নতুন দিন

কাল পঞ্চায়েত
ভোট। সকাল থেকেই
থেমে থেমে গোলাগুলির
আওয়াজ হচ্ছে। পরিবর্তনকামী
সরকার হিংস্র মানুষমারা
রাজনীতির কোন পরিবর্তন
আনতে পারেনি। হরিদেবপুর
গ্রামের দিন আনি
দিন খাই মানুষগুলো
তাদের রোজকার নুনভাতের
জীবনে কোন পরিবর্তনই
টের পায়না। আজকাল
তো এই দুমদাম
আওয়াজটাও কানসহা হয়ে
গেছে। ঠিক যেমন
কানসহা হয়ে গেছে
মানুষমরার পরের বিলাপধ্বনি।
মানুষ মরছে গড়পড়তা
রোজই, এ পাড়ায়
কি ও পাড়ায়, কিন্তু
নিশ্চুপে টুপ করে
তারা খসার মত।
শুধু বলহরি হরিবোল
ধ্বনিটাই যা মাঝেমধ্যে
ব্যাপারটায় একটু শব্দ
ছিটিয়ে যায়। গ্রামের
প্রায় মাঝামাঝি বয়ে
চলা শীর্ণা সোনামুখী
নদীর ওপর জীর্ণ
কাঠের পুলের কাছে
ঘন নলবনের জঙ্গলের
ঘেরাটোপে শুকনোমুখে চুপচাপ
দাঁড়িয়ে আছে শাঁওলী।
গোলাগুলির আওয়াজটা আপাতত
গ্রামের অন্যপ্রান্ত থেকেই
আসছে। আওয়াজগুলো যেন
মনে হচ্ছে ওকে
একটুও বিচলিত করছে
না, আসলে সকাল
থেকে সে শুধু
অপেক্ষায় আছে । জানে, আজ
সময় অবশ্যই এসে
ওর সাথে দেখা
করবে। দিন গড়ায়, সকাল
থেকে দুপুর, দুপুর থেকে
বিকেল,মেয়েটার অপেক্ষার
প্রহর যেন দীর্ঘ
থেকে দীর্ঘতর হয়।
আস্তে আস্তে বাড়ীর
দিকে রওয়ানা দেয়।
মনে আশা, সময় আসবেই, কিন্তু
অবুঝ চোখের জল
আর বাঁধ মানে
না।
কনে দেখা
আলো ফুরিয়ে পৃথিবী
কালো আঁধারী ওড়নায়
যখন মুখ ঢাকব
ঢাকব করছে ঠিক
তখনই শাঁওলীর একটেরে
ঘরের দক্ষিণকোনের বন্ধ
জানালায় মৃদু ঠক
ঠক শব্দ হয়।
সে জানালা খুলে
দেখে পেয়ারা গাছটার
নীচে সন্ধ্যার ঝুপসি
অন্ধকারে নিজেকে লুকিয়ে
সময় একমুখ নিস্পাপ
হাসি মেখে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ
একদম শুকনো। গালে
অনেকদিনের না কাটা
দাঁড়ি। পেটে সকাল
থেকে বুঝি কিছু
পড়েনি। সরকারী ত্রাণশিবিরে
পালিয়ে যাবার পর
গত নয়মাস সময়কে
দেখেনি শাঁওলী। দীর্ঘ
অদর্শনের অভিমান তাই
কান্না হয়ে দলা
পাকিয়ে বুকের কাছে
আটকে রইলো। অচেনা
আশঙ্কায় আর নারীসুলভ
ভালবাসায় ভিজে
উঠল মন।
এসেছ ?
জানতাম তুমি আসবে। কেমন আছ ?
সময় অনেকদিনের বুভুক্ষা
নিয়ে তার প্রিয়
নারীটির মুখের দিকে
অপলক চেয়ে থাকে।
এই, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে
কেন
?
কেমন দেখাচ্ছে ?
বলে সময় একটু
ম্লান হাসে।
কেমন আবার কি ? মনে
হচ্ছে ঠিক যেন
এক কাকতাড়ুয়া, এ কি
চেহারা বানিয়েছ ক’দিনে ?
আমি তো চিরকালই
এমন রোগাভোগা, সলমান খান
তো কোনদিনই ছিলাম
না।
ইস রে, শোনো না
কাল তোমায় নিয়ে
বিশ্রী একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি
তাই বুঝি? তুই না
সত্যি একটা পাগল, না
না , পাগলী,
পাগল কি আর
নতুন করে পাগল
হয়? তোমার সাথে
পালা পড়েছে যখন, পাগল
না হয়ে আর
কি উপায় আছে
বলো
?
তুই তো একটা
পাগলীই, আমার পাগলী
বউ।
পাগল কি আর
এমনি? তোমার কথা
ভাবলেই তো…কান্নার ঝোঁকে
আর কথা শেষ
হয়না।
কাঁদিস না। তুই এমন
করলে আমি তোকে
ছেড়ে আর থাকতে
পারবো ন। জানিস
না
?
না, না, তা হবে না।
বেশ, এই দেখো, আর
কাঁদছি না আমি।
এই শোন, তোর জন্য
একটা জিনিষ এনেছি।
বাইরে আয়। জানলার
ফাঁক দিয়ে ঢুকবে
না।
কি গো ?
বাইরে আয়, দেখাচ্ছি, তোর বাপ
শালা কোথায় রে ?
কি কথার ছিরি? আমার
বাবাকে একটাও বাজে
কথা বলবে না
বলে দিচ্ছি।
কোথায় বাজে কথা ? বললাম, তোর
বাপ আর ভাই
কোথায়?
ভয় পাচ্ছো ?
নিজের জন্য
ভয় পেলে কি
আজ আসতাম ? মা-টা রয়েছে
যে! ভয় তো
আমার মা-টাকে নিয়ে।
আজ আমি ছাড়া
মায়ের যে আর
কেউ নেই রে
শাঁওলী। সেদিনের আগুনে
ঘরবাড়ী তো যা
যাবার গেছেই, সাথে বাবা, আমার
যমজ ভাইটা, নিলয়, সব পুড়ে
ছাই। তুই সেদিন
আমায় তোর ঘরে
দোরবন্ধ করে না
রাখলে..
কথা শেষ না
করেই বিবর্ণ নীল
শার্টটার হাতায় চোখ
মোছে সময় । তারপর দীর্ঘশ্বাস
ফেলে বলে,
অথচ দেখ তোর
ভাইটাকে, নিজের পোয়াতী
বউটাকে অবধি রেহাই
দেয় নি। নীতিটা
বাড়ীর সব্বার ছোট
ছিল রে। বড়
আদরের বোন ছিল
আমার।
বলার কোন
কথা খুঁজে পায়না
শাঁওলী। সবই তো
ওর জানা। কলাঝোপের
অন্ধকারে সময়ের বাহুবন্ধনের নিভৃত আশ্রয়ে
ওর শীর্ণবুকের ওপর
মাথা রেখে দ্রুত
হাপড় পড়ার মত
আওয়াজ শোনে। আর
ভাবে কাল কি
হবে
?
শাঁওলী, ও শাঁওলী।
মায়ের ডাকে
চমক কাটে শাঁওলীর। কি যেন একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখছিল সে, সময় চলে
যাবার পর থেকেই
অন্ধকার ঘরে গুম
খেয়ে বসে আছে
মেয়েটা।মনের মধ্যে অদ্ভুত একটি কাঁটা খচ খচ করে যাচ্ছে ক্রমশ ।যেন অখন্ড অবসাদে বিসন্ন হয়ে আছে সব কিছু । আসলে মানুষ অসহায় হয়ে গেলেই বোধ হয় এই ধরনের অনুভুতি তাঁর মনকে গ্রাস করে । বুকের ভেতরে একটা ক্ষত বিক্ষত স্মৃতির গুটি পোকা বিনিসুতোয় দুশ্চিন্তার গুটি বাঁধছে । তড়িঘড়ি উঠে ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে শাড়ীর আঁচলটা কোমরে জড়তা জড়াতে মায়ের ডাকে
রান্নাঘরে যায় সে।
- যাতো মা, এই চা
মুড়িমাখাটা তোর বাবাআর
দাদাকে দিয়ে আয়
দেখি।
দাদা ফিরেছে ? সেই সকালে
ভোটের কাজে বেরিয়েছিল।
দুপুরে খেতেও তো
আসলো না। আজ
আমি রান্ধলাম এত
কষ্ট করে।
আচ্ছা বাবা, ভাইবোনে
পরে ঝগড়া করিস
খন , সারাদিন
পর ফিরল ছেলেটা, কোথায়
কোথায় ঘুরেছে ভোটের
কাজে। সারাদিনে পেটে
কি পড়েছে কে
জানে। যা মা, তাড়াতাড়ি
খাবারটা দিয়ে এসে
হাতে হাতে আনাজটা
কেটে দে দেখি।
কই দাদা?
ঐ তো, তোর বাপের
সাথে বার-উঠানে বসা।
আচ্ছা।
শাঁওলীর বাবা
শ্যামানন্দ আর বড়ভাই
সুজয় আলো আঁধারি
ঘেরা উঠানের এককোনে
বসে আলাপে মশগুল।
মাথা দুটো প্রায়
একজায়গায় এনে নীচু
স্বরে কি যে
গোপন আলোচনা চলছে, কে
জানে! কেউই শাঁওলীর
উঠানে আসা টের
পায় না। তাদের
কথা চলতেই থাকে।
- ব্যাটার
মরণের শখ লাগছিলো।
নয় কি আর
এদ্দিন পর ঠিক
ভোটের আগটায় কোনো
সুম্বুন্ধির পো এই
শত্তুরের দেশে হাওয়া
খেতি আসে? ভাবছিল আন্ধারে
আন্ধারে গেরামে আসবে, চুপিচুপি
ঘোঁট বান্ধাবে আর
পালাবে। আমরা সব
শালা বোকচন্দরের দল, মাটিতে
মুখ দিয়ে চলি ! বল একটা অশ্রাব্য
গালি দিয়ে ওঠে
সুজয়।
-ভাল হইছে
মরছে। লাশটার কি
হইছে
?
- ও নিয়ে
ভেবোনা। বেবাক মাটিতে
পুঁতছি। কাকপক্ষীতেও টের
পাবেনা।
- তয়
কিনা ওদের জমির
দখলটা এখনই নেওয়া
মুশকিল। ভোটটা যাক।
ও বাড়ীর খালি
বুড়িটাই যা আছে।
ও কি আর
ত্রাণ শিবির থেকে
গেরামে ফিরে জমির
দখল নিতে আসবে? তবে
লোকের সন্দেহ যেন
না জাগে। যা
গরম হাওয়া বইছে।
তোর তো খালি
মাথাগরম। আগুপিছু ভাবা
নেই কাজের আগে।
- শ্বশুরঘরের
কুটুম বলে কথা, সাক্ষাৎ
বড়কুটুম। শেষ খাতিরদারি
করে দিলাম। কথায়
বলে শত্তুরের শেষ
রাখতে নেই।
- হ্যা, সে তো
ন্যায্য কথা, শ্বশুরবাড়ীর সম্পত্তি
তো ফেলনা নয়।
ভাগীদার রাখবি কেন? তয়
দেখিস এ ঘরেও
যেন কেউ না
জানে, বাড়ীর মেয়েছেলেগুলান
তো আবার….
উঠোনে কিছু
পরার শব্দে বাপ-বেটার
গোপন কথায় ছেদ
পরে। দুজনে ঘাড়
ঘুরিয়ে দেখে, শাঁওলী ইঁটের
সিমেন্টখসা দেওয়ালে পিঠ
ঠেকিয়ে ভীত স্বন্ত্রস্ত
দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে
তার বাবা-দাদার দিকে
।থরথর করে কাঁপছে, হাত
থেকে কাঁসার থালা, থালায়
বসানো মুড়ি ভর্তি দুটো
বড় স্টীলের জামবাটি
আর চা ভর্তি
কানা উঁচু স্টীলের
দুটো মগ অপ্রশস্ত
উঠানে গড়াচ্ছে।
বেশ কিছু দিন
পর। আপনা আপনিই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল শাঁওলীর । সেই হরিদেবপুরের শাঁওলী, অবশ্য বিয়ের পরে এই প্রবাসে সবাই ওকে ওর স্কুলের খাতায় লেখা ‘শ্যামলী’ র অপভ্রংশ করে ‘শামলী’ বলেই ডাকে। কি যেন একটা স্বপ্ন দেখছিল,পাশে অখিল, ওর ছয় মাসের পুরানো বর , নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। স্বপ্নটাকে এক লহমায় উড়িয়ে দিয়ে ফের পাশ ফিরে শুয়ে পড়তে পারে না সে, কি যেন একটা মনের ভিতর খচখচ করছে।হঠাত ঘুমের বারোটা বেজে যাওয়ায় বিছানায় উঠে বসে।আজও ফেলে আসা দিনের ‘শাঁওলী’ নামটা ভুলতে পারে না সে, ঠিক যেমন প্রাণপনে ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারেনা সে বিষাক্ত দিনগুলোর স্মৃতি।
সেদিনের পর থেকেই হঠৎ করে পালটে গেছিল সদা হাসিখুশী উচ্ছ্বল মেয়েটা । মরনোন্মুখ তাড়া খাওয়া জন্তুর মত ভেতর থেকে এক অজানা আতঙ্কে গুটিয়ে গেছিল।ঘরের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ থেকে দিনের আলোতে বাড়ীর উঠানেও আসতে ভয়ে শিঁটিয়ে যেত। মা ছাড়া বাড়ীর কাউকে যেন চিনতে পারতো না।পাড়া প্রতিবেশীর কেউ বলতো ভূতে ধরেছে, কেউ বলতো নজর লেগেছে, কেউ ওঝা ডাকতে বলতো , তো কেউ বদ্যি। গুটি কয়েক হাতে গোনা শুভার্থী নীরবে ছলছল চোখে বুঝতে চাইত ওর আতঙ্কের উৎস। তাদের কারো পরামর্শেই হয়তো অনেক টাকা বরপণ দিয়ে খুব তাড়াহুড়ো করেই আধাপাগল মেয়েকে পাত্রস্থ করে দেয় শ্যামানন্দ।বিয়ের পর থেকেই ও হায়দরাবাদে। ভালোই তো আছে ও। ওর বর এখানেই কাজ করে।দ্বিরাগমনে একবেলা বাড়ীতে থেকেই কোনমতে পালিয়ে বেঁচেছিল, আর ও মুখো হয়নি।কিন্তু আজ এতদিন পর আবার সেই গ্রাম, সেই জানলার ধারের পেয়ারা গাছের স্মৃতি,সেই চেনামুখ। স্বপ্ন তো কখনই ভেঙে গেছে তবু এখনও যেন চোখের সামনে
ভাসছে একটা নিস্পাপ
মুখ। বড় বড়
চোখ, মাথাভর্তি অবাধ্য
ঝোপড়া চুল। মুখে
মলিন হাসি, কিন্তু চোখমুখ
একদম শুকনো, সারা গায়ে, পোশাকে, চুলে, মাটি
মাখা, শুকনো গুঁড়ো
মাটি। গালে অনেকদিনের
না কাটা দাঁড়ি।
রংজ্বলা নীল ফুলশার্ট
আর ময়লাটে সাদা
প্যান্ট।
তুই আমায় একদম ভুলে গেছিস, না? আমি কিন্তু একটুও ভুলিনি তোকে। আজ তোর জন্মদিন না? ঠিক মনে আছে আমার। ভয় পাচ্ছিস না তো পাগলী? তুই তো
একটা পাগলী, আমার
পাগলী ….।
কথাটা শেষ
হয়না, হঠাৎই সে
পিছন ফিরে মাঠ
দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে
কালো অন্ধকারে মিলিয়ে
গেল। জীবনের খাতায় চাওয়া-পাওয়া, লাভক্ষতির অঙ্কের হিসেব মেলাতে গিয়ে কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে শাঁওলীর ৷ ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ গেল। ঘরের স্তিমিত নাইট লাইটের আলোতেও পড়া যাচ্ছে। সত্যিই রাত পোহালেই কালকের দিনটা শাঁওলীর জন্মদিনই বটে। চোখের জলে ক্যালেন্ডারটা ঝাপসা হয়ে আসে। বাইরে তখন পুরানো রাত শেষে একটা নতুন দিন শুরুর আলো ফুটছে, একটু একটু করে।