গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

দেবাশিস সেনগুপ্ত




গাছমানুষ
 
হরিসাধনবাবুর ধ্যানজ্ঞান তাঁর একচিলতে বাগানখানা। পুরোনো রঙচটা বাড়িটার চারপাশ ঘিরে আছে ঐ বাগানটুকু শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা,বারোমাস ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে এককাপ চা খেয়েই,লাঠি ঠুক ঠুক করে তিনি বাগানে এসে পড়েন। এই বিরাশিতেও কামাই হয় না একদিনও। গোলাপের চারাগুলো ছুঁয়ে দেখেন, গোড়ার মাটিটা সাবধানে একটু খুঁচিয়ে দেন,সদ্যফোটা গাঁদা বা জুঁইফুলগুলো ছুঁয়ে দেখেন, কোণের টগর গাছটার গুঁড়িতে হাত বুলিয়ে দেন সস্নেহে।
একমাত্র সাথী দশরথ পাশে পাশে থাকে। প্রায় তিরিশ বছর হল তারও এবাড়িতে। তখন ভরা সংসার, গমগম করত বাড়ি। হরিসাধনকে ধরে ধরে রোজ বাগানে নিয়ে যায় সে। এসময় কেউ কোনো কথা বলে না। একেকদিন কোনো কারণে দশরথের একটু দেরী হলে হরিসাধন নিজেই দেওয়াল ধরে ধরে পৌঁছে যান বাগানে। দশরথ দৌড়ে আসে, অনুযোগ করে তোমার কি তর সয়না? বিছানাটা তুলতে গেছি কেবল,একদিন পড়ে হাত পা ভেঙে বসবে দেখো। হরিসাধন উত্তর দেন না।
গত বৈশাখে লাগানো হলুদ গাঁদাগাছগুলো কেমন তরতর করে বেড়ে উঠলো! তিনি মমতায় হাত বোলান সরু ডালে, পাতায়। ছেলেমেয়েদুটোর বেড়ে ওঠা মনে পড়ে যায়। ফুলগুলোর ওপর আঙুল বোলান, যেন মেডেল পেয়েছে সোনার জলের। অভিমান হয় না এখন আর। দুজনেই বিদেশে বহুকাল, মাঝেসাঝে কথা হয় ফোনে। যেন বিগত জন্মের ফসল, এই বয়সে এসে নাতি নাতনীদের নামও গুলিয়ে যায় আজকাল। অথচ,এই ছোটো ছোটো ফুলের গাছগুলোকে নিত্যদিন যত্নে আদরে যে বড় করে তোলেন,এদের এত আপন মনে হয় কেন কে জানে!
খুব ছোটবেলায় একবার হাতে গোলাপের কাঁটা ফুঁটে রক্তারক্তি হয়ে গেছিল। তারপর থেকে এড়িয়ে চলতেন গোলাপ। এখন সেই গোলাপ গাছের যত্ন করতে করতে বোঝেন, ঠিকঠাক ধরতে পারলে কাঁটাটুকু এড়িয়েও ভালোবাসা যায়। ঠোঁটকাটা ছিলেন খুব, ছেলে বউমা তাই হয়ত এড়িয়ে চলে গেছে। কাঁটা বাঁচিয়ে জড়িয়ে ধরার অনেক হ্যাপা,ওরা ব্যস্ত মানুষ।
রোজ এভাবেই কেটে যায় সকালের অনেকটা সময়। সবার পরিচর্যা সেরে বাগানের শেষপ্রান্তের শিউলি গাছটায় হেলান দিয়ে বসেন হরিসাধন। ঠিক যেভাবে অনেক যুগ আগে বসতেন শীতের দুপুরে ঠেস দিয়ে শেফালীর পিঠে। কোলে উল, কাঁটা নিয়ে রোদ পোয়ানো শেফালী হেসে উঠতো খিলখিলিয়ে আঃ, সুড়সুড়ি লাগে যে!হরিসাধন আরো ঘন হয়ে হেলান দিতেন তার পিঠে,ঠিক এখনকার মত। গাছের কি সুড়সুড়ি লাগে? আপন মনে হাসেন হরিসাধন। ঠিক এই সময়টাতেই কোনো না কোনো কাজের অছিলায় সরে যায় দশরথ। একটা গাছের মত মানুষ আরেকটা মানুষের মত গাছের সঙ্গে অস্ফূটে বকে যায়। বেলা বাড়তে থাকে।



 ফাটল
 
ভাঙাচোরা পুকুরঘাটের যে ফাটলগুলো সচরাচর মানুষের পা এড়িয়ে চলে, আর তাতে জল জমে জমে শ্যাওলা পড়ে ক্রমশঃ ফ্যাকাশে সবুজ আঁকিবুকির জন্ম হয়,ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে বুড়ো আঙুল ঘষতে ঘষতে শ্যামা অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করছিলো । ঘরের সব কাজ সেরে ঘাটে আসতে আসতে বেলা গড়িয়ে যায় রোজ । পাড়ার মেয়ে বৌরা হইহই করে স্নান সেরে ফিরে যায় ততক্ষণে । নির্জন পুকুরঘাটে যখন সে এসে পৌঁছয় ততক্ষণে দত্তদের পোষা আধবুড়ো ময়নাটাও ডেকে ডেকে ফিরে গেছে ।
রোজকার মত আজও ঘাটে একজনও নেই । ভাবে কোনোমতে একটা ডুব দিয়ে গিয়ে দুমুঠো গিলে রুগ্ন ছেলেটার পাশে একটু বসবে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে । অথচ, পুকুরপাড়ে পৌঁছে আর পা সরে না । দুরে কোথাও একটা কুবো পাখি খুব ডাকছে একনাগাড়ে ।
মায়ের কথা মনে পড়ে যায়,ভাইটা কলেজে উঠলো এবছর । নয়নতারা গাছটা মরেই গেলো । কালুর পিঠে নাকি একটা ঘা হয়েছে । মরা গাছের শুকনো ডালে গা ঘষে সারাদুপুর ।
শ্যামা অপেক্ষায় থাকে তবু,মালতী,বিন্তি,তুলসীবৌদি কেউ না কেউ আসুক । ডানদিকের ঝোপের ফাঁক দিয়ে নিবারণকাকার তেলচিটে চাদরটা দেখা যায় । পোড়া বিড়ির কটূ গন্ধটা হাওয়ায় দোল খেতে খেতে মাঝপুকুরে থমকে যায় । বিজয়ার পরদিন প্রণাম করতে গিয়ে পিঠের ওপর একটা খরখরে হাতের চলাফেরা মনে পড়ে । গাটা গুলিয়ে ওঠে শ্যামার, ঘাটের ফাটলগুলো হাঁ করে আসে ।  আসুক,আরো দু একজন আসুক নাইতে,লালসার চোরাচাউনি ভাগাভাগি হয়ে যাক শরীরে শরীরে ।

        না গ্রাম না শহর জনপদে অপেক্ষায় দুপুর গড়াতে থাকে । একটু দুরে আধো অন্ধকার ঘরে জ্বরে পুড়তে থাকে এক মা মরা ছেলে । ঠিক তখন ডাউন হাওড়া লোকালের কামরায় খিনখিনে গলায় হেঁকে ওঠে তার খয়াটে দোজবরে বাপ,‘এসে গেছে !এসে গেছে আপনাদের শঙ্কর ! টক ঝাল মিষ্টি নোনতা চানাচুরের শোভা নিয়ে এসে গেছি দাদারা ! দুটাকা দুটাকা দুটাকা।
        রাত গভীর হলে ছেলেটাকে টপকে শঙ্করের বুকের কাছে ঘন হয়ে আসে শ্যামা । কন্ঠার হাড়, বুকের পাঁজরে হাত বোলায় বারবার,হাপরের মত ওঠানামা করে বুকটা । একহাতে জড়িয়ে ধরে শঙ্কর, হাত বোলায় শ্যামার নরম পিঠে । শ্যাওলাধরা ফাটলগুলো বুজে আসে, আবেশে গলা ধরে আসে শ্যামার । শঙ্করের হাড়গিলে বুকে নরম পাখির মত কুঁকড়ে যেতে যেতে অস্ফূটে বলে ওঠে – ‘আমারে একটা ছেলে দিতে পারো?’