সমর্পণ
শৈল
আর রমাকান্তর বিচ্ছেদ হতে চলে ছিল। বিবাহের সাতটা বছর তখন কেটে গেছে। তখনও তাঁদের
কোন সন্তান নেই। দেহের রংচং তখনও বিশেষ কিছু ঘেঁটে যায়নি। বিবাদের পূর্ণ বিষয় আজ
আর মনে নেই রমাকান্তর। তবে ঘটনার শেষ দিকটা সামান্য মনে আছে তাঁর। তিন দিন যাবত ওদের মধ্যে কথা
শূন্যতা চলছিল। জীবনের বেশ কিছুটা ভাল লাগার স্বপ্ন হারিয়ে সে দিন শৈলর মনে হয়ে ছিল, এ কেমন মানুষের সঙ্গে সে ঘর করছে ? সে বলে ছিল, তোমার মত জেদি পুরুষ তো আমি জীবনে
দেখিনি !
রমাকান্ত রেগে গিয়ে বলে ছিলেন, জীবনে বুঝি অনেক পুরুষ মানুষ তুমি
ঘেঁটেছ ? ব্যাস
এই পর্যন্ত,
শৈল বিনা বাক্য ব্যয়ে ঘরে ঢুকে দোর দিয়ে ছিল।
এ তো সংসার জীবনের ধর্ম--কখনো কোন্দল,
কখনো প্রেম, সোহাগ। কোন্দলের পরে আবার আমে দুধে মিশে
যাওয়া। আমে দুধে
মিশে গেলেও কোথাও তো আঁটি গড়াগড়ি খায়। সে আঁটি বড় কঠোর কঠিন, নরম মাটি না পেলে গলে
না।
দুটি মানুষ কখনও একেবারে খাপে খাপে মিলতে
পারে না--যে খাই খন্দ থেকে যায়, তাকে সংসারে মিলিয়ে নিতে হয়। তবেই না সংসার ধর্মে
সুখ আসে ! রমাকান্ত মেজাজ শান্ত হবার পর, ভেবে দেখলেন, সত্যি শৈলকে, পুরুষ ঘাঁটার
কথা, তাঁর বলা উচিত হয় নি। তিনি এসে শৈলবালার দোরে ধাক্কা দিলেন। শৈল তখনও কঠিন, দরজা খোলেনি।
অহম
ভাব মানুষের খুব ক্ষতি করে, সমর্পণের প্রয়োজন আছে নতুবা ঘর সংসার উজাড় হয়ে যেতেই পারে ! যখন
তুমি আপন লোকটার প্রতি রেগে গেলে তখন তার অমিল খারাপ ঘটনাগুলি সার বেঁধে তোমার মন ঘিরে থাকে। আপন
লোকটার আপনত্বের ভাবছবি তোমার চোখে আসে না।
রমাকান্ত ভাবেন, তিনি এমন কি বলে
ফেলেছিলেন যে তিন দিন যাবত শৈল তাঁর সঙ্গে কথা বলেনি ?
স্বামী স্ত্রীতে তো কত কথাই হয় ! তিনি হাসলেও শৈল হাসে না। রমাকান্ত ভাবলেন, না আর সমর্পণ নয়, তিনি শৈলকে কখনও বলবেন না যে তিনি
ভুল করেছেন।
শৈল ভাবছে, নিজের স্ত্রীকে স্বামী কি এমন কথা বলতে পারে ? এমন লোকটাকে নিয়ে
জীবনের বাকি সময়টা সে কি করে কাটাবে ? সেও আর মাথা নত করতে চায় না--অনেক সহন হয়ে গেছে, আর না !
দীর্ঘ পনের দিন পরে এক সকালে রমাকান্ত
দেখলেন, শৈল
নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে। রমাকান্তর দিকে অশ্রু
চোখে তাকিয়ে ভাঙা গলায় সে বলে ওঠে, চলি !
রমাকান্ত ধরা গলায় বলে উঠলেন, কোথায় ?
তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারেনি শৈল, খানিক চুপ থেকে বলে ওঠে, দাদার বাড়ি। বাপের বাড়ি কথাটা বলতে
গিয়ে তার মনে পড়ে গিয়ে ছিল--তার তো বাবা মা কেউ জীবিত নেই। অসহায় এক বিষণ্ণ ভাব
ক্রমশ শৈলর মন জড়িয়ে নিচ্ছিল।
ওরা উভয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। ওদের অহং ভাবটা
গলতে শুরু করেছিল। ভিজে মাটির স্পর্শে কঠোর আঁটির আবরণ ক্রমশ নরম হতে চলেছিল। এক
সময় রমাকান্ত মাথা নিচু করে বলে ওঠেন, আমায় ফেলে চলে যাচ্ছ ?
মনের ভেতর হু হু করে হাওয়া বইছিল। জল মাটি
হওয়ার সংস্পর্শে তৎপর অঙ্কুর জন্ম নিচ্ছিল। শৈলর অস্ফুট কান্নার শব্দে বিষাদ
প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল। ধীর পায়ে রমাকান্ত শৈলর দিকে এগিয়ে গেলো। অবসাদ ব্যাপ্ততা
ভুলে, অহং
ভাব কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছে। তিনি শৈলীর দিকে তাকালেন,
শৈল রমাকান্তর দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
সমস্ত কালো মেঘ সময় ও বাতাসের তাড়নায় দূরে
সরে যাচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। শৈল রমাকান্তর সজল চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে তাঁর
আরও কাছে দিয়ে ঘন হয়ে দাঁড়ালো। রমাকান্ত আর থাকতে পারছিলেন না, তিনি আরও স্পর্শকাতর হয়ে শৈলকে দু
হাতের বেড়ে জড়িয়ে নিলেন।
শক্ত আঁটির আবরণ ভেদ করে মূল শিকড় মাটিতে গেড়ে
যাচ্ছিল। এই মুহূর্তে আর কিছু নেই--অহম ভেদ করে এক সমর্পণের রাগালাপ বেজে চলেছে।