গাছটা আমার খুব প্রিয় ছিল । মানে
গোলাপ গাছটা । তখন আমার ছেলেবেলা । বন্ধু বলতে ছিল ওই গোলাপ গাছটাই । সকাল থেকে
সন্ধে পর্যন্ত গোলাপ গাছের তলায় বসে থাকতাম , আপন মনে কত কথা বলতাম , জল দিতাম, ছোট্ট হাত দিয়ে গাছের গোঁড়ার মাটি
খুঁচিয়ে দিতাম … আবার মা বকা দিলে মুখ ভার করে গোলাপ গাছের নীচে এসে বসে থাকতাম আর
কাঁদতাম । গোলাপ গাছ তার দীর্ঘ দেহ আর একঝাঁক ফুল – পাতা
সহ আমাকে সান্ত্বনা দিত । গাছটা আমার সমান বয়সী । বাবা বাজার থেকে নানা রকম সার
কিনে এনে দিতেন গাছে , করতেন স্প্রে – তাই গাছটা প্রায় ছ ফুট সমান লম্বা হয়েছিল অল্প দিনেই । ফুল হত প্রচুর ,
গন্ধও সুন্দর । আজও চোখ বন্ধ করলে তা ভেসে ওঠে । কত মানুষ আসতেন
। সুখ্যাতি করতেন । ফুল নিতেন ,আবার ডালও নিতেন – আমার খুব রাগ হত ; কখনও বা ঝগড়াও করতাম । বাবা
বকতেন । --বড্ড কিপটে হয়েছিস আজকাল । গাছে এত ফুল ,কেউ নেবে না । --কেন নেবে ? --কেন আবার ! ফুল
তো নেবার জন্য ,ঘর সাজাবার জন্য । তাছাড়া লাল গোলাপ সবার প্রিয় … --হোক প্রিয় ।
ফুল ছিঁড়ে নিলে গাছের লাগে না বুঝি ? বাবা হেসে বলতেন ,ধুউস বোকা …এসব কথা তোকে কে বললে ? অমনি আমি বলতাম ,কেন
মাস্টারমশাই সেদিন বলেছিলেন ,গাছের প্রাণ আছে , গাছও উত্তেজনায় সাড়া দেয় , তাদের ভাষা বুঝিনা
বটে , তারাও কথা বলে , আঘাত
লাগলে কান্না করে—গাছই তো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে ,বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু তা প্রমাণ করেছেন । বাবা কিন্তু আমাকে কিছু
বলেননি সেদিন । আশ্চর্য ব্যাপার এই যে আমাদের বাড়িতে আরও অনেক গাছ তো ছিল ;
অমন বন্ধুতা ,অমন মুগ্ধতা তো কারো জন্য
হয়নি । এই বয়সে এসে আজো বুঝতে পারিনি কেন আমি ওই গোলাপ গাছটাকেই ভালবাসতাম ।
স্কুলে এসে বন্ধুদের কাছে ওই গাছের কথাই বলতাম । খাবার সময় গাছের কথা ,শোবার সময় গাছের কথা...সব
সময় কেবল গাছের কথা । গাছে কটা নতুন কুঁড়ি এল , কটা ফুল আছে , কোনটা
ঝরে গেল – সবই তখন আমার জানা ছিল । তখন আমার বয়স দশ –
এগারো হবে । বাড়িতে খুশির আমেজ । কারণটা হল ছোট কাকার বিয়ে ।
কিন্তু ওই চূড়ান্ত আনন্দতেও আমার মনটা চট করে দুঃখে ও বেদনায় ভরে উঠল । বাবার কাছে
শুনলাম , বাড়ির উঠোনে মস্ত প্যান্ড্যাল হবে । তাই গোলাপ
গাছটা কেটে ফেলা হবে । বাবাকে অনেক বোঝালাম । মার কাছে গিয়ে অনেক অনুরোধ করে বললাম
গাছটা যেন কাটা না হয় কিন্তু কেউ আমার কথাকে আমলই দিল না । একদিন স্কুল থেকে ফিরে
এসে দেখলাম বাড়িতে বাঁশ পড়েছে ।প্যান্ডেল হবে ।গাছটা নেই ।তার কোনো চিহ্নমাত্র নেই
।সব পরিষ্কার , সমস্ত উঠোনটা ফাঁকা ।অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে
থাকলাম ।কিছু ভাবতে পারছিলাম না ।তখন কান্নাও যেন আটকে আছে বুকে ।সেই মুহুর্তে
আমার যে কী হয়েছিল তা আজো কিঞ্চিত্ অনুভব করতে পারি ।বিছানার ওপর স্কুলের ব্যাগটা
ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ,পোশাক না খুলেই পড়ার টেবিলে মুখ নীচু
করে কাঁদতে লাগলাম ।মা অনেক বোঝালেন । মাথায় হাত বোলালেন ।অনেক গাছ এনে দেবেন বলে
কথাও দিলেন ।নতুন কোট-প্যান্ট
বানিয়ে দেবেন...এইসব আর কী ! আমি
কারো কথাই শুনিনি ।সেদিন আর আমার খাওয়াই হয়নি ।রাগে-দুঃখে মার সঙ্গে কথাই বলিনি ।এজন্য মার খুব মনখারাপ হয় ।বাবা তখনো বাড়ি
ফেরেননি । মন একদম ভালো নেই ।কাঁদতে কাঁদতে রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম ।দেখলাম গাছটা উঠোনে
দাঁড়িয়ে আছে । গাছের ভেতর থেকে আমার ই বয়সী একটা ছেলে বেরিয়ে এসে আমায় ডাকছে হাত
নেড়ে ,যাকে আমি আগে কখনো দেখিনি ,এই প্রথম ।আমিও দরজা খুলে তার সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম ।দাঁড়ালাম সেই গাছটার
সামনে এসে । ওই ছেলেটার মাথায় পাতার মত চুল ও শরীরে পাতার পোশাক ।হাতে অনেকগুলো
গোলাপ । সে কাঁদছে । আমি অবাক হয়ে সব দেখছি । ছেলেটার দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে
আছি ... ছেলেটি আমার হাতে ওই একগুচ্ছ গোলাপ দিয়ে
বললে ,আমি চলে যাচ্ছি বন্ধু ।তুমি দুঃখ কোরো না ।তুমি যখন
খুব মন থেকে চোখ বন্ধ করে আমার কথা ভাববে ,দেখবে আমি
দাঁড়িয়ে আছি এখানেই ,এভাবেই...বলেই সে ক্রমে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল,অনেক দূরে চলে যাচ্ছিল...আমি ডাকলাম ,শোনো ,শোনো ,যেওনা...
ঘুম ভেঙে গেল । দেখি বাবা-মা
মাথার কাছে দাঁড়ানো ।মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন , কী রে স্বপ্ন দেখছিলি নাকি ? কাকে ডাকছিলি ,শোনো ,শোনো
,যেওনা... বাবা বললেন ,বোকা
ছেলে । দ্যাখ তোর জন্য একগুচ্ছ গোলাপ এনেছি । রাগ করিস না ,তুই
রাগ করলে আমরা যে খুব কষ্ট পাবো ।তাই তো গাছটা কেটে ফেলবার সময় ফুলগুলো তোর জন্য
আমি আলাদা করে তুলে রেখেছিলাম । ফুলগুলো হাতে নিয়ে দেখি কী আশ্চর্য ! স্বপ্নে দেখা সেই ছেলেটি তো আমাকে এই গোলাপগুলোই
দিয়েছিল ।