সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করুন
গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
রবিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৮
৮ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা ১৯ নভেম্বর ২০১৮ অগ্রহায়ন ২, ১৪২৫
সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করুন
অমিতাভ দাশ (ব্যাঙ্গালোর)
খুদিরাম
তিনমাস ধরে রোজ খুদিরামএর মা দুখিয়া মুখে করে একটা
সাদাপাথরের নুড়ি নিয়ে পীরবাবার থানে ফেলে আসত ভোররাতে...আর চোখবুজে প্রার্থনা করতো
''পীরবাবা মোরে
একখান ছাওয়াল দিও''।
দুখিয়া স্বপ্ন দেখল একদিন বেশ ভগবানের মততো একজন, -- একটা নাদুস ছানা তাকে দিয়ে বলছে
''এই নে সামলা তোর ছেলেকে দুখিয়া -- কী টেঁটিয়ারে বাবা!
স্বর্গের ওয়েটিং রুমের সবাইকে নাজেহাল কইরে দিলে বটেক ট্যাঁকস ট্যাঁকস বাক্যে!''
সুবীর কুমার রায়
পাখির
মাংস খাওয়ার ইচ্ছা, স্কুল জীবন থেকেই ছিল। কিন্তু সেই সাধ কোনদিনই মেটাবার সুযোগ হয়নি। স্কুল জীবনে অনেক বাড়িতেই মুরগি পুষতে দেখেছি। আমার
বাড়িতেও বেশ কিছু মুরগি, ও খানতিনেক হাঁস ছিল। তাছাড়া ব্রয়লার মুরগি নামক অদ্ভুত প্রাণীটি তখনও বোধহয় ধরাধামে আবির্ভূত হননি। ফলে, মার হাতের
রান্না করা দেশি মুরগির সুস্বাদু মাংস, কপালে কম জোটেনি। তাই ট্যাঁশ গরুর মতো দেশি মুরগিরও যদি পাখির কৌলীন্য বিন্দুমাত্র থেকে থাকে, তবে আমার পাখির মাংসের সাথে পরিচয়, ওই দেশি
মুরগি পর্যন্ত।
সুদীপ ঘোষাল
সুমন তার স্ত্রীকে সন্দেহ করে। সবসময় মনে মনে তার প্রতি সন্দেহ। ফলস্বরূপ মাসের মধ্যে কুড়িদিন তাকে নিয়ে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে। আজ সকালবেলা চা ও জলখাবারের সময় সুমন তার স্ত্রীকে বলছে,জানো তোমাকে নিয়ে আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছি অন্য পুরুষের সঙ্গে। তার বৌ ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে,তা তো দেখবেই। তুমি তো আমাকে সন্দেহ করো। আমি তো খারাপ মেয়েছেলে।
তাপসকিরণ রায়
খিদিরপুর ডকের ভৌতিক রহস্য
শশীভূষণ
এক রবিবারে ডাকলেন তাঁর বন্ধু, জনান্তিক ও
অর্ণবকে। এমনি হয়, ছুটির দিনগুলিতে তিন বন্ধু এক
সাথে বসে আড্ডা জমান। আড্ডার সঙ্গে থাকে চা ও ভাজিয়া। আজও তেমনি আড্ডা চলছিল
বন্ধুদের। বিকেল হলেও চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। বাইরে শীতের দিন হলেও অকাল
বৃষ্টি ঝরছে, দিনে ঘরের আলো জ্বেলে চলছিল তিন
বন্ধুর খোশগল্প। এক সময় শশীভুষণ বলে উঠলেন, কলকাতার ডক, মানে খিদিরপুর, বুঝলি ?চল এক দিন ও দিকটায় ঘুরে আসা যাক !
দীপলেখা মুখার্জ্জী
রুমাদেবী দুপুরবেলা ফোন করে মেয়ে কে বলেলন,"আমাকে এসে নিয়ে যা, সোনা। আমার আর এক মুহূর্ত এই বাড়িতে ভালো লাগছে না।তুই আস্তে না পারিস আমি একাই ট্রেনে বসে যাবো, তুই হাওড়ায় নাবিয়ে নিবি, সেটাতো পারবি?" সোনা হেসে বলল, "আমি যাব মা , তোমায় নিয়ে চলে আসবো,চিন্তা করোনা। কি হয়েছে আগে সেটা তো বলো।" সোনা মায়ের চাপা গলায় অভিযোগ শুনে বুঝল, সাধারণ ব্যাপার কিন্তু দাদার বলার ধরনটা সত্যিই মাকে বলার মতো নয়। দাদা সব সময় একটু উদ্ধৃত আর বউদি আসারপর, বউদির সামনে মাকে কিছু বললে মায়ের অপমানে লাগছে বেশী লাগতে পারে, সেটা বোঝার মতো মনসিকতা,দাদার কোনোদিনই ছিলনা,এখনো নেই। সোনা এইসব নিয়ে মাথা ঘামায়না কোনোদিনই,এখনওঘামালোনা। সে মাকে বড্ড ভালবাসে,মায়ের কথা তার কাছে বেদ বাক্য।
ডঃ মৌ সেন
চোয়াল
কথায় বলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। কদিন ধরেই বাঁদিকের নিচের পাটির শেষ দাঁতটা খুব ব্যথা করছিল ।ভাগ্যিস এক সপ্তাহের ছুটি পড়ল কালীপুজোর আগে পরে শনি , রবি মিলে। আমি দৌড়লাম দাঁতের ডাক্তারের কাছে। ঠুক করে কি একটা ঠুকতেই বাঁ দিকটা ঝনঝন করে উঠলো। ডাক্তার বরুণ চৌধুরী, আমার
বহুদিনের পরিচিত । সম্পর্কটা এখন খানিকটা দিদি আর ভাইয়ের মত। ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম যা হবার হয়েছে, এ দাঁত না তুলে উপায় নেই । যথারীতি নিদান দিল, পরশুদিন দাঁতটা তুলে দেব। অতএব, একেবারে
ওষুধ কিনে খেতে শুরু করলাম ।
রত্না ঘোষ
ঘুম
ভাঙতেই দেখি কাচের জানালা ভেদ করে সূর্যের আলো এসে পড়ছে বিছানায় । তাড়াতাড়ি
বালিশের কাছে রাখা মোবাইলে সময় দেখে আঁতকে উঠি। ----"আটটা দশ ওরে বাবারে ! খুব দেরি
হয়ে গেছে। সমস্ত কাজ শেষ করতে হবে । তিন দিন ধরে কাজের বউটা দেশে গেছে। আসবে আরো
তিন দিন পর। তারমানে সবই করতে হবে বাসন মাজা ,ঘর পরিষ্কার করা সবই।উঃ আর ভাবতে
পারছিনা।" তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে দাঁত ব্রাশ করে প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করে সবার আগে
রান্না ঘরে ঢুকলাম। রান্নাঘরের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
দিলুদা । আমার নিজের পিসতুতো দাদা। দুর্গ রেলওয়ে ষ্টেশনের ইয়ার্ড মাষ্টার
ছিলেন। সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব একা ঘাড়ে নিয়ে কখন যে তাঁর বয়েস হয়ে-গিয়েছিল
বুঝতেই পারেন নি । ছোট ভাই বোনেদের পড়ান তাদের বিয়ে দেওয়া সব দিলুদা এবং ছটুদার
ওপর ন্যস্ত করে ছোট পিসেমোসাই পিসিমা পুজো আচ্ছায় মন নিবেশ করতেন। সবকটি ছেলে মেয়ে
প্রতিষ্ঠিত । দিলুদা অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। কালি পুজোর ছুটিতে মাঝে মধ্যে আমাদের
বাড়িতে আসতেন। বড়
মামী (আমার মা) বলতে অজ্ঞান। মা দিলুদা কে খুব
আদর যত্ন করতেন। সে সব দিনের কথা ওই স্মৃতিতেই থেকে গেল...... ।
সুমনা সাহা
১
ছোট্ট পলা
বাবার পাঞ্জাবীর হাতা ধরে আলতো টান দেয়। মাইকে ভেসে আসছে ঘোষণা—‘দর্শনার্থীদের
কাছে অনুরোধ, আপনারা ধীরে ধীরে শান্তিপূর্ণ ভাবে অগ্রসর হন, অপরকেও
প্রতিমা দর্শনের সুযোগ করে দিন...পূজোর আগামী
দিনগুলো আপনাদের মঙ্গলময় হয়ে উঠুক...।’ পলাশবাবু
দীর্ঘ দেহ ঝুঁকিয়ে তাঁর মেয়ের মুখের কাছে নামিয়ে আনেন কান, ‘কি বলছ
মামনী?’
বাবা, বাড়ি চলো, আর হাঁটতে
পারছি না, পা ব্যথা করছে!
শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮
৮ম বর্ষ ২য় সংখ্যা ৪ নভেম্বর ২০১৮ ।
এই সংখ্যায় ১০টি গল্প । লিখেছেন অমিতাভ দাশ, সুবীর রায়, নীহার চক্রবর্তী, চন্দনলৃষ্ণ পাল, অঞ্জন সরকার, পার্থ রায়, সুদীপ ঘোষাল, কৃষ্ণা দাস, ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী ও তাপসকিরণ রায় ।
সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করে পড়ুন
সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করে পড়ুন
সুবীর কুমার রায়
তোমার হলো শুরু
সকাল বেলা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আমি তো অবাক। ছয় বছরের
নাতনি তার স্কুলের প্রজেক্ট নিয়ে মায়ের সাথে এতো ব্যস্ত, যে আমার
আগমনে দু’জনের কেউই বিশেষ খুশি হলো বলে মনে হলো না। একটা খাতায় পাঁচটা ফল, পাঁচটা
ফুল, ও পাঁচটা
পাখির ছবি এঁকে রঙ করে আগামীকাল স্কুলে নিয়ে যেতে না পারলে নাকি দেশ, দশ, তার, ও তার
স্কুলের ভবিষ্যৎ এক্কেবারে অমাবস্যার মতো অন্ধকার হয়ে যাবে।
আজ কপালে
এক কাপ চাও জুটবে না বুঝে, চুপ করে বসে, তাদের কর্মযজ্ঞ অবলোকন করতে লাগলাম। বাচ্চাটা এই বয়সেই বেশ ছবি
আঁকে। গোলাপ, জবা, ও পদ্ম ফুল আঁকা ও রঙ করা হয়ে গেছে, এখন গাঁদা ফুল আঁকার পর্ব চলছে। ছবি দেখে আমি তো রীতিমতো বিষ্মিত। স্বীকার
করতে লজ্জা নেই, যে হাজার
চেষ্টাতেও ওই গোলাপ আমি আঁকতে পারতাম না। আমার আঁকা গোলাপকে লাল বা গোলাপি রঙ না
করে সাদা রঙ করলে, স্বচ্ছন্দে গন্ধরাজ
বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
চন্দনকৃষ্ণ পাল
মন্টি পিসির আহাজারি
মন্টি পিসির কথা একটু বলি
মন্টি
পিসির আপনজন বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই। দু’টো বিড়াল আর একটা কুকুরকে আপনজন
বললে আপনজন, না বললে নাই। আসলে পিসু আর মন্টি পিসি এই দু’জনকেই আমরা জন্ম থেকে চিনি।
একদিন হুট করে মন্টি পিসির বাড়ীতে কান্নার রোল। আমরা ছোটরা দৌড় লাগালাম পিসির
বাড়ীর দিকে। সবাই বললো পিসু নেই। এটুকুই। তারপর পিসি খালি পূজা পার্বণ নিয়ে
ব্যস্ত। অনেক জমি জমা, ফলাদীর গাছ। পিসির অনেক টাকাও। কিন্তু পিসি খরচ করতে রাজী না। তিনি টাকা
ভালোবাসেন, ফল ও। বাচ্চাদের ফল পাড়তে দেখতে পিসি বকা ঝকা করেন। বাচ্চারা কষ্ঠ পায়। সারা
গ্রামের সব বাচ্চারা কষ্ট পায়। টসটসে পেয়ারা, পাকাঁ আম, আমলকি, জামরুল সব
পেকেঁ গাছে বসে থাকবে। গ্রামের ছেলেরা খেতে পারবে না! একদিন দোকানদাররা সব গাছ খালি করে সমস্ত ফল বাজারে নিয়ে
যাবে, এটা কষ্টের বিষয়। সব ছেলেদের
জন্য কষ্টের।
অঞ্জন সরকার
তেইশ বছরের দ্বীপেন সান্যাল,
দিল্লির কাশ্মীরি গেট বাস টারমিনাসের ওয়েটিং হলে’র এক কোনে বসে।হলের উল্টোদিকে, এসক্যালেটরের কাছেই,
একটি উগ্রপ্রসাধন সজ্জিতা মেয়ে পর্যাপ্ত যৌবন প্রদর্শন করে বসে আছে।
দ্বীপেনের নজর ঘনঘন মেয়েটির দিকে চলে যাচ্ছিলো, আর চোখাচোখি
হওয়ার মুহূর্তেই নজর সরিয়ে নিচ্ছিল। মেয়েটি বেস স্মার্ট দেখতে, ও অধুনা চলতি ফ্যাশানের চটকদার অফ্-শোলডার টপের সঙ্গে আঁটোশাটো জীন্স পরেছে।
যেন, সঙ্গ ইচ্ছুক পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বসেছে। দু
একবার দ্বীপেনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। মেয়েটিও যেন টের পেয়ে, একটু ঔৎসুক্যের চাহুনি দিয়ে তাকিয়েছিল দু একবার। আজকাল নাকি অনেক হোটেলের
ওয়েটিং লাউঞ্জে, এয়ারপোর্টে, বাস
টারমিনাসের ওয়েটিং হলে, এরকম মেয়েছেলেদের দেখা যায় সন্ধ্যার
দিকে।
মেয়েটি নিজের ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বার করে, কাউকে ফোন করার চেষ্টা করে, এক মিনিট কথা বলেই ফোনটা আবার ব্যাগের ভেতরে রেখে দেয়।বাইরে কোন দূর পাল্লার বাসের প্রস্থানমুহূর্ত ঘোষণা করা হয়, ও তার সঙ্গেই ওয়েটিং হলে’র অনেকেই বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যায়। বিরাট হলের মধ্যে থেকে যায় চার পাঁচজন অপেক্ষারত যাত্রী, দ্বীপেন ও সেই মেয়েটি।
একটু পরে, এসক্যালেটরের দিকে চোখ যেতেই, দ্বিপেন দেখে মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখে চোখ পড়তে, মেয়েটি উঠে দ্বীপেনের দিকেই এগোয়। দ্বীপেন একটু সন্ত্রস্ত হয়ে নড়েচড়ে বসে। আসন্ন কোন সাঙ্ঘাতিক ঘটনার উৎকণ্ঠা তার চোখেমুখে। মেয়েটি দ্বিপেনের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। ঠোঁটে চাপা হাসির ইঙ্গিত।
দ্বীপেন এতক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে।একটু যেন ভয়ই পেয়েছে। একাধিকবার তাকানোর জন্য তিরস্কার, এমনকি একটা চড় কষিয়ে দেয় যদি! দ্বীপেন কিছু বলার আগেই, চোখে চোখ রেখে মেয়েটি বলে ওঠে, “কি! চেনা মনে হচ্ছে? চল না ওই কোনাটায় গিয়ে বসি, নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে।” বলেই, মেয়েটি দ্বীপেনের হাত ধরে প্রায় টেনে নিয়ে যায় হলের ভেতরের কোনের দিকে। দ্বীপেন যেন যন্ত্রচালিতের মতন হলের কোনের দিকে এগিয়ে যায়।
মেয়েটিও তাহলে বাঙালি, অথবা বাংলা ভালো জানে।
-“চেনা’র চেষ্টা করছিলে, না আলাপ করার চিন্তা করছিলে”
দ্বীপেনে ভেবে উঠতে পারছে না কী বলবে।
-“তুমি দিপু না?দ্বীপান্বিতাদি’র ভাই? বিষ্ণুপুরের বসাকপাড়ায় বাড়ি তো? ব্রজমন্দির স্কুলে পড়তে। সাইকেলে স্কুলে যেতে।”
দ্বীপেনের অবস্থা প্রায় হতবাক, কোনঠাসা। চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ প্রকট। কোনমতে মাথা হেলিয়ে জানায় যে দ্বীপান্বিতা সান্যাল তারই দিদি।
মেয়েটি আরো বলতে থাকে, “দ্বীপান্বিতাদি তো লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিলো।এমএ’তে ভর্তি হয়েছিল না? বি এ পাস করার কয়েক মাসের মধ্যেই ত মেশোমশাই মারা যান। সংসার চালানো, মা’য়ের দেখাশোনা, ভাইয়ের লেখাপড়া, এইসব দায়িত্ব দ্বীপান্বিতাদির ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। দ্বীপান্বিতাদি তার পর থেকেই ত টিউশানি’র পেশাটা ধরে নেয়।”
দ্বীপেন এতক্ষন পরে, ইতস্তত করে জিজ্ঞ্যেস করে- ‘আমাদের সম্বন্ধে এত কিছু বলার পরেও কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারি নি।আপনিও কি...’
দ্বীপেনকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে “আমাকে না চিনলেও, পেশাটা আন্দাজ করতে পারছো বোধ হয়।... দ্বীপান্বিতাদি ত এখনও বিয়ে করেনি, তাই না? তুমি কি সমীরনদাকে চেনো? সমীরনদাও তো এখনও বিয়ে করেনি।”
দ্বীপেনের আশ্চর্য ভাবটা আরও বেড়ে যায়। সমীরনদাকে ত এখনও, টিউশানি থেকে ফেরার পথে, দিদির সঙ্গে দেখা করতে দেখেছে কয়েকদিন। দ্বীপেন মনের আনাচে কানাচে খুঁচিয়ে চেষ্টা করে স্কুলজীবনের বন্ধু বান্ধবীদের নাম মনে করতে। কিছুতেই, চেহারার সঙ্গে নাম মিলিয়ে মনে করতে পারে না। দ্বীপেনের প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি সরাসরি পরিচয় দিচ্ছে না।
একটু পরেই, মেয়েটির গলা যেন স্বগতোক্তির মতন কিছুটা ভারী শোনায়।--“ মেশোমশাই মারা যাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই বাবাও মারা যান। ভাগ্যিস দিদি’র বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল।দিদিদের শ্বশুরবাড়ির অবস্থাও খুব একটা স্বচ্ছল ছিলো না। দিদি জামাইবাবুর গলগ্রহ হয়ে থাকাও বেশীদিন সম্ভব হল না। আমাকেও একটা কাজের কথা ভাবতে হোল।চাকুরীর প্রলোভনে, দিল্লি এসে, একটা পেশা’র তকমা লেগে গেল।”
এক সেকেন্ড থামতেই, গলার স্বর যেন আরও ভারী হয়ে ওঠে, “জানো দিপু, তোমাকে না আমার খুব হিংসে হয়। আমার যদি, তোমার দিদি’র মতন একটা দ্বীপাদি থাকতো! দ্বীপাদির এখনকার দায়বদ্ধতার থেকে মুক্তি তার ভাইয়ের পাশ করে, চাকুরী পেয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরে।”
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস দ্বীপেন যেন টেরই পেলো না।
দ্বীপেনের আরো কাছে এগিয়ে আসে মেয়েটি। চোখে চোখ রেখে, কষ্ট করে আনা, হাসি দিয়ে, যেন কিছুটা আবদার আর অনুনয়ের স্বরে বলে,-“দ্বীপাদির কথা ভেবে অন্তত, তাকে দায়বদ্ধতার থেকে মুক্ত করা পর্যন্ত, কোন প্রলোভনের দিকে তাকিও না।” বলেই, দ্বীপেনের চুলের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে, পেছন ফিরে হনহন করে বেরোবার দরজার দিকে হাঁটা দিল।
দ্বীপেন জিজ্ঞ্যেস করার চেষ্টা করলো, “নামটা ত বললে না?”
“মনে করতে পারলে না তো? দরকার কী? যদি ভবিতব্য হয়, আবার দেখা হয়েও যেতে পারে কখনো!” দরজার কাছ থেকে ঘাড় ফিরিয়ে দ্বীপেনের দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে, মেয়েটি বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
ঘাড় ফিরিয়ে কথা বলার সময় দ্বীপেনের হঠাৎ চোখে পড়ে, অফ্-শোলডার টপের খালি ঘাড়ের পিছন দিকে কালো জরুলটা। মনে পড়ে যায়, স্কুলে তারই ক্লাসের কলা বিভাগে পড়ত দেবস্মিতা। দোলের সময় রঙ মাখাতে গিয়ে টের পেয়েছিল জরুলটা। দ্বীপেন দৌড়ে দরজার বাইরে বেরিয়ে ডাকতে যায়। ততক্ষনে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছে দেবস্মিতা।...
মেয়েটি নিজের ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বার করে, কাউকে ফোন করার চেষ্টা করে, এক মিনিট কথা বলেই ফোনটা আবার ব্যাগের ভেতরে রেখে দেয়।বাইরে কোন দূর পাল্লার বাসের প্রস্থানমুহূর্ত ঘোষণা করা হয়, ও তার সঙ্গেই ওয়েটিং হলে’র অনেকেই বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যায়। বিরাট হলের মধ্যে থেকে যায় চার পাঁচজন অপেক্ষারত যাত্রী, দ্বীপেন ও সেই মেয়েটি।
একটু পরে, এসক্যালেটরের দিকে চোখ যেতেই, দ্বিপেন দেখে মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখে চোখ পড়তে, মেয়েটি উঠে দ্বীপেনের দিকেই এগোয়। দ্বীপেন একটু সন্ত্রস্ত হয়ে নড়েচড়ে বসে। আসন্ন কোন সাঙ্ঘাতিক ঘটনার উৎকণ্ঠা তার চোখেমুখে। মেয়েটি দ্বিপেনের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। ঠোঁটে চাপা হাসির ইঙ্গিত।
দ্বীপেন এতক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে।একটু যেন ভয়ই পেয়েছে। একাধিকবার তাকানোর জন্য তিরস্কার, এমনকি একটা চড় কষিয়ে দেয় যদি! দ্বীপেন কিছু বলার আগেই, চোখে চোখ রেখে মেয়েটি বলে ওঠে, “কি! চেনা মনে হচ্ছে? চল না ওই কোনাটায় গিয়ে বসি, নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে।” বলেই, মেয়েটি দ্বীপেনের হাত ধরে প্রায় টেনে নিয়ে যায় হলের ভেতরের কোনের দিকে। দ্বীপেন যেন যন্ত্রচালিতের মতন হলের কোনের দিকে এগিয়ে যায়।
মেয়েটিও তাহলে বাঙালি, অথবা বাংলা ভালো জানে।
-“চেনা’র চেষ্টা করছিলে, না আলাপ করার চিন্তা করছিলে”
দ্বীপেনে ভেবে উঠতে পারছে না কী বলবে।
-“তুমি দিপু না?দ্বীপান্বিতাদি’র ভাই? বিষ্ণুপুরের বসাকপাড়ায় বাড়ি তো? ব্রজমন্দির স্কুলে পড়তে। সাইকেলে স্কুলে যেতে।”
দ্বীপেনের অবস্থা প্রায় হতবাক, কোনঠাসা। চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ প্রকট। কোনমতে মাথা হেলিয়ে জানায় যে দ্বীপান্বিতা সান্যাল তারই দিদি।
মেয়েটি আরো বলতে থাকে, “দ্বীপান্বিতাদি তো লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিলো।এমএ’তে ভর্তি হয়েছিল না? বি এ পাস করার কয়েক মাসের মধ্যেই ত মেশোমশাই মারা যান। সংসার চালানো, মা’য়ের দেখাশোনা, ভাইয়ের লেখাপড়া, এইসব দায়িত্ব দ্বীপান্বিতাদির ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। দ্বীপান্বিতাদি তার পর থেকেই ত টিউশানি’র পেশাটা ধরে নেয়।”
দ্বীপেন এতক্ষন পরে, ইতস্তত করে জিজ্ঞ্যেস করে- ‘আমাদের সম্বন্ধে এত কিছু বলার পরেও কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারি নি।আপনিও কি...’
দ্বীপেনকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে “আমাকে না চিনলেও, পেশাটা আন্দাজ করতে পারছো বোধ হয়।... দ্বীপান্বিতাদি ত এখনও বিয়ে করেনি, তাই না? তুমি কি সমীরনদাকে চেনো? সমীরনদাও তো এখনও বিয়ে করেনি।”
দ্বীপেনের আশ্চর্য ভাবটা আরও বেড়ে যায়। সমীরনদাকে ত এখনও, টিউশানি থেকে ফেরার পথে, দিদির সঙ্গে দেখা করতে দেখেছে কয়েকদিন। দ্বীপেন মনের আনাচে কানাচে খুঁচিয়ে চেষ্টা করে স্কুলজীবনের বন্ধু বান্ধবীদের নাম মনে করতে। কিছুতেই, চেহারার সঙ্গে নাম মিলিয়ে মনে করতে পারে না। দ্বীপেনের প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি সরাসরি পরিচয় দিচ্ছে না।
একটু পরেই, মেয়েটির গলা যেন স্বগতোক্তির মতন কিছুটা ভারী শোনায়।--“ মেশোমশাই মারা যাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই বাবাও মারা যান। ভাগ্যিস দিদি’র বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল।দিদিদের শ্বশুরবাড়ির অবস্থাও খুব একটা স্বচ্ছল ছিলো না। দিদি জামাইবাবুর গলগ্রহ হয়ে থাকাও বেশীদিন সম্ভব হল না। আমাকেও একটা কাজের কথা ভাবতে হোল।চাকুরীর প্রলোভনে, দিল্লি এসে, একটা পেশা’র তকমা লেগে গেল।”
এক সেকেন্ড থামতেই, গলার স্বর যেন আরও ভারী হয়ে ওঠে, “জানো দিপু, তোমাকে না আমার খুব হিংসে হয়। আমার যদি, তোমার দিদি’র মতন একটা দ্বীপাদি থাকতো! দ্বীপাদির এখনকার দায়বদ্ধতার থেকে মুক্তি তার ভাইয়ের পাশ করে, চাকুরী পেয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরে।”
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস দ্বীপেন যেন টেরই পেলো না।
দ্বীপেনের আরো কাছে এগিয়ে আসে মেয়েটি। চোখে চোখ রেখে, কষ্ট করে আনা, হাসি দিয়ে, যেন কিছুটা আবদার আর অনুনয়ের স্বরে বলে,-“দ্বীপাদির কথা ভেবে অন্তত, তাকে দায়বদ্ধতার থেকে মুক্ত করা পর্যন্ত, কোন প্রলোভনের দিকে তাকিও না।” বলেই, দ্বীপেনের চুলের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে, পেছন ফিরে হনহন করে বেরোবার দরজার দিকে হাঁটা দিল।
দ্বীপেন জিজ্ঞ্যেস করার চেষ্টা করলো, “নামটা ত বললে না?”
“মনে করতে পারলে না তো? দরকার কী? যদি ভবিতব্য হয়, আবার দেখা হয়েও যেতে পারে কখনো!” দরজার কাছ থেকে ঘাড় ফিরিয়ে দ্বীপেনের দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে, মেয়েটি বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
ঘাড় ফিরিয়ে কথা বলার সময় দ্বীপেনের হঠাৎ চোখে পড়ে, অফ্-শোলডার টপের খালি ঘাড়ের পিছন দিকে কালো জরুলটা। মনে পড়ে যায়, স্কুলে তারই ক্লাসের কলা বিভাগে পড়ত দেবস্মিতা। দোলের সময় রঙ মাখাতে গিয়ে টের পেয়েছিল জরুলটা। দ্বীপেন দৌড়ে দরজার বাইরে বেরিয়ে ডাকতে যায়। ততক্ষনে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছে দেবস্মিতা।...
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)