এই সংখ্যায় ১০টি গল্প । লেখকসূচি : তাপসকিরণ রায়, সুবীর কুমার রায়, প্রদীপ ঘটক, সুবর্ণা রায়, সুদীপ ঘোষাল। চন্দনকৃষ্ণ পাল, শান্তময় কর, মনোজিৎ কুমার দাস, গোপেশ দে ও সুমনা সাহা ।
বৃহস্পতিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২১
সুবীর কুমার রায়
বড়দিনের শুভেচ্ছা
পঁচিশে ডিসেম্বর, বড়দিন শুভদিনও বটে । একে বড়দিন, তার ওপর প্রভু যীশুর জন্মদিন। এই দিনটি নিয়ে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে একটু লোক দেখানো মাতামাতি করার অভ্যাস আছে। বাড়িতে ডাঁটা চচ্চরি খেলেও, সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রীট অঞ্চলে গিয়ে কিছু খেয়ে ছবিসহ তাৎক্ষণিক প্রচার না করলে, সমাজে নাকি স্টেটাস রক্ষা করাই দায় হয়ে পড়ে, সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ও হয়তো থাকে। আজ এই শুভদিনে হঠাৎ একজনের কথা খুব মনে পড়ছে। না, তিনি প্রভু যীশু নন, কোন বন্ধুবান্ধব বা পরমাত্মীয়ও নন। একটি অচেনা অজানা অপরিচিতা অল্পবয়সি মেয়ে, যার মুখটা আজ আর মনেও পড়ে না।
প্রদীপ ঘটক
ছুরি
"মা,দাদা কোথায়?"
বিরক্ত মা বলে "জানি না যা। যে যমের দুয়ারে গেছে যাক্, আর যেন
না ফেরে।"
গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে
সোমার। দাদাই যে তার সব।
গঅ্যাবনর্মাল দাদা জন্মাবার পর বাবা-মা ভেঙে পড়ে। কত আশা ছিল বুড়ো বয়সে
ছেলে রোজগার করে খাওয়াবে। কিন্তু………
তাই আরেকটা চেষ্টা। কিন্তু এবার মেয়ে। মাথায় বাজ পড়ে বাবা মায়ের। তারপর থেকেই মায়ের বিমাতৃসুলভ আচরণ। বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাবাও নৃশংস হয়ে উঠছেন দিন দিন। মদ্যপ বাবাও মায়ের অনুগামী। সব অপরাধ ওই ভাই-বোনের।
তাপসকিরণ রায়
হ্যান্টেড কাহিনী--৫৬
কিত্ কিত্ কিত্...
কিত্
কিত্ কিত্...তখনও ভোরের আলো ফোটেনি, ফুটবে ফুটবে করছিল। জীতুর কানে এসে শব্দগুলি লাগলো। কি
হল ! আজকে ছাদে কিত্ কিত্ খেলছে কে ? কালই তো খুকুমণি মরে গেল। কিছু
না, মাত্র এক দিনের জ্বরে সে মরলো।
ডাক্তার বলেছিল, ব্রেন ফিভারে মারা গেছে খুকুমণি--
এই খুকুমণির সঙ্গে জীতুর খুব ভাব ছিল। এক দিন খুকুমণি তাকে বলেছিল, চল, কিত্ কিত্ খেলবি ?
সুবর্ণা রায়
বাইরের ডাক
শাশুড়ি বজ্রকঠিন স্বরে বললেন, "না!"
ঘোমটার ভিতর থেকে সরলার মুখটা দেখা না গেলেও আন্দাজে বলা যায় তার চোখে জল বিন্দুমাত্র
ছিল না। একটা জেদের আগুণ ছিল বরং। দু'বছরের মেয়ের হাত ধরে শাশুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে মনস্থির
করল সরলা।
স্কুল তো দূর, চৌকাঠ ডিঙোনো বারণ। পড়াশোনা তো দূর অস্ত! মেয়ে নাকি বাচাল হয়ে যাবে!
লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বসবে।
একান্নবর্তী সংসার। বাড়ির ছেলেরা পড়ছে সার দিয়ে বসে। সরলা ঠেলে দিলেন মেয়েকে,
"যা, দাদাদের কাছে গিয়ে বোস।"
মেয়েও গুটগুট করে মা'র নির্দেশ পালন করল। দাদাদের সামনে বসে পড়া শুনতে আর লেখা দেখতে
তার মজাই লাগত।
সুদীপ ঘোষাল
পরশুরাম
নয় ছেলে আর পাঁচ মেয়েকে নিয়ে মিতা ও তার বর পাঁচবিঘে জমির আমবাগানে বেশ সুখেই ছিল। মিতার বর মিলিটারি বিভাগে কাজ করার সময় এক অত্যাচারী লম্পটকে মেরে জঙ্গলে পুঁতে ফেলেছিল। কেউ জানতে পারে নি। তারপর কয়েক বছর পরে চাকরি ছেড়ে তার শখের আমবাগানে চলে এল। একরাশ বৃষ্টিফোঁটার ঝাপটা লাগা সুখে সে মিতার সংসারে মেতে গেল। ছেলেরা ধীরে ধীরে বড় হল। একে একে তাদের বিয়ে হল। চাকরির সন্ধানে তারা চলে গেল বাড়ি ছেড়ে। মিতার বয়স হল। তার বর চলে গেল পরপারের ডাকে।
চন্দনকৃষ্ণ পাল
খবরটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে শামসুদ্দিনের। মিল ঘরে তো আছেই চাতালেও
প্রায় একশ মন ধান। পুরো সিজন এখন। সারা বছর এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকে শামসুদ্দিন।
এই সময়টায় দিনরাত ব্যস্ত থাকে সে এবং মিলঘরের সবগুলো মানুষ। রোজ কামলাও নিতে হয় তখন।
কলমাকান্দা বাজার ছাড়া আর কোন রাইস মিল নাই আশে পাশে। এই পলাশহাটিতে তো নয়ই। যোগাযোগ
ব্যবস্থাও ভয়াবহ রকমের খারাপ। আশপাশের সবকটা গ্রামের ধান গম ভাঙ্গা হয় এই মিলে। গত
কয়েকটা মাস জুড়ে দেখা স্বপ্নে ধ্বস নামে শামসুদ্দিনের। একটু আগেই মিলঘর থেকে বাড়িতে
এসেছে। সামনের পুকুরটা একটু সংস্কার করাতে হচ্ছে। বেশ কজন নারী পুরুষ কাজ করছে ওখানটায়।
একটা চেয়ার নিয়ে একপাশে বসে কাজ দেখছিল ও। এ সময়ই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিলো নূর
মোহাম্মদ। মিলের লাইন কেটে দিয়েছ পল্লী বিদ্যুতের লোকেরা।
শান্তিময় কর
স্বপ্ন ভঙ্গ
সুবিমলকে কোনদিন ভোলা যায় না। তাই আজও এই পনেরো ষোলটা বছর পরেও সুবিমলের কথা খুব মনে
পড়ে। আমি এখন আমেরিকাতে এক বহুজাতিক সংস্থার কর্ণধার। প্রচুর অর্থের মালিক। অনেক মান,
সম্মান, প্রতিপত্তি ---পরিপূর্ণ, সুপ্রতিষ্ঠিত জীবন আমার। স্ত্রী,পুত্র, কন্যাসহ সুখের
সংসার। বর্তমান কালের বিচারে সুখী বলতে যা বোঝায়, আমি সেই অর্থে প্রকৃত সুখী । তবুও
কোন কালে ছেড়ে আসা আমার সেই ছোট্ট গ্রামটার কথা আমি কখনও ভুলতে পারি না। সবুজ ধানক্ষেত,
নদীর কুলকুল শব্দ, পাখীদের গান গাওয়া, সেই মাঠ, ধুধু প্রান্তর, দল বেঁধে স্কুলে যাওয়া,
সাঁতার কাটা আর বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে হৈ - হুল্লোড়ে মেতে থাকা -- সব যেন আমার চোখের
সামনে ভেসে ওঠে। উদাস হয়ে মনটা আমার কোথায় কোন অজানায় হারিয়ে যায়। ভীষণ ফিরে পেতে ইচ্ছে
করে সেই ফেলে আসা দিনগুলো, সেই হারিয়ে যাওয়া জীবনটা। সে সব দিনের কথা আমার মনটা কে
ভারাক্রান্ত করে তোলে। ইচ্ছে করে এই যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে ফিরে যাই সেই
জীবনে -- আনন্দে উচ্ছল, খুশীতে রঙিন। ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’--- এ কথা আমি পুরোপুরি সমর্থন
করি না, তবে স্মৃতিও যে মাঝে মাঝে মনকে গভীর ভাবে আন্দোলিত করে দেয়, তা আমি অনুভব করি
নিজেকে দিয়ে ।
মনোজিৎকুমার দাস
আমি একজন বাঙালি মেয়ে । গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারপ্রাইজের সাউথ এশিয়ার বর্তমান কান্ট্রি ডিরেক্টর রঞ্জন রায়ের একমাত্র মেয়ে আমি অহনা। আমার মা সোহিনী রায় আমাদের পরিবারের সর্বেসর্বা। আমার একমাত্র দাদা রোহন রায় মা- বাবার আদুরে ছেলে , আর আমি অহনা তাদের একমাত্র আহ্লাদে মেয়ে।
গোপেশ দে
মুখোশ
'দিদি ! কে যেন তোর খোঁজে
এসেছে ?'
'কে এলোরে ?'
'চিনিনারে ...'
'ছেলে নাকি মেয়ে ?'
'ছেলে।একটি লোক।'
রীনা এইমাত্র বাথরুম
থেকে স্নান করে নিজের রুমে ঢুকল।কিছুক্ষণ হল বাইরে থেকে এসেছে।বাইরে বলতে প্রাইভেট
টিউশানি।সকাল সন্ধে বাড়ি বাড়ি টিউশানি করে বেড়ায়।
একটু ভাবসা গরম তাই সে এই সন্ধায় আবার স্নান করে নিল।এখন সন্ধে সাতটা পঁচিশ।এই সময় কে এলো আবার ? রীনা তার ছোটভাই গুড্ডুকে বলেছে লোকটিকে বসতে।
সুমনা সাহা
রথের রশি
শুধু আজকের দিনটায় মুখার্জি জেঠুর বাড়িতে পাড়ার সবার অবাধ প্রবেশ। আজ রথ। প্রায় ১০০ বছরের পুরনো এ বাড়ির রথযাত্রা উৎসব। ওবাড়ির মেয়েরা সব পোর্সেলিনের পুতুলের মত, ধবধবে ফর্সা, টানা টানা চোখ। মুখার্জি জেঠিমা তো সাক্ষাৎ মা দুগগা আর ঝিমলি ও তিতলি তাঁর লক্ষ্মী-সরস্বতী।
বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০
১০ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ।। ১৭ ডিসেম্বর ২০২০
এই সংখ্যায় ১৪টি গল্প । লিখেছেন : সমরেন্দ্র বিশ্বাস, মুক্তা রহমান, সুবীর কুমার রায়, সুদীপ ঘোষাল, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ ঘটক, পার্থ রায়, সালমা রেখা, তন্ময় বসু, মনোজিৎ কুমার দাস, গোপেশ দে, বিনতা রায়চৌধুরী, ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী ও কুমকুম বৈদ্য ।
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
কোম্পানীর বিশ্বস্ত অফিসার সমীরণ সাহা ভ্যাবাচ্যাকা দাঁড়িয়ে রইলো ।
হাতে গুলদস্তা – রঙ্গীন রিবন আর ঝিলিমিলি কাগজে জড়ানো সুন্দর একটা ফুলের তোড়া । বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পর পর একএকটা ভিআইপি গাড়িতে উঠে পড়লো । সামনে লালবাতিয়ালা সাইরেন বাজানো পাইলট ভ্যান। পেছন পেছন কুড়িটা গাড়ীর কনভয় , একে একে সবাই লাইন দিয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে বিদায় নিল ।
মুক্তা রহমান
পাহাড়ের রাণী আলুটিলার অতুলনীয় হৃদয়স্পর্শী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মেয়েটি মোহিত। হাটছে আপন মনে। কখনো মাথা নিচু করে কখনো চারপাশটি দেখতে দেখতে। আকাশ পাহাড় আর মেঘের সাথে যেন তার মিতালি। পর্বতের সর্পিল আকারের আঁকাবাকা রাস্তার দু'ধারের সবুজ বনাঞ্চল, সারি সারি উঁচুনিচু পাহাড় আর লুকিয়ে থাকা মেঘ মেয়েটিকে উন্মনা করে তুলেছে। রোদের তেজ মরে গিয়ে মাত্র মিঠে হতে শুরু করেছে। মেয়েটির নাক ঘামছে, চাপা উত্তেজনায় কাঁপছে।
রাস্তা ধরে মিনিট খানেক হেঁটে মেয়েটি পৌছুলো একটি সরু পাহাড়ি পথে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে পথটি। মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু দ্বিধা কাজ করলো, নিচে নামবে কি? জোরে একটি শ্বাস নিয়ে নিচে নামতে শুরু করলো। মেয়েটি এবার সাবধানী। দেখে শুনে পা ফেলছে। ঢালু পথে পা হড়কে পড়ে না যায়।