বকুল গাছ ও মেয়েটির কথা
বাড়ির পাশে বাগান। বাগানের এক কোনে একটি বকুল
ফুলের গাছ। অনেক ফুল ফোটে সেই গাছে। গাছের পাতার সবুজে ছলকে যায় সূর্যের থোকা
থোকারোদ। ফুলে ফুলে সুগন্ধিত বাতাস। গাছটির খুব যত্ন করে আর ওটার ডালে ঝুলনায় দোলে
মেয়েটি। কথাও বলে ; কেউ জানে না কী কথা হয়
গাছ আরমেয়েটির।
গাছটিতে আসে নানা রকমের পাখি। গান গায়।
বাসা বাঁধে। ফুলে ফুলে ওড়ে প্রজাপতি ও মৌমাছি। মধু খায় মধু নেয়। মেয়েটি রোজ ভোর
বেলা ঝরা বকুলকুড়ায়। কোলে বকুল রেখে মালা গাঁথে। বকুলগাছ মালা গাঁথা দেখে খুশি হয়।
আহা ওর ফুলের কতো যত্ন নেয় মেয়েটি ! জানালা ছুঁইছুঁই বকুল গাছ জানেকোথায় মালা রাখে
মেয়েটি।
মেয়েটি রোজ দুটো মালা গাঁথে। একটা রাখে
মাথার কাছে পিরিচে একটা রাখে বাবার ঘরে দেয়ালে। পরদিন পুরানো মালা দেয়ালে ঝুলিয়ে
নতুন মালা রাখেপিরিচে। বাবার পুরানোটি নিজের ঘরে, বাবার ঘরে নতুন।
বকুলগাছ বুঝতে পারে মেয়েটির কথা। যেমন
বুঝতে পারে প্রজাপতি, মৌমাছি আর পাখিদের
কথা। মেয়েটির মনের কথা ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।বকুলগাছ আর মেয়েটি দুজনেরই জীবন
আছে। মেয়েটি চলাফেরা করতে পারে ; বকুলগাছ তা পারে না।
তবুও দুজনের কথা দুজনই বুঝতে পারে; আরকেউ নয় ! এ সখ্য
দুজনের।
হররোজ ঝিরিঝিরি বাতাসে মেয়েটির অন্তর
ছুঁয়ে যে কথা বেরিয়ে আসে তা নিঃশব্দে বুকে পুরে নেয় বকুল গাছ। মেয়েটিও।
মানুষ কেন অমন হয় না
সকালের খাওয়া সারছিলেন মিসেস শাহানা।
প্রতিদিন একাই সকালের খাওয়া সারেন। তাঁর বয়স হয়েছে। ছেলেমেয়েরা যার যার মতো। সময়ের
বিবর্তন।মেনে নিয়েছেন তিনি। ডায়াবেটিস আছে তাঁর। পরিমিত আহার। আহার শেষে চায়ের
কাপে অতীত দেখছিলেন তিনি। ‘কী পেয়েছেন, কী পাননি’ ঠিক সেহিসেব নয়; আগে কেমন দিন ছিল এখন কেমন চলছে সেই হিসেব মিলাচ্ছিলেন তিনি। এখন যেন
পুরোটা বিশ্ব উথাল-পাথাল। মানুষের মধ্যেআন্তরিকতার ছোঁয়া পর্যন্ত নেই। যার যার মতো
সে সে ! কেন জীবন হয়ে গেল এমন ! মাঝেমধ্যে তিনি এমনই ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে যেতে
চাশেষ করেন। আজও সেরকম ভাবনায় তলিয়ে ছিলেন।
হঠাৎ অনেক কাকের তীক্ষ্ণ চিৎকারে অতীতের
ঘোর কাটলো তাঁর। তিনি ঝুল-বারান্দায় এলেন। দশতলাতে থাকেন তিনি। রাস্তার ওপারে
বাড়ির ছাদেরকার্ণিসে বসে ডাকছে প্রায় বিশ-পঁচিশটা কাক। চক্রকারে ঘুরছে চার-পাঁচটা।
ওদের কা-কা-কা-কা- চিৎকারে একদিকে বিষাদের সুর অন্যদিকে বিদ্রোহের সুর বাজে।
মিসেস শাহানা তাকিয়ে আছেন;
বুঝতে চেষ্টা করছেন। তিনি দেখলেন একটা হুমদো বিড়ালের মুখে কাকের
বাচ্চা। বাচ্চাটাকে বাঁচাবার চেষ্টায় কাকেদেরএই চিৎকার। বিড়ালটির কোন ভ্রুক্ষেপ
নেই। কাক-বাচ্চাটি মুখে নিয়ে সগর্বে ধীরেসুসে' হেঁটে ঢুকে
গেল চিলেকোঠায়। কাকগুলোর বিষণ্ন ডাক বন্ধ হলো।বিষণ্ন হয়ে গেল পরিবেশ। মিসেস
শাহানার মনও খারাপ হয়ে গেল।
মিসেস শাহানা দাঁড়িয়ে রইলেন। মনের ভেতর
দুটো লাইন। এক লাইনে মানুষ অন্য লাইনে কাক। তিনি শূন্যে ছুঁড়ে দিলেন তাঁর ভাবনা -
মানুষ কেন হয়না কাকেদের মতো।