গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬

সুবীর কুমার রায়



তুষার

(গত সংখ্যায় প্রকাশিত প্রথম অংশের পর)

সেবার  ডিসেম্বর  মাসে  আমরা  চারজন  আবার  একসাথে  বেরলাম।  লক্ষ্য—  শিমুলতলা,  দেওঘর।  সাত  দিনের  টুর। চারদিন  শিমুলতলা,  তিনদিন  দেওঘর। অফিসেরই হলিডে হোম বুক করা  হ’ল।  টিকিট কাটাও  হ’ল,এখন শুধু যাওয়ার  অপেক্ষা।  দীপুদা  রান্নার  দায়িত্ব  নিয়ে  নিল।  তুষার  শুধু  বললো  শিমুলতলা  মুরগীর  জায়গা, প্রাণভরে মুরগী আর  ডিম খেতে  হবে। নির্দিষ্ট দিনে খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে আমরা শিমুলতলা স্টেশনে পৌঁছলাম। অসম্ভব  ঠান্ডা। স্টেশন  থেকে  বেরিয়ে,  চা  খেয়ে,  অনেকটা পথ হেঁটে, একপ্রান্তে আমাদের হলিডে হোমে  পৌঁছলাম। রাস্তায় দীপুদা দুপুরে কী কী রান্না বে ঠিক করে  ফেললো।  তুষার  শুধু  জিজ্ঞাসা  করলো -- “দুপুরে  মুরগী না খাসি”?  
দীপুদা জানালো শুধু মুরগীর ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া যায় না। কাজেই ডাল, ভাজা, তরকারীও সে করবে। হলিডে  হোমে  মালপত্র  রেখে,  মুখ  হাত  ধুয়ে,  আবার  অনেকটা  পথ  হেঁটে,  স্টেশনের  কাছে  চা  জলখাবার  খেতে  আসা  হ’ল। এখানে  রাস্তার  পাশে  একটা  মিষ্টির  দোকানে  দেখলাম  গরম  গরম  কচুরি. সিঙ্গারা,  জিলিপী  ভাজা  হচ্ছে।  এই  দোকানটায়  খদ্দেরও  অনেক।  একটু  অপেক্ষা  করে,  একটা  বেঞ্চ  খালি  হতে,  আমরা  চারজন  জায়গা  দখল  করলাম।   খাবারের  অর্ডার  দেওয়া  হ’ল।  সামনে  একটা  বিশাল  রাক্ষসে  কড়াতে  বড়  বড়  অগুনতি  ল্যাংচা  সদ্য  তৈরী  হয়ে  চিনির রসে  সাঁতার  কাটছে।  সংখ্যায়  যে কত  হবে  সঠিক  বলা  যাবে  না।  বিশাল  কড়ার  দু’পাশে  ততোধিক  বিশাল  দু’টো  হাতল।  আমরা  কচুরি  পর্ব  প্রায়  শেষ  করে  এনেছি।  এরপরে  দু’টো  করে ল্যাংচা,  না  চারটে  করে  জিলিপী,  এটা  যখন  প্রায়  স্থির   করে  ফেলেছি,  ঠিক  তখনই  ঘটলো  সেই  হাড়  হিম্  করা  কান্ডটা।

হঠাৎ  তুষার  “ওরে  বাবারে” বলে  বেঞ্চে  বসা  অবস্থায়,  ডান  পা  টা  বিদ্যুৎ  গতিতে  শুন্যে  তুললো।  ওর  পায়ে  ছিল  শিলিগুরি  থেকে  কেনা  হালকা  বিদেশী হাওয়াই  চপ্পল।  চোখের  পলক  ফেলার  আগে  দেখলাম, ওর  পা থেকে  হাওয়াই  চপ্পলটা  হাওয়াই  জাহাজের  মতো  শুন্যে  উড়ে  গিয়ে,   ল্যাংচার  এয়ারপোর্টে ল্যান্ড  করছে।  চারপাশে  অনেক  ক্রেতা  দাঁড়িয়ে,  বসে  খাবার  খাচ্ছে।   দৃশ্য  দেখে  সকলে  হৈ  হৈ  করে  উঠলো।  কিন্তু  আমাদের  কপাল  ভাল,  কড়ার  হাতলে  আঘাত  পেয়ে  হাওয়াই  চপ্পল  ভূপতিত  হ’ল।

হাওয়াই  চপ্পল  ল্যাংচার  কড়াইতে  পড়লে  দোকানদারের  সাথে  একটা  রফা  হয়তো  করা  যেত,  বিশেষ  করে  আমরা  যখন  বড়  খদ্দের,  কিন্তু  সেটা  তো  এত লোকের  উপস্থিতিতে   সম্ভব  হ’ত  না।  কে  আর  সাধ  করে,  পয়সা  দিয়ে,  রসে  ভেজা  চটি   ল্যাংচার  একসাথে  অত  ঘনিষ্ট  অবস্থান  দেখেও,  ল্যাংচাকে আদর  করে  ঘরে  তুলবে  বা  পেটে  পুরবে?  
কী  রে?  কী  করছিলি  বলতো?  এখনি  তো  বিরাট  টাকা  ক্ষতিপুরণ  দিতে  হ’ত।
মাইরি  আর  কী।  আমি  কী  করবো,  কুকুর  পা  চাটলে আমার  কী  করার  আছে?
আসলে  সকলে  খাবার  খেয়ে,  শালপাতা  দোকানের  সামনে  রাস্তাতেই  ফেলছে।  একটা  কুকুর  শালপাতা  থেকে  তরকারী  চেটে  খাচ্ছিল।  বেঞ্চের  নীচে,  তুষারের পায়ের  কাছে একটা  শালপাতা  চেটে  খাওয়ার  সময়,  তুষারের  পায়ের  গোড়ালি  চেটে  দিয়েছিল। হঠাৎ  ভয়  পেয়ে   পা  তুলতেই  এই  অঘটন।
  
বাজারে  গিয়ে  মুরগীর  দর  করে  তো  আমরা  মাথায়  হাত  দিয়ে  বসলাম।  এখানে  তো  আমাদের  হাওড়া,  কলকাতার  থেকেও  মুরগীর  দাম  বেশী।  অনেকক্ষণ  বাজারে  ঘুরে  কাঁচা আনাজ,  ডিম,  চাল ও  অন্যান্য্  প্রয়োজনীয়  জিনিস  কিনে  বাসায় ফিরে  এলাম। দীপুদা  মহানন্দে  রান্না  শুরু  করলো।  আমরা  এক  রাউন্ড  চা  খেয়ে,  চারপাশটা  ঘুরে  দেখতে  গেলাম।  অনেকখানি  জমি,  তারের  বেড়া  দিয়ে  ঘেরা।  জমির একপাশে  হলিডে  হোম।  হলিডে  হোমের  ঘেরা  জমিতে,  একটা  বিশাল  ইঁদারা  আছে।  বেশ  বড়  বড়  গাছপালাও  অনেক  আছে।
দুপুরে  ইঁদারার  ঠান্ডা  জলে  স্নান  সেরে,  দীপুদার  হাতের  ডাল,  ভাজা,  ডিমের  ঝোল  দিয়ে  আহার  সারলাম।

বিকেলের  দিকে  চারজনে  ঘুরতে  বেরিয়েছি,  হঠাৎ  পিছন  থেকে  কে  যেন  তুষারকে  ডাকলো।  পিছন  ফিরে দেখি  রোগা  ছিপছিপে  একটা  বছর  ত্রিশের  ছেলে। মাথায়  পাগড়ীর   মতো  করে  গামছা  জড়ানো,  সরু  গোঁফ  ঠোঁটের  দু’পাশে  গোল  করে  পাকানো,  বাঁ  হাতে  একটা  সরু  লাঠি,  ডান  হাতে  কী  যেন  ছুড়ে ছুড়ে  মুখে  ফেলে  চিবচ্ছে।  ওর  একটু  পিছনে,  একটা  বছর  কুড়ি-বাইশ  বছরের  বিবাহিতা  মেয়ে   বছর  পঁচিশের  একটা  ছেলে।  মেয়েটার  নতুন  বিয়ে  হয়েছে  বোঝা  যাচ্ছে।  ছেলেটার  পোষাকও  বেশ  মার্জিত।  তুষারতো   তাকে  দেখে অবাক,  আমরা  আতঙ্কিত। 
কী  রে  কবে  এলি?
দিন  তিনেক  হ’ল  এসেছি।  তোরা  কবে  এসেছিস?
আজ  ভোরে।  কিন্তু  তোর   কী  দশা?  মাথায়  গামছা  জড়িয়েছিস  কেন?   রকম  পাকানো  গোঁফই  বা  কেন  রেখেছিস?
 কথার  কোন  জবাব  না  দিয়ে,  সে  পিছনের  মেয়েটার  সাথে  আমাদের  পরিচয়  করিয়ে  দিল।  তার  স্ত্রী।  নতুন  বিয়ে  হয়েছে।  বিয়ের  পর  বেড়াতে  এসেছে।  হয়তো  হনিমুনে   এসেছে।  সঙ্গের  ছেলেটা  তার  ছোট  ভাই,  অর্থাৎ  মেয়েটার দেবর।
তা  তুই   রকম  জোকার  সেজেছিস  কেন?
আরে  জসমিন  দেশে  যদাচার।  এখানকার  লোক  আমাকে  স্থানীয়  লোক  মনে  করে  ঠিক  দাম  নেবে।  তোরা  এখানকার  বাজারটা  ঘুরেছিস?  বাজারের  হাল দেখেছিস?
মেয়েটাকে  দেখে  মনে  হ’ল  স্বামীর  পাগলামিতে  সে  লজ্জা  পাচ্ছে।  লজ্জা  পাওয়াটাই  স্বাভাবিক।  হনিমুন  করতে  এসে  জিনিসপত্রের  দাম  কম  নেবে  বলে,  কারোকে গামছা  মাথায়  জড়িয়ে,  হাতে  লাঠি  নিয়ে,  সরু  পাকানো  গোঁফ  রেখে,  ভেজানো  ছোলা  খেতে  খেতে,  নতুন  বউকে  পিছনে  ফেলে,  রাস্তা হাঁটতে  দেখিনি।  তুষারের  সৌজন্যে   জীবনে  আরও  কত  দেখবো,  কে জানে। 
পরদিন  সকালে  তুষার  তাল  তুললো–- সাঁওতাল  এলাকায়  এসে  মহুয়া  খাব  না,   হতেই  পারে  না।  মহুয়ার  নাম  ওর  মতো  আমরাও  শুনেছি,  কিন্তু জিনিসটা  কখনও  চোখে  বা  চেখে  দেখিনি।  ওর  কথায়  বুঝলাম,   নিজেও কখনও  খায়  নি  বা  চোখেও  দেখে নি।
এখানে  সাঁওতাল  দেখলি  কোথায়?  একজন  সাঁওতালও  তো  চোখে  পড়লো  না।
আরে  আছে  আছে।  খোঁজ নিলেই  জানা  যাবে।
খোঁজ  নেওয়ার  পাটটাও  সেই সারলো।  বাইরে  থেকে  ঘুরে  এসে  জানালো,  স্টেশন  ছাড়িয়ে  দুরে  যে  ঢিবি  পাহাড়টা  দেখা  যায়,  তার  নীচে  সাঁওতালদের  বাস।  সব  খোঁজ  নিয়ে   এসেছি, এবার  দয়া  করে  আমার  সঙ্গে  তোরা  চল্।
দীপুদা  রান্না  করবে  তাই  যাবে  না।  মাধব  জানালো অতটা  পথ  হাঁটা  তার  পক্ষে  সম্ভব  নয়।  আমিও  একটা  জুতসই  অ্যালিবাই  খোঁজার  আগেই,  সে  আমার  হাত  ধরে  টেনে  নিয়ে  চললো।  যাবার  আগে  দুপুরে  মাংস  ভাতের  মেনু  ঠিক  করে  দিয়ে  গেল।
বাইরে  এসে দেখি  দুরে,  বহুদুরে  তুষারের  সেই  স্বপ্নের ঢিবি  পাহাড়।  দশ-বিশ কিলোমটার দুরে  হলেও  হতে  পারে। এখান  থেকে  ঠিক  দুরত্ব  বোঝা  মুশকিল।  আমি  ওকে  ওখানে  না  যাবার  জন্য  অনেক  বোঝাবার  চেষ্টা  করলাম। 
আরে   তো  অনেক  দুর।  ওখানে  গিয়ে ফিরে  আসতেই  তো  সন্ধ্যা  হয়ে  যাবে।  তার  থেকে  চল্  রান্নাবান্নায়  হেল্প্  করে,  ক্যারাম  খেলি।
অনেক  দুর  বলে  কী  এখানে  কেউ মহুয়া  খায়  না?  তুই  কী  এখানে  ঘুমতে,  খেতে  আর  ক্যারাম  খেলতে  এসেছিস?  এই  বয়সেই  এত  কুঁড়ে  হলে  বুড়ো  হলে  কী  করবি  ব্যা?  ওরা  রান্নাবান্না   দেখুক,  আমরা  এই  কাজটা  অন্তত  করি।   
সত্যি,  আমাদেরও  তো  একটা  কাজ  করা  দরকার।  তাই  তুষারের  এই  মহান  কাজে,  আমাকে  সঙ্গ  দিয়ে  সাহায্য  করতেই  হ’ল।  প্রায়  ঘন্টা  খানেক  হাঁটার পরও  দেখি  পাহাড়টা    সেই  একই  জায়গায়  দাঁড়িয়ে  আছে।  দুরত্ব  এক  ইঞ্চিও  কমেছে  বলে  মনে  হ’ল  না।
তুষার  প্লীজ্  ফিরে চল্।  দু’-তিনদিন  এখানে  থাকবো।  তার  একটা  দিন  এভাবে  নষ্ট  করিস  না।
আশ্চর্য,  এখানে  ঘরে  বসে  তুই  কী  রাজকার্য  করবি  বল্  তো?  তাছাড়া  এতটা  পথ  হেঁটে  এসে,  এখন আর   ফিরে  যাবার  কোন  মানে  হয়  না।
এখনও  ফিরে  চল্,  এরপর  আরও  বেশী  পথ  হেঁটে  ফিরতে  হবে।  ফিরতে  ফিরতে  অনেক  বেলাও  হয়ে  যাবে।
আরে  হলিডে  হোমে  ফিরে  তো  শুধু  স্নান সেরে  মাংস  ভাত  খাওয়া। আর  কোন্ কাজটা  আছে  শুনি?  

কথা  না বাড়িয়ে  হাঁটতে  শুরু  করলাম।   শীতেও  সারা  শরীর  ঘামে  ভিজে  গেছে।  অবশেষে  আরও  অনেকটা  পথ,  অনেক  সময়  নিয়ে  হাঁটার  পর, পাহাড়টার  কাছে  পৌঁছালাম।  ছোট  ছোট  ঝুপড়ির ঘর।  সামনে  মাটির  দালান,  পালিশের  মতো  চকচক্  করছে।  কী  যে  পরিস্কার  করে  ওরা  জায়গাটাকে রেখেছে,  ভাবা  যায়  না।  জল  তেষ্টায়  আমার  ছাতি  ফাটার  উপক্রম।  আমাদের  দেখেই  মেয়েরা  বাচ্ছা  কাঁকে  ঘরে  ঢুকে  গেল।  দু’জন  পুরুষ  এসে  আমাদের  কী  প্রয়োজন  জিজ্ঞাসা  করায়,  তুষার  মহুয়ার  কথা  বললো।
ক’বোতল  লাগবে?
চার  বোতল।
একজন  ভিতরে  চলে  গেল।  অপরজন  আমাকে জিজ্ঞাসা  করলো,  আমরা  কোথা  থেকে  এসেছি।
কলকাতা।
কলকাতা?  সেখানে  আমার  ভাই থাকে।  সে  কেমন  আছে  জানো?
কলকাতার  কোথায়  থাকে?
ওর মাথা  খারাপ  আছে।  আমার  বৌকে  চাকু  মারতে  গেছিল।  কলকাতায়  তাকে  হাসপাতালে  ভর্তি  করা  হয়েছে।  সে  কেমন  আছে  বলতে  পার?
কলকাতার কোথায়?  কোন  হাসপাতালে?
কলকাতার  হাসপাতালে।
বুঝলাম  কলকাতা  মানে  তার  কাছে তার  পাহাড়ের  কোলে  তার পাড়ার  মতোই।   বিষয়ে  এর  সঙ্গে  কথা  বলা  বৃথা।
ঠিক  আছে,  ফিরে  গিয়ে  খোঁজ  নিয়ে  চিঠি  লিখে  জানাবো।
ঠিক  আছে  বাবু।
একটু  খাবার  জলের  কথা  বলতেই,  ভিতর  থেকে  চকচকে  ঘটি  করে  ঠান্ডা  জল  এনে  দিল।  ঘটিটা  সোনার  তৈরী  কী না  জানিনা,  রঙ  দেখে  মনে  হয়, হলেও হতে  পারে।
এরমধ্যে  ভিতর  থেকে  তালপাতার  ছিপি  লাগানো,  বিয়ারের  বোতলের  মতো  চারটে  সবুজ  রঙের  বোতল  নিয়ে,  আগের  লোকটা  বাইরে  এল।  
তুষার  দাম  জিজ্ঞাসা  করায় সে  দাম  জানালো।  মহুয়ার  দামের  থেকে  বোতলের  কশন্  মানি  বেশী।  তুষার  একটুও  সময়  নষ্ট  না  করে,  আমাকে  সান্তনা দিল— “কাল  বোতল   ফেরৎ  দিলেই  তো  টাকা  পেয়ে  যাব।  চিন্তা  করিস  না”।
হায়  রে!  এই  দশ  টাকার  জন্য  কাল  সকালে  আবার  দশ-বিশ  কিলোমিটার  পথ  হাঁটতেও  সে  প্রস্তুত।  এখন  আর  তার  হনিমুনে  আসা  বন্ধুকে  অস্বাভাবিক মনে  হ’ল  না।  সে  নাকি   কোন  যাত্রা  দলে  তবলা  বাজায়।  সে  কনিষ্ঠ  কী না, গঙ্গারামের  ভাই  কী  না,  বা  যাত্রা  দলে  পাঁচ  টাকা  পায়  কী না  জানিনা, তবে  তাকে  তুষারের বন্ধু  হিসাবে  মানায়। 
যাহোক্,  তুষার  দাম  মিটিয়ে,  দু’হাতে দু’টো  বোতল  নিয়ে,  আমাকে  বললো— “দাঁড়িয়ে  না  থেকে  একটু  হাত  লাগা”।
আমরা  সঙ্গে  কোন  ব্যাগ  নিয়ে  আসিনি।  চার চারটে  মহুয়ার  বোতল,  হাতে  ঝুলিয়ে  এতটা  পথ  যাওয়া  ঠিক  হবে  কী না  ভাবছি।
চল্।  দাঁড়িয়ে  কী  দেখছিস?  সময়  নষ্ট  করিস  না।  বাড়ি  ফিরতে  হবে  তো  না  কী?
খানিক  পথ  এসে বললাম— “তুষার,  এভাবে  দু’হাতে  দুটো  করে  বোতল  নিয়ে  গেলে  পুলিশ  ধরতে  পারে”।
কেন?  পুলিশ  ধরবে  কেন?  মগের  মুলুক  না কী?  পয়সা  দিয়ে  কিনেছি  তো,  নাকি  মাগমা  পাওয়া  গেছে?
তবু  তোর  এগুলো  কেনা  ঠিক  হয়  নি।  আইনত  এরা  এগুলো  বিক্রী  করতে  পারে  কী  না,  তাই  বা  কে  জানে?
আমার  কথায়  তুষার  একটু  ভেবে  বললো— “তবে  চল,  দুটো  বোতল  ফেরৎ  দিয়ে  আসি”।  
তাতে  কী  সুবিধা  হবে জানিনা, তবু  আমরা  ফিরে  এসে  দুটো  বোতল  ফেরৎ  দিয়ে  দিলাম।  কিন্তু  পূর্বের  লোকটা  জানালো,  সে  আমাদের দেওয়া  টাকা  দিয়ে ধার  শোধ  করে  দিয়েছে।  কাজেই  আজ  সে  টাকা  ফেরৎ  দিতে  পারবে  না।  কাল সকালে  দু’টো  বোতল  ফেরৎ  দিতে  আসলে,  দু’টো  ফাঁকা  বোতলের  জমা রাখা  টাকা   ফেরৎ  দেওয়া  দু’টো  মহুয়ার  বোতলের  দাম  সে  আমাদের দিয়ে  দেবে।

অসম্ভব গরীব লোক।  কাল  কেন,  কোন  কালেই  টাকা  ফেরৎ  দিতে  পারবে  বলে  মনে  হয়  না।  কাজেই  টাকার  চিন্তা  ছেড়ে,  কোন  মতে  তুষারকে  নিয়ে ফিরে  যাবার  চেষ্টা  করলাম।
দাঁড়া,  দাঁড়া। তোর বুদ্ধিতে  চললেই  হয়েছে আর কী।  কাল  কোথা  থেকে  টাকা  ফেরৎ  দেবে  ভেবে  দেখেছিস  একবার?  তার  থেকে  চারটে  বোতল  নিয়েই  যাওয়া  যাক্।
পুলিশের  ভয়,  হাতে  করে  বয়ে  নিয়ে  যাওয়ার  অসুবিধা,  ইত্যাদি  বুঝিয়ে  কোন  মতে  ওর  হাতে  দু’টো  বোতল  ধরিয়ে,  ফেরার  পথ  ধরলাম।
দুপুর  রোদে  হলিডে  হোমে  ফিরে  দেখি,  দীপুদারা  স্নান  সেরে  খাটে  শুয়ে  গল্প  করছে।  আমাদের  ফিরতে  এত  বেলা  হওয়ায়,  রাগে  গজগজ্  করতে  শুরু করলো।
তুষার  জানালো  বেড়াতে  এসে  সময়  ধরে  কিছু  করা  যায়  না।  তাহলে  বেড়াতে  আসা  কেন?  টাইম  টেবল্  নিয়ে  বাড়িতে  বসে  থাকলেই  তো  হয়।  ফিরে  গিয়েই  তো  আবার  সেই    ঘানি  টানতে  হবে।

একটু  বিশ্র্রাম  নিয়ে,  জামা  প্যান্ট  ছেড়ে  ইঁদারার  জলে  স্নান  করতে  গেলাম।  তুষার  বোতল  খুলে  মহুয়াটা  দু’নম্বর  কী না  পরীক্ষা  করতে  বসলো।
একটু  পরেই  তুষার  ইঁদারার  কাছে  এসে  জানালো— “আর  চিন্তা  নেই,  এখন  থেকে  এবলা  ওবলা  শুধু  মুরগীর  রোষ্ট”।
মুরগী  পেয়েছিস?  থ্যাঙ্ক  ইউ।  কোথায়  পেলি?
তোদের  মতো  খাওয়া,  ঘুম  আর  ক্যারাম  নিয়ে  থাকলে  তো  আমার  চলে  না।  সব  দিক  তো  আমাকেই  সামলাতে  হয়।  সব  দিকে  নজর  রাখতে  হয়।   লোকটা  মুরগী  নিয়ে    যাচ্ছিল।  আমাকেই  তো  সব  দায়িত্ব  নিতে  হয়,  তাই  নিয়ে  নিলাম।
একটু  দুরে  একটা  লোককে  ঝাঁকা  মাথায়  যেতে  দেখলাম।  তুষারের  ওপর  আজ  সকালের  সমস্ত  রাগ  ভুলে, নতুন  করে  একটা  ভালোবাসা,  একটা  শ্রদ্ধা জন্মালো।  খুশী  মনে  ভিজে   গায়ে  বাড়ির  উঠানে  গিয়ে  দেখি,  একগাদা  দু’এক  দিনের  গোল  গোল  মুরগীর  বাচ্ছা  উঠানময়  চরে  বেড়াচ্ছে।  দেখলেই  বোঝা যাচ্ছে, সবে  ডিম  থেকে  বেরিয়েছে।
আরে  এগুলো  নিয়ে  কী  করবি?   তো  সবে  ডিম  ফুটে  বেরিয়েছে।  একদিনের  বাচ্ছা।  এগুলো  কখনও  খাওয়া  যায়?
দুর  বোকা,  তোর  আর  বুদ্ধি  কোনদিন  পাকবে  না।  বুদ্ধি  থাকলে  সব  হয়।  গম  ছেটাবো  বড়  হবে।  তারপর  এবলা  ওবলা  মুরগীর  রোষ্ট,  আর  কচি  মুরগীর  ঝোল।
আমরা  তো  আর  দু’দিন  থাকবো।  গমই  বা  পাবি  কোথায়,  আর  বড়ই  বা  কবে  হবে,  যে  রোষ্ট্  খাবি? 

 বোধহয়  এবার  বুঝলো  যে  কাঁচা  কাজ  হয়ে  গেছে।  শেষে  ভিজে  গায়ে  দৌড়ে  গিয়ে,  লোকটাকে  ডেকে  এনে,  অনেক  অনুরোধ  করে  মুরগীর  বাচ্ছাগুলো  ফেরৎ  দিতে  সক্ষম    হলাম।  তবে  সেকেন্ডহ্যান্ড  বই  এর  মতো,  বিক্রয়মূল্য  অবশ্যই  ক্রয়মূল্যের  থেকে  অনেক  কম  হ’ল।
পরদিন  সকালেই  দীপুদা   তুষার  জানালো  শিমুলতলা  জায়গাটা  তাদের  ভালো  লাগছে  না।  আজই  তারা  দেওঘর  চলে  যেতে  চায়।

ইচ্ছা  না  থাকলেও  শিমুলতলার  পাততাড়ি  গুটিয়ে  দেওঘর  চলে  আসতে  বাধ্য  হলাম।  শিমুলতলা  আমার  ভালো  লেগেছিল।  ছেড়ে  যেতে  কষ্টও  কম  হচ্ছিল  না।  তবু  কষ্টের  মধ্যেও  সান্তনা— সঙ্গে  অতগুলো  মুরগী  ছানা  বয়ে  নিয়ে যেতে  হচ্ছে  না,  বোতলের  দাম  আদায়  করতে  দশ-বিশ  কিলোমিটার  পথ  অহেতুক হাঁটতে  হচ্ছে  না,  আর  অবশ্যই  তুষারের  মতো  একজন  জিনিয়াস  সঙ্গে  আছে।  দেওঘরের  কথা  আর  একদিন  বলা  যাবে।