গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

সুবর্ণা রায়



মোহনা

- কই গো হরেনদা, তাড়াতাড়ি এক কেজি আলু দাও দেখি,তোমার বৌমার যা মাথা গরম,দেরী হলেই রাগ হবে তেনার।
হরেন গায়েন দুটো পচা মিশিয়ে আটশ আলু নির্বিকারভাবে ব্যাগে ঢেলে দেয় মাস্টারের।
- পিসি এক আঁটি লাল শাক দাও দেখি।
নির্মলা দুর্বল হাসে, একের জায়গায় দুই দিয়ে দেয়। পয়সা চায় না। মাস্টারও বেমালুম ভুলে মাছের বাজারের দিকে এগিয়ে যায়।
কম পয়সায় কিছু পচা মাছ ধরিয়ে দেয় মধু। মাস্টার তাকিয়েও দেখে না। হাসি হাসি মুখে ব্যাগে ভরে নেয়।
সুন্দরী বৌ এর মুখ মনে করে হাসে মাস্টার,একটুতেই মুখ গোমড়া হয়ে যায় গঙ্গার। নাকের ডগাটা ফুলে ওঠে। চোখটা কুঁচকে যায়। মুখের লাল আভাটা কি সুন্দর ফুটে ওঠে তখন। সবাই বলে মাস্টার বৌ পাগলা। মাস্টার হাসে। পাগলই তো!
বাজারের ব্যাগটা নিয়ে হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটে মাস্টার।
মাস্টারের শুকনো চুল হাওয়ায় ওড়ে। দাড়িতে সাদা ঝিলিক। গলার কন্ঠি বাইরে বেরিয়ে এসেছে। চোখে লাগে। দড়ি পাকানো হাতের নখ কবে থেকে না কাটা বলতে পারবে শ্যাম পরামাণিক। যে এখন সেলুন থেকে তাকিয়ে দেখছে মাস্টার বাজার করে বাড়ি যাচ্ছে। তার হাতের ক্ষুর থেমে আছে খানিকক্ষণের জন্য।
বনমালী তার মুদীদোকানে খদ্দের সামলাচ্ছিল, তবু চোখ এড়ালো না। মাস্টার বাজার করে বাড়ি যাচ্ছে, বিকেলে আসবে ঠিক। চোখটা কড়কড় করে ওঠে বনমালীর। হাতের পিঠ দিয়ে ঘষে নিয়ে দুবার, চিনি ওজনে মন দিল।
বাজার শেষে রিক্সা স্ট্যান্ডের পাশ ঘেঁষে সরু গলিটায় শর্টকাট নেয় মাস্টার। এই গরমেও ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায় শীত করে ওঠে। গঙ্গাকে বলবে পাতলা চাদরটা বার করে দিতে। জ্বর এলো কি না কে জানে!
কঞ্চির গেটটা ঠেলে উঠোনে উঠে পড়ে মাস্টার। এত কাছে এসেও ঘরটা খুঁজে পায় না। ঘোলাটে লাগে সামনেটা। উঠোনেই দাঁড়িয়ে ডাকে, গঙ্গা! গঙ্গা! মাস্টারের পায়ের কাছে পদ্মা ছলাৎ ছলাৎ করে বলে,এই তো!এই তো!



মহিনের চিন্তাগুলি


পুকুরের ঢালু পাড়ে পা ছড়িয়ে বসেছিল মহিন। স্কুল ছুটি। দুপুর গড়িয়েছে, তাই তেজ নেই আর বাতাসে। সুবলামাসি পুকুরে বাসন মাজতে এসেছে, টেরিয়ে টেরিয়ে এদিকেই দেখছিল।
চেতক, জ্যাকি, আর ডিজে ঘাস থেকে বারবারই মুখ তুলে দেখছে আর চিবিয়ে যাচ্ছে। ছাগলদের মালিক রাধেশ্যাম আধপাকা রাস্তার ধারে দিব্যি চিত হয়ে শুয়ে মুখে গামছা ঢাকা দিয়ে পাওয়ার ন্যাপ নিচ্ছে।
মহিন কাল্পনিক কিছু উড়িয়ে দিচ্ছে একটু পরে পরেই। হাতে একটা ডায়েরি। পকেটে দুটো পেন - লাল, নীল। বাঁহাতে ডায়েরি চেপে ধরে রেখেছে, আর ওদিকে ডান হাত বাড়িয়ে আকাশের দিকে কিছু একটা ছেড়ে দিচ্ছে।
মহিন কবি, তবে বাড়ির চাপে শান্তিতে লেখা তো দূর, একটু ভাবতেও পারে না। মহিন নির্বোধ নয়। দিব্যি ফাঁক পেলেই এই পুকুরের ধারটায় এসে ঘাঁটি গাড়ে। বেশ খানিকক্ষণ নিশ্চিন্ত এখানে।
তবু গোপালের চোখ পড়েই গেল। মহিন অদৃশ্য কিছু উড়াচ্ছে। কৌতূহল অতি বিষম বস্তু। পাশে ধেবড়িয়ে বসে পড়ল।
- মহিন, কি করিস?
মহিন তাকিয়ে দেখল শুধু। চুপ। উড়িয়ে দিল।
- কি ওড়ালি?
চোয়াল শক্ত হল, কিন্তু মুখ খুলল না।
- কি রে? হল কি তোর? কি করছিস এটা, বল!
পুকুরের জলে চোখ স্থির রেখে কান চুলকে নিল মহিন।
- কি করছি? খারাপ চিন্তাগুলো উড়িয়ে দিচ্ছি।
- আর ভালোগুলো?
- ভালোর জন্যই তো জায়গা বানাচ্ছি! তাই খারাপ কিছু এলেই উড়িয়ে দিচ্ছি।
- হ্যা হ্যা হ্যা, তুই মাইরি পাগল হয়ে গেছিস!
- কিছু খারাপ চিন্তা, জানিস গোপ্‌লা, জোঁকের মত, ছাড়ালেও ছাড়ে না।
- না ছাড়লে নুন দিয়ে দিবি। এনে দেব? হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা
- নুন দিলে চেটে খেয়ে নেয় রে! পুরো সেয়ানা মাল!
- হ্যা হ্যা হ্যা! তাহলে তো ভালোর আশায় ছাই! তোরও লেখায় এক গামলা কালি! ওকি রে! ওরম করছিস কেন?
- দ্যাখ না! যাচ্ছে না! একটা খারাপ চিন্তা কেমন ভনভন করছে, কিছুতেই যাচ্ছে না!

সুবলামাসি "গেল" "গেল" করে চিৎকার দিল। চেতক, জ্যাকি, আর ডিজে ম্যা ম্যা করে আর্তনাদ করে উঠল। রাধেশ্যাম চোখ কচলে ছুটে এলো। গোপাল গড়িয়ে মাঝ পুকুরে খাবি খাচ্ছে। ত্রিসীমানায় মহিনের টিকিও নেই।