গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

দেবাশিস কোনার



অসহায়


অশরীরী আত্মার কথা অনেক শুনেছে শুভাশিস । ভয়ে গা ছম ছম করে উঠত তখন । এখন কিছুটা হলেও বোঝে , সে সবই ছিল এক কাল্পনিক অনুভূতি । এই অনুভূতিই মানুষকে বিপথে চালিত করে । ভূত এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার শেষ নেই শুভাশিসের । চারিদিকে মারকাটারি একটা ভাব । যেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে । তুমি সেই যুদ্ধে কোন পক্ষ অবলম্বন করেছো , সেটা বিচার করা হবে । এ সব আর ভাল লাগেনা তার । সে কখনও অভিনয় করতে শেখেনি । কালোকে কালো আর সাদাকে সাদা বলতে তার কক্ষনো ভয় করেনি । আজকের যা দিনকাল বোধহয় এখন অমন কথা আর বলা যাবে না । শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ভয়ের স্রোত শিরশির করে নেমে আসে । সেই অশরীরী আত্মার অনুভুতির মতো এক দুরন্ত বেগে ধেয়ে আসা ঝড় । শুভাশিস বড় অসহায় বোধ করে ।

          দুই কন্যার জনক শুভাশিসের বাবা মা দুজনেই ইহকালের বন্ধন ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন । তাঁরা গত হবার পর থেকে শুভাশিস একা । একা হয়তো সেই অর্থে নয় । স্ত্রী এবং দুই কন্যা নিয়ে তার সংসার । রাজনীতির মারপ্যাঁচ সে বোঝে না । কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যে দলের সান্নিধ্য পেয়ে এসেছে সে তাদের আনুগত্য থেকে কোন এক অজানা কারনে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না । এই না পারাটাই তার দোষ । সে যদি অন্য পাঁচজনের মতো জামা বদলাতে পারতো তাহলে কোনও সমস্যাই হত না । 

          ছেলেবেলার শোনা ভূতের গল্প বা অশরীরী আত্মার গল্পের মতো তার মনের গভীরে গেঁথে গিয়েছিল কয়েকজন দেশপ্রেমিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম , যারা মানুষের জন্য জীবন দিতেও ভয় পেতেন না । যেমন  গণেশ ঘোষ , মাস্টারদা সূর্য সেন , ভগত সিং , রাজগুরু , হরেকৃষ্ণ কোঙার , জ্যোতি বসু প্রমুখ । শুভাশিসের বাড়িতে বসত তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং । তার বাবা ছিলেন সে সময়ের পার্টি সদস্য । তাই সে ওই দলটার অনুগত্য ত্যাগ করতে পারে না । কোথায় যেন একটা বাঁধ বাঁধ ঠেকে । একবার সে ভেবেছিল যে এই দলটা ত্যাগ করে শাসক দলে যোগ দেবে । সব কিছু ঠিকঠাক । তাদের গ্রামে শাসক দলের দু-নম্বর ব্যক্তিত্ব আসবেন আর সেখানেই তাকে দলীয় পতাকা হাতে ধরিয়ে বরণ করে নেওয়া হবে নতুন দলে এমনটাই স্থির ছিল । কিন্তু তার আগের দিন সারাটা রাত শুভাশিস ঘুমাতে পারে নি । সকাল হতেই সে ছুটে গিয়েছিল পাগলু সোমের কাছে । এই পাগলু এখন গ্রামের মাতব্বর । শাসক দলের নেতা । তার মুখের কথা ছাড়া গ্রামে কোন কাজ হয় না ।
          পাগলু তার কথা শুনে তো রেগে খাপ্পা । সে বলে , ‘কাকা , ওই চিনের দালাল , দেশদ্রোহী দলটা ছেড়ে দিতে তোমার কিসের ভয় ? ওরা আর কোন দিন ক্ষমতায় আসবে না !
          শুভাশিস বলে , ‘ কি করব বাপ , কাল সারাটা রাত ঘুমোতে পারি নি । এতদিন ধরে করে এসেছি তো । আমি পারবো না ।
         ঠিক আছে । তুমি যা ভাল বোঝো কর ! তবে আমার সম্মানটা থাকল না । রাগত স্বরে বলে ।
         আমার ভীষণ ভুল হয়েছে বাবা ।শুভাশিস আমতা আমতা করে ।
          পাগলু বলে , ‘ ঠিক আছে তুমি এখন এসো ! ভবিষ্যতে আর যেন দায়ে-বিপদে আমার কাছে ছুটে এসো না !মাথা হেঁট করে ফিরে এসেছিল শুভাশিস । বাবার কাছথেকে শেখা ছেলেবেলার অনেক কথা তার মনে পরেছিল ।  বাবা বলতেন সমাজ পরিবর্তনের কথা । বিপ্লবের কথা । চোখের সামনে ভাসত স্বপ্ন । আচ্ছা স্বপ্ন দেখা কি পাপ ? সে এখনও স্বপ্ন দেখে ।
 
তারপর থেকেই শুভাশিসের জীবনে ভয়টা তাড়া করে বেড়াচ্ছে । কামদুনি , মধ্যমগ্রাম , কাটোয়া , পার্ক স্ট্রিট প্রভৃতি একের পর এক ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা আর তার ঘরে দুই যুবতী কন্যা এই নিয়ে একটা চিন্তা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে । ভাবিয়ে তুলেছে প্রবল অপপ্রচার । কমিউনিস্ট দলটা নাকি দেশদ্রোহী । শুভাশিসের বিশ্বাস কমিউনিস্টদের মতো দেশপ্রেমিক আর কোন দল নয় । ভারতবর্ষে এত যে দুর্নীতি এতে একজন কমিউনিস্টও যুক্ত নয় ।এতো কুৎসা !

প্রথম এল সুমিতার কাছে একটা প্রেম পত্র । একটা আপাত নিরীহ চিঠির যে এতো মহিমা তা শুভাশিসের জানা ছিল না । চিঠিটা খুব সম্ভবত তার প্রাচীর ঘেরা বাড়ির বাইরে থেকে প্রেরক ইট মুড়ে ছুড়ে মেরেছিল । সে চিঠি পরবি তো পর তার হাতেই এসে পরল । চিঠিটির নীচে প্রেরকের কোনও নাম লেখা ছিল না । সুমিতাকে কারোর ভাল লেগে থাকতেই পারে । সেজন্য সে প্রেমপত্র পাঠালেও দোষের কিছু নেই । মেয়েরা বড় হয়েছে । তাদের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন চিন্তা করার অধিকার আছে । এ বিষয়ে শুভাশিস লিবার‍্যাল । তাই সে চিঠিতে কি লেখা আছে পড়ে মেয়ের হাতে ধরিয়ে দেয় । বলে , ‘ দেখ সুমি , তোর একটা চিঠি আম গাছের তলায় পড়ে ছিল ।
সুমিতা চিঠিটা খুলে পড়তে গিয়েই হাতের লেখা দেখে চিনতে পেরে গজগজ করতে লাগল । বলল , ‘দেখ বাবা , এই ছেলেটা বহুদিন ধরে আমাকে বিরক্ত করছে । বাড়ি অবধি ধাওয়া করছে ।কলেজে জেতে আসতে আমাকে ফলো করছে ।
শুভাশিস আকাশ থেকে পরল । ছেলেটা কে ? কি তার নাম ? কোথায় থাকে ? সে সব কিছুই জানে না সে । তার মানে সুমি ওকে আগে থেকে চেনে । শুভাশিস শান্ত হয়ে বলে , ‘অত মাথা গরম করিস না মা ! আমাকে সবটা খুলে বল দিকি !
সুমিতা যা বলল তার মর্মার্থ এরকম ,-- ছেলেটির নাম বিক্রম । ক্লাশ এইট পাশ । বাবার অঢেল টাকা । রাইশ মিল আছে ।প্রচুর জমি জমা । সুমিতাকে ওর খুব পচ্ছন্দ । ওকে বিয়ে করতে চায় । কিন্তু ওরকম কঅক্ষর গোমাংস ছেলেকে সুমিতার পচ্ছন্দ নয় । সুমিতা সে কথা ওই বাঁদর ছেলেটাকে জনিয়েও দিয়েছে । কিন্তু ছেলেটি নাছোড় ।
শুভাশিস পরল মহা ফাঁপরে ! এখন কি করে সে ? একটি উপায় আছে তার । পাগলুর কাছে যাওয়া । তাকে গিয়ে সব খুলে বলা । গ্রামের ছেলে তো ।যতই হোক । মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না । শুভাশিস যাব কি যাব না করতে করতে হাজির হল পার্টি অফিসে । সেখানে মধ্যমণি হয়ে বসে থাকা পাগলু তাকে দেখেও না দেখার ভান করল । ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল শুভাশিস । শেষে আর না থাকতে পেরে সে বলে উঠল , ‘ পাগলু , বাবা তোমার সাথে ব্যক্তিগত কিছু কথা ছিল । একটু যদি শোন !
তোমার সাথে ব্যক্তিগত কথা ? না-না । একবার আমি ঠকেছি , আর না । তোমার যা বলার আছে এখানে সবার সামনে বল ! এরা সবাই আমার দলের ছেলে
কি আর করে সে ? সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলে সকলের মাঝখানে ।  
সবটা না শুনেই পাগলু বলে , ‘কাকা , ভুল করছেন ! বিক্রম আমদের দলের ছেলে । ওর মতো ছেলে আর একটাও খুজে পাবে না এ তল্লাটে । ওর সাথে সুমির বিয়ে দিয়ে দাও !
শুনে আকাশ থেকে পরে শুভাশিস । বলে , ‘কি বলছ পাগলু ? আমার সুমি লেখাপড়া শেখা মেয়ে আর বিক্রম ক্লাশ এইট পাশ ?’
তো ? আপনার মেয়ে লেখাপড়া জানে বলে কি বিয়ের পরে রান্না করবে না ? 
তা হয়তো করবে । কিন্তু ---
পাগলু হটাত কেমন যেন বদলে যায় । বলে ওঠে , ‘তোমাদের ওই সব ভ্যান্তারা ভাল লাগেনা । শুনে রাখ বিক্রমের পরিবার আমাদের সমর্থক । আর তুমি ---- কথা শেষ না করেই বলে , ‘এখন কেটে পর ! আমি যা বলার বলে দিয়েছি
এর পর থেকেই নিজেকে বড় অসহায় লাগছে শুভাশিসের । দেশে কি কোন আইন নেই ? ভুতের ভয় আর অশরীরী আত্মার ভয় আবার কি তাহলে ফিরে আসবে তার জীবনে । নিজের বিশ্বাস আঁকড়ে কি বেঁচে থাকার কোন অধিকার এই দেশ তাকে দেয় নি ? তার জেদ চাপে।