গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬

মনোজিৎকুমার দাস




ও আমার কৃষ্ণকলি

গ্রামের মধ্যে তরফদাররা পুরনো গৃহস্থ। পুরনো সংস্কার তরফদারদের বাড়ির কেউ এখনো আঁকড়ে ধরে আছে। তাদের মধ্যে জলিল তরফদার অন্যতম । জলিল তরফদারের ছোট সংসার। এক ছেলে আর এক মেয়ে, সাদেক ও দিলরুবা । দিলরুবা বড় আর সাদেক ছোট। প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরোনোর পর পরই জলিল তরফদারের একমাত্র মেয়ে দিলরুবাকে বিয়ে দেয়। দিলরুবার মায়ের ইচ্ছে ছিল একমাত্র মেয়েকে পড়াশোনা করে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা বানানোর। কিন্তু দিলরুবার বাবা জলিল তরফদার রাজি হয় না।তার এক কথা,“ দিনকাল যা পড়েছে তাতে মেয়েকে আমি আর স্কুল কলেজে পড়িয়ে পন্ডিত বানাতে চাই না।” দিলরুবার মা রেহানা পারভীন স্বামীকে বলে,“ দিনকাল বদলে গেছে। এখন আর কেউ এত ছোট্ট মেয়েকে বিয়ে দেয় না।” দিলরুবার মায়ের কথা ধোবে টেকে না। শেষ পর্যন্ত, জলিল তরফদার নিজে পাত্র দেখে অল্প লেখাপড়া জানা ছেলের সঙ্গে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়। দিলরুবার মায়ের আর কিছুই করার থাকে না।
দিনের পর দিন গড়িয়ে যায় সাদেক বড় হয়ে উঠে।সাদেক স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। রেহানা পারভীন মন কুঁকড়ে যায় একটা আশংকায়।তার স্বামী জলিল তরফদার একমাত্র ছেলে সাদেককে বিয়ে দেবার জন্য কখন না জানি উঠে পড়ে লাগে।
সাদেক ইন্টার ক্লাসের সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর জলিল তরফদার ছেলের বিয়ে দেবার কথা ভাবতে শুরু করে। এমনটাই আশংকা করছি সাদেকের মা রেহানা পারভীন। ছেলের জন্য মেয়ে দেথা সম্বন্ধে শলাপরামর্শ্ করতে সাদেকের মামা মিঠু মিয়ার সঙ্গে দেখা করতে সে শ্বশুর বাড়ি কলিমোহর যায়।সাদেকের মা ভাবে, মোবাইল ফোনে সাদেকের বিয়ের সম্বন্ধে ভাইয়ের সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারলে হতো।পাশের বাড়ির কানন ব্যাপারীর বউয়ের ফোনে মিঠু ভাইয়ের সঙ্গে সে কথা বলে। “ তোর দুলো ভাই তোর ভাগনের বিয়ের বিষয়ে আলাপ করতে যাচ্ছে। তুই তাকে বলে দিস আইন আগেও ছিল, এখন কিন্তু কড়াকড়ি হয়েছে বিয়ের আইন। ছেলের বয়স হতে হবে ২১ আর মেয়ের ১৮ । সাদেক ১৯ এ পড়েছে। দিলরুবার মত সাদেককে বিয়ে দিলে তোর দুলো ভাইকে জেলের ঘানি টানতে হবে এবার।” কলিমোহর থেকে ফিরে জলিল তরফদার ছেলের বিয়ে কথা মুখে আর আনে না। রেহানা বুঝতে পারে ভাইকে ফোন করে কাজ হয়েছে।

সাদেকদের বাড়িতে কারোই মোবাইল ফোন নেই। সাদেকের বাবা সে সেকেলে মানুষ, তাকে মোবাইল ফোন কেনার কথা বললে সে তার বউ রেহানাকে  বলে,“ বাপ দাদার আর আমলে ওসব ছিল না,তারা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতো চিঠিতে।তুমি বাপের বাড়িতে গেলে আমি তোমাকে আমার ভালবাসার কথা তোমাকে চিঠি লিখতাম,‘ ওগো আমার প্রাণেরশ্বরী---’, তুমিও আমাকে লিখতে,‘ ও আমার প্রাণেরশ্বর---’ সোয়ামীর কথা শুনে রেহানা আচঁল দিয়ে মুখের হাসি আড়াল করে,“ বুড়ো বয়সে এখন জুয়ান বয়সের কথা তুমার মনে উথলে উঠছে দেখে মরে যাই আর কী!”

সোয়মীর কথা শুনে রেহানার মনে জোয়ান বয়সের কথা সত্যি সত্যি মনে পড়ে। কী দিনই না গেছে!সে ভাবে, তার সোয়মী জোয়ন মরদ জলিল তরফদারের সে সময়ের রাতের রূপ দেখে সে তাজ্জব হয়ে যেত। আদর আদরে ভরিয়ে দিয়ে সে তাকে নিয়ে কী যে খেলায় মেতে উঠত তা আজ মনে পড়লে সে সব রাতের সুখানুভূতির কথা ভেবে এখনো রেহানা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।

রেহানাকে ভাবতে দেখে জলিল তরফদার তার বউকে বলে,“ এত কিছু কী ভাবছো, দিলরুবার মা! আমার বাপ তোমাকে পছন্দ করে বেটার বউ করে ঘরে এনেছিল। তুমি ছিলে সাধারণ চেহারার মেয়ে। কিন্তু তুমার ছিল পেটা শরীর।ফর্সা রঙ না হওয়ায় আমার মনে কোন দু:খ ছিল না তুমার শরীরের সুঠোল বুক,আর সুঠাম চেহারার কথা ভেবে। জুয়ান কালে তুমি আমাকে কম সূখ দাও নাই, আমিও তোমাকে----” সোয়ামীকে থামানোর জন্য রেহানা ধমকের সুরে বলে উঠে,“ তুমি থামবে!”

ধমক খেয়ে রেহানার সোয়ামী কিছু সময় নীরব থেকে বলতে শুরু করে,“ তুমরা আমাকে যতই সেকেলে ভাব না ক্যানে, আমি কিন্তু ততটা সেকেলে না। আমি ভেবে দেখলাম  তোমাকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দেওয়া লাগবেই।ফোন থাকলি তুমি দিলরুবার সঙ্গে আর নাতি নাতনির সঙ্গে কথা বলতে পারবে।”                                              
এতদিনে আমার প্রাণেরশ্বরের সুবুদ্ধি হয়েছে।” রেহানা উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠে সোয়মীর মুখে একটা চুমু দেয়। “ দূর ছাই, কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে! বুড়ো বয়সে জোয়ানকী যেন উথলে উঠেছে।” জলিল তরফদার বলে উঠে।

তাদের একমাত্র ছেলে সাদেক ইন্টার পাশ করেছে তিন বছর ।আরো পড়াশোনার ইচ্ছে থাকলেও বাবা মার ইচ্ছেতে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সাদেক স্থানীয় নাড়ুয়া বাজারে হার্ড্ওয়ারের দোকান দেয়।বাজারে মাত্র দুটো হার্ড্ওয়ারের দোকান । সাদেকের কারবার রমনমা। এবার সাদেকের মা রেহানাই ছেলের বিয়ের কথা ভাবে।

তাদের বংশে ছেলেকে মেয়ে দেখার রেওয়াজ না থাকায় সাদেকের বাবা নিজে পছন্দ করে সাদেকের সঙ্গে সুদোরপুরের কাছের ব্যাপারীর ছোট মেয়ে জমিলার সঙ্গে  বিয়ে দেয়। জমিলাকে বিয়ে করার পর সাদেক প্রথম নতুন বউয়ের মুখ দেখে বাসর ঘরে।বউয়ের মুখ দেখে তার মাথা বিগড়ে যায়। সে মনে ভাবত তার বউ হবে সিনেমার নায়িকার মত।কিন্তু --  সাদেক আর ভাবতে পারে না। এক সময তার মনে হয়, জীবনে  কোনদিন সে সুখের মুখ দেখবে না ।
বিয়ের আগে সাদেকের বাবা বলেছিল ,“ আমি পছন্দ করে বেটার বউ ঘরে আনব , আর সেই বউকেই ছেলেকে মেনে নিতে হবে।”
এখনকার ছেলেদের মত সাদেক  যদি বিয়ের আগে বউয়ের মুখ দেখতে পারতো তবে  সে কাছের ব্যাপারীর এই মেয়েকে জীবন থাকতে বিয়ে করতো না। বাসর রাতেই সাদেকের ইচ্ছে  হয় , সে জামিলাকে তালাক দেবে। কিন্তু বাবার  ভয়ে সে ওই কখা বলতে পারেনি। তবে  পরদিনই সে তার মাকে বলে " বাবা কি তোমার বউমার মুখের মুখ দিকে তাকায়ে দেখেছিল না ,গা গতর দেখেই হয়তো ... "                                                                                                                                 সাদেকের কথা শেষ করতে না দিয়ে মা কয় - "তুই কী যে কোস , মেয়ের গা গতরটাই তো সব। আমার চোখে বউটার চেহারায় মিষ্টতা আছে। টানাটানা চোখ। হাঁটু পর্যন্ত চুল। হাতপাগুলোও লম্বা আর টসটসে। তেমন কালোও নয় , শ্যাম বর্ণে। ”
মায়ের কথা শুনে মনে মনে সাদেকের রাগ হয়। এক সমময় সে মাকে বলেই ফেলে,“ যা চাইছিলাম তা নয় তোমার বেটার বউ। চেহারা হবে সুচিত্রা সেন কিংবা শাবানা, না হয় একালের সাড়া জাগানো----”
“ থাম বাবা , আর আমি শুনতে চাচ্ছি না।” সাদেকের মা ধমকের সুরে বলে উঠে।“
সিনেমার নায়িকাদের মত চেহারা হবে তোর বউ! বউকে তুই কি সিনেমায় নামাবী, নাকি ঘর সংসার করবি তাই বল । বউয়ের গা গতরোটাই তো সব । চন্ডিপুরের নবাব আলির ধলা চামড়ার  টিনটিনে শরীরের মেয়েটিকে তুই আজও ভুলতে পারিসনি। মা হয়ে তোরে কী আর কবো ! রাতির বেলা সাদা কালো সব সমান যদি হয় বউ সুস্থ সবল স্বাস্থ্যের।তোর বাবা আমাকে নিয়ে কি সুখে ঘর করেনি।আমি তো আর দেখতে নায়িকাদের মতো নই। বাজি রেখে বলতে পারি জমিলার সঙ্গে সংসার করে তুই সুখী হবি।”
দু’দিন পর্  সাদেক বুঝল মায়ের কথাই ঠিক বউয়ের চেহারা নায়িদের মত না হলেও তার জুয়ান বউ সত্যিই রসে টলমল । রাতের বেলা বউ সাদা আর কালো মনে পড়ে না সাদেকের বুঝতে দেরি হয় না ।রাতে তার মনে হয় তার বউ যেন রসের হাড়ি ।রাতের আঁধারে জমিলার সুডোল স্তন দুটো নিয়ে সাদেক যখন মেতে উঠে তখন সাদেকের শরীরে যেন জোয়ার জাগে ,জগত সংসারের কোন কথা তার মনে পড়ে না । তার বউ যে এত  রঙ জানে সে আগে কখনো ভাবতে পারেনি ।
রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে মোড়লপাড়ার মুকুন্দ মোড়লের সুন্দরী বেটার বউ আর তার শ্যামলা চেহারার তার বউয়ের মধ্যে কোন ফারাক খুঁজে পায় না।
রাতের আঁধার তার বউ  কী যে সুখ দেয় তা দিনের বেলাতেও ভাবে । তার মনে পড়ে খগেনবাবুর বাড়িতে যাত্রাগানে কৃষ্ণকলি নামে একটা মেয়ে সখি  সাজতো, সাদেক ভাবে ।
চোত মাসের রাতে জানালা দিয়ে চাঁদের আলো জমিলার মুখের উপর পড়লে সাদেকের মনে হয়  তার বউ যেন যাত্রাদলের সেই কৃষ্ণকলি । চাঁদের আলোয় বউয়ের ডাগর ডাগর চোথ দুটোর দিকে তাকিয়ে সাদেক মুগ্ধ হয়। জানালা বন্ধ করে জমিলা সোয়ামীর সাথে খেলায় মেতে উঠলে এক সময় সাদেক  বলে উঠে ,"ও আমার কৃষ্ণকলি তুমি কতই না জাদু জান! তুমি আসলেই আমার কৃষ্ণকলি ।