গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬

ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী



  ঘোষবাবু

যাবার আগে বন্ধুরা পইপই করে বলে দিল, যে ব্যাঙ্কের যে দারোয়ান আছে, ‘ঘোষবাবু’ বলে সবাই,একটু ছিটগ্রস্থ পাবলিক,বেশি কথা না বলাই ভালো। এমনিই আমি পাগলদের বেশ ভয় পাই,তাই বন্ধুদের কথায় মুডটা পুরো চটকে গেল। কেন যে আমাকে কথা গুলো ওরা বলল, আমি খামোখা দারোয়ানের সাথে কথা বলতে যাব কেন, আমি যাব টাকা জমা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে। আমার নতুন চাকরি, হায়দ্রাবাদ থেকে আজ প্রায় পাঁচ বছর পর কলকাতায় আমি ফিরে এসেছি। নিজের শহরে ফিরে এসে বেশ ভালো লাগছে,পড়াশুনো স্কুল লাইফ সবই এই শহরে। আমাদের অফিস থেকে ব্যাঙ্ক খুব দূর না হলেয় হাটা পথে ১৫ মিনিট। অফিস থেকে বেরিয়ে চট করে সিগারেটটা ধরিয়ে নিলাম, অফিসে আনেকখন বসে থাকার পর মনটা সুখটানের জন্য ছটফট করছিল। কাগজ পত্র বের করে আরেকবার দেখে নিলাম, সব ঠিক আছে কিনা। যাই হোক, আমি কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা ব্যাঙ্কের ভিতরে ঢুকে গেলাম। আর চোখে একবার দারোয়ান ভদ্রলোকটিকে দেখে নিলাম। সুপুরুষ ব্যাক্তি, বয়স ৫৪-৫৫ মতন হবে,মধ্যপ্রদেশ কিঞ্চিত বড়, বলিষ্ঠ কাঁধ। সবচেয়ে চোখে পরার মতন হল তার গোঁফটি, একবারের দারোয়ানের মতনই দেখলে একটা সম্ভ্রম জাগে। এক ভদ্রলোককে দেখি কি সব বোঝাছেন এই ঘোষবাবু আর ভদ্রলোকও বাধ্য ছাত্রের মতন বিনা বাক্যবায়ে মন দিয়ে শুনছেন। আমার বেশ হাসিই পেল ঘোষবাবুর বলার ভঙ্গি আর ভদ্রলোকের শোনার ভঙ্গি দেখে। খুব কৌতুহল হল,ওই ভদ্রলোক আসতে জানতে চাইলাম, “দাদা, কি বলছিলেন উনি”? ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, “আর বলবেন না, আমি একটা লকার নিয়েছি এখানে, তো আমার লকার টা একটু টাইট কিছুতেই খোলা যায় না আর সেই জন্য ঘোষবাবু কে বার বার ডাকতে হয়। উনি লকারের জয়েন্টটাতে একটু সরষের তেল দেন তাতে লকার টা খুলে যায়। আর তাই উনি আমাকে বলছিলেন যে জীবনে যখনি কোনো কাজ হয় না তখনি একটু তেল দিলে সব কিছু ভালো ভাবে হয়ে যায়, এই আপনারা শুধু এর সাথে ভাল,মন্দ এই সব যোগ করেন”। বলেই ভদ্রলোক হাসতে লাগলেন,আমারও বেশ হাসি পেল। 

ব্যাঙ্কের কাজ প্রায় শেষ,আমি একটি পিন খুজছি,হঠাৎ দেখি ঘোষবাবু আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। বেশ ঘাবড়ে গেলাম, কি মুশকিল! খামোখা আমার দিকে আসছেন কেন, আমি তো কিছু জানতে চাইনি। এসে বললেন, “দেখি,ক্যাশ জমা দেবার স্লিপটা।” আমি ভ্যবাচাকা খেয়ে উনার হাতে স্লিপ টা দিলাম। উনি নিজের হাতের বই টা আমার হাতের দিকে বারিয়ে বললেন, “এই বইটা সামনের টেবিলে রেখে দিন তো”। আমি বই টা নেওয়ার সাথে সাথে উনি বললেন, “থাক, থাক, আমি রাখছি”। এই বলে নিজেই রেখে এলেন। এসে বললেন, “বুঝলেন, কত লোক তো দেখলাম জীবনে,দারোয়ানের ফরমাশ সবাই খাটতে চায় না, ক্ষেপে যায়”। তারপর ক্যাশ জমা দেবার স্লিপটা দেখে বললেন, “আপনারা সবাই শিক্ষিত লোক, আমি তো অশিক্ষিত, তা ক্যাশ যখন জমা দেন তখন নিজের কাছে যে অংশটা থাকবে তা পুরো ভর্তি করেন না কেন, অন্যকে সুযোগ দেবেন কেন, নিন তারিখটা বসান”। আমি অবাক হয়ে গেলাম পুরদস্তুর, কিন্তু কোথায় যেন ভিতরে বেশ একটা ভালো লাগার বোধ কাজ করছিল।