গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১১ মে, ২০১৬

মিলন বনিক



কালি

রসহরির বউয়ের হাতে যশ আছে।
রাণীহাটের ছোট্ট ঝুপড়িতে রসহরির চায়ের দোকান। ওর দোকানের পিঁয়াজু একবার যে খেয়েছে তাকে স্বীকার করতেই হবে। পিয়াঁজু বানানোর কায়দা কানুন, মাল মসল্লা, ভালোই জানে রসহরির বউ। শীল পাটায় খেসারী ডাল বেটে সাথে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, হিলিঞ্চা শাক, ধনে পাতা, কুচি কুচি করে কেটে, আদা লবণ মেখে শুধু গামলাটা রসহরির হাতে দেয়। রসহরি পিঁয়াজু গরম গরম ভেঁজে দেয়। ভাঁজা পিঁয়াজু থালিতে নামানোর সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যায়।
  
রসহরির দোকানটা রাণীহাটের পশ্চিম কোণায়। দোকানের পেছনেই সরু রাণীখাল। অমিতাভ স্কুলের সাঁকো পার হয়ে কিছুদুর গিয়েই লিক লিক করে কিছু শাখা প্রশাখা ধানি জমিতে ঢুকে গেছে। রাণীখালটাও শেষ সীমারেখা টেনে দিয়েছে ওখানেই। তবে বাজার পর্যন্ত এই খাল দিয়ে বড় বড় নৌকা সাম্পান চলে। চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে মুদি দোকানের সবরকম মালপত্র আসে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে আনতে গেলে অনেক খরচ। তাতে দোকানদাররা কুলিয়ে উঠতে পারে না।

বাজারে নৌকা ভিড়লে একমাত্র কুলি অনন্তর ডাক পড়ে। আগে রসহরি নিজেই কুলির কাজ করত। বউকে দোকানে বসিয়ে মালপত্র নামিয়ে দিত। তাতে বাড়তি কিছু আয় হতো। স্বামী স্ত্রী দুজনের কোন রকমে চলে যেতো দিন। এখন শরীরে কুলোয় না। বয়সের ভারে ন্যুজ। কোনরকমে টেনেটুনে দোকানটা চালিয়ে নিচ্ছে। রসহরির বউ চারুবালা আছে বলে রক্ষে। দোকানের পেছনেই বুড়ো বুড়ি দু’জনের সংসার। একসময় নিজের ভিঠে ছিল। ছিল ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। এখন ভিটে বাড়ি বলতে কিছু নেই।
   
যুদ্ধের পাঁচ বছরের মাথায় জ্যেঠতুতো ভাই সুরেন্দ্র মাঝি এল বাড়িতে। বেশিদিন থাকেনি। কয়েকদিন এ গ্রাম ও-গ্রাম দৌড়াদৌড়ি করে জায়গা সম্পত্তি সব বুঝিয়ে দিয়ে গেল নালিতাপুরের আলম শেখের কাছে। আলম শেখ দখল নেওয়ার পর রসহরির ভিটের সীমানা আরও ছোট হয়ে এলো। বলল, কাগজে কলমে এ সম্পত্তি আমার। রসহরি নিরীহ মানুষ। জায়গা সম্পত্তির হিসাব নিকাশ বোঝে না। স্কুলের প্রভাত মাস্টার বলল, কী আর করবি? তোর ভাই-ই তোর পায়ে কুড়ালটা মারল। যা আছে তা নগদ কিছু পেলে শেখের কাছে বেঁচে দে, নয়তো পরে ওইটুকুও ছাড়তে হবে। তখন রাস্তায় বসা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। মাস্টারের কথাটা রসহরির মনে ধরেছে। শিক্ষকরা জ্ঞানী মানুষ। তারা ভবিষ্যত বলতে পারে। সেই থেকে এই রাণীহাটের পরিত্যক্ত একটা দোকানে ঠাঁই হয়েছে। যে টাকা পেয়েছে তা দিয়ে দোকানের সদাইপত্র কিনেছে।

স্কুল থেকে ফেরার পথে একদল ছেলে এসে বলল, ও দাদু, কুড়ি টাকার পিঁয়াজু দাও না গো। প্লেটে কয়েকটা পিঁয়াজু এখনও আছে। তবে কুড়ি টাকার হবে না। গরম গরম ভেঁজে দিতে হবে। যুদ্ধের পর পর এক টাকার কুড়িটা বিক্রি হতো। এখন কুড়ি টাকায় দশটা। কালো ছিপছিপি শরীর। হাতে লাঠি না থাকলেও অনেকটা ধনুকের মতো বেঁকে গেছে রসহরির শরীরটা। পরনে ময়লা ধুতিটা ন্যাংটির মত কোনরকমে কোমরে প্যাঁচিয়ে আছে।
 
একদল মুক্তিযোদ্ধারা যেদিন লাল সবুজের চাদর মুড়িয়ে অমিতাভ স্কুলের ক্যাম্প থেকে চারুবালাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসল সেদিন চারুর কোন জ্ঞান ছিলনা। গায়ে ছিলনা কোন কাপড়। এখানে ওখানে সব ক’টা জানোয়ারের নিথর দেহ পড়ে ছিল। সেদিনই এই উদয়পুরে নতুন সূর্য উঠেছিল। শত্রুমুক্ত হয়েছিল। মতি মিয়ার গলাকাটা লাশ পাওয়া গিয়েছিল অমিতাভ স্কুলের সাঁকোর নীচে। গলায় প্যাঁচানো ছিল একটা লাল বেনারসী। 

রসহরি ভিতরের দিকে মুখ করে গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকল, ও কালির মা, কই গেলি? এই যে দাদু সোনারা আইছে। অল্প পিঁয়াজুর কাঁই দিয়া যা, গরম গরম ভাইজা দিই। কালির মা পেছনের দরজা দিয়ে নদীর পানি আনতে গেছে। একটু পরেই ফিরে আসে। পরনে সবুজ পাড়ের সাদা শাড়ি। এখন আর সাদা বলে মনে হয় না। তেল ছিটছিটে ময়লায় ধূসর হয়ে গেছে। বুকে কাপড়ের আঁচলাটা কোনরকমে দড়ির মতো প্যাঁচিয়ে আছে। মাই দুটো ঝুলছে। শীর্ণ শরীর। গায়ের রং শ্যামলা। সাদা চুল। সাদা চুলের মাঝখানে সিঁথিতে এক দলা সিঁদুর। জ্বল জ্বল করছে। এখনও বেঁচে আছে স্বামীর সংসারে। এয়োস্তির চিহ্নটুকু সযতেœ ধারণ করে রাখে। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা মা দূর্গার কাছে মিনতি করে, হে জগততারিনী, এই মানুষটার হাতে যেন আমার মরণ হয়
এর মধ্যে উনুনটা ফুঁ দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে রসহরি। বেঁকে যাওয়া চিটচিটে কালো কড়াইয়ের মধ্যে তেলগুলো ফুটছে। চারুবালা পেছন থেকে কাঁই ভর্তি গামলাটা দিয়ে বলল, ঘরেই ত আছিল। হাত টাইনা নিলেই পারতা। পোলাগুলান খামাকা দাড়াই আছে। দাও দাও, তাড়াতাড়ি ভাইজা দাও।
পিঁয়াজুর সাথে একটা টিনের কাতিতে মুড়ি থাকে। আর একটা বৈয়ামে ক’টা টোষ্ট বিস্কুট। আছে পাঁচ ছয়টা কাপ। কোনটার হাতল ভাঙ্গা, কোনটার কাঁছা ভাঙ্গা। প্রায়ই ময়লা হয়ে থাকে। গ্রামের কিছু বাঁধা কাস্টমার আছে। তারা অন্য কোন দোকানে যায় না। রোজ আধা সের গরুর দুধ রোজ নেয় চানু গোয়ালার কাছ থেকে। তাতে কিছু পানি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে ঘন করে এখনও গরুর দুধের চা বানায়। মানুষও জানে খাঁটি গরুর দুধের চা এখনও বাজারে আছে। সেটা রসহরির দোকানে। দিনশেষে কিছু দুধ থেকে গেলে তাতে আবারও পানি মিশিয়ে  দু’জনে গরম ভাত মেখে খেয়ে নেয়।
 
রাণীখালটা পশ্চিমে বেঁকে গিয়ে উদয়পুর আর নালিতাপুরকে আলাদা করে রেখেছে। উদয়পুর সীমানায় রাণীখালের কোলঘেষে ছিল রসহরির একটুকরো ভিটে। পাশাপাশি জেঠতুতো ভাই সুরেন্দ্র মাঝির কিছু জায়গা জমি ছিল। এই কালিকে রেখে চরম দুর্দিনেও রসহরির কোথাও যাওয়া হয়নি। কোথায় আর যাবে? কালিকে কার কাছে রেখে যাবে? কে দেখবে কালিকে? বিক্রির কথা বললে রসহরি দুঃখ করে বলত, আমার বংশে তো বাত্তি জ্বালাবার কেউ নাই। আছে তো একমাত্র কালি। ওরেও যদি বেঁচে দিই তাইলে আমরা বাঁচবো কেমনে? একই কথা বলত চারুবালাও। কেউ কি নিজের পোলারে বিক্রি করে? কালি না থাকলে আমাদের বাইচা থেকে লাভ কী? কোথাও যাব না। এই কালিরে রাইখা কোথাও যাব না। এই দেশেই থাকবো।

বিয়ের সময় বার তের বছরের কিশোরী ছিল চারুবালা। জমি জিরাত না থাকলেও, শক্ত সোমত্ত জোয়ান খেটে খাওয়া মরদ দেখে চারুর মা-বাবা বিয়েতে না করেনি। অথচ বিয়ের দশ বছরের মাথায়ও কোন ছেলে পুলে না হওয়াতে দুজনেই সন্তানের আশা ত্যাগ করেছে। বিয়ের বছর খানেক পর ক’টা টাকা হাতে আসলেই কোনদিন বুড়াকালির মন্দিরে, কোনদিন মা শীতলার মন্দিরে, কোনদিন সত্য পীরের মাজারে গিয়ে মানত করে আসত। তখন মনের আনন্দে ঘরের দাওয়ায় বসে শুধু রাতের আকাশ দেখত রসহরি। আকাশ ভরা তারার মেলা দেখত। এক দুই করে কয়েকটা তারা গুনতে চেষ্টা করত। আবার পরে হাসি দিয়ে বলে উঠত, মানুষের কী সাধ্য, ভগবানের লীলা বুঝে? চারুবালা তামাক সাজিয়ে দিয়ে পাশে বসে নিজের অক্ষমতার কথা অকপটে স্বীকার করে বলত, আমি তো ভাঁজা, তোমারে কিছুই দিতে পারি নাই। তুমি আর একখান বিয়া কর।
রসহরি আকাশ দেখিয়ে বলত, আকাশটা যেমন সোন্দর, চাঁদটা আরও বেশি সোন্দর। কাঁচির মতন একফালি বাঁকা চাঁদ পুরা আকাশটারে কী সোন্দর কইরা আলো দিতাছে। সবকিছুই কেমন ফকফকা। ভগবানের দুনিয়ায় কোনকিছুই লুকানোর নাই। যার কপালে যা লেখা আছে, তাই হবে।

একদিন সমস্ত মানত সির্নি বন্ধ করে দিল। গায়ে গতরে খেটেখুটে ক’টা টাকা যখন হাতে এলো, মুন্সিবাড়ি থেকে একটা কালো কারুল গরুর বাচ্চা এনে চারুর হাতে দিয়ে বলল, এই ল, আইজ থেইকা এইটাই আমাগো পোলা। দু’জনে মিলে নাম রাখলো কালি। সেদিনের সেই রাতের আকাশটা আজও ভাবিয়ে তুলে রসহরিকে। এত সুন্দর আকাশ জীবনে আর কখনও দেখা হয়নি।
শীত কাল। ছোট্ট কালির সারা গায়ে গরম চটের ছালা জড়িয়ে দুইজন দুপাশে বসে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে সংসারের কথাবার্তা। দশ বছর ধরে যে কষ্ট সারাদিন বুকের ভিতর হু হু করত, আজ তার লেশমাত্রও নেই। একটা সন্তান যেমন পরিবারের বন্ধনটাকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে, কালিও তাই করেছিল। ভগবানের উপর তো হাত নাই। এই কালিকে আশ্রয় করেই এতদিনের অপূর্ণতাকে জয় করতে পেরেছে দু’জনেই। সারারাত জুড়ে ছিল সুন্দর সব স্বপ্নের হাতছানি।   
এখন আর কষ্ট নেই। সারাদিন খাটাখাটুনি করে রসহরি যখন ঘরে ফিরে দেখে চারু কালির গলা জড়িয়ে ধরে মন্ড খাওয়াচ্ছে। রসহরি অবাক হয়ে কালি আর চারুর দিকে তাকিয়ে থাকে। রসহরির চোখ জলে ছলছল করে। কালি তাকিয়ে থাকে রসহরির দিকে। কথা বলে রসহরি। সুখ দুঃখের কথা। রসহরি কালির গলা টেনে নিজের পাশে বসায়। কালির গলার নরম তুলতুলে ধলধলিতে হাত বুলাতে বুলাতে রাতের আকাশ দেখে। সময় কেটে যায়। নিত্য একই আকাশ দেখে রসহরি। তবুও দেখার তৃষ্ণা মেটে না। কালিটাও অল্পকয়েক মাসে গায়ে গতরে বেশ নাদুস নুদুস হয়েছে। গায়ের রংটা কালো। একেবারে টান টান শরীর।
আজ  নৌকা থেকে মাল খালাস করতে গিয়ে মুদি দোকানদার রেবতী মহাজনের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে রসহরির। রসহরির তেজ দেখে মহাজন বলে কিনা-
ব্যাটা মরদ! ল্যাজ নাই কুত্তা, বাইগ্গ্যা নাম। আর্মি মেলিটারির সাথে হে করবে লড়ায়, কেমন মরদ আমার!
মরদ না মর্দি, আসুক না। দেখামু। তয় মহাজন, তোমার মত লেজ গুটাইয়া ভয়ে পালাব না। মরলে বাঘের মতই মরব।
ওরে আমার বাঘরে, চাল নাই চুলা নাই, আমারে জ্ঞান দ্যাছ। সারা গ্রামে দেখ কয়ডা মানুষ আছে। সবাইতো পালাইছে। আমিও ব্যবসা বন্ধ করে দিলে যারা আছে তারা খাইবো কী?
ব্যাবসা বাণিজ্য বন্ধ করে ওই পারে চলে যাও। আমি আর কালিরে রেখে কই যামু? পাশে সুরুদা আছিল, তারাও সবাই চলে গেল।
দ্যাখ, সবসময় সাবধানে থাকবি। তেমন কিছু আঁচ পাইলে সরে পড়বি।
মহাজনের কথাটা রসহরির ভালো লেগেছে। ভাবল, মহাজন ঠিকই বলেছে। সারাগ্রামে নারী-পুরুষ মিলে শ’খানেক হবে না। এদের কোথাও যাবার জায়গা নাই। ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে, যার যেটুকু সম্বল তার জন্যই চোখ বুজে থেকে যাওয়া। সবকিছু ভগবানের উপর ছেড়ে দিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না কেউ। সন্ধ্যা নামলেই কুপি নিভিয়ে ইষ্টনাম জপতে থাকে সবাই। কয়েকজন মিলে রাত জেগে পাহারা বসিয়েছে। যাতে বিপদ আসলে আগে ভাগে সাবধান হতে পারে। রসহরিও সেই পাহারায় সামিল হয়। বাড়ি থেকে বের হয়ে সরু রাস্তার মাথায় বসলে ইউনিয়নের প্রধান সড়কের মোড়টা দেখা যায়। মোড়েই বটগাছের নীচে ছোট্ট একটা মগধেশ্বরী মন্দির। ডালপালায় ছেয়ে আছে মন্দিরটা। বাড়ির পিছনে খালি একটু জায়গা। ওখানে বসে নদীর পাড়টা স্পষ্ট দেখা যায়।
কেন যে পোড়ামুখীটা এই বেহান বেলা কালিরে নিয়া নদীর পাড়ে গেছিল। রসহরি আজও ভেবে পায় না। অবশ্য সকালে উঠে চারুবালাই তো কালির দেখাশুনা করে। গোয়াল থেকে কালিকে বের করে। মাথায় গলায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে, রাতে কষ্ট হয়েছে কি না? ঠান্ডা লেগেছে কি না? কালি মাথা নাড়ে। বাইরে কাঁঠাল গাছের সাথে বেঁধে গোয়াল ঘর পরিষ্কার করে। হাঁস মুরগীগুলো ছেড়ে দিয়ে নদীর পাড়ে কালিকে বেঁধে দিয়ে আসে। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।
মিজ্জি আযানের পর পাহারা শেষ করে ঘুমাতে গেছে রসহরি। সারা শরীর ক্লান্ত। দু’চোখ ভরে কেবল ঘুম আর ঘুম। শীত আসি আসি করছে। সকালের কুয়াশা সারাগ্রাম আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ভোরের সুর্য মাথা তুললেও পৃথিবীতে তার রেশ পড়েনি। নদীর পাড় থেকে রসহরির ঘরটাও ঝাপসা দেখাচ্ছে। এই  ভোরবেলা কালিকে খুটি বেঁধে কিছুক্ষণ আদর করল চারুবালা। ঘরে খাওয়ার কিছু নেই। তাই নদীর পাড় থেকে ক’টা কচুর ডগা, কলমির ডগা, হিলিঞ্চা শাক তুলে শাড়ির আঁচলে কুড়িয়ে নিচ্ছিল।
বড় নৌকাটা নদীর কোল ঘেষে একবারে কাছাকাছি ভীড়তেই চারুর খেয়াল হল, সর্ব্বনাশ হয়ে গেছে। পালিয়ে বাঁচারও সুযোগ নাই। বন্দুক তাক্ করে রেখেছে। মুহূর্তেই কয়েকজন সৈন্য দ্রুত লাফিয়ে নামল। চারুকে পাঁজাকোলে করে উঠিয়ে নিল নৌকায়। এমন চকচকে টান টান শরীর দেখে একজন অফিসার বার বার কুকুরের মত জিব চাটছিল। তা দেখে চারুবালার ঘেন্নায় গা গিনগিন করছে। একজন বলে উঠল, ইয়েতো হিন্দু লেড়কী, সাচ্ছা মাল হে। ক্যাম্পে চলো। চারুবালার এ ভাষা বোঝার কথা না। যে সৈন্যটা চারুর বুকে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে হঠাৎ তার দিকে ঘুরে মুখে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল।
সুর্য উঠতে যেন আরও কতকাল বাকী। রসহরির সাথে কালিটাও এবার একা হয়ে গেল। রসহরি বেশিরভাগ সময় রানীহাটে নদীর ঘাটটায় বসে থাকে। মনে মনে একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। চারুবালা যে ক্যাম্পে কীভাবে আছে তা মতি মিয়া বাজারে বলে বেড়াচ্ছে। মতি মিয়ার বিশেষ পারমিশান আছে ক্যাম্পে যাওয়ার। মতি মিয়াও জানে রসহরি হইলো টুটো জগন্নাথ। লেজ নাই কুত্তা বাঘাইয়া নাম। আশে পাশেও কেউ নাই যে, রসহরির সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসবে। মতি মিয়া বাজারে আসলে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে, পারলে তোর বউয়ের জন্য একখান কাপড় কিনে দে। আমি দিয়া আসুমনে। রসহরি মতি মিয়ার কথা বিশ্বাস করে। ঘর থেকে বিয়ের লাল বেনারসিটা নিয়ে সারাক্ষণ সাথে সাথে রাখে। কিন্তু মতিকে দেয় না।
     
ক’দিন ধরে কালি অস্বাভাবিক রকম ডাকছে। ডাক শুনে রসহরির বুঝতে কষ্ট হয় না। কালি সাবালক হয়েছে। পাল দিতে হবে। এ পাড়ায় পাল দেওয়ার মত তেজী ষাঁড় নাই। নালিতাপুরের সৈয়দ মুন্সীর পালের ষাঁড়টার তেজ বেশি। তেজী ষাঁড় হলে বাইচ্চাটাও হৃষ্টপুষ্ট হবে। ওখানেই নিয়ে যেতে হবে। চারু থাকলে দু’জনেই খুশি হতে পারতো। এবার নাতি-পুতির মুখ দেখবে বলে মনে আনন্দ পেতো। রসহরির মনটাও ভালো নেই।
 
সৈয়দ মুন্সী উঠানে বসে বেতের কাজ করছিল। হাতে বেত তোলার ধারালো দা। দাও’টা পাশে রেখে গোয়াল থেকে ষাঁড়টা বের করে আনল। কালিকে পাল দিতে গিয়ে সৈয়দ মুন্সীর কথা শুনে রসহরির কপালে ভাঁজ পড়ল। পাল দেওয়ার জন্য ষাঁড়টাকে রাগী করে তুলতে কিছু সময় লাগে। কালিকে বেঁধে রাখা হয়েছে ষাড়ের সামনে। ষাঁড়টাও একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কোন উত্তেজনা নেই। ঐ সময়টাতে সৈয়দ মুন্সী রসহরিকে কথাটা বলল-
কী যে হবে? এই অসময়ে তোর কালিটা ডাক দিলো।
ক্যান চাচা, কী হইছে? অসময় কইতাছ ক্যান? আমার কালির কী হইবো?
বলছি, দেখার তো কেউ নাই। তোর বউয়ের কোন খবর পেলি? 
না চাচা, শুধু মতি মিয়া কইতেছে একখান শাড়ি দিতে। বউটা তো এক কাপড়েই ছিল, মনে হয় অসুবিধা হইতেছে।
চ্যাটাং করে হাতের হুকোটা মাটিতে রেখে লাফ দিয়ে উঠল সৈয়দ মুন্সী। রাগে সারা শরীর কাঁপছে। লুঙ্গির কোঁচা শক্ত করে বেঁধে বলল,
ঐ মইত্যা খানকীর পুত দেশটারে গিলে খাইলো। যত সর্ব্বোনাশের মূল ঐ জানোয়ারটা। শুধু তোর বউ ক্যান, আরও কত মায়ার যে সর্বনাশ করছে, এইতো সেদিন মনু দফাদারের জোয়ান মেয়েটাকে তুলে নিয়ে পাকি কুত্তাগুলোর ডেরায় তুলে দিলো। তার অপরাধ, দফাদারের পোলা নাকি মুক্তির লোক।
তো এই খবর মতি জানলো ক্যামনে?
জানবো আবার ক্যামনে? তার ক’দিন আগেই তো দফাদারের সাথে মইত্যার কথা কাটাকাটি হইলো। মইত্যা কয়, এটা হিন্দু মুসলমানের যুদ্ধ। পেয়ারের পাকিস্তানরে আলাদা করার দরকার কী? দফাদারও ছাইড়া কথা কয় নাই। তার জন্যই তো এই কাজটা করলো।
ভাদ্র মাসের কাঠফাটা তাতানো রোদ। পিটে আগুনের আঁচ লাগছে। মনে হচ্ছে আগুনের হলকা। উঠানের মধ্যেই একটা নেড়ী কুত্তাকে কয়েকটা মদ্দা কুকুর তাড়া করছে। পেছন পেছন ছুটছে। মাঝে মধ্যে নেড়ী কুত্তাটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠে। কুত্তাগুলো একটু পেছনে সরে আসে। আবার পিছু নেয়। মুন্সীর ষাঁড়টাও হঠাৎ তেজী হয়ে উঠে। মনে হয় রাগ উঠেছে। কালির পেছনে এসে ফোঁস ফোঁস করছে।
রসহরির মাথা ঘুরছে ভনভন করে। কালির পালটা হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারতো। হঠাৎ চারুবালার কথা মনে হয়। ক্যাম্পে কী অবস্থায় আছে কে জানে? আর কিছু ভাবতে পারে না। রসহরির চোখের সামনে ভেসে উঠলো একপাল বন্য জন্তু জানোয়ার। তারা নিলর্জ্জভাবে কালির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কালিকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। এদিকে অসহায় নেড়ী কুত্তিটার উপর হামলে পড়েছে একদল হিংস্র হায়েনা। কালি আর নেড়ী কুত্তিটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। সারা শরীর হিংস্র হায়েনা আর বন্য জানোয়ারের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত।
চোখের সামনে মুন্সীর রোদে পোড়া দাওটা জ্বলজ্বল করছে। রসহরির শরীরে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। খুব দ্রুত দাটা হাতে নিয়ে ঘ্যাচাং করে খুটির সাথে বাঁধা কালির দড়িটা কেটে দিল। ছাড়া পেয়ে মুক্তির আনন্দে ছুটছে কালি। পেছন পেছন ছুটছে উত্তেজিত ষাঁড়টা। উম্মাদের মত হাতে দাও নিয়ে দৌড়াচ্ছে রসহরি।