ফিরে দেখা
আমি বেণু
অনেক অনেক
দিন পর তোকে দেখলাম অনি। তুই ও আমাকে দেখে কেমন একটা হয়ে গেলি ঠিক অবাক নয় হতবাক বলতে পারি । অনি তোর সেদিন গুলো মনে পড়ে
কিনা জানিনা।আমাদের ছেলেবেলা আমাদের শৈশবের সোনালী দিন।একসঙ্গে বড়ো হচ্ছি।আমাদের পড়াশোনা
খেলাধুলা গাছে ওঠা সাঁতার কাটা বনে বনে রাঙামাটি র ধূলো মেখে মেখে ঘুরে বেড়ানো সব
একসাথে।আমরা কজন তুই আমি সুধা অমল । শুধু খাওয়া আর ঘুমনোর সময় টুকু ছাড়া আমরা সবসময়ই একত্রে। তুই বৈশাখের ভোরে রোজ একমুঠো
চাঁপাফুল হাতে দিয়ে গালটা টিপে আদর করতিস।যেন কতো বড়ো আমার থেকে ।
হয়তো দু এক বছর কিন্তু ভাব করতিস
যেন অনেক বড়ো ।
আমি অবশ্য মেনে নিয়েছিলাম তোর বশ্যতা । সুধা মুখ টিপে হাসতো।
শাল পিয়ালের বনে যখন বৃষ্টি নামতো আমরা সেই অঝোর ধারায় ভিজে প্রাণের সুরে গান গাইতাম ।
নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে কতো বকুনি খেতাম ।
আমাদের
কিছুই মনে হতো না ।
আবার বৃষ্টি এলে আবার ভিজতাম
। যখন জোরে বিদ্যুত চমকে উঠতো তুই আমাকে
বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতিস । তোর বুকে
মাথা রেখে আমি তোকে আরও জোরে জড়িয়ে
ধরতাম। আমার সব মনে আছে
অনি । স্বপ্নের
মতো ছবির মতো। তোর মনে
আছে কিনা আমি জানি না । জানতে চাই না । আমার সেই
কিশোরী বেলা আমি কোনও দিন ভুলবো না ।
তোর ভালোবাসার স্পর্শ আমি এতো
এতো বছর পরেও অনুভব করি ।
আস্তে আস্তে
আমরা বড়ো হয়ে গেলাম । তুই আগেই স্কুল পাশ করে কলেজে ভর্তি হলি।কোলকাতার বড়ো কলেজে।প্রেসিডেন্সি কলেজ।
আমি গ্রামের স্কুলে তখনো ।
হস্টেল থেকে ছুটিতে বাড়ি এলেই
যে কটা দিন থাকতিস আমাকে একটুও ছেড়ে থাকতে পারতিস না ।
বুঝতে পারতাম আমরা দুজনেই কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারবো না । একেই কী প্রেম বলে জানি না । শুধু জানি
তুই ছাড়া আমি বাঁচবো না।আমি এখন
বড়ো হয়ে গেছি তাই আমার
চলা ফেরা একটু নিয়ন্ত্রনের মধ্যে হয়ে গেছে । বেশী রাত অবধি গল্প করলে
বকুনি খেতাম ।
তবু তুই যে কদিন থাকতিস আমি কোন বারণ
শুনতাম না । বেপরোয়া
হয়ে যেতাম । শেষবার পূজোর
ছুটিতে আমরা সারারাত জেগেছিলাম । কেউ জানে
না । মাঝরাতে
তুই এসে ডেকে নিয়ে গেলি নদীর ধারে।আসন্ন পূর্নিমার চাঁদের আলো ঝকঝক করছে
চারদিকে । কাশ ফুলের
গাছ গুলো দুলছে হাওয়ায় ।
শিরশির
বাতাসে তোর কোলে মাথা রেখে
সারারাত আমি শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখলাম ।
তুই চুম্বনে চুম্বনে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভরিয়ে দিলি। শিথিল শরীরে কতো স্বপ্ন বুনে গেলাম ।
সকালে শুনলাম
তোকে এখুনি কোলকাতা ফিরে যেতে হবে ।
আমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করার সময় হলো না। তুই চলে গেলি ।
আমি অভিমান ভরে বসে রইলাম অনেক দিন । তুই কোন চিঠি কোন খবর কোন যোগাযোগ করার
সময়ই পেলি না ।
পরে পরে
জানলাম তুই নিষিদ্ধ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিস । বাবা
মিলিটারী হুকুম জারি করলেন অনির নাম উচ্চারণ করবে না । আমাকে চোখে চোখে রাখা হতো
। আমি কোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি কিনা । আমার বন্ধু দের ও সবসময় দেখা
করতে দেওয়া
হতো না । অথচ আমি কিছু জানি
না । ঘরের
মধ্যে নিজেকে নিজেই নির্বাসিত করে রাখলাম । কারুর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করতো না।সবাই কে আমার শত্রু মনে
হতো । তুই তো এসব কিছুই জানিস না অনি ।
আজ তোকে দেখে এসে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না ।
আজ গত
দশকের একাত্তর সাল আমার
চোখের সামনে ভেসে উঠলো । বাবা মা আরও সব গুরুজনেরা আলোচনা করেন । আমি শুনতে পাই ।পুলিশের
হাত থেকে অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে ওকে ওর
আমেরিকায় কোন ওর মাসির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে । এ যাত্রা ছেলেটা রক্ষা পেল । আমার সব আশা
সেদিনই ভেঙে গেল গুঁড়িয়ে গেল চির কালের মতো শেষ
হয়ে গেল । অনেক দিন নিজেকে
অন্তরালে রেখে মনটা স্থির করে নিলাম । সকলে আমার ব্যাথা ভোলানোর অনেক কিছু চেষ্টা করতে থাকলো।সবাই আমার প্রিয়জন । আমার দুঃখ
তাদের প্রাণে
বেশী বাজে । আমি আবার মন
দিলাম পড়াশোনায় । কলেজে পড়াকালীন ভালো পাত্র
পেয়ে আমার গুরুজনেরা বিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত নিলেন । আমি অমত করি
নি । তুই তো আমেরিকার থেকে
একবারও কোন খোঁজ নিস নি ।
কোনও
বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করিস নি ।
পৃথিবীর বাইরে তো
আমেরিকা নয় । আমি তোকে ঘেন্না করতে শুরু করলাম ।
মনের মধ্যে একটা আশার চারাগাছ লাগিয়ে ছিলাম । রোজ তাতে জল দিতাম
বাঁচিয়ে রাখার জন্য । জল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি ।
খুব সুন্দর
এক ভালোমানুষ উদারমনা নিরহংকারী স্বামী রূপে
পেলাম । এই সহৃদয় মানুষটি তোর কথা মনে থেকে একদম মুছিয়ে দিলেন । আমার সুপ্রসন্ন ভাগ্য অনেক অনেক
দিয়েছে । চল্লিশ বছর আমাকে এ জীবনে
যা কিছু ভালো যা কিছু সুন্দর যা কিছু অমূল্য
সব দিয়ে গেছেন । আমি তাকে ধরে রাখতে পারি নি সে আমার ভাগ্য
। তবু আজও তিনি আমার
সাথে আছেন এই
বিশ্বাস নিয়ে আমি বেঁচে আছি । ভালো
আছি ।
হঠাত কেন এই অসময়ে
তুই এসে দাঁড়ালি অনি । বেশ তো ছিলাম আমি । কোন অনুষ্ঠানে
আমি যাই না । আজকের অনুষ্ঠান
আমার প্রাণ প্রিয় দুই বন্ধুর । তাই তাদের নাচের
অনুষ্ঠানে আমাকে আসতেই হলো । বন্ধু দুটি আমার
নাতনী ও নাতি । আমার ছেলের ছেলেমেয়ে । আমার জীবনে
এরা আমার আকাশের মতো,দখিনা বাতাসের মতো। আমার শৈশব,আমার কৈশোর,আমার যৌবন শেষে অপরাহ্ণ বেলায় সব ভুলে আমি বেশ তো ছিলাম
অনি ।
প্রোগ্রাম শেষে মিস্টার অনিরুদ্ধ রায় কেন শুধু
শুধু দেখা করতে চাইলেন
আমার সঙ্গে আমি জানি না । তোর পুরো
নাম যে অনিরুদ্ধ আমি ভুলে গেছি । তোর কি
হারিয়ে যাওয়া দিন গুলি খুঁজতে চেয়ে
আমাকে দেখতে
চেয়েছিলি অনি? সে দিন
গুলো একেবারেই মুছে গেছে
অনি।
অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী কথা । আমি অনি
শুধু ষোলো টি বছর আমি বেঁচেছিলাম বাঁচার
মতো । আমার বেণু ছাড়া জীবনে
কেউ আসে নি । বেণু বেণু করে যেদিন গুলি কেটেছিল সেদিন গুলি আমার বেঁচে থাকার স্বপ্ন,
আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা । রাজনীতি
না করেও একটা জালে আমি আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছিলাম সে আমার দুর্ভাগ্য ।স্বজনদের ছেড়ে বিদেশ বিভুঁই বড়ো অসহায়,বড়ো একাকীত্ব আমাকে ছন্নছাড়া করেছে বেণু ।খবর পাই তুমি
সুখে আছো ভালো আছো । আমি নিজের
দুঃস্বপ্ন তোমাকে আড়াল করে রেখেছি । তুমি কষ্ট
পেলে আমি তার হাজার গুন কষ্ট পাই এটাও কি ভুলে গেছো বেণু ।
আমি আমার শেষের দিনগুলি
তোমার শহরে কাটাবো বেণু । খবর পেলাম তোমার
নাতি নাতনীর নাচের প্রোগ্রাম রবীন্দ্র
সদনে । লোভ হলো । যদি তোমাকে একবার দেখতে
পাই । দেখলাম আমার চঞ্চল নদী কতো প্রশস্ত, কতো নাব্য,কতো গভীর । আমি তোমার গভীরে ডুবে যেতে চাই বেণু
।
তোমার । মনের
গোপন কোনে যে চারাগাছ টি আছে জল ঢেলে
ঢেলে যদি নতুন পাতা মেলে আমি সেই আশায় বসে থাকবো চিরকাল তোমার
চরণ তলে। এখন আমার শুধুই
বসে থাকা তোমার কৃপার আশায় । যেদিন
গুলো হারিয়ে গেছে ভাবো
হয়তো আছে ছোট্ট আশা হয়ে । নতুন চারা
লাগাবো আবার মাটি দিয়ে জল দিয়ে নিপুণ
হাতের সেবা দিয়ে
কচি পাতা মেলে গাছটি বড় হবে । আর তো ক টি দিন বেণু ভেবে দেখো তোমার অনি র কথা ।