গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬

সূর্যস্নাত বসু




দ্রুতি

বড় শরীরের মাধব চোর হলে খুবই সমস্যায় পড়ত ভিড়ের মধ্যে লুকোতে গেলে খুব অনায়াসেই ওকে ধরে ফেলা যেত। সিঁথির মোড় থেকে দমদমের অটোর লাইনে এখন মাধব দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও এতটাই বড়সড় চেহারার অধিকারী যে ওর সামনে আদৌ কেউ আছেন কি না বোঝা মুশকিল। না না, আছেন আছেন   তাও নয় নয় করে গোটা উনত্রিশেক মানুষ।  অফিস কাচারি শেষে সারাদিনের ব্যস্ততাকে এক কাঁধে আর আরেক কাঁধে সারাদিনের ক্লান্তিকে জড়ো করে মাধব রোজ এই রুট ধরে বাড়ি ফেরে কিন্তু আজ হয়েছে মহা বিপদ একে ইলেকশনের রেজাল্ট বেরিয়েছে।  রাস্তা তাই ফাঁকা। আর তার ওপর দলবাজির ঝাণ্ডাধারী অটোচালকদের ফুঁ হয়ে যাওয়া  প্রায় মিনিট পনেরো হয়ে গেল মাধব লাইনের শেষে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং প্রতিরাতের মত এ রাতেও মাধবই লাইনের সর্বশেষ দেওয়াল। 

প্রাইভেট সেক্টরে পয়সা যেমন,খাটনিও তেমন। প্রতিদিন রাত দশটা হয়ে যায় ফিরতে এবং কী আশ্চর্য! মাধব নিজেকে সবসময়ই এ লাইনের শেষে খুঁজে পায়।  যেন শেষের সিটটা ওর জন্যই বরাদ্দ করে রেখেছেন অটোদেবতা। একে একে লাইন এগোয় কিন্তু মাধবের পেছনে আর কেউই এসে দাঁড়ান না কখনো।  রাতের শেষ অটো করে মাধব এরপর বাড়ি ফেরে।

কিন্তু আজ তো কোনো অটোরই দ্যাখা মেলা ভার। কাজেই লাইনও আর এগোচ্ছে না।
"
শালা একটা রিক্সাও তো নেই, এই রাতে আবার মালগুলো একশো ফ্যাকশো চেয়ে পুরো কেলো করে দেবে---মাধব বিড়বিড় করে। এখন সাড়ে দশটা। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাধব আকাশ দ্যাখে। খুব ছোটবেলায় যখন ভরপুর গতিময়তা ছিল জীবনে, তখন সে ছাদে দাঁড়িয়ে তারা গুনত।  আকাশের থেকে নিঃসঙ্গ বুঝি কেউ নেই।  আকাশের নিঃসঙ্গতাকে বারবার মনে করিয়ে দেবার জন্যই বুঝি মানুষ তারা গোনে অথবা মানুষের চাহিদাকে পরখ করবার জন্যই বুঝি আকাশ মানুষকে তারা গোনবার অনুমুতি দেয়। 

মাধবের সামনের ছেলেটিও তারাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।  কানে হেডফোন। তার ঠিক আগের মাঝবয়সী লোকটি মাঝেমাঝেই অটো না আসার বিরক্তি প্রকাশ করছেন মুখ দিয়ে ক্রমাগত চু চু আওয়াজ করে। বাড়ি থেকে ঘনঘন ফোন আসে মাধবের।  মাধব ফোন তোলে না।  আজ সাইলেণ্ট মোডেই রেখে দিয়েছে ভুল করে। জীবনও কী ওকে ফোন করে চলেছে? কানে কানে এসে কী বলে দিচ্ছে, "মাধব পৌনে এগারো,  মাধব এগারো, মাধব এগারোটা কুড়ি, মাধব সাড়ে এগারো। কাল সকালে আবার অফিস, আবার অটো, পরশুও তাই, কিংবা তরশু। আর তারপর একদিন সব শেষ। লাইনে তুই একাই ছিলি,একাই থাকবি। মাঝে বর্তমানটাকে উপভোগ কর যে কোথাও কোনো অটোই আসে না। 

চমকে ওঠে মাধব। তারপর একবার পেছনে ফেরে। ততক্ষণে মাধবের পেছনে আরও তিনজন এসে দাঁড়িয়েছে লাইনে। নাহ তার মানে এখন আর মাধব শেষে নেই।  এই প্রথম। তার মানে ঘুরিয়ে ভাবল মাধব---লাইন বুঝি এগিয়েছে। এদিকে সবশেষে দাঁড়ানো ছোকরা তখন নিজের  নম্বর গুনতে ব্যস্ত। হ্যাঁ,মাধবের মতই। ফারাক বলতে নম্বরে। একজন উনত্রিশ আর একজন তেত্রিশ। অথচ ওরা জানে না যে স্থানাঙ্ক আদপে দুজনেরই সমান----পরম শূন্য।