
প্রথমেই
বাংলা ছোটগল্পের
অনন্য কথাকার ‘বনফুল’এর ১১৮তম জন্মদিনে জানাই আমাদের বিনম্র প্রণতি । ‘গল্পগুচ্ছ’র এই
বিশেষ সংখ্যা তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
সভ্যতার
উষালগ্নে গল্পের সৃষ্টি । মানুষ মুখে মুখে গল্প তৈরি করেছে । সভ্যতার সমবয়সি হয়েও ছোটগল্প
বলতে এখন আমরা যা বুঝি তা নিতান্তই আধুনিক কালের ফসল,সাহিত্যের আর সব শাখার তুলনায় নবীনতম । বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোটগল্পের
প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ । পত্রিকার প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ গল্প লিখতে শুরু করেন ।
১৮৭৭ সনে কিশোর রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ প্রকাশিত হয় ‘ভারতী’ পত্রিকায় । এর চোদ্দ বছর পরে তার দ্বিতীয় ছোটগল্প
‘দেনা পাওনা’ প্রকাশিত হয় । আর ‘দেনা পাওনা’কেই প্রথম সার্থক ছোটগল্প বলা হয় ।
ছোটগল্প কথাটিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্যবহার করেন । সেই হিসাবে বাংলাসাহিত্যে
ছোটগল্পের বয়স মাত্রই একশো বছর ।
রবীন্দ্রোত্তর
কালে বাংলা ছোটগল্পর অবয়ব রচনায় নতুনতর মাত্রা যোগ করেছিলেন বনফুল বা ডাক্তার
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯ - ১৯৭৯ ) । স্বল্প পরিসরে, ক্ষুদ্র অবয়বে তাঁর অজস্র
সার্থক ছোটগল্প সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যকে । আমি এও মনে করি, এখন অতি ক্ষুদ্র অবয়বে গল্প নির্মাণ বা অণুগল্পের যে ধারণা বা ভাবনা,তার
বীজ রয়েছে ‘বনফুল’এর গল্পনির্মাণ প্রকরণের মধ্যেই । অতয়েব গল্পগুচ্ছ তার বিশেষ
অণুগল্প সঙ্খ্যা প্রকাশের জন্য ‘বনফুল’এর জন্মদিনটিকেই বেছে নিয়েছে ।
এই
সংখ্যাটি গল্পগুচ্ছর দ্বিতীয় ‘অণুগল্প সংখ্যা’ । আগেরটি প্রকাশিত হয়েছিল গত মে মাসে
। বলেছিলাম গল্পগুলি যেন ২০০ থেকে ৩৫০
শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে । এই নির্দেশ প্রকাশিত লেখাগুলিতে সম্পূর্ণভাবে মানা
সম্ভব হয়নি । এ কথা মানি যে, শব্দসীমার
শিকল পরালে সার্থক সৃষ্টি হয় না। আবার একথাও ঠিক যে অণুগল্প রচনার ক্ষেত্রে
শব্দসীমার শৃঙ্খলা থাকাটাও জরুরি, নতুবা অণুগল্প রচনার ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হবে
নৈরাজ্যের জগৎ । ইতিমধ্যে ‘পরমাণু গল্প’ অভিধায় কিছু লেখা ‘ফেসবুক’ নামক ‘সব-জান্তা’,
‘সব-পেয়েছি’র বাজারে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে । জীবনের কোন খন্ড অনুভুতি দশবারোটা
শব্দের বাঁধনে নাকি ‘গল্প’ হচ্ছে ।
সে
কথা থাক । গল্প বা গদ্যকাহিনীর আসরে অণুগল্পের ধারণাটা নিতান্তই নবীন । ফেসবুকের
নানান সাহিত্যগোষ্ঠী এবং ওয়েব পত্রিকাগুলিই অণুগল্পের ধাত্রিগৃহ। অণুগল্প তো আদতে ‘গল্প’ই,
ছোটগল্পের মান্য সংজ্ঞা আছে, তার আয়তন কেমন হবে তারও স্পষ্ট নির্দেশ পাই বিশ্বের
শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের লেখায় । অনুগল্প ছোট গল্পের চেয়ে ক্ষুদ্রায়তন হবে সেটা বুঝি, কিন্তু
কতছোট, তার কোন স্পষ্ট মিমাংসা এখনও কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই । বাংলা সাহিত্যে পত্র-পত্রিকাগুলির
চাহিদা মেটাতেই ছোটগল্পের প্রবর্তনা হয়েছিল আর তা প্রবর্তন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ।
একইভাবে আজ সময়ের স্রোতে অন্তর্জালবিশ্বে অন্তর্জালের সামাজিক পরিসর ও অন্তর্জাল
পত্র-পত্রিকার চাহিদা মেটাতে অণুগল্পে এসে পৌঁছেছি ।
আয়তনে
ক্ষুদ্র হলেও অণুগল্পও আদতে ‘গল্প’ । তাই আমি মনে করিনা ‘ছোটগল্প আর ‘অণুগল্প’র
মধ্যে প্রকরণগত কোন প্রভেদ আছে । নাটকীয় আকর্ষণীয়তা, উৎকন্ঠা, চরম মুহূর্ত, লিখনশৈলীর দৃঢ় সঙ্ঘবদ্ধতাই সার্থক ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য । অণুগল্পের ক্ষেত্রেও
এই মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় থাকা চাই । ছোটগল্পের ভগীরথ রবীন্দ্রনাথ যেমন বলে
গিয়েছেন যে, ছোটগল্পে থাকেনা ঘটনার ঘনঘটা, বর্ণনার ছটা, থাকে না তত্ব ও উপদেশ ।
থাকে অতৃপ্তি, যেন মনে হয় ‘শেষ হয়ে না হইল
শেষ’ ।
আবার
বলি, ‘অণুগল্প’র ধারণা নিতান্তই নবীন এবং এখনও প্রাথমিক স্তরে । সাহিত্যের আসরে
তার স্থিতি স্পষ্ট ও পোক্ত করতে তাকে পেরোতে হবে আরো অনেক পথ । পাঠককুলই গ্রহণ ও
বর্জনের মধ্য দিতে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে অথবা যাবে না । কারণ, নিশ্চিতভাবেই
অণুগল্পের মোড়কে ‘না-গল্প’কে তারা গ্রহণ করবেন না, করেনওনি কোন দিন । তাই, রবীন্দ্রনাথের
অমোঘ পংক্তি উদ্ধার করেই শেষ করি
“... তোমার টানাটানি টিঁকবে না ভাই,
রবার যেটা সেটাই রবে” ।
রবার যেটা সেটাই রবে” ।