গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

শ্যামশ্রী চাকী





নাগরদোলা



লাল প্লাস্টিকের চেয়ারটা নড়বড়ে। বাঘের মাথার কাছটা খুবলে তোলা, তাও দেখো ! কি জোরে বনবন করে ঘোরায় লোকটা!! দু দন্ড তাকিয়েছ তো মাথাটা চক্কর কেটে একশা।আজও বসেছে লোকটা, ঠিক স্কুলটার পাশেই।এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে, সেই পরিচিত দেঁতো হাসি। মিষ্টুর হাতটা শক্ত করে ধরে মানবী।এবারে দুটো বাচ্চাকে তুলে পাক খাওয়াচ্ছে নাগরদোলায়, পাশে মায়েরা মশগুল । প্যান্টালুন্সে কি যেন একটা অফার চলছে । তাড়াতাড়ি পা চালিয়েও শেষ রক্ষা হলোনা । মিষ্টুর হাতের ইশারা আর লোকটার হাসির মেলবন্ধন..। কটমটিয়ে তাকিয়ে মিষ্টুকে কোলে তুলে নেয় মানবী, ঝটপট রাস্তা পেরোয়। চোখ পিটপিট করছে লোকটা, কেমন একটা জোলো চাউনি। 'কিম্কর্তব্যবিমূঢ' শব্দটা মাথায় ঝলকে হঠাৎ ঝলকদিয়েই আবার সেই উদ্ভট চিন্তাগুলো ভীড় জমালো । নাহ! ! কাল থেকে দু নাম্বার গেট দিয়েই বেরোবে মানবী,ঘুরপথ হলেও । একরত্তি তিরতিরে মেয়ে, বকবক লেগেই আছে। 'দেখো!! ওই ছেলেটা আকাশ, আজ হোম ওয়ার্ক কপি আনেনি আন্টি পানিশমেন্ট দিয়েছে।' 'ওই দেখো সৃজা!! আজ একটা ক্যাটবেরি এনেছিল, এত্ত বড়ো!'
গাড়িতে বসিয়ে জলের বোতলটা খুলে মেয়েকে জল খাওয়ায় মানবী,হাত মুখ মুছিয়ে দেয় সাবধানে।মুখটা শুকিয়ে গেছে মেয়ের।গাড়ি চলতে শুরু করে, আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে মিষ্টু ।


খাওয়ানো এক হ্যাপা হয়েছে আজকাল। মেয়ে কিছুই খাবে না, আর মানবী তার কৌশল চালিয়েই যায়।
ঘাড় গোঁজ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে, মাথা নিচু, এক চামচও মুখে দেবেনা, এদিকে মানবীও ছোড়নেওয়ালী নেহি।সোফা থেকে টেবিল, টেবিল থেকে খাট, ব্যলকনি পেড়িয়ে এই ইঁদুর বেড়াল রেস চলে। আজকাল খুব ক্লান্ত লাগে মানবীর, বয়েসও তো বাড়ছে । জামা ছাড়িয়ে টিভি তে সিঞ্চন চালিয়ে সোফায় মিষ্টুকে বসিয়ে কিচেনে ঢোকে মানবী। কিছুক্ষনের মধ্যে মিষ্টু ঘুমে কাদা আর মানবী পেঁয়াজ কাটতে কাটতে প্রেশারকুকারের হুইসেল গোনে। মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে খোলা জানলাটায় এসে দাঁড়ায় মানবী। অর্ধেক আকাশ; রান্নাঘরের চিকেন স্ট্রু তখন টগবগাচ্ছে। জানলার পাশের টবে পড়ে থাকা শুকনো পাতা তুলে ফেলে দেয়, আগাছা উপড়ে ফেলে। দুটো চিল উড়েযায়, অনেক অনেক ওপর দিয়ে। খাবার গুলো টেবিলে গুছিয়ে রাখতেই অবসাদ ভর করে মানবীর দু চোখের পাতায়।


চার মাসে প্রথম মুভমেন্ট টের পেয়েছিল মানবী । সোনোগ্রাফির সময়ে স্ক্রিনে একটা কি নড়াচড়া করছিল, সেই প্রথম দেখা।চা'রঙা রিপোর্টে প্রথম দৈর্ঘ্যপ্রস্থের মাপ জেনেছিল মানুষটার। ঠিক তার কয়েকমাস পরেই আকাশনীল পোশাকে নার্স হাতে তুলে দিয়েছিল এইটুকু পুতুলের মত অবয়ব। সেই হাসি সেই কান্না, সেই রাত জাগা, প্যারাম্বুলেটারে ঘোরানো আজও মনে শিশির মাখা ধানশিষ।একবার জ্বর হয়েছিল, টানা তিনদিন মেয়ের মাথার কাছে বসেছিল মানবী, দুচোখের পাতা এক করেনি। যেদিন মা ডেকে ম্লান মুখে রোগা হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল মানবীর মনে হাজার ভোল্টের আলো ! গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে ঘুমন্ত মেয়ের মাথায় হাত বোলায়,এই তো দুদিন বাদেই পাঁচে পড়বে দস্যিটা ।


চোখ লেগেই এসেছিল দরজায় বেল, হুড়মুড়িয়ে খুলতেই সুজাতা । হাতে অনেকগুলো প্যাকেট । 'অনুষ্কা খেয়েছিল ? ঘুমিয়েছে ?' ঢকঢক করে মাথা নাড়ে মানবী । 'যাও,এগুলো অনুস্কার ঘরে রেখে এসো।' অনুষ্কা...মিষ্টুকে ওই নামেই ডাকে সুজাতা, মানে ওর লিগ্যাল মা। 'তুমি আমাকে এক কাপ চা করে দাও। আর হ্যাঁ, অনুষ্কার জন্মদিনে আমি ছুটি নিয়েছি, ওদিন তোমাকে আসতে হবেনা।' আবেগহীন যান্ত্রিক গলায় শব্দ উচ্চারণ করে সুজাতা । চোখের উপচে পড়া জলকে মূহূর্তে আগুনে বদলে দেয় মানবী, ধীর পায়ে কিচেনে ঢোকে, চায়ের পাতা দুধ চিনি মেলায় পরিমিত ব্যালেন্সে।বাষ্পীয় স্রোতে বারুদের আঘ্রাণ ওঠে। মা হতে পারছিলনা সুজাতা, কোন আশা দিতে পারেনি ডাক্তার । সদ্যজাত শিশু খুঁজছিল মোটা টাকার বিনিময়ে, তখন সদ্য কারখানে লকআউট হয়েছে সুমনের। বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়তেই লুফে নিয়েছিল সুমন।রুগ্ন মেয়েটার সাথে বেশকিছুদিন থাকতে হয়েছিল মানবীর। মাতৃদুগ্ধ বড় দায়!! মিষ্টুর চেহারায় গত্তি ফেরার মাস ছয়েক বাদে শর্ত অনুযায়ী বিদায় দেয়নি সুজাতা। মানবীকে রেখে দিয়েছিল সারাদিনের জন্য মেয়ের বেতনভুক ধাত্রী হিসেবে।আজ পাঁচ বছর হল রোজ এই সিঁড়িভাঙা সকালে শুরু সন্ধ্যায় শেষ । অংক টা হয়তো অতটা জটিল নয় অথবা আদতে এমন কোন অংকই নেই, হয়না হয়তো ।


বাস থেকে নামতেই আলো আঁধারি রাস্তাটা শুরু। সেখানে বুক ভরে শ্বাস নেয় আকাশমুখী মানবী। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে নাগরদোলা কাঁধে লোকটা, সাথে একটা উশকোখুসকো চুলের ছেলে।সেলাই খোলা জামাটা এক হাতে ধরে আর একটা হাত বাড়িয়ে দেয় মায়ের দিকে, মিলিয়ে যায় ছায়ামূর্তি গুলো। একটা বাড়িতে টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছে এক বছর আটেকের পংগু মেয়ে, অপেক্ষা করছে তার মা, বাবা আর ভাইএর। সুমনের কাঁধের স্থবির নাগরদোলা নিজের খেয়ালে ঘুরে যায়।