গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১৬

ঝর্ণাচট্টোপাধ্যায়



বনফুল--বাংলা ছোটগল্পের বড় গল্পকার
 

পৃথিবীর যে কোন ভাষার সাহিত্যে আমরা উপন্যাস
, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনি, জীবনী, আত্মজীবনী, বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা ইত্যাদির পাশাপাশি পাই ছোটগল্পও।  বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ  আসনটি অবশ্যই ছোটগল্পের, একথা বললে অত্যুক্তি করা  হয় না। আর বনফুলওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় সেই ছোটগল্পকারদের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার।  

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৯শে জুলাই বিহারের পূর্ণিয়া জেলার (বর্তমানে কাটিহার জেলা) মণিহারি গ্রামে। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়, মাতার নাম মৃণালিনী দেবী। পিতা  ছিলেন চিকিৎসক।

প্রথম জীবনে ভর্তি হন সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে স্কুলে। সেখানে থাকাকালীন হাতে লেখা একটি সাহিত্য পত্রিকা, যার নাম ছিল বিকাশ’, তাতে প্রকাশিত হয় প্রথম দিকের  কিছু লেখা। এর পরে মালঞ্চ নামে একটি খ্যাতনামা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বলাইচাঁদের একটি কবিতা। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নজরে পড়েন। এইসব সাহিত্য চর্চার ফলে বলাইচাঁদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে মনে করে তিনি সাহিত্য চর্চা করতে নিষেধ করেন। বলাইচাঁদ বনফুলছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন। অল্প বয়সে লুকিয়ে সাহিত্য চর্চা করার জন্য যে নামটি তিনি  গ্রহণ করেছিলেন, আজীবন সেই ছদ্মনামই তিনি ব্যবহার করে গেছেন।
স্কুলের পর কলেজের  শিক্ষাগ্রহণ প্রথম হাজারিবাগ কলেজ, তারপর কলকাতা মেডিকেল কলেজ। চাকুরী জীবন শুরু করেন প্রথম পাটনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল,  পরে আজিমগঞ্জ ও ভাগলপুর। সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সারা জীবন চিকিৎকের দায়িত্ব পালন করেছেন।  
  
সাহিত্যসেবা করেছেন দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে। চিকিৎসকের দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে এই দীর্ঘ সময় ধরে রচনা করেছেন অজস্র ছোটগল্প, যার সংখ্যা প্রায় ৫৮৬ টি। রচনা করেছেন প্রায় ৬০টির মত উপন্যাস, নাটক ৫খানি, কিছু একাঙ্ক নাটক, কবিতা, অন্যান্য রচনার পাশাপাশি একটি আত্মজীবনীও তিনি লিখেছেন, যার নাম পশ্চাৎপট


কি ধরণের বিষয় নিয়ে তিনি লিখতেন
? তাঁকে নিয়ে বিশেষতঃ তাঁর ছোটগল্প নিয়ে আলোচনার প্রাক্কালে এই প্রশ্ন আসবেই। বনফুলের রচনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন মানুষকে, তাই তাঁর রচনায় স্থান  পেয়েছে মানুষ, তাঁর ভাল-মন্দ সব কিছু নিয়েই । মানুষের পরিচয় কেবলমাত্র ভাল মানুষ নয়, ভালোমন্দ মিশিয়েই মানুষ। তাঁর রচনায় নীতিবাগীশতা যেমন ছিল না, আবার অন্যায় করলে তার জন্য শাস্তিও প্রাপ্য ছিল। জীবন সম্বন্ধে তাঁর যেমন কোন মোহ ছিল না, আবার তেমনি বিশেষ কোন আদর্শের প্রতিও ঝোঁক ছিল না। সম্পূর্ণ কথকতার ভঙ্গী নিয়ে তিনি লিখে গেছেন। তাই সাহিত্যের জগতে তাঁকে একজন বিজ্ঞান নিষ্ঠ বুদ্ধিবাদী লেখক বলা যেতেই পারে।
উপন্যাসও লিখেছেন অনেক। কয়েকটি উপন্যাস যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছিল। সবগুলিই যে উৎকর্ষতার বিচারে সমাদর লাভ করেছিল, তা বলা যাবে না, কিন্তু উপন্যাস, ছোটগল্প যাই হোক না কেন, রচনার বিষয়বৈচিত্র লক্ষ্য করার মত।


আমরা জানি বাংলা সাহিত্যে তাঁকে ইংরাজি সাহিত্যের ছোটগল্পকার ও হেনরির সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। ও হেনরির নামটীও তাঁর নিজের নয়
, এটি ছদ্মনাম। ও  হেনরির রচনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, গল্পের শেষে চমক বা আমরা  যাকে বলি surprising ending.এছাড়া বাস্তব ঘটনার প্রতিফলন বলা হয় তাঁর ছোটগল্পকে। যদি বনফুলের রচনার দিকে লক্ষ্য রাখি, আমরা এই দুটি গুণই তাঁর রচনায় দেখতে পাই। সাধারণ নিত্য জীবনের ঘটনা উঠে আসে তাঁর ছোটগল্পগুলিতে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া-পাওয়া, নিত্য সংঘর্ষ, মান-অভিমান, প্রেম, প্রণয়, ঈর্ষা, কলহ, হিংসা, অসফলতা, অবহেলা কোন অনুভূতিকেই বাদ দেননি তিনি, সব দুহাতে কুড়িয়ে নিয়ে মালা গেঁথেছেন।  এসবই তাঁর রচনার বিষয় হয়েছে বলে তাঁর ছোটগল্পগুলিও হয়েছে এত মধুর। গল্পের আয়তনেও হার মানিয়েছেন তিনি সকলকে। কোন কোন গল্প মাত্র এক পৃষ্ঠা/আধ পৃষ্ঠার হলেও তার ভিতর ধরে রাখতে পেরেছেন হয়ত কোন জীবনের প্রায়  সত্তর বছরের ঘটনাবলীকে। এখানেই  তাঁর রচনার মুন্সীয়ানা। আর গল্পের শেষে চমক তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অজস্র ভাললাগা গল্পের মধ্য থেকে মাত্র কয়েকটি গল্প এখানে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করলেই বোঝা যাবে তাঁর গল্পের শেষে চমকটা কিরকম ছিল।


প্রথম গল্পটির নাম হল
সুলেখার ক্রন্দন।

বিছানায় শুয়ে একটি মেয়ে কাঁদছে। দুধের মত ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে একটি অল্পবয়সী মেয়ের কান্না সকলকে ভাবাচ্ছে। পরিবারের লোকেরা নানাজনে নানারকম মনে করছেন। এমন কি স্বামীর সঙ্গে কোনরকম অশান্তি
, মনোমালিন্য  কিনা তাই নিয়েও সকলে চিন্তা করছেন। এমন সময় জানা গেল মেয়েটি অর্থাৎ সুলেখা কাঁদছে দাঁতের ব্যথায়।
চমক তো বটেই, কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের যে অসামঞ্জস্য, তা নিয়েও কাহিনি রচিত হয়েছে। এও কিন্তু বাস্তব।


দ্বিতীয় কাহিনিটির নাম
জাগ্রত দেবতা।

আগেই বলেছি বনফুল বিশেষ কোন মোহ বা বিশ্বাস নিয়ে চলতেন না
, জীবনকে দেখেছেন একেবারে বাস্তব ভাবে। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস যে মানুষের মনকে কিভাবে ছেয়ে ফেলে এই গল্পটি তারই প্রকাশ।
গ্রামের জাগ্রত দেবতা ছিলেম বাবা মহাদেব। তাঁর প্রচুর নাম-ডাক, দুরদুরান্ত থেকে লোক আসে, পুজো দেয়। বাবা মনস্কামনা পূর্ণ করেন। বাবা দয়া করেন কাউকে না কাউকে। প্রতিবছর বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর পূজার দিনে কৃপা পেয়ে থাকেন একজন,  সেই ব্যক্তির ভর হয়, পরে সে  পাগল হয়ে যায়। কিন্তু তার জন্য গ্রামবাসীর মনে দুঃখ নেই, সবই মহাদেবের কৃপা। পাগলের উপর দেবতার অশেষ কৃপা বর্ষিত হয়েছে বলেই সে পাগল হয়েছে। দিকে দিকে দেবতার মহিমা প্রচারিত হয়। গ্রামবাসীরা দেবতার কৃপালাভে সচেষ্ট থাকেন, সন্তুষ্ট থাকেন।  
  
একবার পুজার দিন কোন মানুষ পাগল হয়েছে বলে জানা গেল না। গ্রামবাসীরা ভয়ে তটস্থ। সকলেই সংবাদ নিচ্ছে কেউ পাগল দেখেছে কিনা, কোন সংবাদ পেয়েছে কিনা। যখন কারো সংবাদ পাওয়া গেল না, সকলে মনে করলেন দেবতা রুষ্ট হয়েছেন। ভয়ে তারা দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। এক ব্যক্তি ছিলেন  দেবতার অন্ধ ভক্ত। তাঁর মনে কিন্তু দেবতার কৃপা সম্বন্ধে কোন অবিশ্বাস নেই, সে প্রতিদিন রোদ, জল, ঝড় সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায় দিনের  পর দিন পাগলের খোঁজ নিতে। দেবতা কৃপা করবেন না, তা কি কখনও হতে পারে!
গ্রামবাসীরা তাঁকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক, একজন তাহলে পাগল  হয়েছে, দেবতার মাহাত্ম্য কি মিথ্যা হতে পারে!  
গল্পের শেষে চমক তো আছেই, সঙ্গে আছে দেবতার প্রতি অন্ধবিশ্বাস নামক অতি পরিচিত আমাদের সমাজের কুসংষ্কারের বাস্তব ছবিটি।


তৃতীয় গল্পটি হল
তাজমহল।

প্রেমের অপূর্ব উদাহরণ এই গল্পটি। এক অতি বৃদ্ধ মুসলমান ভদ্রলোক
, তাঁর স্ত্রীকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে লেখকের কাছে নিয়ে আসেন চিকিৎসার জন্য। কিন্তু রোগিণীর শরীরে রোগের এত দুর্গন্ধ যে হাসপাতালে  তো নয়ই, হাসপাতালের বারান্দাতেও তাকে স্থান দেওয়া গেল না অন্যান্য রোগীদের আপত্তিতে। তাঁর মুখের একটি দিক সম্পূর্ণ গলে-পচে গেছে। সেই পচনের ফলে এই দুর্গন্ধ। শেষ পর্য্যন্ত হাসপাতালের সামনে এক গাছের তলায় সেই বৃদ্ধ তার স্ত্রীকে নিয়ে রইলেন। লেখক তাঁকে রোজ দেখে আসেন, ইঞ্জেকশন দিয়ে আসেন। একদিন হাসপাতালে ফিরবার পথে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে তিনি দেখেন সেই বৃদ্ধ তাঁর শতছিন্ন চাদরের একটি খুঁট ধরে রেখে তাঁর স্ত্রীকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা  করছেন।  লেখককে দেখে জিজ্ঞাসা করেন তিনি বেঁচে উঠবেন কিনা। স্বভাবতঃই চিকিৎসক লেখক তাঁকে জানিয়ে দেন বাঁচার কোন আশা নেই।
কয়েকদিন পরে তিনি দেখেন হাসপাতালের সামনে মাঠে সেই বৃদ্ধ ইঁট দিয়ে কিছু গাঁথার চেষ্টা করছেন। জিজ্ঞাসা করলে জানান, এটি তাঁর স্ত্রীর কবর, তিনি মারা গেছেন। লেখক জিজ্ঞাসা করলেন সেই বৃদ্ধের নাম কি? উত্তর এল---শা-জাহান।
এই যে প্রগাঢ প্রেম, এও তিনি দেখেছেন মানুষের মধ্যেই। তা আছে বলেই এখনও সুখ আছে, এখনও জীবন এত আনন্দময়।


তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প
নিমগাছদিয়েই আলোচনা শেষ করি। গল্পের আয়তন যেমন ছোট, অনুভূতিতে তেমনই বড় এ কাহিনী।
আগাছার মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক নিমগাছ। অযত্ন, অবহেলায় সে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু তার ফল ভোগ করছেন সকলেই। কেউ তা থেকে দাঁতন করছেন, কেউ পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কেউ বা ডাল কেটে কাজে লাগাচ্ছেন। শুধু একদিন একজন এসে গাছটির দিকে তৃপ্ত নয়নে তাকিয়ে রইলেন। গাছটির ফুল, ফল, সবুজ পাতা সবই তাঁর ভাল লাগল। গাছটির মনে হল, যদি তাঁর সঙ্গে চলে যাওয়া যেত! কিন্তু তা কি করে সম্ভব, তার শিকড় যে ভিতরে ভিতরে অনেকদূর চলে গেছে, আর কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। গল্পটি যদি এখানেই শেষ হত, আমরা খুব অবাক হতাম না কিন্তু গল্পের শেষে বনফুল লিখছেন, এই নিম গাছটি ঠিক যেন ওবাড়ির বৌ টির  মত। চমক এখানেই।
অযত্ন, অবহেলা যাই হোক, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের বৌ দের থাকতে হয়, হবে  সংসারের  বেড়াজালের মধ্যেই, কোথাও তার যাবার জায়গা নেই। এ যেন মনের ভিতরে ঢুকে গিয়ে চরিত্রের বর্ণনা। এই জন্যই তিনি অন্যতম সফল ছোটগল্পকার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।    

একাধারে চিকিৎসক, কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার ও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকারকে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা তাঁর জন্মদিনে।