গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬

স্বাগতা মুর্মু (মুখার্জী)




সিদ্ধান্ত



আজ পাপিয়ার বৌভাত,নতুন জীবনে প্রবেশ করছে আজ সে। সারাদিন ভালোই গেল গোল বাঁধল রাতে..হঠাৎ শাশুড়ি ননদ বড় জার সাথে ওর বর রাজার খুব তর্কাতর্কি শুরু হল,ব্যাপারটা কি সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না। খুব ভয় পেয়ে গেল পাপিয়া। হঠাৎ রাজা খুব রেগে ঘরে এসে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এল। আশ্চর্য কেউ বাধা দিল না। কিছুই বুঝে ওঠার আগেই রাজা বলল "তোমাকে আগেই বলেছিলাম এবাড়িতে কেউ আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে না,আলাদা থাকব তোমার জেদ ছিল আলাদা থাকবে না,এবার বোঝ। এখন সারারাত বায়রে কাটাও।" কি বলবে বুঝে পাল না পাপিয়া । কি যে ঝামেলা তাই তো বুঝতে পারল না,কাকে নিয়ে সমস্যা তাই বুঝতে পারল না,রাজাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও খারাপ লাগছে। এই সেই রাজা যার সাথে বন্ধু রশ্মির বাড়ি গিয়ে তার দাদার বন্ধু হিসেবে আলাপ,সেখান থেকে ভালো লাগা,ভালোবাসা। কথায় কথায় জেনেছিল ওর দাদা ভালো চাকরী করে বিদেশে থাকে বলে বাড়িতে খুব খাতির আর রাজা একটা কলেজের প্রফেসর হয়েও ওকে কেউ সম্মান তো দূর ভালোবাসে না।মাও সারাক্ষণ শুধু রাজার দাদার কথাই বলে যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে রাজার ডাকে চমকে উঠল,দেখল একটা হোটেলের সামনে গাড়ী দাঁড় করিয়ে পাপিয়াকে নেমে আসতে বলছে। আজ রাতটা এই হোটেলেই কাটাতে হবে সেই রাতটা ওরা হোটেলেই কাটাল
কাকভোরে শাশুড়ি ফোন করে বাড়ী আসতে বললেন। পাপিয়া বুঝল বাড়ীর অতিথিদের কাছে মুখ দেখানোর উপায় নেই তাই বাড়ী যেতে বলছে। রাজাকে অনেক কষ্টে রাজী করিয়ে বাড়ী নিয়ে এল। যাইহোক তারপর কিছুদিন আর কোন ঝামেলা হয় নি। ঠিক ১মাসের মাথায় কাজের জন্য পুণা গেল রাজা আর ওইদিন থেকেই শুরু হল পাপিয়ার ওপর মানসিক অত্যাচার। অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করার মেয়ে পাপিয়া নয়।মাঝে মাঝেই প্রতিবাদ করত। কিন্তু লাভ হত না। এরমাঝে রাজাও ফিরে এল,পাপিয়া সব বলল শুরু হল আবার ঝামেলা। ওরা যে কোন উপায়ে পাপিয়াদের বাড়ী থেকে বের করতে চাইছিল। যে রাজা বিয়ের আগে বলেছিল আলাদা থাকবে সেই রাজাই হঠাৎ বেঁকে বসল,বলল সহ্য করতে,মানিয়ে নিতে কারণ এই বাড়ী থেকে বেরলে আর কোনদিন ফিরতে পারবে না এখানে ওরা ঢুকতেই দেবে না। পাপিয়া চুপ করে যায়।কিন্তু সেইদিন আর সহ্য হল না সেদিন রাজা সবে অফিসে বেরিয়েছে আর তখনই ওর ননদ এসে খুব আজেবাজে কথা বলে অপমান করল,এমনকি গায়ে হাত তুলতে গেল,সেইদিন পাপিয়া বেরিয়ে এল শ্বশুরঘর ছেড়ে।  ফোন করল রাজাকে,সব জানাল।রাজা অদ্ভুত শান্ত গলায় বাড়ী ফিরে যেতে বলল।না ফেরে নি পাপিয়া,ওর প্রবল আত্মসম্মানবোধ ওকে ফিরতে দেয় নি। রাজাকে অনেক বুঝিয়েও লাভ হয় নি। পাপিয়া বাবা-মা এর কাছে ফিরবে না ঠিক করল।এমনিতেই বাবা - মা এখন ভাইয়ের কাছে শিলং এ গেছে,মাস ৬এর আগে ফিরবে না। তাই ওর বন্ধু অহনার কাছেই সাহায্য চাইল। অহনার মা পাপিয়াকে খুব ভালোবাসেন কিছুতেই অন্য কোথাও থাকতে দিলেন না,ওদের বাড়ীতেই থেকে যেতে বললেন। এরপর মাঝে মাঝেই অহনার মা পাপিয়াকে বোঝাতেন নিজের মায়ের মত করে যে সব সংসারে অশান্তি হয়, তাই বলে অভিমান করে ঘর ছাড়তে নেই।রাজার সাথে কথা বলতে বলতেন। এইভাবে কেটে গেছে এরপর আরো ২মাস।পাপিয়া এর মধ্যে চাকরি পেয়েছে। রাজা আজকাল ফোন করলেই বলে ফিরে আসতে, মানিয়ে নিতে। বিরক্ত হয়ে ফোন করাই বন্ধ করে দিল। ৬মাস কেটে গেছে। অফিস ফেরার পথে দেখা হল সোহমের সাথে, কলেজ ছাড়ার পর অনেক বছর বাদে পুরোন বন্ধুর সাথে দেখা দুজনে গল্প করার জন্য কফি শপে ঢুকল। সোহমের কাছ থেকে অনেক বন্ধুদের খবর পেল।আর খবর পেল রক্তিম এর। রক্তিম যাকে পাগলের মত ভালোবেসেছিল পাপিয়া কলেজে পড়ার সময়।কিন্তু রক্তিম ওকে প্রশ্রয় দিলেও ওকে ভালোবাসে নি।পুরোটাই ছিল একতরফা। জানতে পারল রক্তিমের বিয়ে হয়েছিল তারপর ওর বউ ওকে ছেড়ে আর একজনের সাথে চলে গেছে। এখন রক্তিম চাকরি ছেড়ে দিয়েছে সারাদিন শুধু মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকে। কোথাও যেন একটা কষ্ট হচ্ছিল পাপিয়ার। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। বারবার মনে হচ্ছিল যদি একবার রক্তিমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারত!
রাতে ফিরে এসে ফোন করল রাজাকে অনেকদিন পরে। রাজা শুধু বলল যদি ও ফিরে না আসতে চায় তাহলে এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মানেই হয় না। পাপিয়া নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, ও তো সম্পর্কটা জোড়া লাগাবার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল, রাজা কিছু না শুনেই এত বড় কথা বলে দিল....খুব অভিমানে ফোন রেখে দিল পাপিয়া। এতমাসে রাজা নিজে থেকে একবার ও ফোন করে নি আর আজ যখন অ ফোন করল তখন এই কথা শোনালো রাজা! কি করবে ভাবতে ভাবতে সারারাত কেটে গেল। মনের মধ্যে অশান্তি থাকলে সব কিছুতেই তার ছাপ পড়ে, পাপিয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হল না। কাজে ভুল,অফিসে বসের কাছে কথা শোনা চলতেই থাকল মাঝে মাঝে। একদিন রাতে ঘরে ফিরে রাজার পাঠানো ডিভোর্স এর চিঠি দিল অহনা। পাপিয়ার মনে হল পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। কোনপ্রকারে নিজের ঘরে এসে চিঠিটা নিয়ে পাথরের মত বসে রইল। নিজের অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে এল। ঠিক এইসময় মোবাইলটা বেজে উঠল,সোহমের ফোন। না আজ ও কারুর ফোন ধরবে না ভালো লাগছে না। বার কয়েক বেজে থেমে গেল। পাপিয়া শুধু রাজার ফোনের অপেক্ষায় আছে এখন। আবার বাজছে.... একটানা বেজেই চলেছে...খুব বিরক্ত হয়ে মোবাইল অফ করে দিল।আজ সে শুধু নিজেকে সময় দিতে চায়। সকালে অহনার ধাক্কায় ঘুম ভাংগল, কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে নিজেই জানে না। অহনাকে দেখে কিছু বলার আগেই অহনা বলে উঠল "রক্তিম নেশার ঘোরে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল কাল রাতেই সোহম খবর দিয়েছে তোকে ফোনে না পেয়ে। খুব একটা সাংঘাতিক কিছু নয় আঘাতটা ডাক্তার বলেছেন  তবে একটু সাবধনে থাকতে হবে।আজ ই ছেড়ে দিচ্ছে বাড়ী নিয়ে আসছে,যাবি নাকি দেখতে?" আবার সেই মনের কোনে ব্যাথাটা যেন চিনচিন করে উঠল...তবে কি এখনো রক্তিমকে ভালোবাসে?  নাকি.....  যাইহোক একবার যাবে দেখতে। 
অহনার সাথে কতবছর পরে রক্তিমের বাড়ী পা দিল পাপিয়া। পাপিয়াকে দেখে খুব অবাক হল রক্তিম, মনে মনে খুশিও হল। ডাক্তার কথা বলতে বারণ করেছে তাই সেদিন একটু থেকে চলে এল। এরপর পর পর কয়েকদিন পাপিয়া গেল রক্তিমকে দেখতে,এখন অনেক সুস্থ অনেক গল্প করল। ফিরে আসার মুহুর্তে রক্তিম হঠাৎ ওর হাতটা ধরল, খুব অপ্রস্তুতে পরে গেল পাপিয়া, শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল..এই হাতটাই তো একদিন ধরতে চয়েছিল। কিছু বলার আগেই রক্তিম বলল " আমি তোকে সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম,দুজনেই ভুল মানুষকে বিয়ে করে ঠকেছি, তোর সম্পর্কটাও আজ টলমটল করছে। আমরা কি নতুন করে কিছু ভাবতে পারি না?" কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না পাপিয়া শুধু শুনতে পাচ্ছিল ব্যাগের ভেতর মোবাইলটা বেজে যাচ্ছে। কোনরকমে হাতটা ছাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল রাজার নামটা জ্বলজ্বল করছে। না আর কিছু ভাবতে পারল না পাপিয়া বুকের ধুকপুকানি যেন শতগুণ বেড়ে গেছে,এটার ই তো অপেক্ষায় ছিল এতদিন। আজ সে রাজার ফোন ধরবে না,আজ সে রাজার কাছে যাবে, রাজা তো চেয়েছিল ও ফিরে আসুক...  আজ সে এই সম্পর্কটা জোড়া লাগাবেই। শেষ চেষ্টা করতেই হবে...একছুটে সে রক্তিমের বাড়ী থেকে বেরিয়ে এল সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসে গেছে, পাপিয়া বুঝেছে সত্যি ও আজ কাকে ভালোবাসে,ওকে যে ফিরতেই হবে রাজার কাছে। উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে চলল... মোবাইলটা তখনো বেজে চলেছে....