গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬

মৃন্ময় চক্রবর্তী



বাতাস ফকির

এমন নাম কখনো শুনেছেন,বাতাস? আমিও শুনিনি আগে। চড়িশ্বরের বনবিবির মেলায় আলাপ।
মাঠের মধ্যে মেলা, ধানকাটা মাঠে। তিনদিনের না কাটা দাড়ির মত খোঁচা খোঁচা এবড়ো খেবড়ো জমি। খিচুড়ি খাচ্ছিল সবাই সেই মাঠে, শালপাতায়। কি আশ্চর্য খাওয়া। আমি বিশাল বটদেবতার নীচে সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম গেঁয়ো মেলার জমক।

আমি আগন্তুক তাই প্রসাদ নিতে বসে যেতে পারিনি । সে ই ডাকল,বলল, বাবু দাঁইড়ে কেন এসো, মায়ের পেসাদ লজ্জা কী? তার সাথে আলাপ জমে উঠল । একসাথে খিচুড়ি খেলাম নাড়ার উপরে বসে। জলখিচুড়ি, চালের দানা গোনা যায়, তবু অমৃত যেন।

আমার নাম বাবু বাতাস শেখ । চমকে উঠলাম মুসলমান ! মুসলমান ভেবে চমকে ওঠা একারণেই, পরণে তার সাদা কাছা মেরে পরা ধুতি, সাদা গেঞ্জি, গলায় তুলসির মালা, আর গালে শ্বেতশুভ্র দাড়ি এবং গোঁফ। মুসলমান ভাবা যায়না!

বাতাস নামের সাথে তার সাযুজ্য আছে, ফুঁ দিলে সে হাওয়ায় উড়ে যাবে। কিন্তু তার হাসি, সে যেন বসন্তের দখিনা হাওয়া। সে নিজেকে বাতাস ফকির বলে । কিন্তু ফকিরি দীক্ষা তার নেই।
সে আমাকে তার বাড়ি যেতে বলেছিল, গিয়েছিলাম তার বাড়ি। এক তাজ্জব মানুষ তাজ্জব তার ধর্মমত। বিদ্যাধরী নদীর মজা কিনারায় তার পলাশ ছাওয়া কুটীর। তার ছোট ডেরা ঘিরে রেখেছে শিরিষ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া । বসন্ত তখন। পল্লবিত গাছের নীচে বাতাসের দীন গৃহ স্বর্গোদ্যানের মত লাগছিল। নিকোনো উঠোনের কোণে সন্ধ্যামণি, টগর, জুঁই অলঙ্কৃত করে রেখিছিল যেন তার ঘর।
অনেক আগে থেকেই বাতাস গান বাঁধত, মুখেমুখে রচনা করত গান । বিবির, গাজীর,শেতলার পুজোয় হাজতে তার ডাক পড়ত। মাঝে মাঝে সে এদেশ ওদেশ বেরিয়ে পড়ত, ঠিকানা হদিস মিলতনা। এই অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু সে একবার নদীয়ায় গিয়ে হরিদাসের আশ্রমে ছিল একমাস। তারপর সেখান থেকে কাঠের গৌরাঙ্গ নিয়ে ফিরেছিল দেশে। বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই বাধল গোল। গাঁয়ের মুরুব্বি মাতব্বররা ওর বাবা রহমান আলির উপর চাপ আনল। মসজিদে বিচার হল তার। মারধোর, অত্যাচার হল খুব,চুলদাড়ি কেটে দিল ওরা, কাঠের গৌর আছড়ে দিল ভেঙে।ঘর ছাড়ল বাতাস ফকির। সেই থেকেই তার আস্তানা এই মজা বিদ্যার কিনারে।

সে ভাঙা কাপে গুড়ের চা বানিয়ে আনল। বলল দাঁড়াও সন্ধ্যা ধরিয়ে আসি। কখন সূর্য পাটে গেছে বুঝতে পারিনি। এর মধ্যে বাতাস বেশ কয়েকটা গান শুনিয়েছে। দখিনা বাতাস আর বাতাসের গানে তন্ময় হয়ে আমি দেখছিলাম টুপটাপ খসে পড়া পলাশের ফুলে লাল হয়ে উঠা উঠোনে ছড়িয়েছে আশ্চর্য বিভা। ময়ূর পালকের মত দোদুল শিরিষের ফুল যেন হাজার রামধনুর চন্দ্রাতপ।
বাতাস শাঁখ বাজাল, শাঁখের শব্দ মজা নদীর প্রান্তরে যেন তরঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। মাথার উপর তাকিয়ে দেখলাম কি অদ্ভুত সুন্দর রাত্রির আকাশ তার সহস্র নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে কুটীরের কাছাকাছি নেমে এসেছে। বাতাস প্রদীপ ধরালো, দিল ধূপ। পলাশ গাছটির তলায় তার প্রিয় দেবতার থান। তুলসী মঞ্চে রাখা প্রদীপের আলোয় দেখলাম কাঠের গৌর আর তার পাশে কাবার অলঙ্কৃত ছবি, কোনো ক্যালেন্ডার থেকে কেটে নেওয়া, আরবি হরফে কি সব লেখা। আমি মুগ্ধ হলাম।
বাতাস ফিরে এসে শোনাল লালনের একখানি পদ। শুনতে শুনতে দেখলাম মানুষের ঈশ্বর তার উঠোনে টগর ফুলের মত হাসছেন।

বাতাস গান থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,বাবু মানুষি মানুষি এত ভেদ কেন বলতি পারো? আমি বলতে পারিনি।সে অনেকক্ষণ থেমে বলেছিল,একজন্মে এর উত্তর খোঁজা যায়না তাইনা বাবু?
অনেকদিন তার আখড়ায় যাইনি। বাতাসকে ভুলেই ছিলাম প্রায়। কাল হঠাৎ ইচ্ছে হতেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। চড়িশ্বর বাজারে এসে শুনলাম বাতাসকে কারা খুন করেছে। বিদ্যার মজা চড়ায় তার ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেছে। স্তব্ধ হয়ে গেলাম শুনে।বাতাসের শত্রু!তার আবার শত্রু আছে নাকি ? বুকের ভেতর এক সমুদ্র জল চোখের কিনারে আঘাত করে উঠল।
বাবু মানুষে মানুষে এত ভেদ কেন বলতি পারো? আমি যেন আবার স্পষ্ট শুনলাম তার কণ্ঠস্বর---বিদ্যাধরীর মজা চরে ছড়িয়ে গেল সেই কন্ঠ তাপদগ্ধ হাওয়ায়।