গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬

চন্দনকৃষ্ণ পাল




ফিরিয়ে দেবার সময়

.    তার তীব্র চাউনী আমাকে ভীত, সম্ভস্ত করে ফেলে। ঝড়ো মেষ তছনছ করে ফেলে পরিপার্শ্ব। আমি বুঝে উঠতে পারিনা কি এমন অন্যায় আমার। আমার অন্যায় ছিলো এটুকুই। দীর্ঘ দিন তাকে আমি সময় দিতে পারিনি। তাকে বুঝিয়ে লিখেছি বার বার। লিখেছি এই মুহুর্তে আমি ভীষন অসহায় মিতু, তুমি আমার অনিচ্ছাকৃত এটি টুকু মার চোখে দেখো। সে দেখেনি। এখন এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে সে আমার অনিচ্ছাকৃত ত্রটি টুকু মার চোখে দেখেনি। সে চোখ দেখে সাত বছর আগে এক তরুন তার সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে স্বপ্নের উত্তাল ঢেউয়ে নাও ভাসিয়ে ছিলো। আজ কম্পনহীন সেই স্থির জলে তার হাত কাঁপছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার। এমনি হয়? হতে পারে? হয় বোধ হয়। আমিতো অন্ততঃ এই মুহুর্তে বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়ে গেছে আমার। কিংবা এমনও হতে পারে সাত বছর আগের সীমাবদ্ধ গন্ডিতে ফিরে গেছি সাতামোধ যুবক আমি। হয়তোবা।

.    সে কিছুই বলেনা। আমিও না। কি বলবো? কিছু কিছু মুহুর্ত আছে মানুষ নির্বাক হয়ে যায়। গরম বালিতে বালায় ধান অনবরত ফুটে ফুটে যখন খই হয়। তার অদ্ভুত ছন্দের মতো মানুষের মুখেও কথা ফুটে। সেই একই মুখ যখন মনের সাথে আঁড়ি দিয়ে ছিপিবদ্ধ করে রাখে তখন আর কে কাকে কি বলবে? না বলা মুহুর্ত গুলো কেটে যাচ্ছে ক্রমাগত। আমরা দুজন স্থির, নিস্কম্প। মিতু তার তীব্র তীখ্ন দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে আমার চোখ থেকে। তার দৃষ্টি এখন নকসী কাঁথা আাঁকা ক্যালেন্ডারের পাতায়। ওর চোখ এখন খুটিয়ে দেখছে ক্যালেনডারের রং রূপ আর আমি চেষ্টা করছি পরিক্রমনরত সময়ে নিরাকার টুকরো গুলোকে অতিক্রম করে যেতে, একটু সহজবাধ্য সমংেয়র মুখ দেখতে। অন্তত মিতু যেন একটু খানি আগের ফর্মে ফিরে আসে এই মুহুর্তের একান্ত চাওয়া আমার শুধু এইটুকু।

.    আমার বাধ্যতার কথা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই এক ফোটা কোন মানুষ কি কখনো নিজে ব্যর্থ হতে চায়? চায় না। অন্ততঃ আমি চাইনি। আমার কৌশর অন্য দশটা ছেলের মতো খেলার মাঠ আর স্কুলের গন্ডিতে কাটেনি। আমার খেলার মাঠ, বন্ধুদের আড্ডা বলতে কিচু ছিলো না। স্কুলের কঠোর সময়টুকুর পর আমাকে এক পাল গরুর পিছনে ছুটতে হয়েছে। একরাশ কান্তির মেঘ মরীরে মেখে সন্ধ্যে বাড়ী ফিরে আমি নিরুদ্বিগ্ন বসে থাকতে পারিনি। বাজারের বিশাল হলে,তেলের টিন,কেরসিনের পাত্র নিয়ে ছুটে যেতে হয়েছে বাজারে। রাতে বাড়ি ফিরে বই খুলতেই চোখের সামনে কান্ত প্রজাপতির ডানা মেলা। গভীর ঘুমেই কেটেছে রাত। স্বপ্ন দেখার সময় কোথায়? তারপর দিন কেটেছে রাত কেটেছে। শত প্রতিকূলতার মাঝে স্কুল তার গন্ডিতে আটকে রাখতে পারেনি আমাকে। কলেজের স্বাধীন চত্তর স্বাগত জানালেও আমি তাকে সংগ দিতে পারিনি। আমার রঙিন বান্ধবীরা কষ্টের সলতে বাড়িয়ে দিতে জিজ্ঞেস
করেছে,তপু তুই এতো চুপচাপ থাকিস কেন?
 
. সেদিন ২১শে ফেব্রয়ারি। কামাল ভাই এর সম্পাদনায় একুশে সংকলনে আমার প্রথম লেখা ছাপার অরে প্রকাশ হবা কথা। ভোর পাঁচটায় উঠে ফুলের গুচ্ছ নিয়ে ছুটে যাচ্ছি চার কিলোমিটার দূরের আমার প্রিয় শহরে। আমি একা গ্রামের মানুষ একুশ বুঝে না। তাদের ফুল দেবার তাড়না নেই। শেষ বাড়িটার নীল গেটে সে কিশোরী লাল গোলাপ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে ছিলো। তাকে দেখে প্রথমে বারের মতো চকমাই আমি। কিশোরীর চোখের চাহনি আমাকে সমুদ্রের গভীরে ছুড়ে দেয়। ওরও সাথী নেই। ওর চোখ বলে দেয় ও সাথী হবে। আমার চোখও বুঝি অজান্তেই বলে ফেলে এসো। ও আমার সাথেই পা বাড়ায়। নাম জানা হয়ে যায়। মিতু। চৌরাস্তার মোড়ে প্রভাত ফেরীর মিছিলে পাশাপাশি হাটি দুজন। মিতুর চোখ বড্ড টানে। শহীদ মিনারের পাদদেশে ফুল দিয়ে ফিরে আশার সময় মিতুকে পাইনা আমি। শুধু ওর চোখ আর হাসি বুকের গভীরে ডানা মেয়ে ওড়াওড়ি করে। তপুর বুকের গভীরে এক গোলাপ কুড়ি পূর্ণ হতে থাকে দিন দিন।
.
    একদিন কলেজ চত্তর আমাকে বিদায় জানায়। বন্ধু বান্ধবীরাও। আমি ভার্সিটির বিপুলায়তন ক্যাম্পাসে নিজেকে ছুড়ে দেই। মিতুও ভীষন খুশি। আমার বুকের গভীরে বেড়ে ওঠা গোলাপ কুঁড়ি তত দিনে পূর্ণ গোলাপ। আমার হাতে হাত রেখে মিতু প্রতিজ্ঞা করে তোমার জন্য অপোয় আছি, থাকবো আমি। বাড়ির আর্থিক সহযোগিতা পাইনা। কারন আমি বুঝি। আর সেজন্যই বিকল্প রাস্তা খুঁেজে নিতে হয়। পুরনো বন্ধুরা ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। টিউশানীর প্রচন্ড চাপ পড়ার চাপ সব সামলাতে হিমশীম খাই। তবুও প্রায় প্রতি সপ্তাহে মিতুর চিঠি অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে রাখে আমাকে। বাড়ি যাই খুব কম। ছাত্র-ছাত্রী, নিজের পড়াশুনা সময় দেয় না আমাকে। মাষ্টার্স ফাইনাল হয়ে যায়। মুক্তির শ্বাস ফেলি। মিতুরও গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট। দরখাস্তের পর দরখাস্ত চলে। মামা-চাচাহীন রাজধানী বিট্রে করে বার বার। তবুও এক সময় ফুল ফুটে, ফল ধরে। বাড়ি যাই। সবাইকে জানাই। একান্তে মিতুকেও। আমার মিতু প্রথম চুম্বনে আমাকে প্রকম্পিত করে। মাত্র তিনমাসের মধ্যেই মিতুও একটা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মী হয়ে ওঠে। চুম্বন ফেরত দেবার পালা আমার। কিন্তু ট্যুর আমাকে মিতু থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
.
    মিতুর কষ্ট ছোয়া চিঠি পাই। বুকের ভেতর কান্নার বরফ জমে। জমতেই থাকে। অনেক দায়িত্ব ঘাড়ে আমার ইচ্ছে করলেই প্রি সান্নিধ্য পেতে পারি না। এক শীতের দুপুরে মিতুর চিঠি আসে। সামান্য লাইনে আতি। ভরে আমার বুক কাঁপে। কিন্তু বিশেষ তদন্ত কাজে পাঁচ দিনের ট্যুরে দিনাজপুর যেতেই হবে। জমানো বরফ কঠিন শীলা হয়ে ওঠে। সংেেপ অবস্থা জানাই। তার পর যাত্রা করি ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। যথাসময়ে রাজধানীতে ফিরি। যাত্রাবিরতী না রেখেই ছুটি মিতুর কাছে। ওর অফিসে পৌছাই ঝড়ো কাকের মতো চেহারা নিয়ে। মিতুর কলিগ দেখে চমকায়। ও সব কিছু জানে। আমার অবস্থা বুঝে নেয়। একটা ঠিকানা লিখা কার্ড মেলে ধরে। ওখানেই আছে। পৌছাই। মিতুই দরোজা খুলে দেয়। আমাকে দেখে। দরোজা ছেড়ে সরে দাড়ায়। ভিতরে আসি। সোফায় গা এলিয়ে দেই। দীর্ঘ জার্নির কান্তি আমার শরীরে। মিতু দাড়িয়েই থাকে। ওর তীব্র চাউনী আমাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে ফেলে। তছনছ করে ফেলে পারিপার্শ্ব।
.
    ক্যাল্ডোর থেকে চোখ সরায় মিতু। আমার চোখে ওর চোখ। আগের তীব্রতা নেই চোখে। আমি উঠে দাড়াই। হত-বিহ্বল ভেঙ্গে পড়া মনে হয় ওকে। ওর হাত দুটো তুলে নেই হাতে। কি হয়েছে মিতু? ওর মুখ থেকে একটা কথাও বের হয় না। শুধু আমার প্রিয় দুটো চোখ থেকে জলধারা নেমে আসে। বুকের কাছে টেনে নেই ওকে। মিতু অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কান্নার গমকে কেঁপে ওঠে বার বার। আমি বুঝে নেই এই কান্নার অর্থ। পাওয়া আর না পাওয়ার সন্ধিস্থলে দাড়ালে এরকম কান্না চুয়ে যাবেই। ধীরে মিতু স্থির হয়ে আসে। ওকে হাত ধরে বসাই। বসি। মাটির দিক থেকে চোখ তুলে তাকায় মিতু। জলের দাগ মুছিয়ে দেই। ওর চোখের ভাষা পড়তে পাড়ি সহজেই। সবাইকে ছেড়ে ছুড়ে বেরিয়ে এসেছে মিতু। সারা জীবনের জন্য। আমার চুম্বন ফিরিয়ে দেবার সময় এখন।