
সহযাত্রী
ছোট বড়
পাথর ছড়ানো এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি পথটা বেয়ে তরতরিয়ে নেমে আসছিল অতীশ।
অতীশ, মানে ডাক্তার অতীশ দীপঙ্কর চৌধুরী মাস কয়েক হল এই ছোট্ট পাহাড়ি টাউনের হসপিটালটায় এসেছে চাকরি নিয়ে। নামেই হসপিটাল, আদতে
একটা গ্রামের হেলথ সেন্টারের থেকে খুব উচ্চমানের কিছু বলা যাবে না একে। খানিকটা জেদের বশেই আসা। ডাক্তারি ডিগ্রী পাবার আগে এক, আর পরে এক- ভাল রেজাল্ট করে ডিগ্রী নিয়ে ডাক্তাররা কেউ শহর ছেড়ে যায় না, এটা যে ভুল, নিজেকে
দিয়ে সেটা প্রমাণ করে দিতে চায় অতীশ। অন্তত দুটো বছর এখানে কাজ করতে চায়। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে
আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু, খাড়া-ঢালু পথ চলে গেছে বহুদূর, কাছাকাছি
বড় শহরটার দিকে। পাহাড়ে পিঠ দিয়ে ছোট্ট টাউনটা পুরোনো-নতুনের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। পাহাড়ি মানুষই বেশি। সহজ সরল জীবন তাদের। কিছু কিছু শহুরে বিত্তবান মানুষও স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায় বাড়ি করেছেন। মাঝে মাঝে এসে থাকেন। একটা দুটো হোটেলও আছে। একেবারেই সাধারণ। অতীশের সামাজিক ক্লাসের সঙ্গে একেবারেই মেলে না পুরো ব্যাপারটা, কিন্তু
ওই যে! তার জেদ! তাই দুটো বছর কাটাতেই হবে এখানে।
দুপুরবেলা খুব
একটা চাপ থাকে না। অনেকসময় তাই অতীশ পাহাড়ে হাঁটতে যায়। প্রথমে হাঁটা, তারপর
স্পীড বাড়িয়ে জগিং। নিজেকে ফিট রাখার জন্যে। খাড়া এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি পথ বেয়ে কিছুটা ওঠা আবার নেমে আসা। এরকমই কয়েকবার। আজও দ্বিতীয়বার নামছিল যখন, দেখতে
পেল সিংজী সেদিকেই আসছে। তার কাছেই নাকি? একটু
স্পীড বাড়াল অতীশ। পাথুরে জমিতে বয়ে চলা তিরতিরে জলের ধারাটা যেখানে বাঁদিকে ঘুরে গেছে, সেই
মুখটায় এসে দেখা হয়ে গেল।
‘জলদি
চলিয়ে ডাগদার সাব, এক পেশেন্ট হ্যায়। হাথমে চোট, বহতসি
খুন নিকাল গয়া।’
যা বোঝা
গেল, নার্স
দিদিরা চান অতীশ একবার দেখুক। হয়তো ওষুধপত্রও দিতে হবে। নাহলে এসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক ব্যাপারটা ওঁরাই সামলে নিতে পারেন।
বয়স্ক মানুষ, বছর সত্তর বা কাছাকাছি। ধারাল ছুরিতে কেটে গেছে গভীর হয়ে।
যা যা
করতে হবে নার্সদের বলে দিয়ে নিজের ঘরে এসে অপেক্ষা করছিল অতীশ। একটু কুন্ঠা নিয়ে ঢুকলেন ভদ্রলোক।
“দুটো
ওষুধ লিখে দিলাম। একটা এখানেই পেয়ে যাবেন। খেয়ে নিন। আর একটু অপেক্ষা করে যান। সুগার আছে তো, ব্লিডিং
বন্ধ হতে দেরি হচ্ছিল। পুরোপুরি যে থেমেছে, বুঝে
নেয়া দরকার।”
“অসাবধানে
এমন কেটে গেল”
একটু ইতস্তত
করেন ভদ্রলোক।
“বলছি
কি, বেশ
খানিকক্ষণ হল এসেছি। আর ইয়ে, মানে, এখন তো আর রক্ত বেরোচ্ছে না। এবার মনে হয় যেতে পারব।”
“আপনি
যেতে পারলেও আমি বলছি আর একটু থেকে যান।”
“না
মানে…”
ঘড়ির দিকে
একবার তাকালেন ভদ্রলোক। একটু অস্থির ভাব মুখে চোখে। অতীশের চোখ এড়াল না। এই এক মুশকিল! অসুবিধেয়
পড়লে ডাক্তারের কাছে আসবে। কিন্তু একটু সামলে উঠলেই নিজেরাই সব ডিসাইড করতে থাকবে। প্রায়ই এটা দেখে দেখে এতদিনে গা-সওয়া
হয়ে যাবার কথা অতীশের। তবু কথা না বলে পারে না।
“কী
ব্যাপার বলুন তো? আপনার
ভালোর জন্যেই বলছি তো! এত
তাড়া কীসের? কাজ
আছে অনেক?”
একটু হাসার
চেষ্টা করলেন ভদ্রলোক।
“আমার
আবার কী কাজ! রিটায়ার্ড
মানুষ…”
“তাহলে? যান, ওরা
ওষুধটা দিয়ে দেবে। খেয়ে, আধঘন্টা
বসে, তারপর
যাবেন।”
আসলে…আসলে আমার স্ত্রী অপেক্ষা করে থাকবেন…”
“একা
আছেন বাড়িতে?”
“না
না, কাজের
মেয়ে আছে একটি। সেজন্যে নয়। প্রায়
চারটে হয়ে এল তো। এই বিকেলবেলার চা-টা আমরা একসঙ্গে খাই। অনেক বছরের অভ্যেস...”
উফ! একদিন
বিকেলে চা খেতে দেরি হলে বা একসঙ্গে খাওয়া না হলে কি পৃথিবী রসাতলে যাবে! অসন্তুষ্টিটা চাপতে পারল না অতীশ।
“আপনার
দেরি হলে কি উনি খুব বিরক্ত হবেন? রেগে
যাবেন?”
একটা দীর্ঘশ্বাস
চাপার চেষ্টা করেন ভদ্রলোক। একটু থেমে থেমে বললেন,
“নাহ!
সেসব কিছুই হবে না। সেরকম কোন চান্সই নেই। আসলে... ও তো জানেই
না আমি কে...”
“তার...
মানে?”
“অ্যালঝাইমার।
চিনতে পারে না আমাকে। অনেকদিন।”
এরকম উত্তরের
জন্যে তৈরি ছিল না। একটু থমকে গেল অতীশ। তারপর প্রশ্নটা আচমকাই বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।
“আপনার
স্ত্রী জানেন না আপনি কে! তবু একটুও দেরি করা যাবে না একদিনও?”
অতীশের দিকে
একবার তাকালেন ভদ্রলোক। এক চিলতে ম্লান হাসি মুখে। চেয়ারটা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন,
“ঠিকই।
ও জানে না আমি কে। কিন্তু ডাক্তারবাবু, আমি
তো জানি, ও
আমার কে...।”
হতবাক অতীশকে
হাত তুলে নমস্কার করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন।