গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১১ মে, ২০১৬

রুখসানা কাজল



 চোরের মা           

                   জায়েদা বেওয়া স্বপ্ন দেখছিল। তার  নয়নের মণি কলিজার ধন তাদের তিন শতাংশ ভিটামাটির জমিন ছেড়ে সাত আসমানের উপরে উড়ে যাচ্ছে। তিনি স্বপ্নের ভেতরেও অবাক হন, ও মুরাদ তুই কেমনে উড়তিছিস বাপ? মুরাদের চোখ ভেজা ভেজা। ছায়া মাখা। শরীর ছুঁয়ে মেঘ ঘিরে যাচ্ছে। কত রঙের মেঘ। যেন মেঘের   বাগানে বসে নানা রঙের মেঘফুল নিয়ে খেলা করছে তার ছেলে। সেই যে একবার ছোটবেলায় চালের গুড়োর হাঁড়ি উলটে দিয়ে ছোট্ট মুরাদ মুখে মাথায় হাতে সাদাগুঁড়ো মেখে ফিক ফিক করে হেসেছিল। জায়েদা বেওয়া সুখ স্মৃতিতে হেসে উঠেন ঘুমের ভেতর। 

       হাসতে হাসতেই তিনি দেখেন ছেলের শরীর লাল মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে।  রক্তরাঙা লাল মেঘ। এই মেঘ জায়েদা বেওয়ার খুব চেনা। সূর্য ডোবার সময় পশ্চিম আকাশ লাল লাল মেঘে ঢেকে যায়। মাঝে মাঝে এই মেঘগুলো ফুলে ফেঁপে গলগল   করে ভেসে আসে সন্ধ্যা আকাশে। যেন কেউ ঘড়া ঘড়া রক্ত ঢেলে দিয়েছে রক্তসাগরে  সূর্যকে ডুবিয়ে দেবে বলে। সেই সব সন্ধ্যায় খুব দুঃখী আতুর আর মনমরা লাগে। গ্রামের হুজুররা বলেন এই হচ্ছে আমাদের পেয়ারের নবী হযরত মোহাম্মাদ(সাঃ) এর দিল কা টুকরা নাতি হাসান হোসেনের বুকের রক্ত। তিনি ঘুমের ভেতরে সালাম দেন,  আস্‌সালামু আলাইকুম হে প্রিয় নবীর শেষ বংশধর। আল্লাহর দেওয়া বেহেশ্‌তের শ্রেষ্ঠ বেহেশ্‌ত আপনাদের জন্যে। আমিন। ছুম্মা আমিন।”    
        “তোর ঠান্ডা লাগিচ্ছে মনে হয়! লাল মেঘগুলো ঠান্ডা নাকি রে মুরাদ?”  মুরাদ কেমন শিউরে উঠছে। চমকে চমকে তাকাচ্ছে এদিক সেদিক। একটু যেন কাঁপছেও। অজস্র লাল লাল মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে ছেলের শরীর। মুখচোখ দেখা যাচ্ছে  না। আবছা শরীরে ছায়ার মত আরো উপরে উড়ে যাচ্ছে তার ছেলে। পাঙ্খা নাই তবু   উড়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।তিনি বোঝেন সব আল্লাহর ইশারা। তার চেয়ে বড় কারবারি আর কে আছে এই আসমান জমিনে!সব তার কারসাজি। তার মর্জিতেই ফেরেশ্‌তারা অদৃশ্যে থেকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেকে। একটু ভয় ধরে তার অন্তরে। মুরাদ যদি পড়ে যায় ? অত উঁচু থেকে পড়লে তার ছেলে কি আর আস্ত থাকবে? 

       মায়ের মন আতংকে ছেয়ে যায়। ছেলেকে নীচে ফেরাবেন বলে যখন  ডাকতে যাবেন তখনই তার পুরানো টিনের জং ধরা চালে ঝুরঝুর করে শিশির  ঝরিয়ে ফজরের আজান ভেসে আসে। জায়েদা বেওয়ার ঘুম কেটে যায়। আড়মোড়া ভেঙ্গে তিনি উঠে বসেন বিছানার উপর। হাই ছেড়ে বোঝেন এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলেন   মুরাদকে নিয়ে। তার একমাত্র সন্তান। ঢাকায় থাকে। চাকরী করে। মাসে চার পাঁচবার বাড়িতে আসে। চব্বিশ বছর বয়েস পেরুতেই গেল বর্ষায় বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। নতুন  বউয়ের টান বড় টান। জায়েদা বেওয়া না বুঝ নন। তিনি ছেলের আনা জিনিসপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে রাখেন আর হাসেন। যাক ছেলে ঘরমুখো হয়েছে তাহলে। 
  
       কত কিছু যে নিয়ে আসে মুরাদ। ওর কোন ভাই বোন নাই। কুড়ি বছর  বয়েসেই গার্মেন্টসে চাকরি করে টাকা উড়ানো স্বভাব হয়ে গেছিল। এই জন্যেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া। আয়ের টাকা ঘরে থাকুক। বিয়ের পর অবশ্য মুরাদ বেশ সংসারি   হয়েছে। কত কিছু করবে বলে বুদ্ধি করে দিনরাত। সব কিছুতেই মায়ের সুখের কথা  চিন্তা করে। ঘরের টিন পাল্টাতে হবে। ছেলের সখ হয়েছে মাটির মেঝে বদলে পাকা মেঝে করার। কাঁচা মাটির ঘরে মায়ের বড় কষ্ট হয় বর্ষা বাদলায়। মা তার জনম দুখী। বাপ মা ভাই বেরাদর বলতে আপনজন কেউ নেই। সম্পর্কের চাচার কাছে পেট  যোগানি হিসেবে থাকত। সেই চাচা তার এক ভাগ রাখালের সাথে বিয়ে দিয়ে বিড়াল  পার করেছে। আর কোনদিন খোঁজ রাখেনি। রাখালি ছেড়ে বহু কষ্টে একটি দোকান দিতে পেরেছিল মুরাদের বাপ। বড় ইচ্ছা ছিল মুরাদকে লেখাপড়া শেখানোর। কিন্তু ক্লাশ নাইনের টেস্টের আগে মুরাদের বাপটাও মরে গেল ডেঙ্গু জ্বরে। তারপর আর  পড়াশুনা হয়নি। দোকানদারি বোঝে না বলে বিক্রি করে কবছর এদিক সেদিক কাজ করে মসজিদ পাড়ার লোকমানের সাথে ঢাকায় চলে যায় মুরাদ। 
       
        টাকা থাকলে ঢাকার মার্কেটে বাঘের দুধও নাকি পাওয়া যায়। তার ছেলে  কত কিছু যে নিয়ে আসে তার জন্যে। ভারী পাগল ছেলে। বেতনের টাকা দিয়ে প্রথম বছরেই তার টেনে ঘরে ইলেকট্রিক আলো এনেছে। অনেক টাকা খসে গেছে তাতে। তা  খসুক। প্রায় এক বছর ধরে সেই ধার শুধতে হয়েছে। মুরাদের এক কথা মা যেন আলোতে থাকে। একটি ঢাউস পুরানো টেলিভিশন কিনে এনেছে। মোবাইলে কথা বলা শিখিয়ে দিয়েছে । শীতে খুব কষ্ট পায় জায়েদা বেওয়া। দুই বছর আগে পানি গরম করার মেশিন এনে দিয়েছে মুরাদ। খাবার গরম রাখার কত রকমের পাত্র। শীতকালে  এখন আরামেই থাকে জায়েদা বেওয়া। শাশুড়ি বউ চা খাওয়ার অভ্যাস করেছে। বিকেল হলে আশপাশের মহিলারাও আসে চা খেতে। তারা টিভি দেখে চা বিসকুট খেয়ে কত সুখ্যাতি করে তার ছেলের।বড় আশ্চর্য ছেলে মুরাদ ।হাত খোলা দিলদার।   মাঝে মাঝে অবশ্য এমন জিনিসপত্র আনে তা সংসারের কোন কাজে লাগে না। আবার বাড়তি জিনিসও নিয়ে আসে কখনো সখনো। সেগুলো বাজারে বিক্রি করে দেয় মুরাদ। এই তো  গেল সপ্তাহে  দুটি দামি মোবাইল এনেছিল। তারা তিনজন মানুষ। তিনটে মোবাইল। আবার কেন ও মুরাদ? ছেলে বলেছিল, সস্তায় পেয়ে গেলাম তাই! বিক্রি করে লাভ তুলে নেব। তুই চিন্তা করিস না মা।”  
  
       বিছানা থেকে নামতে নামতে রাতে দেখা স্বপ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করেন জায়েদা বেওয়া । আজানের আগে স্বপ্ন দেখেছন! তিনি বোঝেন এই স্বপ্নে খারাপি কিছু   নেই । তবে বড় আজব স্বপ্ন। ভয় লাগে তার অন্তরে। সকাল হোক ছোট হুজুরের কাছে গিয়ে স্বপ্নের মাজেজা জেনে আসবে । মা ভক্ত ছেলে তার। এই ছেলে তো ফেরেশতাদের সাথে সাত আসমানের উপরে উড়বেই। বিপদ কেন হবে? সর্বক্ষণ মায়ের দোয়া আছে ছেলের সাথে! তিনি বাসিমুখে কুলি করে তিন বার আয়তুল কুরছি পড়ে বাতাসে ফুঁ দেন। দূর হ আলাই  বালাই, দূর হ খবিস শয়তান।  
           
      উঠোনের কোনায় শান বাঁধানো চাপকল। প্রাতকৃত্য সেরে একবারে গোসল করে ফেলেন জায়েদা বেওয়া। মন দিয়ে আজ কোরাআন শরীফ পড়বেন। ছেলেকে  নিয়ে স্বপ্ন দেখলে কোরআন শরীফ না পড়লে তার ভাল লাগে না। বউমা ছেলেমানুষ  তায় সন্তান সম্ভাবা। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। লাইট জ্বেলে রেহেল পেতে দুলে দুলে নীচু স্বরে তেলাওয়াত করতে করতে কেমন যেন কিছু শব্দ ভেসে আসে। দূরে অনেক লোকের কথা শোনা যাচ্ছে। জায়েদা বেওয়ার মন একটু বেচাল হয়। তিনি মনকে শাসন  করতে সুরা বাকারার আয়াতগুলো জোরে জোরে পড়েন। নাহ শব্দটি এবার বেশ   কাছেই। মানুষের কোলাহল মনে হচ্ছে। কে যেন ডাকছে, চাচি ও চাচি শীগগির বারায়ে আইসেন।”
  
      জায়েদা বেওয়া দ্রুত উঠে পড়েন। হাতেম কেন ডাকে? গ্রামের রাত পাহারাদার হাতেম আলি। বউমার দূর সূত্রে আত্মীয়। বউমার বাবার বাড়ির কোন খারাপ খবর নয় ত! একবার ভাবেন বউমাকে কি ডেকে তুলবেন? পরমূহূর্তে নিজেই এগিয়ে আসেন, কি হইছে বাবা হাতেম?” হাতেম কোন কথা বলে সময় নষ্ট করে না। জায়েদা বেওয়ার হাত ধরে টেনে নিতে থাকে ইশকুল ঘরের দিকে। চলেন চলেন চাচি।  কোরআন শরীফ পড়ে থাকে খোলা রেহেলের  উপর। হাতেমের  সাথে কয়েকজন গ্রামের মানুষ। তারা কেমন যেন হতভম্ব। কেউ কোন কথা বলছে না।   
   
     ভোরের আবছা আলোয় ইশকুল ঘরের মাঠে বেশ ভিড় । ব্যাপার কি? এত লোক কেন? কুতুব চেয়ারম্যানও আছে দেখছি। “কই মুরাদের মা এদিকে আইস দেখি!” জায়েদা বেওয়ার বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। মাথার ঘোমটা বড় করে টেনে  বাঁধো বাঁধো পায়ে এগিয়ে আসে । ভিড় সরে যায় দু পাশের । কে একজন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মাঠে। হাতপা ন্যাতানো। ভেংগেচুরে এলিয়ে পড়ে আছে। শরীরে জ্যান্ত মানুষের  কোন সাড় নেই। হাতেম চিত করে দেয় দেহটি। মুরাদ!আমার মুরাদ! চিল চীৎকারে  ছুটে আসেন জায়েদা বেওয়া। ছেলের মাথা তুলে নিতে গিয়ে দেখেন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে  গেছে। ঘাড় ভাঙ্গা। শরীরের প্রতিটি হাড় ভেঙ্গে গুঁড়ো গুড়ো হয়ে গেছে। মুরাদ একদলা মাংস মাত্র। “কে কইরলো চেয়ারম্যান সাব। আমার মুরাদে কি  দোষ কইরছিল গো। ও আমার আল্লারে!কি কইরলা তুমি। এই ছিল তোমার মনে? ওরে আমার মুরাদ বাপধন আমার!”  

        কুতুব চেয়ারম্যান ফোন করে দিয়েছিল থানায়। দুজন গ্রাম পুলিশ এসে গেছে। তারা জানতে পেরেছে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসছিল মুরাদ। চুরি করাই ছিল মুরাদের পেশা। ওদের একটি দল ছিল। পাঁচজনের দলটি ট্রেনে, বাসে, প্ল্যাটফরমে, বিভিন্ন ষ্টেশনে যাত্রীদের মালামাল চুরি করত। গেল রাতে ওর দলের তিনজন ধরা পড়েছে কমলাপুর রেলস্টেশনে।মুরাদ আর একজন পালিয়ে চলন্ত বাসে উঠে পড়তে পেরেছিল। কিছুদিন গা ঢাকা দেবে বলে বাড়ি ফিরছিল। কিন্তু বাজারের কাছে বাস থামতেই অভ্যাসের বশে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় মুরাদ। জনতার মার বড় কঠিন মার। একজন ছুট দিতে পেরেছিল। কিন্তু মুরাদকে মেরে হাতের সুখ মিটিয়ে নিয়েছে বাসযাত্রীরা। তাদের চোর চোর চীৎকারে বাজারের  জেগে থাকা লোকেরাও মুরাদকে আচ্ছা করে মার দেয়।মুরাদের আর বাঁচার কোন উপায় ছিল না। কি করে যেন হাতেম সেই সময় উপস্থিত হয়। সেই উদ্ধার করে মুরাদকে। কিন্তু ততক্ষণে মুরাদ আর মুরাদ নাই। মুরাদের জান জমিন ছেড়ে সাত আসমান পেরিয়ে আল্লাহর দরবারে পৌঁছে গেছে।

                   কোলের উপর শুয়ে আছে মুরাদের বউ। হাতেম চৌকিদার সামলে নিয়েছে সবকিছু। থানা পুলিশ করে মুরাদের লাশ দাফন হয়ে গেছে বাড়ির সীমানা আঁকা  শালগাছের নীচে। লোকজনেরাও চলে গেছে। যাওয়ার আগে চকচকে চোখে ঘরের সব জিনিস দেখে ফিসফিস করেছে, তাই ত, তাই ত এত এত দামি জিনিস-- বউমার বাবা চাচা রা মুখভার করে বসে আছে উঠোনে। তারা বউমাকে নিয়ে যেতে চায়। জায়েদা  বেওয়া বোঝেন বউমা গেলে আর ফিরবে না। গ্রামে নাকি রটে গেছে এটা চোরের বাড়ি। থমথম করছে আত্মীয় কুটুম্বের মুখ। তিনি হাতেম আলীকে বলেন, বাবা হাতেম উনাদের বল বউমা যাবে।বউমা কেঁদে উঠে, আপনি একা থাকবেন আম্মা? কেউ যদি কিছু –

       জায়েদা বেওয়া চমকে উঠেন।শাল গাছের মাথার উপর শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে তিনি বলেন, চোরের মার আবার লজ্জা কি বউমা?  শাকুর চেয়ারম্যান গমচুরির মামলায় জেল খাটিল ছয়মাস। কই তার মা তো লজ্জা পাই নাই? কেউ অভাবে চুরি করে কেউ স্বভাবে চোর হয়। তুমি যাও। ভাল থাইকো গো মাইয়া---