তুষার
তুষারের কথা আজ এতদিন পরে হঠাৎ মনে হ’ল। কলেজ
জীবন বা চাকরীর প্রথম বন্ধনমুক্ত জীবনের কথা মনে হ’লে, যাদের ছবি চোখের সামনে ভাসে,
তুষার অবশ্যই তাদের একজন। কী আশ্চর্য ও বিচিত্র এক চরিত্র। তার জীবনের সব কিছুর মধ্যে
এক বৈচিত্র্য বিরাজ করে।
লেখাপড়া খুব একটা করে নি। বাবার একটা থিয়েট্রিকাল
স্টোর ছিল। সে আমলে উত্তর কলকাতার থিয়েটার হলগুলো এবং যাত্রা দলগুলোর খুব রমরমা বাজার
ছিল। আচ্ছা আচ্ছা থিয়েটার দল, কলকাতার নাম করা বড় বড় হলে, তাদের অনুষ্ঠানে ওদের দোকান
থেকে সাজপোষাক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই ভাড়া নিত। নাট্য জগতের প্রয়োজনীয় সব কিছুই
ওদের দোকানে পাওয়া যেত।
দোকানে ওর বাবা অথবা বড় দাদা-ই বেশীর ভাগ সময়
দেখাশোনা করতো। ও নিজে খুব কম সময় দোকানে বসতো। কিন্তু নাটকের দলগুলোর প্রয়োজনে তাকে
এ হল, ও হল, যেতেই হ’ত। ফলে ছোট বড় নানা অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, মেক-আপ ম্যান,
লাইট ম্যান ইত্যাদি ব্যক্তির সাথে, তার ছিল প্রত্যক্ষ পরিচয়। পরবর্তীকালে সে আমার অফিসেই
চাকরী পায়।
স্কুল কলেজ জীবনে প্রত্যেক যুবকের যেমন চায়ের
দোকান বা অন্য কোথাও আড্ডাস্থল থাকে, আমারও একটা ইলেকট্রিকাল স্টোরে আড্ডা দেবার স্বভাব
ছিল। দোকানটা ছিল তুষারের দোকানের বিপরীতে। ঐ দোকানে প্রতিদিন সকাল, বা কলেজ না থাকলে,
সন্ধ্যাবেলা আড্ডা দিতে যেতাম। আর সেই সুত্রেই তুষারের সাথে আলাপ। অদ্ভুত সব কথা বলতে
পারতো বলে, তাকে বেশ ভালো লাগতো।
একদিন কোন এক নাটকের দল, তাদের নাটকের প্রয়োজনীয়
সাজ সরঞ্জামের বড় একটি লিষ্ট্ তাদের দোকানে দিয়ে গেছে। সেদিন সন্ধ্যায় কোন হলে নাটক
মঞ্চস্থ হবে। সকালবেলা দোকানের এক কর্মচারী মালপত্র গোছাচ্ছে। তুষার দোকানের বাইরে
বেঞ্চে বসে, লিষ্ট্ নিয়ে একে একে দাগ দিয়ে দিয়ে মালপত্র বার করাচ্ছে। একটু পরে বেঞ্চের
ওপর লিষ্ট্ রেখে তুষার কোন প্রয়োজনে দোকানের ভিতর ঢুকেছে, আর সেই সুযোগে একটা কালো
গরু জিভ দিয়ে লিষ্টটা মুখে তুলে চিবতে চিবতে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। দোকানের
বাইরে এসে বেঞ্চে লিষ্ট্ না পেয়ে, তুষার খুব ঘাবড়ে যায়। তারপর গরুর মুখে ঝুলন্ত লিষ্ট্
দেখতে পেয়ে, দু’তিনজন গরুর পিছন পিছন ছুটে, ছুটন্ত গরুর মুখ থেকে ঝুলন্ত লিষ্ট্ উদ্ধার
করে। তবে লিষ্টটার অনেকটাই ততক্ষণে গরু হজম করে ফেলেছে। ব্যাপারটার গভীরতা বুঝে তুষারের
দাদা ও অন্যা্ন্য কর্মচারীরা তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। “গরু লিষ্ট্ খেয়ে নিলে,
আমি কী করবো”, বলে তুষার আমাদের আড্ডাস্থলে এসে বসলো। শেষ পর্যন্ত কী ভাবে এই বিপদ
থেকে মুক্তি পেল জানার সুযোগ হয় নি।
এ হেন তুষারের সাথে চাকরী পাওয়ার পর প্রথম
বাইরে যাবার সুযোগ হয়। বাইরে বলতে দীঘা। কিন্তু এখনকার দীঘার সাথে, তখনকার দীঘার কোন
মিল ছিল না। নতুন দীঘা, যাকে আমরা নিউ দীঘা বলি, তখন হয়তো কল্পনায় ছিল।
আমি, দীপুদা, মানে ইলেকট্রিক দোকানের মালিক,
মাধব, ও দি গ্রেট তুষার, একদিন দীঘা গিয়ে পৌঁছলাম। দোতলার ওপর একটা ভালো ঘর পাওয়া গেল।
রান্না করার ব্যবস্থাও আছে। কাজেই কোন অসুবিধা হবার কথা নয়।
প্রথম দিন স্নান সেরে একটা দোকানে গেলাম ভাত
খেতে। সেই সময় দীঘায় যাতায়াতের এত সুবিধা না থাকায়, হোটেলের সংখ্যা কম থাকায় এবং অসময়ে
যাবার জন্য পর্যটকের ভিড় খুব কম ছিল। একবারে ফাঁকা বললেই ঠিক বলা হয়। একটা ছোট হোটেলে,
মিল সিস্টেমে ভাত, ডাল, ভাজা, তরকারী ও মাছের জন্য দাম ঠিক করে খেতে বসলাম। তুষার যে
কত খেতে পারে, সে সম্বন্ধে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। দোকানদারের তো ছিলই না, তা না
হলে সে কখনই মিল সিস্টেমে আমাদের খেতে দিতে রাজী হ’ত না। তিনজনের খাবার তুষার একাই
স্বচ্ছন্দে খেয়ে নিয়ে, আবার ভাত চাইলো। আমরা অনেকক্ষণ খাওয়া শেষ করে, শুকনো এঁটো হাতে
বসে আছি। হোটেল মালিক জানালো ভাত বসানো হয়েছে, বসতে হবে। তুষার নির্লিপ্ত মুখে ভাতের
অপেক্ষায় বসে রইল। বাধ্য হয়ে আমরাও বসে থাকলাম।
যাহোক্, তুষারের ভাত খাওয়া শেষ হলে, রাতের
খাবারের প্রসঙ্গে আসা গেল। দোকানদার খুব একটা উৎসাহ দেখাল না। পরদিন দুপুরে মুরগীর
মাংস, ভাত পাওয়া যাবে কী না জিজ্ঞাসা করায়, জানা গেল আগে থেকে অর্ডার দিতে হবে। সত্তর
এর দশকে দীঘার অবস্থা এরকমই ছিল। সে সময় মুরগীর মাংস কিন্তু এখনকার মতো সহজ প্রা্প্য
ছিল না। মুরগীর মাংসের দামও, তুলনামুলক ভাবে অনেক বেশী ছিল। বড়লোকের খাদ্য বলা-ই বোধহয়
ঠিক হবে। শেষে রাতে রুটি তরকারী ও পরদিন দুপুরে মুরগীর মাংস ভাতের মৌখিক অর্ডার দিয়ে
আমরা ফিরে এলাম।
রাতে খেতে গিয়ে পরের দিনের খাবারের জন্য কিছু
অগ্রিম দেবার কথা বলায়, হোটেল মালিক জানালো—“আগ্রিমের প্রয়োজন নেই, কাল অবশ্যই আসবেন।
আপনাদের জন্য একটা আস্ত মুরগী রান্না করা থাকবে”।
পরদিন সকালে আমাদের সাথে কুন্ডুবাবুর দেখা
হয়ে গেল। এই কুন্ডুবাবুই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সব সময় ভদ্রলোকের হাতে
একটা লম্বা টর্চ থাকে। দু’চার কথার পর ভদ্রলোক, আমরা খাওয়া দাওয়ার কী ব্যবস্থা করছি
জিজ্ঞাসা করায়, কালকের ঘটনা বললাম। ভদ্রলোক বললেন, “আপনারা চারজন যুবক এসেছেন, ঝাড়া
হাত পা, হোটেলে খাচ্ছেন কেন? নিজেরা রান্নার ব্যবস্থা করে নিন। আমি স্টোভ, কেরোসিন
এনে দেবার ব্যবস্থা করছি। বাসনপত্র তো হলিডে হোমেই আছে”।
এতক্ষণে জানলাম বাড়িটা আসলে কোন অফিসের হলিডে
হোম। কোন পর্যটকের বুকিং না থাকায়, কেয়ার টেকার ও কুন্ডুবাবু গোপনে একটা ব্যবসা করে
ফেললেন। এখানে কুন্ডুবাবুর বিরাট পরিচিতি। যাহোক্, কুন্ডুবাবুর পরামর্শ মতো, আমরা ব্যাগ
নিয়ে বাজার করে নিয়ে আসলাম। ওদিকে বেচারা মুরগী বিনা কারণে এতক্ষণে বোধহয় প্রাণ দিয়ে
বসে আছে।
দীপুদাকে দেখলাম রান্না করতে খুব ভালোবাসে।
ভাত, ডাল, তরকারী, মাছ ও স্যালাডের ব্যবস্থা করার পর, একটা পায়েস জাতীয় মিষ্টি কিছু
করার জন্য ক্ষেপে গেল। অনেক কষ্টে তাকে নিবৃত্ত করে, আমরা চার মুর্তিমান সমুদ্রে স্নান
করতে গেলাম। যাবার পথে হোটেল মালিক জিজ্ঞাসা করলো— “কখন আসছেন?”
কিছু বোঝার আগেই তুষার জানালো স্নান সেরে খেতে
আসবে, গরম ভাতের ব্যবস্থা করতে।
দীর্ঘক্ষণ সমুদ্রে স্নান করে, হলিডে হোমে ফিরে
কলের জলে আর একবার স্নান করে, জামা কাপড় পাল্টে খাবার জন্য তৈরী হ’লাম। দোতলা বাড়ির
ওপর তলার একটা ঘরে আমরা আছি। সঙ্গে বাথরুম ও রান্নাঘর। গোটা বাড়িটাতে আর কেউ নেই। কাজের
মাসী ঘর পরিস্কার করে দিয়ে গেছে। আমরা চারজন একসাথে খেতে বসলাম। এই প্রথম দীপুদার রান্না
খেলাম। ধনেপাতার আধিক্য থাকলেও, মোটের ওপর রান্নাটা সে ভালোই করে। পেট ভরে খাবার পরও
দেখা গেল প্রচুর ভাত রয়েছে। চারজনের জন্য কতটা চাল নেওয়া প্রয়োজন, সে সম্বন্ধে দীপুদার
কোন ধারণা আছে বলে মনে হ’ল না। চারজনে যতটা ভাত খেয়েছি, প্রায় সমপরিমান ভাত তখনও হাঁড়িতে
রয়েছে। তুষারকে আজ বাধা দেবার কেউ না থাকায়, গতকালের থেকে অনেক বেশী ভাত খেয়ে, ক্লান্ত
হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। দীপুদা জিজ্ঞাসা করলো এত ভাত বেঁচেছে, কী করা যায়।
আমি বললাম “কাজের মাসীকে দিয়ে দাও, গরীব মানুষ।”
তুষার শুয়ে শুয়ে গর্জে উঠলো— “বাপের পকমিল
দেখেছো, না? মাসীকে ভাত দিলেই হ’ল”?
তাহলে অত ভাত নিয়ে কী হবে?
আমি খেয়ে নেব।
কাল দুপুর পর্যন্ত এই ভাত কখনও ভালো থাকে?
আমি এখনই খেয়ে নেব। পয়সা রোজগার করতে হয় না?
দেখলাম তুষার রাজনৈতিক নেতাদের মতো মুখে এক
বলে, কাজ করে আর এক জাতীয় চরিত্রের মানুষ নয়। খাট থেকে নেমে এসে, নতুন করে বেশ খানিকটা
ভাত নিয়ে, ডাল তরকারী দিয়ে খেতে বসে গেল।
বিকেল বেলা সমুদ্রের ধারে ঘুরে ফিরে ফেরার
পথে, হোটেল মালিকের সাথে দেখা হ’ল। কাউন্টারে বসে সে যে দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালো—
নেহাত কলি যুগ বলে আমাদের ভষ্ম করে ঋষি হবার সুযোগ থেকে সে বঞ্চিত হ’ল।
রাতেও দীপুদার কৃপায় খাবার ব্যবস্থা বেশ রাজকীয়-ই
হ’ল, এবং তিন-এক ভোটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল, যে সকালের ভাত কালকে মাসীকে দিয়ে দেওয়া
হবে।
পরদিন সমুদ্রে স্নান করছি, হঠাৎ দেখলাম কিছুটা
দুরে একটা জটলা। দীপুদা ধরেই নিল কেউ সমুদ্রে ডুবে গেছে, এবং সেইমতো আমাকে দুরে যেতে
বারণ করলো। অবশেষে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সিনেমার সুটিং হচ্ছে। জটলার কাছে গেলাম সুটিং
দেখতে। ভিড়ের কাছে গিয়ে অনেক বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীকেই দেখলাম। শুনলাম আগামীকাল
উত্তম কুমার আসবেন। ছবির নাম, থাক্ ছবির নামটা না হয় নাই বললাম। কারণ আমার নায়ক উত্তম
কুমার বা অন্য কেউ নন, আমার নায়ক শ্রীমান তুষার।
ভিড়ের মধ্যে থেকে হঠাৎ একজন চিৎকার করে তুষারকে
ডাকলো। দেখলাম এক যুবক এগিয়ে এসে তুষারের সাথে গল্প করতে শুরু করলো। ফিরে আসার সময়
তুষারের কাছে তার পরিচয় পেলাম। ধরা যাক তার নাম, অধম কুমার। সে নাটকে ছোটখাটো রোলে
অভিনয় করে। এই ছবিতে সে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছে।
পরদিন মাধব দোকান থেকে কী কিনতে গিয়ে ছুটতে
ছুটতে এসে খবর দিল— উত্তম কুমার এসেছেন, সুটিং হচ্ছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সুটিং দেখতে
যাবার জন্য তৈরী হলাম। দীপুদা যেতে রাজী হ’ল না। তার রান্নার কাজ অনেক পড়ে আছে। আমরা
তিনজন স্পটে গিয়ে খুব কাছ থেকে উত্তম কুমারকে দেখলাম। অনেকক্ষণ সুটিং দেখলাম। আর দেখলাম
সুটিং দলটার ব্যস্ততা ও গাড়ি নিয়ে ছোটাছুটি। দেখলাম না কেবল মহানায়ক অধম কুমারকে।
পরদিন সকালে অন্য একটা স্পটে আবার অনেকক্ষণ
সুটিং দেখলাম। আবার দেখলাম সুটিং এর ব্যস্ততা। বিকালে সমুদ্রের ধারে অধম কুমারের
সাথে দেখা হ’ল। তার বড় বড় কথা শুনতে শুনতে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। তাকে একটু
উৎসাহ দেবার চেষ্টাও করলাম।
আপনাদের জীবনটা কত সুন্দর। কতলোক আপনাদের ছবি,
আপনাদের অভিনয় দেখে। আপনি এ লাইনে এলেন কী ভাবে?
উত্তমদার ব্যাকিং এ।
আমারও খুব অভিনয় করার সখ। একটা ব্যবস্থা করে
দিন না। আপনি চেষ্টা করলে নিশ্চই পারবেন। একটু ব্যবস্থা করে দিন না প্লীজ্।
আসবেন না দাদা, একদম আসবেন না। হাড় ভাঙ্গা
খাটুনি। চব্বিশ ঘন্টা পরিশ্রম করতে হয়। আমাদের লাইনে চল্লিশ ঘন্টায় দিন হলে ভালো হ’ত।
ভালো পারিশ্রমিকও তো পান?
হ্যাঁ, তা তো দিতেই হবে। খালি পেটে তো আর অভিনয়
আসে না। তবে খাটুনির তুলনায় কিছুই দেয় না।
খাবার বা থাকার ব্যবস্থা নিশ্চই খুব ভালো?
ওটা ভালো দেয়। মিথ্যা বলবো না, সকাল বেলা ব্রেকফাষ্টে
মাছ, মাংস, ডিম যা চাইবেন তাই।
ব্রেকফাষ্টে মাছ, মাংস?
না না, ব্রেকফাষ্ট ঠিক নয়, মানে দুপুর বেলা।
কতক্ষণ কাজ করতে হয়?
ঐ যে বললাম, কাজের কী আর শেষ আছে? যখন ডাকবে
সঙ্গে থাকতে হবে, বড় পার্ট তো। আপনারা দশটা পাঁচটা করে অভ্যস্ত, আপনারা সুখে আছেন।
তুষার হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসলো, সে আমার পরিচয়
জানে কী না। অধম কুমার আমার পরিচয় জানেনা বলায়, তুষার আমাকে দেখিয়ে বললো, “এ একজন বিখ্যাত
ফটোগ্রাফার”।
আমার গলায় একটা ছোট, অতি সাধারণ কোডাক ক্যামেরা।
তাও আবার মাধব কার থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছে। ছবি তোলার অভ্যাস বা সুযোগ কোনটাই আমার নেই।
গতকাল সমুদ্রে স্নান করার সময় স্রোতের টানে ক্যামেরাটা সমুদ্রে চলে গেছিল। সেটাকে উদ্ধার
করে আনলেও, সেটা জলে ভিজে ঠিক মতো কাজ করছে না। শার্টার টিপলে ক্যামেরার লেন্সের মুখ
খুলে আর বন্ধ হচ্ছে না। চড়চাপড় মেরে কাজটা সারতে হচ্ছে। যথেষ্ট সন্দেহ আছে আদৌ ছবি
উঠবে কী না।
তাই নাকি? আপনি ফটোগ্রাফার? ভেরি গুড। খুব
ভালো হ’ল। আপনার সঙ্গে কী কী ক্যামেরা আছে?
দু’চারটে ক্যামেরার নাম শুনেছি। সেই মতো বললাম,
একটা ইয়াসিকা, একটা নিকন ম্যাট, আর এটা।
খুব ভালো, খুব ভালো। আপনাকে কিন্তু একটা উপকার
করতে হবে। উত্তমদার সাথে আমার একটা ছবি তুলে দিতে হবে। জাষ্ট্ একটা পাবলিসিটি আর কী।
একটা কাগজের সাথে জানাশোনা আছে, তাতে ছাপার ব্যবস্থা করে নেব। আপনারা চিন্তা করবেন
না, আপনাদের উত্তমদার অটোগ্রাফ ম্যানেজ করে দেব। উত্তমদার সাথে আপনাদের ছবিও তুলে দেবার
ব্যবস্থা করে দেব।
আমি একটু কিন্তু কিন্তু করতেই, সে জানালো আগামীকাল
সকালে সে আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। কোন অসুবিধা হবে না।
আমরা এগিয়ে গেলাম। সে আমাদের ফিল্মী কায়দায়
আঙ্গুল নেড়ে সী-ইউ গোছের কী একটা বললো। ব্যাপারটাকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে, ওকে নিয়ে
হাসাহাসি করতে করতে, বাসায় ফিরে এলাম।
পরদিন সকাল ন’টা-সাড়ে ন’টা নাগাদ দীপুদা রান্নার
জোগাড়ে ব্যষ্ত, মাধব আর আমি মাছ বেছে পরিস্কার করছি, হঠাৎ একটা চিৎকার— এই তু-উ-উ-ষা-আ-আ-র-র।
আবার সেই একই সুরে চিৎকার।
মাথা উচু করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি, মূর্তিমান
বিভীষিকা বেশ ড্রেস দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর কথা ভুলেই গেছিলাম। এবার আমার ভয়
পাওয়ার পালা। সত্যিই যদি সে আমাদের উত্তম কুমারের কাছে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে এই ক্যামেরায়
ছবি তুলতে গেলে মারধর না খেতে হয়।
দীপুদাকে বললাম বলে দাও আমরা বাড়ি নেই, বাজারে
গেছি। কিন্তু দীপুদা কিছু বলার আগেই, তুষার তাকে ওপরে এসে চা খেয়ে যেতে বললো।
নারে এখন হাতে একদম সময় নেই, ওকে পাঠিয়ে দে।
ফেরার সময় চা খেয়ে যাব। শুধু চায়ে হবে না, দুপুরে মাংস ভাতের ব্যবস্থা কর। কথাগুলো
বলতে বলতে, সে দোতলায় উঠে এল।
বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত হাত ধুয়ে, জামা প্যান্ট
পরে, অকেজো ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে তৈরী হ’লাম।
এটা না নিয়ে ভালো ক্যামেরাটা সঙ্গে নিয়ে নিন।
বুঝতেই পারছেন একটা পাবলিসিটির ব্যাপার, ছবিটা ভালো হওয়া প্রয়োজন। দাদার সাথে আপনাদের
ছবিটাও ভালো হ’লে, বড় করে বাঁধিয়ে রাখতে পারবেন। একটা স্মৃতি।
“বাবুরা অন্য ক্যামেরাগুলোর ফিল্ম্ শেষ করে
রেখেছেন। অনবরত ছবি তুলে বেড়াচ্ছে। আসলে প্রফেসনাল ফটোগ্রাফার তো, ছবি তোলাটাই নেশা”—
হাসিমুখে কথাগুলো বলে, তুষার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো।
শেষ পর্যন্ত মাধবকে নিয়ে, অধম কুমারের সাথে
চললাম, উত্তম কুমারের ছবি তুলতে। কী রকম একটা ভয় ভয় করতে লাগলো। সমুদ্রের ধারে গিয়ে
অধম বাবুর বন্ধুর সাথে দেখা হ’ল। যে ছবির সুটিং হচ্ছে, তার পরিচালক নাকি এই বন্ধুটির
কাকা। শুনলাম এই বন্ধুটিও নাকি এই ছবিতে অভিনয় করছে।
আপনাদের অভিনয় করতে দেখলাম না তো?
কেন? গতকাল গুরু যখন গাড়ি নিয়ে বাংলোতে ঢুকলেন,
তখন আমি এগিয়ে এসে প্রণাম করলাম, সে দৃশ্যটাই দেখেন নি?
বন্ধুটি বেশ জোর গলায় প্রতিবাদ করলো— “তুই
কোথায়? ঐ দৃশ্যে তো আমি প্রণাম করলাম”।
শেষে মোটামুটি এই সিদ্ধান্তে আসা গেল, যে তারা
দু’জনেই প্রণাম করেছে।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর। আরও অনেকের
সাথে, মাত্র দশ ফুট দুর থেকে গতকাল ঐ দৃশ্য দেখেছি, দু’জনের কাউকেই প্রণাম করতে দেখিনি।
এই ক’দিন সুটিং এর গাড়িগুলোকে অনবরত ছোটাছুটি
করতে দেখেছি। এক স্থান থেকে অপর স্থানে, এক স্পট্ থেকে অপর স্পটে, যাতায়াতে তারা সদাই
ব্যস্ত।
অধম কুমার জানালেন, উড়ি্য্যার বর্ডারে সুটিং
হচ্ছে। তিনি আরও জানালেন, চিন্তার কোন কারণ নেই, হাত দেখালেই সুটিং এর যে কোন গাড়ি
তাদের ও আমাদের লিফ্ট দেবে।
কিন্তু তার হাত দেখানো সত্বেও কোন গাড়ি না
দাঁড়ানোয়, আমরা হেঁটেই উড়িষ্যার বর্ডারে চললাম। বন্ধুটি কিন্তু বারবার তাকে সাবধান
করে অতদুর যেতে বারণ করতে লাগলো।
কাকা কিন্তু গতকালই সন্ধ্যায় তোকে হোটেল ছেড়ে
দিতে বলেছেন। গিয়ে কাজ নেই, ফিরে চল্। হোটেল ছেড়ে দিতে হবে।
একটু পরেই তো
ফিরে আসবো। জাষ্ট্
দু’টো ছবি তুলেই
ফিরে এসে লাগেজ
নিয়ে কলকাতায় ফিরে যাব।
এই ভাবে আমরা আরও অনেকক্ষণ হাঁটার পরও, কোথাও
কোন সুটিং হ’তে দেখলাম না। সম্ভবত এদের ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে।
শেষে বন্ধুর কথায়,
অধম কুমার আমাকে
বললেন— “দুঃখিত দাদা, আপনাকে
উত্তমদার সাথে ছবি
তুলে দিতে পারলাম
না, বা অটোগ্রাফ জোগাড় করে
দিতে পারলাম না”।
এমন ভাবে কথাগুলো
বললো, যেন আমরাই
তাকে আমাদের ছবি
তোলার জন্য নিয়ে
যাচ্ছি। একবার ভাবলাম
ওর একটা অটোগ্রাফ
চেয়ে দেখি কী
করে, কিন্তু অযথা আর সময় নষ্ট
করতে ইচ্ছা করলো
না।
যাহোক, ওরা ফিরে
গেল। আমরা আরও
কিছুক্ষণ সমুদ্রের ধারে ঘোরাফেরা
করে, অনেকটা পথ হেঁটে,
ঘেমেনেয়ে বাসায় ফিরলাম।
তুষার সব শুনে
বললো “ও থিয়েটারে
ছোটখাটো অভিনয় করে।
বোধহয় এই ছবিতে
কাউকে ধরে মৃত
সৈনিকের অভিনয় করার
সুযোগ পেয়েছে।
তাই যদি জানিস তো ওকে উসকে আমাকে বিপদে
ফেললি কেন?
আরে ও তো চিরকালের মুরগী। ওকে
মুরগী করাতে কত
আনন্দ, তোরা বুঝবি
কী?
এই হল শ্রীমান
তুষার। কত অদ্ভুত
সব মানুষের সাথে যে
ওর পরিচয়, ভাবলেও
অবাক হতে হয়।
(শেষাংশ আগামী সংখ্যায় )