গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১১ মে, ২০১৬

নীহার চক্রবর্তী



 কিংবদন্তী

বৃদ্ধ শিবানন্দ চক্রবর্তী তার যৌবনকালে অনেক সিনেমা দেখেছেন । এখনো সে গল্প করেন বৌমা আর নাতী-নাতনীদের কাছে । তারা শুনে খুব মজা পায় । শুনতে চায় তার কাছে সে সময়ের কথা । সিনেমার কথা । নায়ক-নায়িকাদের কথা তারা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে । এখন যখন বৃদ্ধ শিবানন্দ শোনেন তার নাতী-নাতনীরা কোন সিনেমা দেখতে যাচ্ছে,তখন তিনি শুনে খুব খুশী হন । তাদের বলেন,’’এসে আমাকে গল্প শোনাতে হবে কিন্তু । গান গাইতে হবে ।‘’ নাতী-নাতনীরা তার কথায় লজ্জা মরে । তাকে বলে,’’সে তোমার কালের মতো কিছু না । অমন গল্প এখন কোথায় ? আর গান যা...’’ বৃদ্ধ শিবানন্দ হাসতে হাসতে উত্তর দেন,’’আরে না । সবই এক । সময় বদলেছে বলে কিছু ভঙ্গী বদলেছে । সে আমি বুঝে নেবো খন ।‘’
নতুন নতুন সিনেমার গল্প শুনে বৃদ্ধ শিবানন্দ মুচকি-মুচকি হাসেন । তার নাতী-নাতনীরা দেখে তার অবস্থা দেখে হেসে ফেলে । তাকে জিজ্ঞেস করে,’’কী বুঝেছ তুমি ? বল তো একবার শুনি আমরা ।‘’ শিবানন্দ ফোকলা হাসি ছড়িয়ে বলে ওঠে,’’কিছু আলাদা বুঝলাম না । সেই তো প্রেম আর আর হিংসার কথা । সে সব কালেই ছিল । এখন আবহাওয়া বদলেছে বলে কাহিনীর মোড় ঘুরেছে । প্রকাশ অন্যরকম হয়েছে । আসলে কিছুই তেমন বদল ঘটেনি । সব প্রেমের জন্য দাপাদাপি ।‘’ শিবানন্দের কথা শুনে তার নাতী-নাতনীরা হেসে খুন ।
তারপর দু-একটা গান শোনার পরেই শিবানন্দ সহাস্যে বলেন,’’এখানেও তেমন বদল দেখলাম না । গানের ভাষা আর সুর বদলাতেই পারে । কিন্তু সবই মনের আবেগের প্রকাশ । সবকিছুতে চিরন্তন প্রেম লুকিয়ে আছে । তাই গানগুলোও খারাপ বলতে পারি না। আর একবার গা তো শুনি ।‘’ তার বৌমা কখনো কাছে থেকে,কখনো বা দূর থেকে বৃদ্ধ শ্বশুরের কথা শুনে হেসে মরে । পরে ছেলে-মেয়েকে কাছে ডেকে বলে এক-মুখ হেসে,’’তোরা যে বাচ্চাটাকে পাকিয়ে ছাড়বি দেখছি । এ কিন্তু ঠিক না ।‘’ তার কথা শুনে ছেলে-মেয়ে বলে বেশ মজার সুরে,’’তোমার বাচ্চা পাকতে চাইলে আমরা কী করতে পারি ? আরও পাকাবো দাঁড়াও ।‘’ ছেলে-মেয়ের কথা শুনে শিবানন্দের বৌমা হেসে-হেসে বলে,’’দেখাচ্ছি তোদের মজা ।‘’
বৃদ্ধ শিবানন্দের ছেলে জীবানন্দ স্ত্রী আর ছেলে-মেয়ের কথা শুনে বড় তৃপ্তির হাসি হেসে বলে,’’এইসব মানুষকে পাকানো যায় না । আর এরা তো পেকেই আছে । এরা আদ্যিকালের দাদাঠাকুর । সব দেখে-দেখে এরা নিজেদের মতো করে সব ভাবে । তাদের ভাবনাকে কেউ ছুঁতেই পারবে না । তোমাদের কপাল ভালো নব্বইয়ের মানুষটা আজো তোমাদের মধ্যে আছেন । যত পারো তাকে আনন্দ দিয়ে যাও । একটাই তো আমার ছাতা । তাকে সহসা উড়ে চলে যেতে দিও না ।‘’
জীবানন্দের কথা শুনে তার স্ত্রী আর ছেলে-মেয়ে বলে প্রতিজ্ঞার সুরে,’’এমন মানুষকে কেউ যেতে দেয় ? তিনি আমাদের সংসারের মঙ্গল । চিন্তা কর না তুমি । তাকে আমরা আনন্দে ভরিয়ে রাখবো সবসময় ।‘’ একথা শোনার পর প্রায়দিন জীবানন্দের চোখে জল ভরে আসে । খুব মনে পড়ে যায় তার মায়ের লক্ষ্মীপানা মুখটা । তা দেখে তার স্ত্রী আর ছেলে-মেয়ে নিশ্চুপে নিজেদের কাজে চলে যায় ।