গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০

১০ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ।। ১৭ ডিসেম্বর ২০২০

এই সংখ্যায় ১৪টি গল্প । লিখেছেন : সমরেন্দ্র বিশ্বাস, মুক্তা রহমান, সুবীর কুমার রায়, সুদীপ ঘোষাল, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ ঘটক, পার্থ রায়, সালমা রেখা, তন্ময় বসু, মনোজিৎ কুমার দাস, গোপেশ দে, বিনতা রায়চৌধুরী, ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী ও কুমকুম বৈদ্য ।

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

ভিআইপি পোষাক আর গুলদস্তার গল্প

কোম্পানীর বিশ্বস্ত অফিসার সমীরণ সাহা ভ্যাবাচ্যাকা দাঁড়িয়ে রইলো । 

হাতে গুলদস্তা   রঙ্গীন রিবন আর ঝিলিমিলি কাগজে জড়ানো সুন্দর একটা ফুলের তোড়া । বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পর পর একএকটা ভিআইপি গাড়িতে উঠে পড়লো । সামনে লালবাতিয়ালা সাইরেন বাজানো পাইলট ভ্যান।  পেছন পেছন কুড়িটা গাড়ীর কনভয় , একে একে সবাই লাইন দিয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে বিদায় নিল ।

মুক্তা রহমান

বিভ্রম 

পাহাড়ের রাণী আলুটিলার অতুলনীয় হৃদয়স্পর্শী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মেয়েটি মোহিত। হাটছে আপন মনে। কখনো মাথা নিচু করে কখনো চারপাশটি দেখতে দেখতে। আকাশ পাহাড় আর মেঘের সাথে যেন তার মিতালি। পর্বতের সর্পিল আকারের আঁকাবাকা রাস্তার দু'ধারের সবুজ বনাঞ্চল, সারি সারি উঁচুনিচু পাহাড় আর লুকিয়ে থাকা মেঘ মেয়েটিকে উন্মনা করে তুলেছে। রোদের তেজ মরে গিয়ে মাত্র মিঠে হতে শুরু করেছে। মেয়েটির নাক ঘামছে, চাপা উত্তেজনায় কাঁপছে। 

 

রাস্তা ধরে মিনিট খানেক হেঁটে মেয়েটি পৌছুলো একটি সরু পাহাড়ি পথে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে পথটি। মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু দ্বিধা কাজ করলো, নিচে নামবে কি? জোরে একটি শ্বাস নিয়ে নিচে নামতে শুরু করলো। মেয়েটি এবার সাবধানী। দেখে শুনে পা ফেলছে। ঢালু পথে পা হড়কে পড়ে না যায়।

সুবীর কুমার রায়

ভেস্তে যাওয়া পাকাদেখা

আজ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার কথা শোনাবো, অনেকদিন আগে এক পাত্রী দেখতে যাওয়া, হয়তো বা পাকাদেখাও বলা যেতে পারে। তবে বিধিবাম, তাই শেষপর্যন্ত আর বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার সুযোগ না পেয়ে, অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। না, আমি নিজে পাত্র নই, বরং বরকর্তাই বলা যেতে পারে।

ভারতীয় স্টেট ব্যঙ্কে কর্মরত আমার ভাইয়ের জন্য, উত্তর কলকাতায় আমরা চারজন একটি পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম। আমি, আমার স্ত্রী, আমার ছোট বোন, ও ভাবী পাত্র স্বয়ং। আমাদের মিঞাবিবি দুজনের পছন্দ-অপছন্দ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আবার সবসময়েই দুই মেরুতে বসবাস করে, আজও করে। আমি মিষ্টি খাওয়া কোনকালেই পছন্দ করি না, চপ্-কাটলেটই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। আমার উনি আবার মিষ্টি খাওয়ার জন্যই বোধহয় এই ধরাধামে আবির্ভুত হয়েছেন। পারলে ঠাকুর পূজার নকুলদানাও তিনি সাবাড় করে দিতে কিছুমাত্র কুন্ঠাবোধ করেন না। ভাবী পাত্রীর ভাবী স্বামী, ভাসুর, জা, ও ননদের পদধুলির কল্যানে তাঁরা ধন্য হয়ে যারপরনাই মিষ্টান্নর আয়োজন করবে, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি আধপেটা খেয়ে আমাদের সাথে গেলেন। তখন মোবাইলের প্রচলন হয়নি, হাতেগোনা কিছু বাড়িতে দশফুটোর কালো রঙের ল্যান্ড ফোনের দেখা মিলতো। খবরের কাগজ দেখে সম্বন্ধ, তাই উভয় পক্ষের চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে, আজ সেখানে যাওয়ার আয়োজন।

সুদীপ ঘোষাল

 

ভূত নয় অদ্ভূত

আমার শোনা তিনটি, রহস্যঘেরা সত্য কাহিনী তোমাদের আজ শোনাবো। বন্ধুরা ভয় পেও না কিন্তু। প্রথমে আমার দেখা ভূত। হয়তো বিশ্বাস করবে না। তা হলেও বলছি শোনো।

অমাবস্যা র রাতে অন্ধকার হয় শুনেছি । কিন্তু তার থেকেও ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি চারজন। হঠাৎ সামনে দেখি গলা থেকে মাথা পর্যন্ত কাটা একটা স্কন্ধ কাটা ভূত ।আমার আর অনুপের  হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। ছোটো থেকেই জয় দা ও রমা দি র সাহস বেশী । আমরা ভয়ে বু বু করছি । এমন সময় দেখলাম অনুপকে  কে যেনো ছুঁড়ে পাশের হাই ড্রেনে  ফেলে দিলো। জয় দা হাঁক  দিয়ে বললেন, কে রে ভয় দেখাচ্ছিস । কিন্তু ভূত কোনো সাড়া না দিয়ে থপাস করে বসে পড়লো।

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

মাস্ক ও বিধবা সিঁথি  

শিবু বলে,ওই দ্যাখ, কতগুলো মাস্ক ঝুলছে।

-- চল তবে ওখান থেকেই কিনি।আকাশ উত্তর দেয়।
রাস্তার দিকে মুখ টানা বারান্দার সামনে শেড সেখানে একটা দড়িতে রংবেরঙের বেশ
কয়েকটা মাস্ক।নানারকম কোয়ালিটির অর্থাৎ দামও বিভিন্ন।
-- কোনটার কত দাম গো?
সামনে কেউ নেই ঘরের ভেতর সেলাই মেশিনের শব্দ।
-- আসছি -- বলে যে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় তাকে দেখে বেশ চমকে গেল আকাশ,
পসারিনি থমকায়, অপলক চেয়ে থাকে। অবাক দুজন শব্দহীন। এভাবেও দেখা হয়!
-- তুমি এখানে? বলে একজন।
-- তুমি এখানে? অন্যজনও একই প্রশ্ন করে।
তাকিয়ে থাকে বন্ধু শিবু।

প্রদীপ ঘটক

 কুমড়ো ছক্কা

স্কুল গেটের দু'ধারে স্কুলের বাগান। পাঁচিলে দু'হাত ঠেকিয়ে থুতনিতে ভর দিয়ে আনমনা অরি। অরি মানে অরিত্র। ম্যাগি করে দেয় নি মা, মোটা হয়ে যাচ্ছে বলে। বাগানে নতুন হরেকরকম গাঁদা, ক্যালেন্ডুলা, একমনে নিরীক্ষণ করছে ভগ্ন হৃদয় অরি। হঠাৎ কাঁধে একটা হাত। অস্ফুটে অরির মুখে বের হয় "পাপা!"

-নতুন বছরে তো বড় স্কুলে আসবি। চল্ আমাদের স্কুলটা তোকে ঘুরে দেখাই।

একটা গেট, দু'টো গেট তারপর দু'পাশে সারি সারি ঘর। বাবা ঘুরে ঘুরে দেখান কোন ঘরে তাঁরা কোন ক্লাসে পড়তেন। কোন ক্লাসে অনিলবাবু বেধড়ক মেরেছিলেন ক্লাসে দুষ্টুমির জন্য, কোন ম্যামের ক্লাসে বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়েছিলেন, পড়া না পারার জন্য।

পার্থ রায়

গরম ভাতের গন্ধ


ঝটিতি অফিস ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয় সুপ্রতিম। প্রচণ্ড তাড়া। অবশ্য এর জন্য ও নিজেই দায়ী। দেরি করে অফিস যাবার প্রস্তুতি নেওয়া ওর অনেকদিনের অভ্যাস। কথায় আছে ‘স্বভাব যায় না মলে’। তাই স্ত্রী সুতপা এবং বাড়ির অন্য সদস্যরা এই সময়টা খুব তটস্থ থাকে। শেষ মুহূর্তে গাড়ি ঘোড়ার মধ্য দিয়ে সুপ্রতিমের মিলখা সিং হয়ে ছুটে যাওয়া ওদের বিলকুল না পসন্দ।

“তোমাকে একটা কথা না বলে পারছি না। নুতন কাজের লোক বিমলাকে টিফিন দাও না?”, নিচু স্বরে স্ত্রীকে বলে সুপ্রতিম।

সুতপার ভ্রূ কুঁচকে যায়। “হঠাৎ এই কথা? এই সময়ে? তোমার কি আজ ট্রেন ধরার ইচ্ছে নেই? অফিস থেকে ফিরে এলে না হয়...”

“ওহ! যা জানতে চাইছি সেটা বলো। দাও কি দাও না? আস্তে কথা বলো”

সালমা রেখা

তমসাছন্ন ছায়া

প্রথম পর্ব

সুর্মার মত কাউকে দেখেই সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেনকালো সে যতই কালো হোক দেখেছি তার কালো হরিন চোখদেখতে সুর্মা যেমনই হোক, স্বভাবে সে ভারী লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। তাদের বাড়ী নবাবগঞ্জের দোহারে। এলাকাটি অনুন্নত, বেশীরভাগ মানুষই কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। সুর্মা তার বাবা সালাম মিয়ার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কাজলীর গর্ভের প্রথম সন্তান।

সুর্মার পিঠেপীঠী তার এক ভাই রাজু, আর আছে তার চেয়েও সতেরো বছরের বড় সৎভাই মালেক। সুর্মার বাবা সালাম মিয়া অস্থির এবং রগচটে  ধরনের মানুষ, কোন কাজই বেশীদিন সে মন লাগিয়ে করতে পারেনা। পৈতৃকসুত্রে  যথেষ্ট সহায় সম্পত্তি পেলেও অদূরদর্শী সালাম মিয়ার আর্থিক অবস্থা এখন নিতান্তই করুন। বেহিসেবী জীবনযাপন আর  দুই সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে জমিজিরাত বিক্রি করতে করতে এখন সালাম মিয়ার নিজস্ব সম্পত্তি বলতে কেবল ভিটেটাই অবশিষ্ট আছে। সালাম মিয়া দাওয়ায় বসে যখন হুক্কায় টান দেয় তখন রান্নাঘরে দুই বউ উচ্চস্বরে ঝগড়া করে। আর দুই বউয়ের ঝগড়া শুনে সালাম মিয়ার অন্ধ মা তার ঝুপড়িঘর থেকে ধমকে বলে,  

তন্ময় বসু

 

বসন্ত

বাড়ির পাশে গাছগুলোতে পাখিদের আড্ডাখানা হয়েছে। কমবে কি, দিন দিন আনাগোনা বেড়েই চলেছে। এমনিতে ল্যাংড়াশিবে এখন প্রায় হাফ বৈরাগী, তাতে আবার এই গাদা গুচ্ছের পাখির ভীড়। ধারে পাশে বেশ কয়েকটা পেল্লায় বড়মাপের প্রাচীন গাছ, বসতি থেকে নিরিবিলিতে ল্যাংড়াশিবের বাড়ি। এদিকটা আজকাল কেউ বড় একটা আসে না। হলে কি হবে, নতুন এক আপদ এসে হাজির। ইয়ে, রোজ উটকো কিছু পাখির ডালে বসে আলোচনা! কি? না -- 'বসন্ত আসছে' এক কথা শুনে শুনে কান ঝালাপালা। শেষে থাকতে না পেরে ল্যাংড়াশিবের চিৎকার প্রশ্নকে পাকিয়ে আকাশে ধাক্কা খেয়ে গাছের ডালে ডালে ঝুলতে লাগল। তাতে অন্য ফের! পরদিন থেকে ল্যাংড়াশিবের কানে যখনই এল 'বসন্ত আসছে' পরক্ষণেই কোথাও বেজে উঠছে -- 'এই শীত গেলে সামনের শীত' তারপরেই নাকি বসন্ত! মহাজ্বালা! 

মনোজিৎ কুমার দাস

 

বৃষ্টিভেজা রাত                                                                                                                           

শ্রাবণের রাত । অবিশ্রান্ত ধারায় বারি বর্ষণ হচ্ছে । ব্যাঙের ঘ্যাংঘর ঘ্যাংঘর ডাকে কান ঝালাফালা!  এক সময় লায়লার ভাল লাগতো টিনের চালের উপর বৃষ্টির পানি পড়ার ঝমঝম শব্দ! এক টানা ব্যাঙের ঘ্যাংঘর ঘ্যাংঘর শব্দে লায়লার ঘুম এসে যেত। এখন কিন্ত  বৃষ্টির শব্দ, ব্যাঙের ডাক তেমনটা ভাল লাগে না। সে বুঝে উঠতে পারে না  এখন কেন এমনটা হয়। তবে বর্ষা ও শরত এলে লায়লা এখন নস্টালজিয়ায় ভোগে। বিয়ের আগেই অনার্স শেষ করেছিল সে।বিয়ের পর মাস্টার্স পাশ করেছে। পাঁচ বছর হতে চললো বিয়ে হয়েছে তার।এখনো কিন্তু সন্তানের মুখ দেখেনি লায়লা। বিয়ের আগ থেকেই লায়লার স্বামী নাহিদ বিদেশে, বছরে দুবার মাস দেড় দুয়েকের জন্য সে দেশে আসে। জলজঙ্গল, বাদলের দেশের ছেলে নাহিদ এখন মরুভূমির দেশের স্কাইক্রাপার বিল্ডিং তৈরির  কাজের ডাকসাইটে প্রকৌশলী। তার কাজে খ্যাতি ও যশের জন্য রিয়েল গেøাবাল ইন্টারপ্রাইজ তাকে বছরে তিন মাসের সবেতন ছুটি দিয়ে থাকে।

গোপেশ দে

 


মধুরেণ সমাপয়েৎ

কাকু একটা গল্প শুনবেন ?

আমি একটা চায়ের দোকানে বসে ধ্যানে ছিলাম।আমার ধ্যানভঙ্গ হল।

একটা ছেলে আমার পাশে বসে বেশ উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে।আমি ছেলেটির দিকে সেলুলয়েডের মোটা কাচের চশমার ভেতর দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।

অল্প বয়সী ছেলে।বয়স আন্দাজ করলাম।পঁচিশ- ছাব্বিশ।

আমাকে ছেলেটি এরকম একটা প্রশ্ন করায় বেশ অবাক হলাম।এই প্রথম মনে হয় অচেনা কেউ আমাকে এরকম প্রশ্ন করল।

আমি তার কথাটা না বোঝার ভান করে বললাম, কি বললে ?

ছেলেটি বলল, গল্প শুনবেন ?

কি গল্প ?

এবার ছেলেটি বুকপকেট থেকে চশমা বের করে বলল, প্রেমের গল্প।

বিনতা রায়চৌধুরী

সাঁঝবাতি


শীত পড়তে না পড়তেই সোয়েটার বোনার অর্ডার চলে আসে সাঁঝবাতির।সারা বছর ওকে বোনাটা চালিয়ে যেতে হয়,তবে শীতের সময় অর্ডারটা বেশি আসে,বোনার হাতটাও ওর খুব ভাল।বিদেশেও ওর বোনা সোয়েটার যায়। অসুস্থ বাবা আর মা,ভাই কে নিয়ে ওর পরিবার।

সাঁঝবাতির বিএ পাশ করার পর আর পড়াশুনা করা হয়ে উঠেনি।অভাবের সংসার তার উপর একটা এক্সিডেন্টের পর বাবার নিচের দিক টা একেবারে অবশ হয়ে গেছে তাই সংসারের সব ভারটাই ওর কাঁধে,তার ওপর ভাইটা স্কুলে পড়াশুনা করছে,এখন মানুষ হতে অনেক দেরি, তাই অনেক চেষ্টা করে যখন কোন চাকরি জুটল না,তখন পাড়ার এক দিদির সাহায্যে অর্ডার নিয়ে হাতে বোনা উলের সোয়েটার বিক্রি করে রোজগার করতে শুরু করে,পরে অবশ্য এক টা উল বোনার মেশিন কিনে বেশি টাকার অর্ডার নিতে শুরু করে। রোজগার যা হয় তাতে চলে যায় ওদের কোন রকমে। 

ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী

 ঋণ শোধ 


পাড়ার বাবলু দা যেমন মজার মানুষ ঠিক সেই রকম পরোপকারি।কারুর অসময়ে উনি নিশ্চই  পাসে থাকেন এবং শুধু তাই নয় সমস্যার সমাধান ও করেন। কিন্তু বাবলুদার বাড়ির লোকেরা ওনার এই পরোপকারী স্বভাবটা পছন্দ করেন না। ওনারা বলেন জমিদারের বংশের ছেলেরা পাড়ার কেউ মারাগেলে শ্মশানে যায়না শবদাহ করতে। কিন্তু বাবলুদা বলেন শ্মশান যাত্রা মহা পূণ্যের কাজ। শবদাহ করা আরো পূণ্যের। 

বাবলুদার বাবা মা দুজনেই বাবলুদাকে ঘরে ঢুকতে দেন না। বলেন ঐ সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে থাক তুই। বাড়িতে ঢুকিসনা। আপদ অপদার্থ এক ছেলে জন্মেছে। বাবলুদার কিন্তু কোন রাগ দুঃখ নেই সে জন্য। বলেন অসময়ে লোকের কাছে থাকা তাকে সমবেদনা জানানো  মনুষ্যত্বের কাজ। এই মনুষত্ব মানুষের হৃদয় থেকে উবে যাচ্ছে দিন দিন।

কুমকুম বৈদ্য

কনে দেখা


মেয়ে ইন্জিনিয়ারিং শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছে. প্রথম অনসাইট ও হয়ে গেছে .সুতরাং এবার মেয়ে পাত্রস্থ করার সুবর্ণ সময়. বাবা উকিলr, মা রিটায়ার্ড প্রধান শিক্ষিকা.মেয়ের প্রেম বছর খানেক হল কেটে গেছে, সুতরাং আনন্দবাজার  এর পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন ভরসা. মেয়ের ঘোরতর আপত্তি অগ্রাহ্য় করে বেশ ঘটা করে বেরলো বিজ্ঞাপন. ব্য়াস তারপর থেকে শুরু হল ফোনের পর ফোন. সে নানা ধরনের মানুষের নানা প্রশ্ন. রেলের হকার থেকে শুরু করে ৪০ বছর বয়সি সংস্কৃতর অধ্য়াপক লম্বা লিস্ট. গুটি কত ভদ্র সন্তান বাবার কাছে ইন্ট‍ারভিউ দিয়ে বিদায় হলেন. গুটি কয়েককে মেয়ে দেখানো হল. কিন্তু ব্য়পারটা তেমন জমল না. উৎসাহের ঢেউ যখন একটু থিতু হয়েছে, হঠাৎ একটা ফোন এল.

ভদ্রলোকের ছেলে কোল ইন্ডিয়াতে চাকরি করেন, উনি নিজে ওএনজিসি তে চাকরে করতেন রিটায়ার্ড . আসতে চান মেয়ে দেখতে. কিন্তু উনি মুর্শিদাবাদ থেকে আসবেন তাই একরাত থাকবেন. বাড়িতে তো জোর প্রস্তুতি. যদি ও মেয়েটি  প্রচন্ড আপত্তি করছিল, অচেনা  মানুষকে রাতে আশ্রয় দেওয়া বেশ বিপজ্জনক হতে পারে. কিন্তু আপত্তি কেউ কানে তুলল না.

বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০

১০ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা ।। ২৮ নভেম্বর ২০২০


এই সংখ্যায় ৭টি গল্প । লিখেছেন ঃ তাপসকিরণ রায়, সুবীর কুমার রায়, নীহার চক্রবর্তী, প্রদীপ ঘটক, রত্না মজুমদার, গোপেশ দে ও কুমকুম বৈদ্য ।

                              সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করে পড়ুন
 

সুবীর কুমার রায়


 মাস্ক বিভ্রাট


শান্তশিষ্ট স্বভাবের নারায়ণবাবু মানুষটিকে আশেপাশের সকলেই খুব পছন্দ করতেন। আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না হলেও, তিনি কারও কাছে কোনদিন সাহায্য চেয়েছেন, যদিও তাঁর কোন শত্রু নেই, তবু থাকলে তিনিও হয়তো একথা স্বীকার করতেন না। মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই টাকার অভাবে সংসার চালাতে হিমশিম খেলেও, তিনি সবসময় তাঁর ক্ষমতা অনুযায়ী নগদে বাজার দোকান করতেন। বাজারের সবজি বা মাছ বিক্রেতারাও তাঁকে কোনদিন ধার চাইতে ও দরাদরি করতে না দেখায়, তাঁকে বেশ পছন্দও করতেন। কতবার পছন্দের মাছ কিনতে গিয়ে দাম শুনে পিছিয়ে আসায়, মাছ বিক্রেতা তাঁকে সুবিধা মতো পরে দাম দিয়ে যেতে বলে, মাছটা নিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু নারায়ণবাবুর যুক্তি হচ্ছে, তিনি নুন ভাত খেয়ে থাকতেও রাজি আছেন, কিন্তু বাকিতে কিছু কিনতে তিনি রাজি নন। ধার করে ঘি খাওয়া তিনি আদপেই পছন্দ করেন না।

এরমধ্যে শুরু হলো করোনার ঝামেলা। বিপদটার গুরুত্ব কতখানি বোঝা না গেলেও, আশেপাশের শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে বেশি করে চাল, আটা, তেল, নুন, মশলাপাতি, ও বাজার করে বাড়িতে জমা করে রাখার কথা বলে সতর্ক করে জানালেন, যে যেকোন মুহুর্তে বাজার দোকান সব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পরের দিনই নারায়ণবাবু বাজারে গিয়ে সমস্ত বাজার করে, এক মাছ বিক্রেতার কাছে যান। লোকটা ভালো, সঙ্গে তার ছেলেকে নিয়ে বসে মাছ বিক্রি করে, কিন্তু তিনি মাছ পছন্দ করার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। বাজারের সকলেই তাঁকে চেনেন, তাই অনেকেই ছুটে এসে তাঁকে তুলে চোখেমুখে জল দিয়ে কিছুটা সুস্থ করে তুললেন। ওই মাছ বিক্রেতা তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও বেশ কিছু মাছ তাঁর মাছের ব্যাগে দিয়ে, বাজারের ব্যাগ ও মাছের ব্যাগ সমেত তাঁকে রিকশায় তুলে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার সময় বললো, “সাবধানে বাড়ি ফিরে যান। সুস্থ হয়ে যখন আবার বাজারে আসবেন, তখন মাছের দাম সাতশ’ টাকা দিয়ে যাবেন। তাড়াহুড়ো করে শরীর খারাপ নিয়ে এরমধ্যে যেন মাছের দাম দিতে আসবেন না”। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও নারায়ণবাবু এই প্রথম বাকিতে কিছু কিনতে বাধ্য হলেন।

রিকশাচালক তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে, তাঁর স্ত্রীকে আজকের সমস্ত ঘটনার কথা বলে ফিরে গেল। ডাক্তার দেখানো হলো এবং ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওষুধপত্রও খাওয়া শুরু হলো। একটু সুস্থ হয়েও কিন্তু তাঁর পক্ষে বাজারে গিয়ে মাছের দাম পরিশোধ করা সম্ভব হলো না, কারণ ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে সত্য সত্যই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ঋণ পরিশোধের চিন্তায় অসুস্থ নারায়ণবাবু আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

দিন পনেরো পরে স্ত্রীর কথা অগ্রাহ্য করেই তিনি বাজারে চললেন ঋণ পরিশোধ করতে। বাইরে গিয়ে তাঁর বহু বছরের চেনা শহরটাকে কেমন যেন অপরিচিত মনে হলো। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় কোন টোটো বা রিকশা নেই, মানুষজনও প্রায় নেই বললেই চলে। যে ক’জন মানুষকে দেখা যাচ্ছে, তাদের সকলের মুখেই মাস্ক বাঁধা, সহজে চেনার উপায় নেই। তাঁর মনে হলো মাস্ক ছাড়া তাঁর রাস্তায় বেরোনোটা উচিৎ হয়নি। তিনি ঠিক করলেন ফেরার সময় মাস্ক কিনে নিয়ে যাবেন। অন্যান্য দিন যেটা বিশেষ দেখা যায় না, আজ দেখলেন রাস্তার দুপাশে কিছু সবজি বিক্রেতা সামান্য কিছু সবজি নিয়ে মুখে মাস্ক বেঁধে বসে আছে। দু’-চারজন মাছ নিয়েও বসেছে। নিজেকে মাস্কহীন অবস্থায় নিজেরই যেন কিরকম অস্বস্তিবোধ ও লজ্জা করতে লাগলো। নারায়ণবাবুর আজ মাছ বা বাজার, কোনটারই প্রয়োজন নেই, তাই দ্রুত পা চালালেন। এমন সময় রাস্তার বাঁপাশ থেকে মুখে বেশ শক্তপোক্ত মাস্ক পরা একজন চিৎকার করে বললো, “বাবু কেমন আছেন? মাছ লাগবে নাকি? নিয়ে যান, একবারে টাটকা মাছ আছে”। নারায়ণবাবু লক্ষ্য করলেন, যে তাঁর পরিচিত সেই মাছ বিক্রেতা আজ এখানে বসে মাছ বিক্রি করছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে তাকে বললেন, “আজ এত লোক মাছ ও সবজি নিয়ে রাস্তার দুপাশে কেন বসেছে”? উত্তরে মাছ বিক্রেতা মাস্কের ভিতর থেকে অস্পষ্ট গলায় জানালো, “বাজারে সবাইকে বসতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তার দুপাশে বসেছে”। নারায়ণবাবু আর কথা না বাড়িয়ে মানিব্যাগ থেকে সাতশ’ টাকা বার করে দুবার গুণে নিয়ে তার হাতে দিয়ে বললেন, “শরীরটা সুবিধের নেই বলে কয়েকদিন বাড়ি থেকে বেরোইনি। আজ তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম, সেদিনের মাছের দামটা রেখে দাও”। মাছ বিক্রেতা হাসি মুখে টাকাটা পকেটে রেখে দিলো। নারায়ণবাবু একবার বললেন, “টাকাটা গুণে নাও”। উত্তরে মাছ বিক্রেতা বললো, “কি যে বলেন বাবু, আপনার মতো মানুষ আমাকে কম টাকা দিয়ে ঠকাবে”?

এই মাস্ক বিক্রেতার মাস্কটা তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে, এরকমই একটা মাস্ক কেনার জন্য তিনি ওষুধের দোকানের দিকে পা চালালেন। বাজারের কাছে এসে অভ্যাসবশত মাছের বাজারের কাছে গিয়ে তিনি আঁতকে উঠলেন। তাঁর পরিচিত মাছওয়ালার ছেলেটা কাছা পরে সামান্য কিছু মাছ নিয়ে বসে আছে। তিনি ভাবলেন, বাড়িতে এরকম একটা অঘটন ঘটেছে, অথচ ওর বাবা তো কিছু বললো না? দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, “তোর এরকম পোশাক কেন, কে মারা গেছে”? ছলছল চোখে ছেলেটা উত্তর দিলো, “বাবা মারা গেছে”। নারায়ণবাবুর চোখের সামনে গোটা পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো। চোখে অন্ধকার দেখে তাঁর মাথাটা কিরকম ঘুরতে শুরু করলো। কোনরকমে একবার জিজ্ঞাসা করলেন, “কি করে মারা গেল? কবে মারা গেল”? ছেলেটি উত্তর দিলো “গত শনিবার রাতে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে, আগামী রবিবার কাজ। বাবা আপনাকে খুব ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন, আপনি তো আমাদের বাড়ি চেনেন, ওইদিন আপনি যদি একবার আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন, তাহলে বাবার আত্মা শান্তি লাভ করবে”।

মানিব্যাগ হাতড়ে ছেলের হাতে সাতশ’ টাকা দিয়ে, তিনি বাড়ির পথ ধরলেন। মনে মনে ভাবলেন, এমাসে আর মাস্ক কিনে কাজ নেই, যেটুকু টাকা পড়ে আছে, সামনের রবিবার ফুল ও ধুপকাটি কিনতে চলে যাবে। যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে আগের সেই মাছ বিক্রেতা বসার জায়গাটা আড়চোখে একবার দেখলেন। জায়গাটা ফাঁকা, দুটো কুকুর নিশ্চিন্তে শুয়ে ঘুমচ্ছে।

 

তাপসকিরণ রায়

 হ্যান্টেড কাহিনী--৫৫ 


মৃত্যু পারাপার
  

 

বৈদ্যনাথ বাবু অসুস্থ ছিলেন। তিনি হার্টের রোগী। সারা দিনের বেশির ভাগ সময়ে তাঁকে বিছানায় বিশ্রাম নিয়ে কাটাতে হয়। তার শরীর ও মন যেন আর ঠিকঠাক কাজ করছিল না। ঘরের লোকজনকে তিনি মাঝে মাঝে চিনতে পারেন না। কেবল কাছে বসা স্ত্রী, রমলাকে চিনতে পারছিলেন। এর মধ্যে ব্যাপারটা ঘটল, বৈদ্যনাথের মনে হল কিছুটা জড়ো জড়ো ভাব থেকে তিনি যেন হঠাৎ মুক্ত হলেন। এ কি ! শরীর এত হালকা লাগছে কেন ? তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন, হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছেন তিনি, স্ত্রী স্থির অদ্ভুত চোখে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন। একটা হৈ-হল্লা, আওয়াজ পাচ্ছেন তিনি, সবাই তাঁর কাছে এসে জড়ো হয়েছে।  ছেলেরা তার গায়ে হাত লাগিয়ে পরক করছে, নাতি-নাতনিরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। আর হঠাৎই বৈদ্যনাথ বাবু চমকে উঠলেন, দেখলেন, তিনি যে দাঁড়িয়ে আছেন! নিজের বিছানায় শায়িত  নিজের নিথর দেহটা তিনি স্পষ্ট দেখতে পারছেন ! 

অভিজ্ঞতা, এই কি অভিজ্ঞতা রে বাবা ! জীবিত কালে কত না অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি করেছেন তিনি ! আর এখন মৃত্যুর পরেও এখানেও সেই অভিজ্ঞতা--দেহ নেই কিন্তু ভাবনা স্মৃতিগুলি সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে। কান্নার রোল পড়ে গেছে, স্ত্রী আছড়ে পিছড়ে কেঁদে চলেছেন। ছেলেরা চোখ মুছছে. নাতি-নাতনিরা থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের কান্না আসন্ন প্রায়। শরীর নেই, বৈদ্যনাথ বাবু বুঝেছেন, তবুও তিনি অঝরে কেঁদে চলেছেন। কার জন্য এ কান্না ? নিজের জন্য! নিজের মৃত্যু থেকে বড় শোক আর যে কিছু হতে পারে না।

কোমরটা খুব টাইট লাগছিল বৈদ্যনাথের, হাত দিয়ে তিনি নিজের কোমর খুঁজে পেলেন! পেট কমাবার জন্য বেল্ট এখানে লাগা থাকত, পেট কতটা কমেছে বোঝেননি তিনি তবে অভ্যাস বশত প্রায়ই তিনি ব্যাল্টটা কোমরে লাগিয়ে  রাখতেন। মনে হচ্ছে, এখনো যেন সেই ব্যাল্টটা  তাঁর কোমরে লাগা আছে।  ব্রাউন কালারের ব্যাল্টটা তিনি কোমর থেকে খুলে ফেললেন। কেন যেন মনে হল তাঁর, এটাকে সঙ্গে রাখতে হবে। এখন কার্যকারণ মনের অবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তিনি বুঝতে পারছিলেন। নিজের মনই তাকে বলে দেয়!  

না, আর ঘরের ভেতরে থাকতে পারছেন না তিনি। হঠাৎ তিনি চিৎকার করে উঠলেন, এত ভিড়ে থাকতে পারছি না আমি--সাপোকেশন লাগছে আমার--আমাকে বাইরে যেতে দাও। না, কেউ তার কথা শুনতে পেল না। ঘরের বাইরে যাবার মত জায়গাও নেই। জীবিতকাল ও মৃত্যুর পরের কিছু কিছু ভাব-ভাবনা তিনি বই পত্রে পড়েছেন। তাহলে, হঠাৎ বৈদ্যনাথের মনে হল তা হলে ওই জালনা দিয়ে তিনি অনায়াসে বাইরে যেতে পারেন কি ? যেই ভাবা সেই কাজ, তিনি দেখলেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। বৈদ্যনাথ বড় পরিশ্রান্ত, মৃত্যুর আগে অনেক ধকল গেছে তাঁর ওপর দিয়ে,  আত্মা ও মন তাতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত তো হতেই পারে। তিনি ভাবলেন তাঁর মৃত শরীর ওরা খাট থেকে সরিয়ে নিলে তিনি সেখানে গিয়ে একটু শুয়ে বিশ্রাম নেবেন। এই চল্লিশ বছরের খাটটাও যে ভার বহন করে তাকে আরাম দিয়েছে। সে মায়া কি ভাবে তিনি ছাড়তে পারেন ? বিশেষ একটা পরিবর্তন নেই, স্ত্রীর কান্না প্রায় ছেড়েছেন, অবাক, এতো তাড়াতাড়ি সবাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে নাকি। তার মানে তার মৃত্যুর ফলাফল এইটুকু মাত্র! খুব ব্যথা পেলেন বৈদ্যনাথ কিন্তু তিনি তো ভুলতে পারছেন না কাউকে। এই মিনিট তিন-চার আগে তিনি ভূত হয়েছেন, সবাইকে কাঁদতে দেখেছেন--বাসনা কামনা ছাড়তে পারেননি তিনিও। রাতের পোশাক এখনো যে তার শরীরে জরানো আছে। 

ঘরের বাইরে থেকে জানলা দিয়ে বৈদ্যনাথ বাবু বারবার ঘরের ভেতরে উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। নাতি-নাতনিরা কাঁদছে,  তাদের মুখে 'দাদু, দাদু' শব্দ লেগে আছে। তিনি এক বার নাতি-নাতনির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ালেন, বললেন এই যে আমি এখানে আছি-- 

কিন্তু কিছুই শুনতে পায়নি তারা, কিছুই দেখতে পায়নি তারা। বৈদ্যনাথ জানেন,  এমনটাই হয়। তবে হ্যাঁ, আত্মারা মনের জোরে অনেক কিছু তৈরি করে নিতে পারে। ভূতের জোর  মনের মধ্যে থাকে  আর তার মধ্যে মন নিবিষ্ট থাকে  শুধু তাদের দেহ থাকে না।  মনের জোর দিয়ে আত্মারা অনেকটা ধোঁয়াশা দেহ ধারণ করতে পারে। ভূত এক্টোপ্লাজম সৃষ্টি করে তার মনের  জোর থেকে,  এক্টোপ্লাজম থেকে তারা  নিজেদের ভৌতিক দেহ সৃষ্টি করতে পারে। তখন জীবিত মানুষরা ভূতকে দেখতে পায়  এবং তা দেখে ভয়ে শিউরে ওঠে। 

বৈদ্যনাথ ঠিক করলেন তিনিও  এক্টোপ্লাজম দিয়ে শরীর তৈ তাই করবেন, স্ত্রীকে দেখা দেবেন, নাতি-নাতনিদের  সামনে শরীর ধারণ করে কথা বলবেন, ওদের সঙ্গে খেলে বেড়াবেন। তাঁর ইচ্ছে,  রোজ ঘরে এসে  সবাইকে দেখা দেবেন এবং জীবিত লোকের মত  সবার সঙ্গে বাস করবেন। তিনি জানেন ভূতেদের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। মরে যাবার পরে নিজের লোকরা মৃত লোককে দেখে ভয় পাবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবু সদয় ভূত হয়ে যাওয়া বৈদ্যনাথ ভাবলেন, চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি ?

হঠাৎ বৈদ্যনাথ দেখতে পেলেন, ঐ তো তাঁদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, অমল বাবু আসছেন। তার মানে অমল বাবু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডেথ সার্টিফিকেট দেবেন। তারপর বৈদ্যনাথের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে এবং অন্তিম সৎকারের ব্যবস্থা হবে। জালনা দিয়ে তাকালেন বৈদ্যনাথ, ছেলেদের সঙ্গে ডাক্তারের . কিছু কথা হবার পরে ডাক্তার তার মৃতদেহে হাত লাগালেন। তিনি হঠাৎ যেন চমকে উঠলেন, গলার টেথিসস্কোপ নিয়ে বারবার দেখতে লাগলেন, খাট থেকে সবাইকে উঠিয়ে দিয়ে মৃত বৈদ্যনাথ বাবুর বুকে ডাক্তার  ধীরে ধীরে, জোরে জোরে  চাপ দিতে থাকলেন এবং প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে পাম্প করার মত করে তিন-চার বার প্রেশার দিলেন। তারপর হঠাৎ কক করে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো, আর এ কি হল ! বৈদ্যনাথ ভ্যানিস হয়ে গেলেন। তবে কি আর তার কোন অস্তিত্বই রইল না ? এবার ডাক্তার বাবু চাপা স্বরে বললেন, বৈদ্যনাথ বাবু এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন। সামান্য পরেই বৈদ্যনাথ ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। এ কি তিনি বেঁচে আছেন নাকি ! তবে কিছু সময় আগের ঘটনা যা তিনি উপলব্ধি করে ছিলেন সে সব কিছুই কি শেষ ? তবে কি এ সব কিছুই ছিল অলীক-স্বপ্ন ? ভ্রম মাত্র ছিল ?

  ধরনের ঘটনার কোন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নেই। তবে হার্টফেল রোগীদের ক্ষেত্রে নাকি এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।  মানে, রোগী খানিক সময়ের জন্য মৃত্যু লোকে বিচরণ করে আবার ফিরে আসতে পারে।  

সমাপ্ত