড়ল । একটা অপরাধ বোধ কাজ করছে মনে । জানে, প্রতিমা দেখেই হাড় জ্বালানো হাসি হাসবে । অহনা ফুট কাটবে , ‘সব সংগ্রামীদের জানা আছে’ !
একটু এগিয়েই দেখল- বন্ধ দোকানগুলোতে শাবল দিয়ে পেটান চলছে শাটার গুলোতে । একপাল ছেলে দৌড়াদৌড়ি করছে লাঠি নিয়ে । স্কুলের গেটে ভীষণ ভীড় । ঢুকতে পারবে কিনা স্কুলে, এই চিন্তা কেয়ার মনে । অজিতকে দেখল, পুলিশ নিয়ে খেদানোর চেষ্টা করছে ওই সব ছেলেদের । স্থানীয় কাউন্সিলর চড় উঁচিয়ে হঠাৎ তেড়ে গেল অজিতের দিকে। অজিত প্রাণপণে বোঝাবার চেষ্টা করছে তাকে । অজিতের সহযোগী কন্সটেবলরা ধীরে ধীরে অধৈর্য হয়ে উঠছেন। সহকারী এস আই ছেলেটি এসে অজিতের কানে কানে কিছু বললে সে একটু সরে এল । অজিত মোবাইল বের করে পকেট থেকে। কাউন্সিলার ভদ্রলোক তান্ডব শুরু করেছেন। সঙ্গে বহু ছেলে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে যে কোন মুহূর্তে। এক্ষুণি কিছু করা দরকার। শূন্যে ফায়ার করতে পারলে ভালো হত, কিন্তু প্রয়োজনীয় পারমিশান পাবে না, অজিত জানে। কাউন্সিলার অজিতের দিকে দু’হাত দিয়ে কদর্য ঈঙ্গিত করছে। কেয়া দেখল অজিত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে লাঠি। সামান্য পাঁচ-সাত জনের পুলিশবাহিনী লাঠিচার্জ করতে উদ্যত হতেই কাউন্সিলার পেছিয়ে এসে দাঁড়াল একটা বাসের পেছনে। ফ্লিপ-টপ মোবাইল খুলে চাপাগলায় কাউকে নির্দেশ দিলেন, “টপকা দে শালে কো!” ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে হতভম্ব কেয়ার তখন নড়ার ক্ষমতা নেই।
হঠাৎই একটা চকরা-বকরা
সার্ট পরা ছেলে
পেছন দিক থেকে তীরবেগে দৌড়ে গেল অজিতের দিকে। পাতলা হিলহিলে চেহারা। বয়েস বড়জোর কুড়ি। এস আই শান্তনু সাবধান করার আগেই ছেলেটা
রিভলবার বের করে গুলি ছুঁড়ল। অজিতের পিঠ ভেদ করে ঢুকে গেল
সেই বুলেট।
সকলের সামনে অজিতের সুঠাম দেহ লুটিয়ে পড়ল রাস্তায় । কেয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধরাধরি করে অজিতকে নিয়ে গেল কনষ্টেবলরা । এবার আর কেয়া এগুলো না স্কুলের গেটের দিকে । প্রায় দৌড়ে এসে
সামনের
মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল কেয়া। পথের দশ
পনের মিনিট
সময় তার সমস্ত স্বত্ত্বা জুড়ে আতঙ্কের ছায়াছবি।
মাসীমার ফ্ল্যাটের দরজা ঠেলে
ঢুকলো কেয়া ।
বুবাই ওকে দেখেই লাফিয়ে উঠে কেঁদে বলল :- মা, অজিতকাকুকে গুলি করে মেরে ফেলেছে ওরা!
মাসীমাকে দেখল- আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন । মৌমিতা আর টুনটুনির মুখটা ভেসে উঠতেই বুবাইকে জড়িয়ে ধরে কেয়া কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে । চোখের জলের নোনতা স্বাদ পেতে পেতে কেয়া টের পেল তার কান গরম হয়ে উঠছে। বুকের ভেতর এক অসহ্য জ্বালা। কিসের জন্য বুঝে উঠতে পারল না কেয়া। তার গলা দিয়ে কান্নার বদলে এক তীব্র চিৎকার উঠে আসতে চাইছে। সারা শরীরে পাক খাচ্ছে,একটা প্রচন্ড ঘেন্না । কেয়া বুঝতে পারল সে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে আজ।
তখন টিভিতে বারবার,বিরক্তিকর ব্রেকিং নিউজ :- সমাজ বিরোধীদের গুলিতে পুলিশ আধিকারিকের মৃত্যু !
কেয়া জানে এ দৃশ্যও উপভোগ করার দর্শক আছে...
১.
এরপরের সবকিছু খুবদ্রুত ঘটে গেল।
মা
হঠাৎ শিসের
মতো অদ্ভুত আওয়াজে চমকে উঠলো রুষা । কিছুদিন ধরে ছোট ছেলেটা স্কুল এ যেতে পারছেনা, জ্বরে
কাশিতে নাজেহাল অবস্থা । অ্যাজমা নেই কিন্তু অ্যালার্জি তে ভোগে, টানের জন্য
সারারাত ঘুমতে পারেনা। সারারাত আধশোয়া হয়ে বুকে নিয়ে বসে থাকে রুষা । তবেই একটু
ঘুমোয়
। কিন্তু
ওভাবে বসে রুষার চোখে ঘুম কোথায় আসে? কদিনের
রাত জাগা চোখ কখন যে জড়িয়ে এসেছে বুঝতেও পারেনি। সম্বিত ফিরলে বোঝে টানেল
এফেক্ট এ বাতাস ঘুরছে, চিমনির
ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে ঠিক যেন কেউ শিস দিচ্ছে। বন্ধ জানলার কাঁচে ঝরা পাতা গুলো আছড়ে পড়ছে বাতাসে ।
রুষারা যখন
প্রথম এই শহরে আসে তখন এই ছোট্ট টাউন শিপ এ বেশ কিছু ফার্ম ছিল । গাছে ভরা এই
কমপ্লেক্সে ছোট্ট এই টাউন হাউস দেখতে এসে রুষা আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠেছিল যখন
আবিষ্কার করেছিল তার বাড়ির ঠিক পেছনেই একটা রেললাইন রয়েছে আর তার দুপাশ দিয়ে
বড়ো বড়ো ওক মেপল এর সারি । ফল’এর
সময় যখন এই গাছ গুলো লাল,হলুদ কমলায়
সেজে উঠবে তখন এই প্যাটিয়ো তে বসে বিকেল বেলা চা খেতে কত ভাল লাগবে এই ভেবেই সে
রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল।
আবহাওয়া
বদলের সময় । ফল এসেছে, পাতায়
পাতায় রং এর পরিবর্তন। গাছেরা নতুন সাজে সেজে উঠেছে ,লং উইকেন্ড
এলেই প্রকৃতিপ্রেমী আর ফটোগ্রাফারের দল
ছুটবে নিউ হ্যামসায়ার নতুবা মেইন কিংবা ক্যাটস্কিল । এই অপরুপ দৃশ্য মনের পাতায়
আর ক্যামেরার স্ক্রিন এ ধরে রাখতে ।পাতাঝরার দিন এদের কাছে এক আকর্ষণ কিন্তু রুষার
কাছে এক আতঙ্ক ; প্রকৃতি র
এই রং যেন ছেলেটার গলা টিপে ধরে ,একটু
বাতাসের জন্য ওর ছটফটানি দেখলে মনে হয় বুকের সম্পূর্ণ বাতাস যদি ওকে দিতে পারতো। যেদিন
মেয়ের মা হয়েছে,নিজের
অস্তিত্ব হারিয়েছে "মা " এই হয়ে গেছে তার পরিচয় ঠিক আর সব মায়েদের
মত ,না তার
জন্য মনে কোনো আক্ষেপ ছিল না । নির্দ্বিধায় বেছে নিয়েছিল হোম মেকার এর জীবন। পুতুল
খেলার মতো মেতে উঠেছিল ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে। পৃথিবীটা কবে যেন ছোট হতে হতে নিজের
ঘরের চার দেওয়ালে ঢুকে পড়ল রুষা বুঝতেও পারল না
রণিত
অভিযোগ করত রুষা তুমি আমাকে ভুলেই যাচ্ছ,দুরে ঠেলে দিয়েছ, মনে মনে
হাসতো রুষা ভাবত ‘কবেই বা কাছে এসেছিলাম যে দুরে ঠেলব?’
উত্তরবঙ্গের
এক ছোট্ট শহরের মেয়ে রুষা,মেট্রো
সিটির বাসিন্দা রণিত কে প্রথম দেখে বিয়ের দিন । একটা কথাও বলেনি, যখন দাদা
বলেছিল ‘বোন বাবা যে তোর বিয়ে পাকা করে ফেললো তুই কিচ্ছু বলবি না ,একবার
ছেলেটা কে তো দেখ’ । মনে মনে
ভেবেছিল রুষা, যাকে ১৫ বছর বয়স থেকে দেখলাম তাকে চিনলাম কই আর একদিন দেখে এই
মানুষটাকে কি করে চিনবো ?
এতোটাই অনুভূতিহীন হয়ে গেছিল যে জীবন কে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে বিয়ের দশদিনের মাথায়, মানুষ টার হাত ধরে পৃথিবীর অপর প্রান্তে পাড়ি দিতে একটুও বুক কাঁপে নি রুষার। পুতুল খেলার মতো, ওদের নিয়ে সংসার সংসার খেলতে খেলতে কবে যে দশ টা বছর পার হয়ে গেল। অনেক জল বয়ে গেছে ।
এতোটাই অনুভূতিহীন হয়ে গেছিল যে জীবন কে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে বিয়ের দশদিনের মাথায়, মানুষ টার হাত ধরে পৃথিবীর অপর প্রান্তে পাড়ি দিতে একটুও বুক কাঁপে নি রুষার। পুতুল খেলার মতো, ওদের নিয়ে সংসার সংসার খেলতে খেলতে কবে যে দশ টা বছর পার হয়ে গেল। অনেক জল বয়ে গেছে ।
ছোটো ছেলে
হবার পরেই রুষার শরীর ভাঙতে শুরু করেছিল। বিরল এক রোগে নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল । প্রায়ই কিছু না কিছুতে ভুগে ভুগে ক্রমশই ভেঙে পড়ছিলঢ়
রণিতও যেন আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিল , নিজের জগতে মশগুল হয়ে গেল। শরীরের সাথে
সাথে মন ও ভেঙ্গে গেল |
যে
মন কোনদিন আপোষ করতে শেখেনি সেই মনটাই কোথায় যেন হারিয়ে গেল ,ধীরে ধীরে
গ্রাস করলো বিষন্নতা | শরীরের
কষ্ট বাঁচার ইচ্ছেটাকেই হারিয়ে দিল, জীবন
টা কে একটা বোঝা মনে হত আর টানতে ইচ্ছে করত না | ডাক্তারদের দেওয়া ওষুধ ও ওর বিষন্নতা
সারাতে পারল না ।
হঠাৎ একদিন
ওর এক ছোটবেলার বন্ধু বলল,
রুষা,
‘চল তুই আর আমি সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং করি ,আমাদের সেই পুরনো প্রেমিকদের খুঁজে পাওয়ার
চেষ্টা করি’ । অদ্ভুত প্রস্তাব, কিন্তু মনে ধরল । এতদিন
কম্পুটার ছিল রুষার সতীন ,বিয়ের আগে
দায়ে পড়ে, হবু
কম্পুটার ইঞ্জিনিয়ার বর এর কথায় কিছু শিখেছিল বটে , কিন্তু
সময়ের সাথে সেই বিদ্যে কবেই মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে | সেই প্রথম
নাম শুনল ফেসবুক ,অর্কুট । শুরু হলো
জীবনের এক নতুন অধ্যায় । আসতে আসতে সব পুরনো বন্ধুরা ফিরে এলো জীবনে, মানে
সাইবার লাইফে, কবে যে
আবার বাঁচতে শুরু করল রুষা ,নিজেও
বোঝেনি ।
একটু
একটু করে ফিরে এলো রু ...শুভ্রর রু । সারাটা দিন বসে আছে রুষা কম্পুটার এর সামনে, যে
যন্ত্রটার থেকে শত হস্ত দুরে থাকতো। রণিত অনেক বার শেখানোর চেষ্টা করেছে রুষা রাজি
হয় নি ,বলেছে
যেটুকু আমার দরকার ততটুকু তো জানি, এর বেশি আর জেনে কি হবে? ছেলেকে পড়াতে আর তোমার সংসারের কাজ চালানো
,সে তো
দিব্যি করছি । আজ এই সাইবার ওয়ার্ল্ড ই রুষার জীবন এর অনেকটা নিয়ে বসে আছে , সারাদিন
কেটে যায় শুভ্রর সাথে চ্যাট করে। রণিত এর অবহেলা আজকাল আর রুষাকে ব্যাথা দেয়না।
হঠাৎ ফোনে
এ সেট করা অ্যালার্ম এর আওয়াজে , মনে পড়ল বড় ছেলের স্কুল থেকে ফেরার সময় হলো ,ওকে নিয়ে
আসা,দুজন কে
খাওয়ানোর মাঝেও মন পড়ে আছে স্ক্রীনে, একবার করে দেখছে আর ভাবছে , যদি কোনো
উত্তর আসে ...
আট মাস হতে চলল শুভ্র আবার এসেছে ওর জীবরে, হোকনা সাইবার ওয়ার্ল্ড...তবুও ফেলে আসা সেই দিন গুলো যেন ফিরে পেয়েছে দুজনে । আজও মনে পড়ে সেই দিনটির কথা ,মন খারাপ কোরনা বলে শুভ্রর চলে যাওয়া । একবারের জন্যেও পিছু ফিরে দেখেনি শুভ্ররে
আট মাস হতে চলল শুভ্র আবার এসেছে ওর জীবরে, হোকনা সাইবার ওয়ার্ল্ড...তবুও ফেলে আসা সেই দিন গুলো যেন ফিরে পেয়েছে দুজনে । আজও মনে পড়ে সেই দিনটির কথা ,মন খারাপ কোরনা বলে শুভ্রর চলে যাওয়া । একবারের জন্যেও পিছু ফিরে দেখেনি শুভ্ররে
দশ বছর পার
হয়ে গেছে
।
তারপর একই শহরের ছেলে মেয়ে তারা ,ইচ্ছে
করলে ঠিক জানতে পারত শুভ্রর কথা কিন্তু জানার ইচ্ছে হয়নি। বার তিনেক দেশে গেছে
কিন্তু সেই শহরে আর যায়নি । বাবা মা শ্বশুরবাড়ি তে এসে দেখা করে গেছে তারাও
জানতে চায়নি কেন সে বাড়ি যায় না।
কাজ শেষ করে
আবার স্ক্রীন এর সামনে । মাথায়
কিছুই আসছেনা । আজই
শুভ্রর জানানোর কথা কবে সে লন্ডন থেকে ভারতে যাওয়া ফাইনাল করবে সেই বুঝে রুষাও
টিকিট করবে। সাদা স্ক্রীন তাকিয়ে থাকে রুষার দিকে...
মাথায় তার একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে আমার সাথেই কেন হয় এইসব । অবশ স্নায়ু আর কাজ করছিল না আস্তে আস্তে উঠল রুষা ,যন্ত্রের মত শেষ করল রাতের সব কাজ; আবার এসে বসলো কম্পুটার এর সামনে ইনবক্স শূন্য চ্যাটবক্স ও শূন্য। হঠাৎ একটা গোঙানিতে সম্বিত ফিরল রুষার কখন থেকে যে ছেলেটা একটু বাতাসের জন্য ছটফট করছে বুঝতেও পারেনি । চেষ্টা করছে মা বলে ডাকতে হাত থেকে পড়ে গেল সব স্লীপিং পিল । শুনতে পেল টিং টিং আওয়াজ , বুঝল নতুন ম্যাসেজ এসেছে চ্যাট বক্সে ।
মাথায় তার একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে আমার সাথেই কেন হয় এইসব । অবশ স্নায়ু আর কাজ করছিল না আস্তে আস্তে উঠল রুষা ,যন্ত্রের মত শেষ করল রাতের সব কাজ; আবার এসে বসলো কম্পুটার এর সামনে ইনবক্স শূন্য চ্যাটবক্স ও শূন্য। হঠাৎ একটা গোঙানিতে সম্বিত ফিরল রুষার কখন থেকে যে ছেলেটা একটু বাতাসের জন্য ছটফট করছে বুঝতেও পারেনি । চেষ্টা করছে মা বলে ডাকতে হাত থেকে পড়ে গেল সব স্লীপিং পিল । শুনতে পেল টিং টিং আওয়াজ , বুঝল নতুন ম্যাসেজ এসেছে চ্যাট বক্সে ।
তাকানোর
সময় নেই, এখনই ছেলেটার মুখে দিতে হবে অক্সিজেন মাস্ক ....একটু বাতাস ।
কপালে লিখিতং
কপালে লিখিতং
সরকার
ঘোষণা করেছে যাদের পাঁচ বা তার বেশী সন্তান, তারা
পাঁচ হাজার টাকা করে পুরস্কার পাবে। আশ্চর্য বটে! জনসংখ্যার
চাপে বিপর্যস্ত এই দেশে এমন সিদ্ধান্তের কি কারণ তা নিয়ে নিশ্চই বিতর্কের অবকাশ
আছে। সমাজবিজ্ঞানী,
অর্থশাস্ত্রী
ও সংখ্যাতাত্বিকেরা না হয় তা নিয়ে গবেষণা করুন, এ গল্পের
সাথে তার কোনো সম্বন্ধ নেই।
খবরটা
শোনা ইস্তক নিবারণের মনে আর শান্তি নেই। কারণটা আর কিছুই নয়,
নিবারণের
সন্তান চারটি ।
তার
সঙ্গী-স্যাঙ্গাৎ—হারু,
বিরিঞ্চি,
মহাতাব— সবাই
লাফাতে লাফাতে গিয়ে নাম লিখিয়ে এয়েচে। একটি সন্তান কম হওয়াতে সে তাদের সঙ্গে যেতে
পারলো না, এই চিন্তাটা তার যারপরনাই বেদনার কারণ হয়ে
দাঁড়িয়েছে। অতি অল্প আয়াসেই তো সে এর দাবীদার হতে পারত। বউ আরও দু'বার
পোয়াতি হয়েওছিল। ভগমান বাদ না সাধলে সে এখন ছ' ছেলেমেয়ের
বাপ হতে পারতো। ড্যাংডেঙ্গিয়ে গিয়ে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করে আসতো। এখনও যে খুব
দেরী হয়ে গেছে এমন নয়। তার বয়স কিছু বেড়ে গেলেও, মা
ষষ্ঠীর দয়ায় পরিবার তার এখনো বেশ সোমত্থ আছে। হাতে বছর খানেক সময় পেলে সে এখনও
চেষ্টা করে দেখত। কিন্তু সরকার সে সময় দিচ্ছে না, আর মাত্র
দু'দিনের মধ্যেই নাম লেখাতে হবে। আবার
যাকে-তাকে ছেলে বলে চালানোও যাবে না। বাবুরা কি সব পরীক্ষে করে নাকি জেনে নেবে,
ছেলে
সত্যি তারই কিনা।
ভাবতে ভাবতে
নিবারণের হঠাৎ মনে পড়ে গেল মোতি বাগদিনীর কথা। দুলে
বাগদীর বউ। বছর দশেক আগে নিবারণের কিছুদিন তার কাছে আনাগোনার সুযোগ হয়েছিল,
অবশ্যই
দুলের অজান্তে। এমনিতে মিনমিনে ভিজেবেড়াল টাইপের হলে কি হয়, মোতির সাথে তার নটঘট
অনেক দূর এগিয়েছিল। তার পরেই মোতির একটা ছেলে হয়। আর কেউ না জানলেও নিবারণ জানে
ওটা তারই ছেলে। মোতিও মেনেছিলো সে কথা। লোক জানাজানির ভয়ে দু'জনের
কেউই আর ব্যাপারটা নিয়ে জল ঘোলা করে নি। সে ছেলে এখন বেশ ডাগরটি হয়ে উঠেছে নিশ্চই।
নিবারণ ভাবলো এখন যদি মোতিকে কোনোভাবে রাজি করিয়ে ঐ ছেলেকে তার বলে চালানো যায়,
তাহলেই
তো তার কাজ হয়ে যায়। বিশেষ করে দুলেটাও গতবছর মরেছে ওলাওঠায় । প্রথমটায়
অবশ্য সে খুব উৎসাহিত হতে পারছিলো না। লোক জানাজানি হলে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু
তার চেয়েও মুশকিল হল মোতি কি রাজি হবে? সে মোটেই
ভালো চোখে দেখে না নিবারণকে। বেইজ্জতের একশেষ করে ছাড়বে নিশ্চই। মাগীর যা মুখ।
কিন্তু যতই ভাবতে লাগলো, নিবারণের একটু একটু করে সাহস বাড়তে
লাগলো। পাড়ার লোকের অজান্তে নামটা লিখিয়ে দিতে পারাটা খুব সমস্যা হবে না বলেই মনে
হল। আর এই দশ বছরে মোতির রাগ কি খানিকটা পড়ে আসে নি? কথাটা পাঁচকান করবে না বলেই মনে
হয়। তাছাড়া পাঁচ হাজার টাকার অঙ্কটাও তো খুব কম নয়।
বরং এই ঝুঁকিটা না নেওয়ার পক্ষে একটু বেশীই। অনেক ভেবে সাহস সঞ্চয় করে নিবারণ ঠিক
করল, একবার চেষ্টা তাকে করতেই হবে।
আশা-নিরাশায়
দুরুদুরু বুকে নিবারণ হাজির হল দুলে বাগদীর ঘরে। মোতি বাড়ীতেই ছিল,
তাকে
দেখে নিবারণের অনেক কষ্টে সঞ্চিত সাহসের অর্ধেকটা শেষ হয়ে গেল। তাও একটা কাষ্ঠ
হাসি ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে কোনমতে বলল, 'কিরে
মোতি, কেমন আছিস ?' শুনেই
মোতি এক মুখ ঝামটা দিল। সেটা তেমন গায়ে না মেখে দন্তবিকাশ আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে সে
আবার বলল, 'আহা, অত রাগ
করিস কেন? একটা বিশেষ দরকারে আজ তোর কাছে এইচি।'
মোতির
দুর্গতি করার পর নিবারণ আর বেশী ওদিক মাড়ায় নি। কিরকম যেন মনে হোতো,
দুলেটা
বোধহয় সব জেনে গেছে। দুলে সত্যিই জানতে পারলে অবশ্য নিবারণ আর এই ধরাধামে
বিচরণ করে বেড়াত না, অন্তত একই আকারে । এখন আর
সে ভয় অবশ্য নেই। তাই খানিকটা আমতা আমতা করে হলেও, মোটামুটি
বীরদর্পেই আজ তার আসার কারণটা এবার সে ব্যক্ত করল। নিবারণের আসার কারণটা শুনে মোতি
প্রথমটা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। যাচ্ছেতাই বাপান্তসহ একপ্রস্থ গালমন্দ করে গায়ের
ঝাল মেটাল। তারপর সাফ মানা করে দিল।
নিবারণ
কিন্তু হাল ছাড়লো না। প্রথমে কাকুতি-মিনতি, তারপর
হাতে-পায়ে ধরা। অবশেষে টাকা পেলে পরে কাঁথা-শাড়ী আর কাঁচের চুড়ি দেবার লোভ দেখিয়ে
অনেক কষ্টে সে মোতিকে রাজি করল। মোতি ছেলেকে ডেকে নিয়ে এলো এই কড়ারে যে কাজ হয়ে
গেলেই নিবারণ আবার ছেলেকে ফেরত দিয়ে যাবে। তাতে নিবারণের অবশ্য কোনো আপত্তি ছিল না,
বরং
ভালই হল। নিবারণের ঘরের মানুষটিও খুব শান্তশিষ্ট নয় কিনা।
ছেলের
মধ্যে নিবারণের আদল খুব একটা অস্পষ্ট নয়। তাকে দেখে নিবারণের বুকের মধ্যেটা কিরকম
যেন করে উঠল, সেটা অদেখা ছেলেকে প্রথম দেখতে পেয়ে,
নাকি
বড় একটা সমস্যার সমাধান করে ফেলার জন্যে, বোঝা
কঠিন।
এতবড়
একটা যুদ্ধ জিতেও কিন্তু শেষরক্ষে হল না। ছেলে নিয়ে হৃষ্টচিত্তে নিজের ঘরে ফিরে
বউকে রহস্য করে বললে, 'ওগো আমার বড়মানষের ঝি,
ছেলে-মেয়েদের
একবার ডাকো দিকিনি।'—'আ গেল,
মরণ
দশা আমার। ভীমরতি হয়ে চোকের মাতা খেয়েচ? ছেলে-মেয়ে
দেকতে পাচ্ছো নি ?' বউ গরগর করে উঠলো । দাওয়ার
ওপর নিবারণের দুই ছেলে-মেয়ে খেলা করছিল।
নিবারণের মনে তখন মলয় বাতাস
বইছে, বউয়ের তিরিক্ষি মেজাজ দেখেও ঘাবড়ালো না। তাছাড়া বউয়ের
গঞ্জনা শোনা তার এখন দিব্যি অব্যেশ হয়ে গেছে। গলার কাছে গামছা ঘোরাতে ঘোরাতে
বললে, 'ও বউ, আমার আরো
দু'টো ছেলেও তো আছে,
নাকি?'
—'না,
নেই।' বউ গোঁজ হয়ে উনুনে হাওয়া দিতে
লাগলো।
নিবারণ কি হয়েছে ঠিক ধরতে না
পেরে প্রায় ককিয়ে ওঠে, —'নেই মানে?
কোথায়
গেছে?'
—'ছেলেপুলে বেশী দেখাতে পাল্লে
নাকি ট্যাকা পাওয়া যাচ্চে । তাই যার ছেলে সে নে গেছে।'
বোঁ করে নিবারণের মাথাটা
একচক্কর ঘুরে গেল। সেটা টাকা ফসকে যাওয়ার শোকে, নাকি আরো
বড় কোনো আশংকায়, ঠিক বোঝা গেল না।
মহাপ্রস্থান
[ গত
সংখ্যার পরের অংশ ]
পরদিন সকালে অদ্রি তার চেনা বাবাকেই দেখতে পেয়ে
চেপে ধরে তাঁকে। তার দেখা রাতের দৃশ্যের কথা বলে। বাবা মৃদু হেসে এড়িয়ে যান কিন্তু
অস্বীকার করেন না। অদ্রি উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে কোনওরকমে সেদিন অফিস করে
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যায়। গিয়ে দেখে বাবা তখনও ফেরেননি অফিস থেকে। সে বাবার ঘরে বসে
থাকে। বাবা ফিরে পোশাক ছাড়ার আগেই অদ্রি মরিয়া হয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা চায় তাঁর কাছে।
বাবা তাকে সংক্ষিপ্ত দুটি কথা বলেন। এক, সে ভুল কিছু দেখেনি – সময় হলে তিনি নিজেই এর বিশদ ব্যাখ্যা দেবেন। দুই, আপাতত সে যেন
চেষ্টা করে ব্যাপারটা ভুলে যেতে; একেবারে
ভুলতে যদি নাও পারে,অন্তত দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির সমক্ষে এটা প্রকাশ না করে।
অদ্রির ভেতরে তখন
এমনই ছটফটানি শুরু হয় যে তার বাবার কথা সাতদিনের বেশি মেনে চলতে পারেনি। গৌরব তার
খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু,তাকে সব বলে ফেলে। কথাটা বিশ্বাস করার মত নয়। আবার অদ্রির স্বভাবটা
একটু হালকা ধরনের হলেও তার বাবাকে নিয়ে এমন একটা রসিকতা করবে সেটাও ভাবা যায় না।
তাছাড়া,ঘটনাটা বলার সময় তার চোখ-মুখের অভিব্যক্তি এমনই ছিল যে সেটা তার অভিনয় ভেবে
নেওয়া অত্যন্ত দুস্কর। গৌরব জানত হিমেশ স্কুপ নিউজ-এর ফিকিরে আছে। দেখা যাক এটা
থেকে সে কিছু করতে পারে কিনা ভেবে সে তাকে সব কিছু খুলে বলে। সোর্সের নাম ফাঁস
করবে না জেনেও গৌরব হিমেশকে গোপনীয়তার শপথ করিয়ে নিয়ে বলেছিল, -- আমি অদ্রির সাথে
তোর আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। তারপরে কী করে কী করবি না করবি সেটা তোকেই ভেবে ঠিক করতে
হবে। আমি ছিদ্রটা তোকে দেখিয়ে দিলাম। বাকি কেরামতি তোর।
হিমেশ প্রথমটা তেমন উৎসাহ পায়নি। এসব গাঁজাখুরি
ব্যাপারে সময় নষ্ট করে লাভ কী? আবার গৌরব যেভাবে বলল,তাতে এটা পরিষ্কার যে সে নিজে
ঘটনাটার নব্বই শতাংশ বিশ্বাস করে ফেলেছে। গৌরবকে ছোটবেলা থেকেই জানে বলে হিমেশ
একটু সংশয়ের মধ্যে পড়ল। সে খুবই যুক্তিবাদী ছেলে,অলৌকিকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস তার
কোনদিনই ছিল না। বহু চিন্তাভাবনা করে অবশেষে একটু বাজিয়ে দেখারই সিদ্ধান্ত নিল সে।
সান্যালজেঠুর একটা উপদেশ তার মনে ধরেছে খুব। তিনি বলেন, যখন কোন উদ্ভট খবরের খোঁজ
পাবে, তখন সেটা উড়িয়েও দেবে না,আবার যাচাই না করে রিপোর্টও লিখতে বসবে না। আর
যাচাই করার প্রকৃষ্ট পন্থা হল ঘটনার কুশীলবদের চরিত্রগুলি অনুধাবন করা। বর্তমান
খবরটির সুবিধে এই যে,এর কুশীলব বলতে একজনই,অদ্রির বাবা আর্য বসু। অদ্রির সাথে আলাপ
করার আগে তার বাবাকে একটু চিনে নেওয়া দরকার। তাঁর প্রাথমিক পরিচয়টা জানার সবচেয়ে ভালো
উপায় তাঁর অফিসে যাওয়া। গৌরবের কাছে তাঁর সরকারি পরিচয় পাওয়া গেল। রাজ্য সরকারের
অর্থবিভাগের একটি দপ্তরের পরিচালক তিনি। হিমেশের সুবিধেই হল। অর্থ দপ্তরে তাদের
কাগজ ‘বাতায়ন’-এর সোর্স আছে দুজন। তাদের একজনের কাছে আর্য
বসুর খবরাখবর জানতে চাইতেই সে তো হতবাক। সোর্সটি একজন প্রতিপত্তিশালী ইউনিয়ন
লীডার। সে বলে, -- তুমি তো অবাক করলে হে! আর্য বসুর কোন ছিদ্র পেলে নাকি? আমাদের
কাছে তো তিনি নিশ্ছিদ্র ব্যক্তি। সরকারি কাজে তিনি রত্নবিশেষ। অবসরের আর দেরি নেই
তাঁর। মুখ্যসচিব নিজে তাঁকে এক্সটেনশন নেওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করছেন,তিনি কিছুতেই
রাজি নন। নাকি কোন ভালো খবর করবে তাঁকে নিয়ে? করলে করতে পার,আমাদের আপত্তি নেই।
ভদ্রলোক সত্যিই ভালো। সৎ,পরিচ্ছন্ন,অহংকার নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা – অসাধারণ দায়িত্ববোধ! কথা কম বলেন,কিন্তু যা বলেন, তা করেন।
হিমেশ টলে গেল। এমন লোককে অবিশ্বাস করা যায় না।
কিন্তু অদ্রি? সে তো মিথ্যে বলতে পারে! গৌরব যা-ই বলুক,ভুল হতে পারে তার। একমাত্র
উপায়,আর্য বসুর সঙ্গে আলাপ জমানো। কিন্তু ঢুকবে কোন পথে? অফিসে কাজের অছিলায় যে
সুবিধে হবে না সেটুকু পরিষ্কার হয়ে গেছে। সোর্সের কাছে আরও যা জানা গেছে তাতে
ভদ্রলোক মৃদুভাষী হলে কি হয়,স্ট্রিক্টলি অফিস-সংক্রান্ত কাজ ছাড়া অন্য ব্যাপার
নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তৎক্ষণাৎ তাকে দরজা দেখিয়ে দেন,তা তিনি গণ্যমান্য যেই হোন না
কেন! ভাবতে ভাবতে আবার সে সান্যালজেঠুকে
স্মরণ করল। উনি বলেন, প্রতিটি মানুষের কোন না কোন দুর্বলতা আছে। সেটা যদি খুঁজে
বের করতে পার,তাহলে তাকে ইচ্ছেমত কাজে লাগানো যায়। আর্য বসুরও নিশ্চয় কোন দুর্বলতা
আছে। সেটা বুঝতে গেলে প্রথমে অদ্রি বসুর সঙ্গে আলাপ জমানো দরকার। গৌরবের অফিসে
গিয়ে কোন লাভ নেই। সে ও অদ্রি দুজনেই অফিসে ভয়ানক ব্যস্ত থাকে। হিমেশ গৌরবকে ফোন
করে জানতে চাইল অদ্রিকে নিয়ে অফিসের পর মধ্য কলকাতার কোন পানশালায় আসা সম্ভব কিনা।
গৌরব জানাল, অদ্রি মাঝে মাঝে পান করে থাকে। কাজেই সে চেষ্টা করবে যত তাড়াতাড়ি
সম্ভব অদ্রিকে নিয়ে যাওয়ার। তারিখ ও সময় ঠিক করে সে হিমেশকে জানাবে।
দিন তিনেক পরে তারা
তিনজনে মধ্য কলকাতার একটি অভিজাত বারে সন্ধে
আটটার সময় বসেছিল। এই পানশালাটিতে নাচা-গানা হয় না,বিশুদ্ধ পানরসিকেরা
শান্তিতে মদ্যপান করতে এখানে আসাটা পছন্দ করেন।
প্রাথমিক পরিচয়ের পর পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে তাদের আলাপ ক্রমশ জমে
উঠল। হিমেশ বাকি দুজনের সঙ্গে পাল্লা না দিয়ে খুবই আস্তে আস্তে পান করছিল। তাকে
মাথাটা পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে আলোচনার স্টিয়ারিংটা তার হাতে থাকে। কিছুক্ষণের
মধ্যেই অদ্রি ও গৌরবের কথাবার্তায় উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া লাগল। হিমেশ বুঝল, সময় হয়েছে।
বলল, -- অদ্রি,কদিন আগে একটা খবর করতে ফিনান্স ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলুম। তা,তোমার
বাবার তো ব্যাপক সুনাম সেখানে!
অদ্রি
বলল, -- আমার বাবার নাম জানলে কী করে?
হিমেশ
একটু ফাঁপরে পড়লেও ঘাবড়াল না। বলল, -- গৌরব বলেছিল তো।
হুঁ, -- বলেই কেমন সন্দেহের চোখে গৌরবের দিকে তাকাল অদ্রি। হিমেশ
প্রমাদ গনল মনে মনে। টাইমিংটা কি ঠিক হল না?যাই হোক,এখন পিছিয়ে গেলে ওর সন্দেহটা
আরও দানা বাঁধতে পারে। গলার স্বর যতটা সম্ভব সহজ করে বলল, -- আমার এক আত্মীয় আছেন
ফিনান্সে,ডেপুটি সেক্রেটারি। সেদিন কাজ শেষ করে ভাবলুম,একবার দেখা করে যাই। যখন
গেলুম তাঁর কাছে,কয়েকজন অফিসার দেখি আড্ডা জমিয়েছেন তাঁর ঘরে। তখনই তোমার বাবার
সম্বন্ধে বিশদ শুনলুম। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না সরকারি আমলাদের কেউ এমন আদর্শ
চরিত্রের হতে পারেন। গৌরবের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় ওকে বলছিলুম আর্য বসুর কথা।
তাতেই ও আমাকে বলল আর্য বসুর ছেলে ওদের কোম্পানিতেই কাজ করে। শুনে তোমার সাথে আলাপ
করার ইচ্ছে হল। কিরে গৌরব,তুই বলিসনি ওকে?
গৌরব
উত্তর না দিয়ে হাসল একটু। তবে অদ্রি আশ্বস্ত হল মনে হল। বলল, -- বাবা ওরকমই।
হিমেশ
বলল, -- আমার তো এক্ষুনি গিয়ে ওঁর পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করছে।
অদ্রি বলল, -- গুলি মারো তোমার ইচ্ছেয়। বাবা ইদানীং আমাদের
আত্মীয়দেরই এড়িয়ে চলছে। আমাকেও পাত্তা দেয় না। অপরিচিত কারুর সঙ্গে দেখাই করবে না।
হিমেশ বলল,-- উনি কি বরাবরই এরকম অসামাজিক – মানে – লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না?
-- সোজা সাপ্টাই বল না,
নো প্রবলেম। বাবা
অসামাজিক – ইট্স ট্রু। বরাবরই নিজের পড়াশুনা,লেখালেখি
নিয়েই থাকে। আগে তাও দু’চারজন বন্ধুবান্ধব,মামাবাড়ির তরফে দু-একজন
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। মা মারা যাওয়ার পর শুধু নিজেকে নিয়েই থাকে।
হিমেশ
যেন একটু আলোর রেখা দেখতে পেল। বলল,-- কী লেখেন উনি?
কি
জানি? পড়ে দেখিনি কখনও ।
খুব
কৌতূহল হচ্ছে আমার। অমন একটা মানুষ! যা-ই লিখুন না কেন,হেলাফেলার নয়।
পত্র-পত্রিকায় লেখেন নাকি?
কিচ্ছু
জানা নেই। বাবা অনেক পত্র-পত্রিকা নেয়। তাতে বাবার লেখা কোনদিন চোখে পড়েনি। এই
অধমকে আর জেরা করে মৌতাত ছুটিয়ে দিও না বস্। আমি পাঠ্যপুস্তক ছাড়া জীবনে একটা
লাইনও পড়িনি,নেট-ওয়ার্কিং ছাড়া কোন বিদ্যেও বাগাতে পারিনি –
অদ্রি,
দেখা গেল,হয় বাবার
ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন,নয় তাঁর ব্যাপারে আলোকপাত করায় নিতান্ত অনিচ্ছুক।
সম্ভবত,বাবার অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড গৌরবকে বলে ফেলে এখন অতরিক্ত সতর্ক হয়ে পড়েছে।
পান করার অভ্যেস,বোঝা যাচ্ছে,তার ভালোই আছে। ইতিমধ্যে তিন পেগ গলাধঃকরণ করেও নেটওয়ার্কে
তার দক্ষতা নিয়ে গোপন গর্ব প্রকাশ করা ছাড়া অন্য কোন বেচাল দেখা যাচ্ছে না। হিমেশ
পরিস্থিতিটা বিচার করতে বসল। বাবা-ছেলের সংসার। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। অদ্রি
ছেলে খারাপ না – গৌরবের দৃঢ় ধারণা। তবে সে পড়ুয়া ছেলে নয়।
সেজন্যে হয়ত বাবার লেখার ব্যাপারে ততটা ইন্টারেস্টেড নয়। কিন্তু বাবার সম্বন্ধে
তার এই আপাত-ঔদাসীন্য অবশ্যই তার অভিনয় – বাবাকে আড়ালে রাখার
চেষ্টা। সুতরাং, হিমেশ এবার গলায় অনেকখানি উত্তাপ মিশিয়ে বলল, -- অদ্রি,তোমার বাবা
খুব হেলাফেলার মানুষ নন, তাঁর লেখাও ফেলে দেওয়ার মত জিনিস হতে পারে না। লেখেন
যখন,তখন নিশ্চয় তাঁর ইচ্ছে,তাঁর লেখা লোকে পড়ুক। পত্র-পত্রিকা পড়ার বদভ্যাস আমার
ভালোরকমই আছে। আর্য বসুর লেখা নিশ্চিতভাবেই কোনদিন চোখে পড়েনি। তিনি চাইলে পাঠকদের
কাছে তাঁর লেখা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করতে পারি।
এবার অদ্রিকে একটু উৎসাহী মনে হল। সে বলল, --
বাবা তার লেখার ব্যাপারে কিন্তু খুবই টাচি। যদ্দুর জানি,বহুদিন আগে একটা নামী
পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছিল। তারা ছাপেনি। বাবাও আর দ্বিতীয়বার কোথাও লেখা পাঠায়নি।
নিজে থেকে ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথাও কখনও শুনিনি তার মুখে। বলছ যখন,বাবাকে বলে
দেখব। রাজি হলে জানাব তোমাকে।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরেও
অদ্রির কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে একদিন হিমেশই ফোন করল তাকে। অদ্রি বলল, -- বলেছিলাম
বাবাকে। বাবা ‘না’ও বলেনি,আবার কোন উৎসাহও
দেখায়নি। তুমি এক কাজ কর বস্,নেক্সট রোববার সকাল ন’টায়
বাড়িতে চলে এস। আমি থাকব। আমার ঘরেই বসবে। তারপর দেখা যাক কী করা যায়। আসলে বাবা
আজকাল লেখালেখির চেয়ে ধ্যান,যোগ ইত্যাকার পাগলামি নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আজব পাবলিক,দেখা হলেই বুঝবে।
অদ্রির
গলায় কিন্তু কোন বিরক্তি নেই,বরং একটা চাপা গর্বের ভাব। রবিবার না আসা পর্যন্ত খুব
ছটফটানির মধ্যে কাটল হিমেশের। রুটিন কাজে মন বসছিল না। তার মন বলছিল, কোন না
কোনভাবে একটা অভাবনীয় সাফল্য আসতে চলেছে।
রবিবার যখন সে অদ্রির বাড়িতে পৌঁছাল তখন
ঠিক ন’টা বাজে। বেল বাজাতেই অদ্রি নিজে এসে দরজা খুলে তাকে নিয়ে নিজের
ঘরে বসাল। তাদের বাড়ির রান্নার কাজে
নিযুক্ত মহিলাকে চায়ের কথা বলে হিমেশের সাথে টুকটাক কথা বলতে লাগল। হিমেশ
জানল,অবসরে নেট-সার্ফিং আর চ্যাটিং অদ্রির একমাত্র নেশা। একটি ল্যাপটপ তার
সারাক্ষণের সঙ্গি। বাবার সাথে ছুটির দিন ছাড়া অন্য কোন দিন তার কথাবার্তা বিশেষ হয়
না। বাবা ষাটে পা দিলেও তাঁর স্বাস্থ্য চমৎকার। সুতরাং তাঁকে নিয়ে অদ্রিকে কোন
চিন্তা করতে হয় না।
চা খাওয়া শেষ হতেই অদ্রি বলল, --
চলো,বাবার ঘরে যাওয়া যাক। কাল রাতে বাবাকে বলে রাজি করিয়েছি।
অদ্রি
এবং আর্য বসুর ঘরের মাঝে ডাইনিং রুম,সেটি পেরিয়ে তারা দুজনে তাঁর ঘরে ঢুকল। ঘরের একটিমাত্র চেয়ারে
ঋজু ভঙ্গিতে বসেছিলেন আর্য বসু। তাঁর পরনে ধুতি,ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। প্রসন্ন
মুখ,নুন-মরিচ রঙের চুল। মুখ ও গলার চামড়া একটু ঢিলে হলেও শরীরের অন্যান্য অংশের
চামড়া টানটান। উচ্চতা সাড়ে পাঁচের কিছুটা বেশি হতে পারে। শ্যামবর্ণ মেদহীন শরীর।
হিমেশ সটান গিয়ে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে
প্রণাম করে উল্টো দিকের সোফায় অদ্রির পাশে বসল। আর্য বসু বললেন, -- তুমি অদ্রির
বন্ধু, বাতায়নের স্টাফ রিপোর্টার,সাহিত্যে উৎসাহ আছে – তাই তো?
হিমেশ
বলল, -- হ্যাঁ কাকু।
তুমি
আমার লেখা পড়তে চাও? কেন?
কাকু,আমি
খবরের কাগজে চাকরি করলেও ‘ঋদ্ধি’ বলে একটি লিট্ল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। আপনি নাম শুনেছেন কিনা
জানি না। কিন্তু ‘ঋদ্ধি’ বহুদিন ধরে নিয়মিত
প্রকাশিত হয়ে আসছে। গদ্যসাহিত্যে এর অবদান ইতিমধ্যেই সাহিত্যমহলে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এই পত্রিকাটি সব সময়েই ভালো লেখা, নতুন ধরনের লেখার সন্ধানে থাকে। অদ্রির কাছে
শুনে মনে হল –
তাকে
শেষ করতে না দিয়ে আর্য বসু বললেন, -- অদ্রির কাছে! সে কতটুকু খোঁজ রাখে আমার
লেখার?
হিমেশ
তাড়াতাড়ি নিজেকে সংশোধন করে, -- একটু ভুল বললুম কাকু। অদ্রির কাছে শুধু এইটুকুই
জানলুম যে আপনার লেখালেখির অভ্যাস আছে। তার আগে – তখনও জানতুম না আপনি
অদ্রির বাবা,আপনার দপ্তরে কাগজের কাজে গিয়ে আপনার সম্বন্ধে প্রায় সকলের কাছে যা
শুনি – কী আর বলি আপনাকে কাকু – সেসব বললে আপনি ভাববেন
চাটুকারিতা –
আবারও
তাকে থামালেন আর্য বসু। বললেন, --চাটুকারিতা ভাবার কোন কারণ নেই। আমার ধারণা,তুমি
আমার কাছে কিছু চাইতে আসোনি। তবে তুমি যা বলতে যাচ্ছিলে সেটা সম্পূর্ণ অবান্তর।
অফিসে আমার কী পরিচয় তার সঙ্গে আমার লেখার কী সম্পর্ক?
মাফ
করবেন কাকু,সম্পর্ক আছে। সৃষ্টির রসায়ন কল্পনা আর মনন। স্রষ্টা উঁচুদরের হলে তার
মননও সেরকম হবে, তাঁর সৃষ্টি কোনভাবেই নিম্ন মানের হতে পারে না।
আর্য
বসু স্থির দৃষ্টিতে হিমেশের চোখে চোখ রাখলেন। হিমেশের একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। মনে
হল,সেই দৃষ্টি থেকে প্রসন্নতা ধেয়ে এসে তার শরীরে স্নিগ্ধতার প্রলেপ বুলিয়ে দিল।
মৃদু হেসে আর্য বসু বললেন, -- তোমাদের ম্যাগাজিন ক’জন পাঠক পড়ে? আমার তো
ধারণা,যারা লেখে তারাই শুধু পড়ে আর পরস্পরের পিঠ চাপড়ায়।
হিমেশও
হাসল। বলল, -- কিছুটা সত্য হলেও সবটা না কাকু। সত্যিকারের ভালো লেখা কিন্তু এই সব
ছোট পত্রিকাতেই দেখতে পাওয়া যায়। আসলে প্রতিভাবান লেখকেরা নামযশের অধিকারী হয়েই
দুহাতে লিখতে শুরু করে দেন। তখনও তাঁদের লেখা বিকোয় বটে, কিন্তু মান থাকে না
লেখার। লিট্ল ম্যাগে কিন্তু অইসব চর্বিতচর্বণ দেখতে পাবেন না।
না
হে,ভালো লেখা কদাচিৎ হলেও সব ধরনের পত্র-পত্রিকাতেই দেখতে পাওয়া যায়। লেখকের
লক্ষ্য কিন্তু পাঠক। যত বেশি সম্ভব পাঠকের কাছে পৌঁছে যাওয়াতেই তাঁর চরিতার্থতা।
আমার তো মনে হয়,লেখার প্রেরণা আসে একজন ব্যক্তিমানুষের আরও বহু মানুষের সাথে
নিজেকে মেলানোর,ভাগ করে নেওয়ার তাগিদ থেকে। ঠিকঠাক বলতে গেলে লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে
টু শেয়ার ওয়ানশেল্ফ উইদ দ্য মাল্টিচ্যুড। সংবেদনশীল পাঠকই যদি না পাওয়া যায়, লেখা
ছাপিয়ে কী লাভ? আবার,মাঝে মাঝে যখন কিছু ভালো লেখা পড়ি তখন মনে হয় আমার লেখা হয়ত
বাহুল্য মাত্র। নিজের লেখার মূল্যায়ন তো নিজে করা যায় না। সংশয় জাগে সত্যই কি আমার
লেখা প্রকাশের উপযুক্ত?
হিমেশ
বলল, -- একটা লেখা বের করুন না কাকু, পড়ে দেখি।
আর্য
বসু চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, তাঁর ঘরের দেওয়াল আলমারি থেকে এক গুচ্ছ কাগজ এনে হিমেশের
দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। অদ্রি এই সময় উঠে দাঁড়াল। বলল, -- আমি আসছি। ঘরেই আছি,যাওয়ার
সময় দেখা করে যেও।
সাদা কাগজের এক পৃষ্ঠে লেখা পনের-ষোল
পাতার পাণ্ডুলিপি। গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ভেবে পড়তে শুরু করেছিল হিমেশ। কয়েক লাইন
পড়েই বুঝল,বিশুদ্ধ গল্প। অচিরেই সে ডুবে গেল গল্পের ভেতরে। উঠল যখন,সে স্তম্ভিত।
অসাধারণ গল্প! সব অর্থেই। বিষয়,কাঠামো এবং ভাষা যেন একে অন্যের পরিপূরক। এর তুলনীয়
গল্প এর আগে বাংলা-সাহিত্যে অথবা তার পাঠ্যপরিধির মধ্যে বিশ্বসাহিত্যেও পড়েছে কিনা
সন্দেহ! সে কেমন যেন আবিষ্ট হয়ে পড়ল।
সেদিন আর বিশেষ
কথাবার্তা হল না। আবার আসবে বলে সে আর্য বসুর কাছে বিদায় নিয়ে চলে এল। পরের রবিবার
আবার এসে সে তাঁর কাছ থেকে তাঁর সব ক’টি গল্প এবং একমাত্র
উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি নিয়ে বাড়ি ফিরল। তারপর থেকে সে একটি দুটি করে গল্প শেষ করতে
থাকে আর আর্য বসুর বাড়ি গিয়ে গল্পগুলি নিয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করে। এই করতে করতে
তাদের অজান্তে বয়সের ব্যবধান ভুলে দুজনের মধ্যে এক সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে
উঠল।
[ শেষাংশ আগামী সংখ্যায় ]
জয়া, তার তিল আর যত তালগোল
রাজন নন্দী
১.
আমি
পালিয়ে আছি। আজ
নয় দিন হয়ে গেল, এই এক ঘরে। একবারও বাইরে যাইনি। যাওয়া বারণ।
ঘরটিতে কোন জানালা নেই। একটি মাত্র ঘুলঘুলি। আর দুটো দরজা। একটি লাগোয়া বাথরুমের।
অন্যটি মূল বাড়িটির দিকে। ওপাশ থেকে বন্ধ। এরা তিনবার খাবার দিয়ে যায়। আমি এখনও
কারও চেহারা দেখিনি। তবে দরজার ওপারে যারাই থাকুক না কেন,তারা
রাত হলে অন্তত নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। কেউ ডাকলে আসছি বলে সাড়া দিতে পারে। প্রাণ
খুলে হাসতে পারে। আমি পারি না। গত নয় দিনে আমার পৃথিবী ছোট হতে হতে এই একটি বন্ধ
ঘরে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে আমি দরজায় কান পেতে শুনেছি,ওপাশে
কেউ একজন গুণগুণিয়ে গান গায়। খিলখিলিয়ে হাসে। নারীর কন্ঠ কিংবা কিশোরীর! বাইরের
পৃথিবী থেকে এই একটি মাত্র কন্ঠই আমার কানে আসে। একেক সময় আমার খুব ইচ্ছে হয়েছে
ডেকে দুটো কথা বলতে। জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছি,ঢাকার
খবর সে কিছু জানে কিনা! বলতে চেয়েছি,শুনছেন? আপনার
গানের গলাটি কিন্তু বেশ। করিনি। করা বারণ।
মনে হতে
পারে যে,আমায়
বোধ হয় কেউ বন্দী করে রেখেছে। আসলে তা নয়। আমি সত্যিই পালিয়ে
আছি। ঠিক নয় দিন আগে,এই সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। ইকবাল টাওয়ারে।
নাহিদের অফিসে বসে চা খাচ্ছিলাম। সময়ের
কথা মনে হওয়ায় ঘড়িটার দিকে তাকালাম। এটা
জয়ার দেয়া ।
নাহিদের ছোট বোন জয়া
- আমার গোপন প্রেমিকা। জয়ার থুতনীতে একটা তিল আছে। ত্রিশ
ছুঁই ছুঁই মসৃন ত্বকে সেটা সন্ধা তারার মত জ্বলে। তবে আমার বেশী প্রিয় ওর বা
কাধের একটু নীচে যে তিল, সেটি। আমি কখনও ওটাতে ঠোঁট ছোঁয়ালে ওর কাধের প্রায় অদৃশ্য
রোমগুলো সারা দেয়। না, লজ্জাবতীর পাতার মত নুইয়ে পড়ে না। সজারুর কাটার মত
প্রতিরোধও জানা নেই ওদের। অনেকটা কদম ফুলের মত। তবে তার থেকে অনেক নরম, ঢের বেশী
সংবেদী যেন। আমার প্রেম সেখানে চুমু খায়, নাক ঘষে। আর জয়ার নরম হাত জঙ্গীর মত
মুঠিতে জড়িয়ে নেয় আমার চুল। আজ নয়দিন আমি যতবার জয়ার কথা ভেবেছি। ভাবনা এসে
কেন্দ্রীভূত হয়েছে ওর সেই তিলে। যেন আমার ভাবনারাও ওইখানে নির্বাসন নিয়েছে
স্বেচ্ছায়। জয়ার গানের গলা খুব মিষ্টি। বাবু তো
বলে, জয়ার গলা নূরজাহানের মত। আমি নূরজাহানের গান কখনও শুনিনি। তবে বাবুর কথায়
ভরসা করা যায়। ও আমার ছোট বেলার বন্ধু। এক স্কুল। এক কলেজ। নাহ্ ভালয় ভালয় সব ঝামেলা
মিটলে, বাবুকে আমার আর জয়ার ব্যাপারটা বলতে হবে। তা জয়া যতই না করুক।
পাশ
করে দুইবন্ধু মিলে শুরু করেছিলাম ব্যবসা। বাবার প্রভিডেন্ড ফান্ড আর মায়ের গয়না বন্ধকের
টাকা মিলিয়ে সাকুল্যে এগার লাখ টাকা ছিল আমার পূঁজি। বাবুদের মেলা টাকা। ওর কোন
সমস্যাই হয়নি। রাত দিন খেটেছি। মাত্র পাঁচ বছরে আমাদের নিজেদের একটি কারখানা
হয়েছে। আমরা ঢাকায় চারটি আর চট্টগ্রামে একটি শোরুম খুলেছি। কখনও কখনও একা হলে,
ভাবি - তখন আমার নিজেরই অবাক লাগে।
এই
সেদিনও খাবার টেবিলে বসে বাবা বলছিল,’আমার বোকা ছেলেটা যে আমাকেও
ছাড়িয়ে গেল।’
মা বললেন,’তুমি এখনও বলবে ছেলে বোকা? ও
তো বরাবরই একটু সরল সোজা। ওর সরলতাই ওর দূর্বলতা । আমি
বললাম,মা,
দূর্বলতা বলছ কেন? আমার
বন্ধুরা এই জন্যইতো আমায় এত ভালবাসে। ওরা জানে আমার মনে কোন প্যাচ নেই’।
তবে সত্যি বলতে কি আমি আদতে একটু বোকাই। নইলে কি আর নীপার
বিয়ের পরই আমি বুঝলাম আমি আসলে ওকে প্রচন্ড ভালবাসি। এক্কেবারে না পেলে বাঁচবোনা
টাইপ ভালবাসা। তারপর কতকান্ড। ভাবলে এখন আমারই হাসি পায়।
২.
বছর
তিনেক আগে। আমরা সেবার সেরা উদ্যোক্তার পুরষ্কার পেয়েছিলাম। হোটেল রেডিসনে এক জমকালো অনুষ্ঠানে
আমাদের পুরুষ্কৃত করা হয়। সেখানেই
নাহিদ মাহবুবের সাথে প্রথম পরিচয় হয়। আরও পরে পরিচয় হয় জয়ার সাথে। নাহিদ তখন
একটি বানিজ্যিক ব্যাংকের ইনভেষ্টমেন্ট এনালিষ্ট। তার মত এমন দিল খোলা,আমুদে
মানুষ আমি আগে কখনও দেখিনি। অল্পকয়েক দিনেই আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। এতটাই যে আমরা তিনজনে আরও
বড় ধরনের ব্যবসা করার পরিকল্পনা শুরু করি। মনে পড়ছে, নাহিদই প্রথম প্রস্তাব
নিয়ে আসে। জার্মান – অষ্ট্রেলিয়া ভিত্তিক এক কম্পানীর স্হানীয়
এজেন্টকে নিয়ে আসে আমাদের বনানীর অফিসে। সৌর বিদ্যুত কেন্দ্র ও নানা ধরনের সোলার
প্যানেল তৈরী করে কম্পানীটি। স্হানীয়
উদ্যোক্তা খুঁজছে। আলোচনা সন্তোষজক হল । এসব
কাজে নানারকম আইনি বাধ্যবাধকতা, ব্যাংকের
ঝামেলা থাকে ।
নাহিদ অত্যন্ত দক্ষ
হাতেসব সামলেছে ।
প্রায়
বছর দেড়েক হল আমরা প্রডাকশনে আছি। আমরা ঢাকা এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে
লিস্টেড হয়েছি। আমাদের প্রাইমারী শেয়ার গুলোসব ভাল দামে বিক্রি হয়েছে । টিভিতে, পত্রিকাগুলোতে
আমাদের নানা পণ্যের বিজ্ঞাপণ যাচ্ছে নিয়মিত । আমি ঢাকা আর বাবু চট্টগ্রামের দিকটা আর কারখানা দেখে । নাহিদ মাকেটিং আর জয়া সব আইনী ব্যাপার গুলো সামলায় । জয়া বিলাতী ডিগ্রীধারী
ব্যারিষ্টার ।
আমরা চারজনই
কোম্পানীর ডাইরেক্টর ।
বাবু আমাদের চেয়ারম্যান ।
গেল
মাসে, রাজশাহীতে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকার টেন্ডার আহ্বান করেছে।
দেশের পত্র-পত্রিকাতে এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। সৌরবিদ্যুৎ দেশের বিদ্যুৎ
সমস্যা দূর করবে। দেশের উন্নতি হবে। অমরাও তখন সেই স্বপ্নে বিভোর। প্রায় ছয়
হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট। তাই ডিসেম্বরে দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি আর বাবু
অষ্ট্রেলিয়ায় গেলাম। যৌথ উদ্যোগের ব্যাপারে কথা বলতে। টেন্ডারের খুঁটি নাটি
নিয়েও বিস্তর আলোচনা হল। ওরা বেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। মনটাও তাই ফুরফুরে।
অষ্ট্রেলিয়াতে ক্রিসমাসের উৎসব। সর্বত্র ছুটির আমেজ। ছবির মত এক দেশ। ভাবলাম, এরপরে
জয়াকে নিয়ে আসতেই হবে। এই সব ভাবতে ভাবতেই ২৬ ডিসেম্বর রাতে দেশে ফিরে এলাম। বাবু
রাতের ফ্লাইটেই চট্টগ্রামে চলে গেল। পরের দিন সকালে উঠেই আমি গেলাম নাহিদের অফিসে।
৩.
আজ
সকাল থেকে দরজার ওপাশে কোন শব্দ পাচ্ছি না। কেউ সকালের খাবারও রেখে যায়নি। ঘড়িতে
সময় দুপুর পেড়িয়ে গেল। ক্ষুধায় গাগুলাচ্ছে। কারও সাড়া শব্দ নেই। কখন যে হঠাৎ ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম নিজেই জানিনা। মায়ের কথা মনে পড়ল। নাকি স্বপ্নে দেখলাম মাকে? জয়া কি
মাকে সব বলেছে? বাবা নিশ্চয়ই বুঝবেন সব। দেখলাম, মা বলছেন, পিয়াল, উঠতো। আর কত
ঘুমাবি? উঠে খেতে আয় ।
উঠে ঘড়িতে দেখি ১০টা । নিশ্চয়ই রাত । আর
তখনই ক্ষুধাটা আবার ফিরেএল ।
দরজার
কাছে গিয়ে দেখলাম। না কোন খাবার রাখা নেই। এই প্রথমবার আমি আতংকবোধ করলাম । দুশ্চিন্তায়,ক্লান্তিতে আবারও হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জানিনা
কতক্ষণ।
৪.
২৭
তারিখ সকালে নাহিদের অফিস। নাহিদ ছিল না। আমি চাখাচ্ছিলাম। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে
এল জয়া। সাথে ঠোঁট কাটা একটা লোক। আমাকে
বলল, তোমাকে এক্ষুনি এর সাথে যেতে হবে।
বললাম, কোথায়?
সেইফ
হাউজে । বলে জয়া চট করে দরজার দিকে তাকাল । লোকটাকে বলল,আপনি গাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা
করুন । স্যার আসছেন । লোকটি
যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। চলে যেতেই উঠে জড়িয়ে ধরলাম জয়াকে। ঠোঁটে ঠোঁট
রাখলাম। জয়া সাড়া দিয়েই মুখ সরিয়ে নিল। বলল,জান
তোমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। নয়ত দেরী হয়ে যাবে।
আমি বললাম,কি
বলছ! কিসের দেরী ?
নাহিদ কোথায় ?
জেলে,বলে
জয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আমি ওর পীঠে হাত বুলিয়ে সান্তনা দিতে
চাইলাম।
কান্না
জড়ানো কন্ঠে ও যা বলল,তা শুনে তো আমার ভীমরি খাবার দশা। কাল মাঝ
রাতের পরে সামস খান খুন হয়েছে। সামস ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীর আপন ভাই। পুলিশ
যারপর নাই রকমের তৎপরতার সাথে খুনীদের একজনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে। আর সেই
খুনীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী নাহিদ আর বাবুকে হুকুমের আসামী হিসেবে গ্রেফতার করেছে
পুলিশ । সপ্তাহ
খানেক
আগে সামসের সাথে আমাদের গন্ডগোল হয় । জয়াকে নোংরা ইঙ্গিত করায়
আমি রেগে গিয়ে ওকে বলেছিলাম,খুন করে ফেলব। পুলিশ এখন আমাকেও
খুঁজছে। আমার অফিসে,কারখানায় রেইড দিয়েছে। নাহিদ আর বাবুকে
নাকি ভীষণ মারধোর করেছে। বাবুর বাবা মাকেও দেখা করতে দেয় নাই। বিপদ বুঝতে পেরে
আমি আর সময় নষ্ট করিনি। ঠোঁট কাটা লোকটার সাথে জানালা বিহীন একটা ভ্যানে উঠে বসেছিলাম।
তারপর থেকে এই ঘরে আছি।
৫.
কেউ কি আছেন ?
ঘুম ভেঙ্গে গেল। কে যেন ডাকছে !
দরজার
কাছে গিয়ে কান পাতলাম। আবারও কেউ কথা বলছে । বলছে, ‘দরজাটা খুলে দিন। আমি আর এভাবে থাকতে
চাই না’ । আমি চমকে উঠলাম’। মনে হল বাবুর কন্ঠ। আমি
নিশ্চই ভুল শুনেছি’!
তবুও বললাম,কে’? ‘বাবু ? অপর
কন্ঠটি জোরালো
হয়ে উঠল,পিয়াল!
পিয়াল তুই আমাকে নিতে এসেছিস ? পিয়াল!
এরপরের সবকিছু খুবদ্রুত ঘটে গেল।
স্থানীয়
পুলিশ এসে আমাদের উদ্ধার করে একটি পরিত্যাক্ত কারখানা থেকে। বিস্তারিত জানতে
পারিনি। পরে জেনেছি,নাহিদ আর জয়া মোটেও ভাইবোন ছিল না। একটি
সংঘবন্ধ চক্রের হোতা এই নাহিদ মাহবুব ও তার দল শেয়ারমার্কেট থেকে কয়েক হাজার
কোটি টাকা তুলে নিয়ে পালিয়েছে ।
জয়া বাবুর সাথেও
একই রকম ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। এবং ওকেও বলেছিল সম্পর্কের কথা গোপন রাখতে।আমাদের সরল
বিশ্বাস এবং আরও কয়েকশ ছোট বড় বিনিয়োগকারীর আকাঙ্খাকে পূঁজিকরে ফটকাবাজেরা
প্রায় পনের হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। ব্যাবসা ও রাজনীতির অনেক রাঘব
বোয়াল এই চক্রের নেপথ্যে ছিল। কোনদিনই হয়ত এদের বিচার হবে না। কত মানুষ যে
নি:স্ব হয়ে গেছে। আইনী ঝামেলা কোন রকমে সামলে,আমি
আর বাবু নতুন করে আমাদের আগের ব্যাবসায় মনোযোগী হয়েছি।
বাড়িতে
ইদানিং বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে ।
বলেছি,এখনই
না । কি
করব ? আমার
যে এখনও জয়ার কাধের সেই তিলটির জন্য মন পুড়ে। হয়ত বাবুরও ।