কবিসম্মেলন ও সেই লোকটি
নিজেকে এভাবে নাকাল হতে লোকটা আগে কখনো
দেখেনি । বস্তুত কেউই দেখেনি ।
স্কুল
বাড়ির উল্টোদিকে রাস্তার একপাশে মঞ্চ করা হয়েছে । চলছে কবি সম্মেলন । লোকটার কবিতা
লিখে বেশ খ্যাতি হয়েছে । এলাকায় এইসব আসরে ডাক পায় । লোকটি খুব ব্যস্ত । সে
উদ্যোক্তাদের বললে ,বেশী সময় থাকব না
।আমাকে একটু আগে ডেকে দিন । কবিতা পড়ে চলে যাবো । এই ডাকে তো সেই ডাকে । কতজনের
পড়া হয়ে গেল । তাঁর ডাক আসে না । লোকটি সঞ্চালকের কাছে এগিয়ে গেল । বৃদ্ধ সঞ্চালক
লোকটির চেনা । ফলত সে এবার ডাক দিল ।
লোকটি
গটগট করে মঞ্চে এসে বসল । হাতে একটা ব্রিফকেস । মঞ্চে সবাই নীচে বসেছে । ফলত
তাঁকেও সেভাবে বসতে হল । ব্রিফকেস খুলে একটা ঝোলাব্যাগের ভেতর থেকে কতগুলি খাতা-বই
বার করলে । সামনে দর্শক । লোকটির হাতে মাইক্রোফোন । লোকটি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে
যাচ্ছে । তাঁর কাঙ্খিত কবিতাটি খুঁজে পাচ্ছে না । সবাই হাঁ করে তাকিয়ে । লোকটি
ভেতরে ভেতরে কাঁপছে । বললে ,আমি তো কবিতা
আনিনি আজ , অন্য কবির কবিতা আবৃত্তি করছি । বলে আবার
খুঁজতে লাগল । কোন কবিতা আবৃত্তি করবে ,সেটাও বুঝতে পারছে
না । চোখের সামনে সবটাই ঝাপসা ।সবাই তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে । কি বলবে বুঝতে পারছে
না । কিছু তো তাঁকে বলতেই হবে । অদ্ভুত এক অসহায়তা বোধ করছে সে । তিনি কেবল পৃষ্ঠা
উল্টে যাচ্ছেন । লোকটার শরীর ঘামে ভিজে গেল । পালাতে চাইল আলো আর মঞ্চ থেকে । অথচ
সামনে কত লোক !
সে আসবে বলে
এই যে তুমি সারারাত জেগে জেগে রাগ সংগীত
শোনো ,তোমার ভালো লাগে ? তোমার
কোনো কষ্ট আছে ? এই যে এতফুল কিনে ফুলদানীতে রেখেছো আজ ,কিছু কারণ আছে তো নিশ্চয় !
--সবকিছুর কারণ খুঁজতে নেই ,বুঝলে ।সব সত্যের সামনে দাঁড়াতে নেই ।না ,কোন
কষ্ট নেই , আবার আছেও হয়ত ।
--তুমি আজকাল বড্ড শক্ত শক্ত কথা বলো
।
--কোথায় শক্ত ! জলবৎ তরল ।
এই
যে রাগ সংগীত ,এই যে গজল -ঠুমরি এসব গতজন্মের
স্মৃতি । এ তো আমার রক্তে মিশে আছে ।
--সে কী ,একটু
খুলে বলো ,শুনি ।
--বছর
বারো আগে এক বৈশাখের সকালে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা নিয়ে বকুল এসেছিল । দ্বিতীয় বৈশাখ ।
সেদিনও আমি গজল শুনছিলাম ,জগজিত্ সিং ।
--তোমার প্রিয় শিল্পী ।
--হুম । তারপর তো সবটাই জানো ।বকুলের
কাছে আসা ,চলে যাওয়া ।
--তার মানে আজ বারো বছর পূর্ণ হল !
--হলো
। তবে সেজন্য নয় । জাতিস্মর না হলেও বলতে পারি বেনারস ,লক্ষ্ণৌ
বা দিল্লীর শহরগুলি ,সেই শহরের অলিগলি আমাকে ডাকে । আমার খুব চেনা মনে হয় । একটা
বাইজীকে ভালোবাসতাম । অসাধারণ নাচত সে । রূপের
চ্ছটাওছিল খুব ।সে কোথায় যে হারিয়ে গেল । আমি কেবল তার ফর্সা পা দুটো দেখতে পাই
কল্পনায় । পায়ে জড়ানো ঘুঙুর । মাঝে মাঝে দৌড়ে চলে যায় একটু দেখা দিয়েই । ঘুমের
ভিতর সে আসে অথচ বাস্তবে সে কোথায় ! কোথাও নেই । রাতের বেলায় মনে হয় এইতো এসে যেন
দাঁড়াবে । অথচ তার মুখটাই তো মনে নেই আমার ।
--তাহলে বকুল বা অন্য কারও ভিতর কি
সে ছায়া দেখেছিলে তুমি ?
--না ,
তাকে আমি খুঁজে চলেছি । এরা কেউ নয় । এই যে রাগগুলি শুনি ।রাত জেগে থাকি । আসলে সে আসবে বলে ।
একদিন নিশ্চয়ই সে আসবে । আসতে তাকে হবেই ।